রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (৭ মে ১৮৬১ – ৭ আগস্ট ১৯৪১; ২৫ বৈশাখ ১২৬৮ – ২২ শ্রাবণ ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ) ছিলেন অগ্রণী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। তাকে বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক মনে করা হয়। রবীন্দ্রনাথকে “গুরুদেব”, “কবিগুরু” ও “বিশ্বকবি” অভিধায় ভূষিত করা হয়। রবীন্দ্রনাথের ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস ও ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন তার জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর অব্যবহিত পরে প্রকাশিত হয়। তার সর্বমোট ৯৫টি ছোটগল্প ও ১৯১৫টি গান যথাক্রমে গল্পগুচ্ছ ও গীতবিতান সংকলনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় প্রকাশিত ও গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রচনা ৩২ খণ্ডে রবীন্দ্র রচনাবলী নামে প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় পত্রসাহিত্য উনিশ খণ্ডে চিঠিপত্র ও চারটি পৃথক গ্রন্থে প্রকাশিত।এছাড়া তিনি প্রায় দুই হাজার ছবি এঁকেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের রচনা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য তিনি এশীয়দের মধ্যে সাহিত্যে প্রথম নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতার এক ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিবান ব্রাহ্ম পিরালী ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।বাল্যকালে প্রথাগত বিদ্যালয়-শিক্ষা তিনি গ্রহণ করেননি; গৃহশিক্ষক রেখে বাড়িতেই তার শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-এ তার “অভিলাষ” কবিতাটি প্রকাশিত হয়। এটিই ছিল তার প্রথম প্রকাশিত রচনা।
১৮৭৮ সালে মাত্র সতেরো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ প্রথমবার ইংল্যান্ডে যান। ১৮৮৩ সালে মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে তার বিবাহ হয়। ১৮৯০ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গের শিলাইদহের জমিদারি এস্টেটে বসবাস শুরু করেন। ১৯০১ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখানেই পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করেন। ১৯০২ সালে তার পত্নীবিয়োগ হয়। ১৯০৫ সালে তিনি বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন।
১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার তাকে ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত করেন। কিন্তু ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি সেই উপাধি ত্যাগ করেন। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য তিনি শ্রীনিকেতন নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠিত হয়। দীর্ঘজীবনে তিনি বহুবার বিদেশ ভ্রমণ করেন এবং সমগ্র বিশ্বে বিশ্বভ্রাতৃত্বের বাণী প্রচার করেন। ১৯৪১ সালে দীর্ঘ রোগভোগের পর কলকাতার পৈত্রিক বাসভবনেই তার মৃত্যু হয়।
রবীন্দ্রনাথের কাব্যসাহিত্যের বৈশিষ্ট্য ভাবগভীরতা, গীতিধর্মিতা চিত্ররূপময়তা, অধ্যাত্মচেতনা, ঐতিহ্যপ্রীতি, প্রকৃতিপ্রেম, মানবপ্রেম, স্বদেশপ্রেম, বিশ্বপ্রেম, রোম্যান্টিক সৌন্দর্যচেতনা, ভাব, ভাষা, ছন্দ ও আঙ্গিকের বৈচিত্র্য, বাস্তবচেতনা ও প্রগতিচেতনা। রবীন্দ্রনাথের গদ্যভাষাও কাব্যিক। ভারতের ধ্রুপদি ও লৌকিক সংস্কৃতি এবং পাশ্চাত্য বিজ্ঞানচেতনা ও শিল্পদর্শন তার রচনায় গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। কথাসাহিত্য ও প্রবন্ধের মাধ্যমে তিনি সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে নিজ মতামত প্রকাশ করেছিলেন।
সমাজকল্যাণের উপায় হিসেবে তিনি গ্রামোন্নয়ন ও গ্রামের দরিদ্র মানুষ কে শিক্ষিত করে তোলার পক্ষে মতপ্রকাশ করেন। এর পাশাপাশি সামাজিক ভেদাভেদ, অস্পৃশ্যতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধেও তিনি তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের দর্শনচেতনায় ঈশ্বরের মূল হিসেবে মানব সংসারকেই নির্দিষ্ট করা হয়েছে; রবীন্দ্রনাথ দেববিগ্রহের পরিবর্তে কর্মী অর্থাৎ মানুষ ঈশ্বরের পূজার কথা বলেছিলেন। সংগীত ও নৃত্যকে তিনি শিক্ষার অপরিহার্য অঙ্গ মনে করতেন। রবীন্দ্রনাথের গান তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি। তার রচিত জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে ও আমার সোনার বাংলা গানদুটি যথাক্রমে ভারত প্রজাতন্ত্র ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। মনে করা হয় শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীত শ্রীলঙ্কা মাতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দ্বারা অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত হয়ে লেখা হয়েছে।
পারিবারিক ইতিহাস
ঠাকুরদের আদি পদবী কুশারী৷ কুশারীরা ভট্টনারায়ণের পুত্র দীন কুশারীর বংশজাত৷ দীন কুশারী মহারাজ ক্ষিতিশূরের নিকট কুশ (বর্ধমান জেলা) নামক গ্রাম পেয়ে গ্রামীণ হন ও কুশারী নামে খ্যাত হন৷ রবীন্দ্রজীবনীকার শ্রীপ্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় তার রবীন্দ্রজীবনী ও রবীন্দ্রসাহিত্য-প্রবেশক গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে ঠাকুর পরিবারের বংশপরিচয় দিতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন,
কুশারীরা হলেন ভট্টনারায়ণের পুত্র দীন কুশারীর বংশজাত; দীন মহারাজ ক্ষিতিশূরের নিকট কুশ নামক গ্রাম (বর্ধমান জিলা) পাইয়া গ্রামীণ হন এবং কুশারী নামে খ্যাত হন৷ দীন কুশারীর অষ্টম কি দশম পুরুষ পরে জগন্নাথ৷
পরবর্তীকালে কুশারীরা ছড়িয়ে পড়ে বঙ্গদেশের সর্বত্র – যশোরের ঘাটভোগ-দমুরহুদা থেকে ঢাকার কয়কীর্তন থেকে বাঁকুড়ার সোনামুখী থেকে খুলনার পিঠাভোগ৷ পিঠাভোগের কুশারীরাই হয়ে উঠল সবচেয়ে প্রভাবশালী ও অবস্থাপন্ন৷
জীবন
প্রথম জীবন (১৮৬১–১৯০১)
বিশিষ্ট বাঙালি কবি ও ব্রাহ্ম দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনের প্রথম চারটি দশক (১৮৬১–১৯০১) ছিল তার শৈল্পিক ও রাজনৈতিক মতাদর্শের বিকাশপর্ব।
পারিবারিক প্রেক্ষাপট
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম জোড়াসাঁকোর ৬ নং দ্বারকানাথ ঠাকুর লেনের পারিবারিক বাসভবনে। জোড়াসাঁকো ছিল সেযুগে “ব্ল্যাক টাউন” (বাঙালি অধ্যুষিত নগরাঞ্চল; ইউরোপীয়দের আবাসস্থল দক্ষিণ কলকাতা ছিল “হোয়াইট টাউন”) নামে পরিচিত উত্তর কলকাতার চিৎপুর রোডের (বর্তমান নাম রবীন্দ্র সরণি) নিকটে। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির আশেপাশের অঞ্চলগুলি সেই সময় ছিল দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চল এবং শহরে কেন্দ্র।
রবীন্দ্রনাথের পিতার নাম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭–১৯০৫) এবং মাতার নাম সারদা দেবী (১৮৩০–১৮৭৫)। দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন তার বন্ধু তথা সমাজ সংস্কারক রাজা রামমোহন রায় প্রবর্তিত ব্রাহ্মধর্মের প্রধান সংগঠক ও অনুশাসনকর্তা। রামমোহন রায়ের মৃত্যুর পর দেবেন্দ্রনাথই হয়ে ওঠেন ব্রাহ্মসমাজের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব। তার অনুগামীরা তাকে মহর্ষি অভিধায় ভূষিত করে। আমৃত্যু দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন আদি ব্রাহ্মসমাজের নেতা। অস্পৃশ্যতা প্রথার কারণে কেবল মাত্র পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশ) যশোর-খুলনার পিরালী ব্রাহ্মণ কন্যারাই ঠাকুর পরিবারে বধূ হয়ে আসতেন।
শৈশব ও কৈশোর (১৮৬১–১৮৭৮)
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তার পিতামাতার চোদ্দো সন্তানের মধ্যে কণিষ্ঠতম। ছেলেবেলায় রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য পত্রিকা, সঙ্গীত ও নাট্যানুষ্ঠানের এক পরিবেশে প্রতিপালিত হন। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার ছিল সেযুগের বিদ্যোৎসাহী ও শিল্পোৎসাহী সমাজে এক বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী। রবীন্দ্রনাথের বড়োদাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ছিলেন একজন সম্মানীয় দার্শনিক ও কবি। তার মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন সেযুগের অভিজাত ও শ্বেতাঙ্গ-প্রধান ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের প্রথম ভারতীয় সদস্য। নতুনদাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ছিলেন একজন প্রতিভাবান সংগীতস্রষ্টা ও নাট্যকার। তার এক দিদি স্বর্ণকুমারী দেবী ছিলেন এক স্বনামধন্য ঔপন্যাসিক। বালক “রবি”-র উপর এঁদের সকলের প্রভাব ছিল অপরিসীম। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী কাদম্বরী দেবী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের থেকে সামান্য বড়ো। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের বন্ধুস্থানীয় এবং তার রচনার এক অনুপ্রেরণা।
১৮৮৪ সালে কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করেন। কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু বহু বছর রবীন্দ্রনাথের মনকে অশান্ত করে রেখেছিল। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যেও এই মৃত্যু এই চিরস্থায়ী ছাপ রেখে যায়।
জীবনের প্রথম দশ বছরে পিতার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাননি রবীন্দ্রনাথ। এই সময় দেবেন্দ্রনাথ প্রায়শই উত্তর ভারত, ইংল্যান্ড ও অন্যান্য স্থানে পর্যটনে রত থাকতেন। এদিকে রবীন্দ্রনাথ মূলত পারিবারিক গণ্ডীর আবদ্ধ থাকতেন। একমাত্র স্কুলে যাওয়া ছাড়া অন্য সময় বাড়ির বাইরে বের হওয়া নিষিদ্ধ ছিল। ফলত বাইরের জগৎ ও প্রকৃতির সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকতেন বালক রবীন্দ্রনাথ।
ঠাকুরবাড়ির ভৌতিক ও রহস্যময় সত্ত্বাটিও রবীন্দ্রনাথকে সন্ত্রস্ত করে রাখত। জীবনের এই পর্বে বাড়ির ভৃত্যদের তত্ত্বাবধানে প্রতিপালিত হন রবীন্দ্রনাথ। তার নিজের ভাষায় এ ছিল এক “ভৃত্যরাজক তন্ত্র”।জানা যায়, এক এক সময় ছোটোদের শান্ত করতে ভৃত্যেরা তাদের মাথা পানীয় জলের বড়ো বড়ো পাত্রের মধ্যে চুবিয়ে রাখত। ভৃত্যদের সন্তুষ্ট রাখতে বালক রবীন্দ্রনাথ অল্প আহার করতেন। শ্যাম নামের একটি চাকর তাকে একটি খড়ির রেখার গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ করে রাখত আর ভয় দেখানোর জন্য রামায়ণের সীতাহরণের উপাখ্যান এবং রক্তপিপাসু ডাকাতদের ভীতিপ্রদ গল্পগুলি শোনাতো।
রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা আরম্ভ হয় দাদা হেমেন্দ্রনাথের হাতে। ছেলেবেলায় রবীন্দ্রনাথ শারীরিকভাবে সুস্থসবল ও বলবান ছিলেন – তিনি গঙ্গায় সাঁতার কাটতেন, পাহাড়ি রাস্তায় হেঁটে বেড়াতেন এমনকি বাড়িতে জুডো ও কুস্তি অনুশীলন করতেন। বাংলা ভাষায় শারীরস্থান, অঙ্কন, ইংরেজি ভাষা (সেই সময় তার সর্বাপেক্ষা অপ্রিয় বিষয়), ভূগোল, ইতিহাস, সাহিত্য, গণিত ও সংস্কৃত চর্চা করতেন গৃহে ও বিদ্যালয়ে।অবশ্য বিদ্যালয়ের ধরাবাঁধা শিক্ষাব্যবস্থা তাকে আকৃষ্ট করে রাখতে পারেনি। নর্ম্যাল স্কুল, বেঙ্গল অ্যাকাদেমি, ওরিয়েন্টাল সেমিনারি ও শেষে সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে কিছুকাল পড়াশোনার পর তিনি অবশেষে বিদ্যালয়ে যেতে অস্বীকার করেন। বিদ্যালয়ের নিষ্প্রাণ শিক্ষাব্যবস্থা পরবর্তীকালেও তার দ্বারা সমালোচিত হয়েছিল।
আট বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ কাব্যরচনা শুরু করেন। তার এক দাদা তাকে এই কবিতাগুলি বাড়ির অন্য সকলকে পড়ে শোনাতে বলতেন। রবীন্দ্রনাথের এক শ্রোতা ছিলেন জনৈক ব্রাহ্ম জাতীয়তাবাদী, সংবাদপত্র সম্পাদক ও হিন্দুমেলা সংগঠক। এগারো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথের উপনয়ন দীক্ষানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। ব্রাহ্মণ্য সংস্কার অনুযায়ী মস্তক মুণ্ডন করে উপবীত ধারণ করেন রবীন্দ্রনাথ। এরপর ১৮৭৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পিতার সঙ্গে কয়েক মাসের জন্য কলকাতার বাইরে যাওয়ার সুযোগ হয় রবীন্দ্রনাথের। প্রথমে তারা যান শান্তিনিকেতনের পারিবারিক এস্টেটে। ১৮৬৩ সালে এখানকার আম্রকুঞ্জ ও উদ্যানমধ্যে দেবেন্দ্রনাথ একটি দুই কামরার গৃহ নির্মাণ করেছিলেন। প্রকৃতির সান্নিধ্যে এই দিনগুলি সম্পর্কে পরে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন:
“যাহা দেখিলাম না তাহার খেদ মিটিতে বিলম্ব হইল না – যাহা দেখিলাম তাহাই আমার পক্ষে যথেষ্ট হইল। এখানে চাকরদের শাসন ছিল না। প্রান্তরলক্ষ্মী দিক্চক্রবালে একটি মাত্র নীল রেখার গণ্ডী আঁকিয়া রাখিয়াছিলেন, তাহাতে আমার অবাধসঞ্চরণের কোনো ব্যাঘাত করিত না।”
কয়েক সপ্তাহ সেখানে অতিবাহিত করে তারা আসেন অমৃতসরে। সেখানে হরমন্দির সাহিবের নিকট অবস্থান করে তারা একটি শিখ গুরুদ্বারে প্রার্থনা করেন। এই সময় রবীন্দ্রনাথ পাঠ করেন ইংরেজি ও সংস্কৃত গ্রন্থাবলি, বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন প্রমুখ ব্যক্তিবর্গের জীবনী, এবং এডওয়ার্ড গিবন রচিত দ্য হিস্ট্রি অফ দ্য ডিক্লাইন অ্যান্ড ফল অফ দ্য রোমান এম্পায়ার। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সপুত্র দেবেন্দ্রনাথ যাত্রা করেন হিমালয়ের শৈলশহর ডালহৌসির (বর্তমানে হিমাচল প্রদেশ রাজ্যে জম্মু ও কাশ্মীর-হিমাচল প্রদেশ সীমান্তের নিকটে অবস্থিত) উদ্দেশ্যে।
ডালহৌসিতে ২,৩০০ মিটার (৭,৫০০ ফুট) উচ্চতায় বক্রোটা পাহাড়চূড়ার একটি বাংলোতে অবস্থান করেন তারা। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বিমোহিত হন রবীন্দ্রনাথ। ছেদ পড়ে না পাঠাভ্যাসেও। হিমশীতল অতি প্রত্যুষে উঠে সংস্কৃত পড়তে বসতেন তিনি; দুপুরে মধ্যাহ্নভোজের ছুটি পেতেন। তারপর আবার চলত পড়া। অবশ্য পড়তে পড়তে প্রায়শই ঘুমিয়ে পড়তেন রবীন্দ্রনাথ। দুই মাস ডালহৌসিতে কাটিয়ে পিতার সঙ্গে কলকাতায় ফিরে আসেন তিনি।
ইংল্যান্ডে শিক্ষা (১৮৭৮–১৮৮০)
১৮৭৮ সালের অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে ব্যারিস্টার হওয়ার উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথ পাড়ি দেন ইংল্যান্ডে।প্রথম দিকে তিনি ব্রাইটন ও হোভের মেদিনা ভিলায় ঠাকুর পরিবারের একটি বাড়িতে অবস্থান করেন। এখানে তিনি একটি স্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন (যদিও দাবি করা হয় যে তিনি ব্রাইটন কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন; কিন্তু উক্ত কলেজের রেজিস্টারে তার নাম পাওয়া যায় না)। ১৮৭৭ সালে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ও কন্যা ইন্দিরাকে তাদের মায়ের সঙ্গে ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হয় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে থাকার উদ্দেশ্যে।
১৮৭৮ সালে বড়োদিনটি পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কাটানোর পর রবীন্দ্রনাথ দাদার এক বন্ধুর সঙ্গে চলে আসেন লন্ডনে। তার আত্মীয়দের ধারণা ছিল লন্ডনে থাকলেই পড়াশোনায় অধিক মনোযোগ দিতে পারবেন তিনি। সেখানে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে ভর্তি হন তিনি। যদিও কোনো ডিগ্রি না নিয়েই এক বছরের মধ্যেই দেশে ফিরে আসেন রবীন্দ্রনাথ। তবে এই বিলেতবাসের সময় ইংরেজি সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ধারণা পেয়েছিলেন তিনি, যা পরবর্তীকালে তার সাহিত্য, সঙ্গীত ও নাটকে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। যদিও রবীন্দ্রনাথ ইংরেজদের কঠোর নিয়মানুবর্তিতা বা পারিবারিক রক্ষণশীল ধর্মমত কোনোটিকেই নিজের জীবন বা সৃষ্টিকর্মের মধ্যে সাগ্রহে গ্রহণ করেননি; বরং বেছে নিয়েছিলেন এই দুই জগতের কিছু শ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতাকেই।
শিলাইদহ
১৮৯০ সালে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে পারিবারিক জমিদারির তত্ত্বাবধান শুরু করেন। বর্তমানে এই অঞ্চলটি বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার অন্তর্গত। ১৮৯৮ সালে তার স্ত্রী ও সন্তানেরাও চলে আসেন শিলাইদহে। “জমিদার বাবু” নামে পরিচিত রবীন্দ্রনাথ এই সময় পারিবারিক বিলাসবহুল ঢাকাই বজরা পদ্মা-য় চড়ে সমগ্র জমিদারি তদারকি করে বেড়ান। প্রজাবর্গের মধ্যে খাজনা আদায় (মূলত প্রতীকী) ও তাদের আশীর্বাদ প্রার্থনা করে তাদের সঙ্গে অবাধে মেলামেশা করেন রবীন্দ্রনাথ। এই সৌজন্যে গ্রামবাসীরাও তার সম্মানে ভোজসভার আয়োজন করতেন। এই দশকটিতে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন বহু গ্রন্থ এবং বাংলা সাহিত্যে প্রবর্তন করেন এক নতুন ধারার: ছোটোগল্প।
১৮৯১ সাল থেকে ১৯০১ সালের মধ্যে তিনি ঊনষাটটি ছোটোগল্প লিখেছিলেন। এই সব গল্পের উপাদান তিনি সংগ্রহ করেছিলেন সাধারণ বাঙালির জীবনের নানা শ্লেষাত্মক উপাদান ও আবেগ থেকে। সোনার তরী (১৮৯৪), চিত্রা (১৮৯৬) ও কথা ও কাহিনী কাব্যগ্রন্থগুলি এই সময়েরই রচনা। এছাড়াও একাধিক উপন্যাস, নাটক ও প্রবন্ধও রচনা করেছিলেন এই সময়।
মধ্য জীবন (১৯০১–১৯৩২)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন (১৯০১–১৯৩২) কবির জীবনের শান্তিনিকেতন বাস এবং এশিয়া, ইউরোপ ও জাপান ভ্রমণ পর্ব।
শান্তিনিকেতন
১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহ ত্যাগ করে চলে আসেন কলকাতার প্রায় ১০০ মাইল উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত শান্তিনিকেতনে (বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বীরভূম জেলায় অবস্থিত)। ১৮৬৩ সালের রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতন রুক্ষ অনুর্বর প্রান্তরের লাল কাঁকুড়ে মাটির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এখানে সাত একর জমি ক্রয় করেছিলেন আশ্রম স্থাপন করার মানসে। নির্মাণ করিয়েছিলেন একটি ভবন ও শ্বেতপাথরের মেঝে-বিশিষ্ট একটি প্রার্থনা মন্দির। এখানেই আম্রকুঞ্জ ও উদ্যানের মাঝে একটি গ্রন্থাগার সহ রবীন্দ্রনাথ স্থাপন করেন তার পরীক্ষামূলক ব্রহ্মবিদ্যালয়। জীবনের এই পর্বেই কবিকে শোকাহত করে প্রয়াত হলে কবিপত্নী মৃণালিনী দেবী (১৯০১), কন্যা রেণুকা (১৯০৩) ও পুত্র শমীন্দ্রনাথ (১৯০৭)।
১৯০৫ সালের ১৯ জানুয়ারি ৮৭ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথের পিতৃদেব দেবেন্দ্রনাথ প্রয়াত হলেন। এরপর থেকে পৈত্রিক সম্পত্তির উত্তরাধিকার হিসেবে প্রতি মাসে ১,২৫০-১,৫০০ টাকা মাসোহারা পেতে শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ। এছাড়া ত্রিপুরার মহারাজার কাছ থেকে পেতেন অনুদান স্বরূপ কিছু অর্থ। স্ত্রীর গহনা ও পুরীর সৈকতাবাসটি বিক্রয় করে কিছু অর্থ পান। আর পান তার রচনার সহস্রাধিক কপি প্রকাশের সম্মানী স্বরূপ সামান্য কিছু অর্থ (২,০০০ টাকা)।
বাঙালি পাঠকসমাজে রবীন্দ্রনাথের পরিচিতি ও খ্যাতি বৃদ্ধি পেতে থাকে। প্রকাশিত হয় নৈবেদ্য (১৯০১) ও খেয়া (১৯০৬) প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ। তার রচনার মধ্যমানের কিছু অনুবাদও প্রকাশিত হতে থাকে অন্যান্য ভাষায়। এই সময় চিত্রকর উইলিয়াম রোদেনস্টাইন প্রমুখ গুণমুগ্ধদের অনুরোধক্রমে রবীন্দ্রনাথ ইংরেজি মুক্তছন্দে নিজের রচনা অনুবাদ করতে শুরু করেন।
১৯১২ সালে রচনার ইংরেজি অনুবাদের গুচ্ছ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ উপস্থিত হন ইংল্যান্ডে। সেখানে এই রচনা পাঠ করলে একাধিক বিশিষ্ট ইংরেজ ব্যক্তিত্ব তার প্রতি আকৃষ্ট হন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ইংরেজ মিশনারি ও গান্ধীবাদী চার্লস এফ অ্যান্ড্রুজ, অ্যাংলো-আইরিশ কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস, এজরা পাউন্ড, রবার্ট ব্রিজেস, আর্নেস্ট রাইস ও টমাস স্টার্জ মুর প্রমুখ। পরে ইয়েটস ইন্ডিয়া সোসাইটি প্রকাশিত গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদটির মুখবন্ধ রচনা করে দেন। অ্যান্ড্রুজ কবির সঙ্গে কাজ করার উদ্দেশ্যে চলে আসেন ভারতে।
১৯১২ সালের ১০ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের আরবানার একটি ইউনিটারিয়ান চার্চে বক্তৃতা দেন কবি। এই বছরই কবি যুক্তরাজ্য সফরে যান। এই সফরে উইলিয়াম রোদেনস্টাইন ও ইয়েটসের সঙ্গে আলাপ হয় কবির। এঁরা ততদিনে তার গীতাঞ্জলি পাঠ করেছিলেন। এই সফরে কবি স্ট্র্যাফোর্ডশায়ারের বাটারটনে অ্যান্ড্রুজের ধর্মযাজক বন্ধুদের সঙ্গে অবস্থান করেন। ১৯১৩ সালের ১৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় রবীন্দ্রনাথ তার সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির সংবাদ পান। গীতাঞ্জলি: দ্য সং অফারিংস (১৯১২) সহ তার অনূদিত সামান্য যে কয়টি রচনা সেই সময় পাশ্চাত্য পাঠকমহলে সুপরিচিত ছিল তার ভূয়সী প্রশংসা করে সুইডিশ আকাদেমি।
১৯১৬ সালের ৩ মে রবীন্দ্রনাথ, মুকুল দে, চার্লস এফ. অ্যান্ড্রুজ ও ডব্লিউ. ডব্লিউ. পিয়ারসন জাহাজপথে প্রথমে জাপান ও পরে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। ১৯১৭ সালের এপ্রিল পর্যন্ত তারা এই দুই দেশে বক্তৃতা দিয়ে বেড়ান। জাপানযাত্রী গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের এই চারমাসব্যাপী জাপান ভ্রমণের বিবরণ লিপিবদ্ধ রয়েছে। উক্ত গ্রন্থে কবি জাপানিদের নন্দনচেতনার ভূয়সী প্রশংসা করেন। যদিও জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে তিনি বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন। তার আক্রমণের লক্ষ্য ছিল মূলত জাপানি ও আমেরিকান জাতীয়তাবাদ। তার “ন্যাশানালিজম ইন ইন্ডিয়া” প্রবন্ধটি একই সঙ্গে নন্দিত ও নিন্দিত হয়েছিল।
রোমা রোঁলা প্রমুখ বিশ্বশান্তীবাদী তথা কবির সমমনস্ক আন্তর্জাতিকতাবাদীরা অবশ্য এই গ্রন্থের প্রশস্তিবাদই করেছিলেন। তবে এই জাতীয় মতবাদ ব্যক্ত করায় সেই সময় তার জীবনও বিপন্ন হয়েছিল: সানফ্রান্সিসকোয় একটি হোটেলে অবস্থানকালে একদল ভারতীয় চরমপন্থীকে কবিকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। কিন্তু তাদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, কারণ হত্যা করা উচিত হবে কিনা তা নিয়ে ষড়যন্ত্রকারীরা নিজেরাই বিবাদে জড়িয়ে পড়েছিল। পরদিন সকালেই কবি লস এঞ্জেলসের নিকটস্থ সান্টা বারবারার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। এখানে কমলালেবুর উদ্যানে ধ্যানমগ্নতার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ এক নতুন ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা করেন। তার ইচ্ছা ছিল শান্তিনিকেতন ভারত ও অবশিষ্ট বিশ্বকে এক সূত্রে গ্রথিত করুক। দেশ ও ভূগোলের সীমারেখার বাইরে এখানে গড়ে উঠুক মানবতার এক বিশ্ববিদ্যাকেন্দ্র।
তিনি তার বিদ্যালয়ের নাম রাখেন বিশ্বভারতী। ১৯১৮ সালের ২২ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে এই বিদ্যালয়ের শিলান্যাস হয়। পরে ১৯২১ সালে ২২ ডিসেম্বর বিশ্বভারতীর উদ্বোধন হয়। এই বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অধ্যক্ষ রূপে রবীন্দ্রনাথ সর্বদাই ব্যস্ত থাকতেন। সকালে ক্লাস নিতেন এবং বিকেলে ও সন্ধ্যায় ছাত্রদের জন্য রচনা করতেন পাঠ্যপুস্তক। ১৯১৯ সাল থেকে ১৯২১ সালের মধ্যে বিশ্বভারতীর জন্য অর্থসংগ্রহের উদ্দেশ্যে তিনি ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণও করেন।
শেষ জীবন (১৯৩২-১৯৪১)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষ জীবন (১৯৩২–১৯৪১) কবির দীর্ঘ অসুস্থতার সময়। এই সময় রবীন্দ্রনাথ তার রচনায় মূলত মৃত্যুর প্রকৃতি অনুধাবনে মনোনিবেশ করেছেন।
১৯৩২-৩৭ সময়কালের রচনাবলি
বিভিন্ন রাষ্ট্র পরিভ্রমণ করে মানবজাতির মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির হীনতা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের নিজের মত সুদৃঢ় হয়। ১৯৩২ সালের মে মাসে তিনি ইরাকের একটি বেদুইন শিবিরে গিয়েছিলেন। সেখানে এক উপজাতীয় নেতা তাকে বলেন, “আমাদের মহানবী বলেছেন, তিনিই সত্যকারের মুসলমান, যাঁর বাক্য বা কর্মের দ্বারা তাঁর ভ্রাতৃপ্রতিম মানুষগুলির ন্যূনতম ক্ষতিসাধনও হয় না।” কবি তার ডায়েরিতে লিখেছেন, “চমকে উঠলুম। বুঝলুম তার কথাগুলিই মানবতার মূল কথা।”
জীবনের শেষ দশ বছরে রবীন্দ্রনাথ পনেরোটি বই লিখেছিলেন। পুনশ্চ (১৯৩২), শেষ সপ্তক (১৯৩৫) ও পত্রপুট (১৯৩৬) নামে গদ্যকবিতা-সংকলনগুলি এই সময়েই প্রকাশিত হয়। জীবনের এই পর্বে রবীন্দ্রনাথ গদ্যগীতিকা ও নৃত্যনাট্য নিয়ে নতুন পরীক্ষানিরীক্ষা করেন। চিত্রাঙ্গদা (১৯৩৬), শ্যামা (১৯৩৯) ও চণ্ডালিকা (১৯৩৮) নামে প্রসিদ্ধ নৃত্যনাট্যত্রয়ীও এই সময়ই লিখিত হয়। এছাড়া তিনি দুই বোন (১৯৩৩), মালঞ্চ (১৯৩৪) ও চার অধ্যায় (১৯৩৪) নামে তিনটি উপন্যাসও রচনা করেন। জীবনের শেষ পর্বে কবি বিজ্ঞান বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
১৯৩৭ সালে প্রকাশিত হয় তার বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ সংকলন বিশ্বপরিচয়। এই গ্রন্থে তিনি জীববিদ্যা, পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত নানা তথ্যমূলক প্রবন্ধ রচনা করেন। তার এই সময়কার কবিতাগুলিতেও বৈজ্ঞানিক সূত্রগুলির উপর আধারিত প্রকৃতিবাদের সুর ধ্বনিত হয়। সে (১৯৩৭), তিনসঙ্গী (১৯৪০) ও গল্পসল্প (১৯৪১) গল্পগ্রন্থগুলিতেও বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানী চরিত্রের নানা সমাবেশ লক্ষিত হয়।
১৯৩৭-৪১ সময়কালের অসুস্থতা
ঋজু শালপ্রাংশু দেহের অধিকারী রবীন্দ্রনাথ সারাজীবন সুস্বাস্থ্য ভোগ করলেও জীবনের শেষ চার বছর দীর্ঘস্থায়ী পীড়ায় কষ্ট পেয়েছিলেন। তার মূল সমস্যা ছিল অর্শ। এই চার বছরে দুবার দীর্ঘসময় অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় শয্যাশায়ী থাকতে হয় তাকে। ১৯৩৭ সালে একবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন কবি ; এই সময় কোমায় চলে গিয়ে মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করেন অত্যন্ত কাছ থেকে। আর তখন থেকেই তার এই দীর্ঘকালীন অসুস্থতার সূত্রপাত। ১৯৪০ সালের শেষ দিকে আবার একই ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। এবার আর সেরে ওঠেননি। এই সময়কালের মধ্যেই জীবনের শ্রেষ্ঠ কিছু কবিতা রচনা করেন রবীন্দ্রনাথ। এই কবিতাগুলির মধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে মৃত্যুকে ঘিরে লেখা রবীন্দ্রনাথের কিছু অবিস্মরণীয় পঙক্তিমালা।দীর্ঘ রোগভোগের পর, শল্য চিকিৎসার জটিলতার কারণে, ১৯৪১ সালের ৭ অগস্ট (২২ শ্রাবণ, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ) কলকাতার জোড়াসাঁকোয় অবস্থিত বাসভবনের প্রয়াত হন রবীন্দ্রনাথ। উল্লেখ্য, জোড়াসাঁকোর এই বাড়িতেই কবির জন্ম ও বেড়ে ওঠা। আজও বাংলাভাষী জগতে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুবার্ষিকী পরম শ্রদ্ধা ও ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে পালিত হয়ে থাকে।
বিশ্বভ্রমণ
১৯১৩-এ নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পর সারা বিশ্ব ভারতীয় কবি রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারে বিশেষভাবে আগ্রহী হয়ে ওঠে। ফলে বিভিন্ন দেশ থেকে আসতে থাকে আমন্ত্রণের পর আমন্ত্রণ। অধিকাংশ আমন্ত্রণে সাড়া দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ; জাহাজযোগে বহু দেশে গেছেন; পরিচিত হয়েছেন বিভিন্ন দেশের বিদ্যজন ও রাজ-রাজড়াদের সাথে। বহু স্থানে, বহু বিদ্যায়তনে, বহু সভায় স্বকণ্ঠে কবিতা পাঠ করে শুনিয়েছেন, বক্তৃতা দিয়েছেন। তাঁর জীবনোপলব্ধি ও দর্শন এবং তাঁর কাব্যের মর্মবাণী এভাবে কবি সরাসরি বিশ্বমানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। প্রবাসের জীবনে তাঁর হাতে পূরবী’র মতো গুরুত্বপূর্ণ কাব্য রচিত হয়েছে। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের ফলে বহুজন তাঁর কবিতা অনুবাদে উদ্যোগী হয়েছেন।
১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পাঁচটি মহাদেশের তেত্রিশটিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেছিলেন। তবে ইংল্যান্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাদ দিলে অন্যান্য দেশসমূহ ভ্রমণ করেছেন ১৯১৩-তে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পর। দেশগুলো হলোঃ ফ্রান্স, হংকং, চীন, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, ডেনমার্ক, সুইডেন, অস্ট্রিয়া,
চেকোশ্লোভাকিয়া, আর্জেন্টিনা, ইতালি, নরওয়ে, হাঙ্গেরী, যুগোশ্লাভিয়া, বুলগেরিয়া, রুমানিয়া, গ্রীস, মিশর, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, জাপান, বার্মা, হল্যান্ড, সোভিয়েট রাশিয়া, ইরান, ইরাক ও শ্রীলঙ্কা। ১৯৩৪ এ শ্রীলঙ্কা (সিংহল) ভ্রমণ শেষে কবি শান্তিনিকেতনে ফেরেন ২৮ জুন। এরপর তিনি আর বিদেশভ্রমণে যান নি। এই ভ্রমণগুলির মধ্যে অনেকগুলিই রবীন্দ্রনাথের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। এর মাধ্যমে তিনি ভারতের বাইরে নিজের রচনাকে সুপরিচিত করে তোলেন এবং প্রচার করেন তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ। একই সংগে বহু আন্তজার্তিক সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সংগে তাঁর সাক্ষাৎ হয়।
তাঁর বিদেশ ভ্রমণ শুরু হয় ১৮৭৮ সালে প্যারিস হয়ে লন্ডন গমনের মাধ্যমে। বিদেশ বিভুঁইয়ে অবস্থানকারে খুব ঘরকাতর হয়ে পড়েছিলেন বলে দীর্ঘকার আর বিলেত যাওয়ার কথা ভাবেন নি। তাঁর দ্বিতীয় লন্ডন ভ্রমণ ১৮৯০-এ। ১৯১২ সালের ২৭ মে রবীন্দ্রনাথ যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ভ্রমণে বের হন। সংগে ছিল নিজের একগুচ্ছ রচনার ইংরেজি অনুবাদ। লন্ডনে মিশনারি তথা গান্ধীবাদী চার্লস এফ. অ্যান্ড্রুজ, অ্যাংলো-আইরিশ কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস, এজরা পাউন্ড, রবার্ট ব্রিজেস, আর্নেস্ট রাইস, টমাস স্টার্জ মুর প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ তাঁর গুণমুগ্ধে পরিণত হন। ইয়েটস গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের মুখবন্ধটি লিখে দেন।
অ্যান্ড্রুজ শান্তিনিকেতনে এসে বিদ্যালয়ের কাজে যোগ দেন। যুক্তরাজ্যে স্ট্যাফোর্ডশায়ারের বাটারটনে অ্যান্ড্রুজের ধর্মযাজক বন্ধুদের সঙ্গে কিছুদিন অতিবাহিত করেন কবি। যুক্তরাষ্ট্র সফরে তিনি লন্ডন ত্যাগ করেন ১৬ জুন ; যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছান ১৯ শে অক্টোবরে। তিনি দেশে ফিরে আসেন পরের বছর অর্থাৎ ১৯১৩ সালের ৬ অক্টোবর। ১৯১৬ সালের ৩ মে থেকে ১৯১৭ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রে বক্তৃতা দিয়ে বেড়ান। এই সব বক্তৃতায় কবি তাঁর জাতীয়তাবাদ-বিরোধী মতামত ব্যক্ত করেছিলেন। এছাড়াও তিনি রচনা করেন “ন্যাশানালিজম ইন ইন্ডিয়া” নামে একটি প্রবন্ধও। এটি যুগপৎ নিন্দিত ও নন্দিত হয়। রোমা রোঁলা প্রমুখ বিশ্বশান্তিবাদীরা এই প্রবন্ধের ভূয়সী প্রশংসা করেন।
ভারতে প্রত্যাবর্তনের অব্যবহিত পরেই ৬৩ বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ পেরু সরকারের কাছ থেকে পেরু ভ্রমণের একটি আমন্ত্রণ পান। পেরু থেকে তিনি যান মেক্সিকোতেও। উভয় দেশের সরকারই এই ভ্রমণকে স্মরণীয় করে রাখতে শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিদ্যালয়ে ১০০,০০০ মার্কিন ডলার অর্থ দান করেন।১৯২৪ সালের ৬ নভেম্বর আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনর্স এয়ার্সে উপস্থিত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন রবীন্দ্রনাথ। এই সময় ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর আতিথেয়তায় ভিলা মিরালরিওতে চলে আসেন কবি। ১৯২৫ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি যাত্রা করেন ভারতের উদ্দেশ্যে। ১৯২৬ সালের ৩০ মে ইতালির নেপলসে উপস্থিত হন তিনি। পরদিন রোমে সাক্ষাৎ করেন ফ্যাসিবাদী একনায়ক বেনিতো মুসোলিনির সঙ্গে। প্রথম দিকে উভয়ের মধ্যে উষ্ণ সম্পর্ক থাকলেও, ১৯২৬ সালের ২০ জুলাই প্রথম মুসোলিনির বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখেন রবীন্দ্রনাথ। তারপরই এই সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়।
১৯২৭ সালের ১৪ জুলাই দুই সঙ্গীকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এক চারমাসব্যাপী সফরে বের হন। এই সফরে তিনি ভ্রমণ করেন বালি, জাভা, কুয়ালালামপুর, মালাক্কা, পেনাং, সিয়াম ও সিঙ্গাপুর। “যাত্রী” গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ এই ভ্রমণের বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন। ১৯৩০ সালের গোড়ার দিকে প্রায় বর্ষব্যাপী এক সফরে তিনি বেরিয়ে পড়েন ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে। যুক্তরাজ্যে ফিরে তিনি বার্মিংহামে একটি ভাতৃসংঘের আশ্রয়ে অবস্থান করেন। এই সময় লন্ডন ও প্যারিস নগরীতে তাঁর অঙ্কিত চিত্রের প্রদর্শনী হয়।
বার্মিংহামে বসেই তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদানের জন্য তাঁর হিবার্ট বক্তৃতামালা রচনা করেন। এই বক্তৃতাগুলির উপজীব্য ছিল “আমাদের ঈশ্বরের মানবতাবোধ সম্পর্কে ধারণা, বা চিরন্তন মানবের দৈবসত্ত্বা”। এই সময় তিনি লন্ডনের বার্ষিক কোয়েকার সম্মেলনেও ভাষণ দেন।এখানে তাঁর ভাষণের বিষয়বস্তু ছিল ভারতীয় ও ব্রিটিশদের সম্পর্ক। এই প্রসঙ্গে তিনি এক “নিরাসক্তির কৃষ্ণগহ্বর”-এর উল্লেখ করেন। পরবর্তী দুই বছর এই বিষয় নিয়ে তিনি অনেক চিন্তাভাবনা করেছিলেন। পরে তিনি ডার্টিংটন হলে অবস্থান করে তৃতীয় আগা খানের সঙ্গে দেখা করেন।
১৯৩০ সালের জুন থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত তিনি ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড ও জার্মানি পর্যটন করেন। এরপর যান সোভিয়েত ইউনিয়নে। অতিন্দ্রীয়বাদী পারসিক কবি হাফিজের কিংবদন্তি ও রচনার গুণমুগ্ধ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯৩২ সালের এপ্রিলে জীবনের শেষপর্বে তিনি তাই যান ইরানে। গ্রহণ করেন রেজা শাহ পাহলভির আতিথেয়তা। এই ভ্রমণের সময়েই তিনি সফর করেন ইরাক (১৯৩২) ও সিংহল (১৯৩৩)।
জীবনের শেষার্ধব্যাপী এই বিশ্বভ্রমণে রবীন্দ্রনাথ হেনরি বার্গসন, আলবার্ট আইনস্টাইন, রবার্ট ফর্স্ট, টমাস মান, জর্জ বার্নার্ড শ, এইচ. জি. ওয়েলস ও রোমা রোঁলা হেলেন কেলার প্রমুখ সমসাময়িক যুগের বিশিষ্ট বহু ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। পরিচিত হয়েছেন অসংখ্য রাজন্যবর্গের সঙ্গে। এর ফলে জগৎব্যাপী মানব সমাজের নানা বিভাজন ও জাতীয়তাবাদের প্রকৃত স্বরূপটি অনুসন্ধান করতে সমর্থ হন কবি।
সৃষ্টিকর্ম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টিকর্ম তাঁর রচিত কাব্য, উপন্যাস, ছোটোগল্প, নাট্যসাহিত্য, প্রবন্ধ, চিত্রকলা ও সঙ্গীতের মধ্যে ছড়িয়ে আছে।
উপন্যাস
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস বাংলা ভাষায় তার অন্যতম জনপ্রিয় সাহিত্যকর্ম। ১৮৮৩ থেকে ১৯৩৪ সালের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ মোট তেরোটি উপন্যাস রচনা করেছিলেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: চোখের বালি, গোরা, ঘরে বাইরে, চতুরঙ্গ, শেষের কবিতা, যোগাযোগ, চার অধ্যায় ইত্যাদি। তবে করুণা উপন্যাসটি তাঁর জীবদ্দশায় গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি।
ঘরে বাইরে উপন্যাসে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ভারতীয় জনমানসে জাতীয়তাবাদের উত্থানের দিকটি আলোচিত হয়েছে। এই উপন্যাসে ধর্ম ও জাতীয়তাবাদের সংমিশ্রণের বিপদ ও তার প্রতি রবীন্দ্রনাথের বিতৃষ্ণা ব্যক্ত হয়েছে। অন্যদিকে গোরা উপন্যাসের বিষয়বস্তুও কতকটা একই; তবে এই উপন্যাসে ভারতীয়ত্বের স্বরূপ সন্ধানেও ব্রতী হন কবি। ঘরে বাইরে উপন্যাসে আত্ম-পরিচিতি, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও ধর্মবিশ্বাসের মতো বিষয়গুলি এক পারিবারিক উপাখ্যান ও ত্রিকোণ প্রেমের সম্পর্কের আধারে আলোচিত হয়। শেষের কবিতা একটি কাব্যিক উপন্যাস।
সাহিত্যতত্ত্ববিদ সুকুমার সেন সংস্কৃত সাহিত্যের গদ্যপদ্যমিশ্রিত চম্পূ রচনাশৈলীর সঙ্গে এই উপন্যাসের তুলনা করেছেন। এই উপন্যাস রবীন্দ্রনাথের এক শ্লেষাত্মক উপন্যাস। এখানে দেখা যায়, নায়ক অমিত রায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামে এক বৃদ্ধ, সেকেলে ও অতি-নন্দিত কবির কাব্যদর্শনটিকে আক্রমণ করছেন।
রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসগুলি বাঙালি পাঠকসমাজে জনপ্রিয়তা পেলেও বহির্বঙ্গে এগুলি খুব একটা পরিচিতি পায়নি। পরবর্তীকালে সত্যজিৎ রায় ঘরে বাইরে চলচ্চিত্রায়ণের মাধ্যমে উপন্যাসটিকে পাশ্চাত্য বিদ্বজ্জন সমাজে তুলে ধরেন। রবীন্দ্র-উপন্যাসের আরও দুটি বহু-প্রশংসিত চলচ্চিত্রায়ণ হল ঋতুপর্ণ ঘোষ পরিচালিত চোখের বালি ও সুমন মুখোপাধ্যায় পরিচালিত চতুরঙ্গ।
উপন্যাস | প্রকাশকাল | বিস্তারিত তথ্য |
---|---|---|
করুণা | ১৮৭৭-১৮৭৮ (১৯৬১) | এটি রবীন্দ্রনাথের লেখা প্রথম উপন্যাস। তবে এটি তাঁর জীবদ্দশায় গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় নি। এটি ‘ভারতী’ পত্রিকায় ১৮৭৭-১৮৭৮ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। ১৯৬১ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক প্রকাশিত রবীন্দ্র রচনাবলীতে ‘করুণা’ প্রথম প্রকাশিত হয়। এটির পরিশেষ হয় নি বলে এটি উপন্যাসের সম্পূর্ণ মর্যাদা পায় নি (অসমাপ্ত উপন্যাস)। এটিকে বাদ দিয়ে রবীন্দ্রনাথ মোট তেরোটি উপন্যাস লিখেছেন। |
বৌ-ঠাকুরাণীর হাট | ১৮৮৩ | রবীন্দ্রনাথের প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত উপন্যাস। যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্য ও বাকলার জমিদার রামচন্দ্রের বিবাদকে উপজীব্য করে রচিত ঐতিহাসিক উপন্যাস। ১৩১৬ বঙ্গাব্দে বৌ-ঠাকুরাণীর হাট অবলম্বনে রচিত হয় রবীন্দ্রনাথের প্রায়শ্চিত্ত নাটকটি। প্রায়শ্চিত্ত ১৩৩৬ বঙ্গাব্দে পুনর্লিখিত হয়ে পরিত্রাণ নামে মুদ্রিত হয়। |
রাজর্ষি | ১৮৮৭ | ত্রিপুরার রাজপরিবারের ইতিহাস নিয়ে রচিত ঐতিহাসিক উপন্যাস। ১২৯৭ বঙ্গাব্দে এই উপন্যাসের প্রথমাংশ অবলম্বনে বিসর্জন নাটকটি রচিত হয়। |
চোখের বালি | ১৯০৩ | সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস। রবীন্দ্রনাথের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। ২০০৩ সালে ঋতুপর্ণ ঘোষ এই উপন্যাস অবলম্বনে চোখের বালি চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন। |
নৌকাডুবি | ১৯০৬ | সামাজিক উপন্যাস। ১৩১০-১১ বঙ্গাব্দে বঙ্গদর্শন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। |
প্রজাপতির নির্বন্ধ | ১৯০৮ | হাস্যরসাত্মক উপন্যাস। ১৩১১ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্র-গ্রন্থাবলী (‘হিতবাদীর উপহার’) সংকলনে চিরকুমার সভা নামে প্রকাশিত হয়। পরে চিরকুমার সভা নামে এই উপন্যাসের নাট্যরূপটি ১৩৩২ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয়। |
গোরা | ১৯১০ | মহাকাব্যিক উপন্যাস। রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘতম উপন্যাস। দেশ পত্রিকার বিচারে বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাংলা উপন্যাস। |
ঘরে বাইরে | ১৯১৬ | রাজনৈতিক উপন্যাস। চলিত ভাষায় লেখা রবীন্দ্রনাথের প্রথম উপন্যাস। ১৯৮৪ সালে সত্যজিৎ রায় এই উপন্যাস অবলম্বনে ঘরে বাইরে চলচ্চিত্রখানি নির্মাণ করেন। |
চতুরঙ্গ | ১৯১৬ | সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস। সাধুভাষায় লিখিত রবীন্দ্রনাথের সর্বশেষ উপন্যাস। রবীন্দ্রনাথের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস বলে বিবেচিত হয়। ২০০৮ সালে সুমন মুখোপাধ্যায় এই উপন্যাস অবলম্বনে চতুরঙ্গ চলচ্চিত্রখানি নির্মাণ করেন। |
যোগাযোগ | ১৯২৯ | সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস। বিচিত্রা মাসিকপত্রে ধারাবাহিকরূপে প্রকাশিত হয় (আশ্বিন, ১৩৩৪ – চৈত্র, ১৩৩৫)। পত্রিকায় প্রকাশকালে নাম ছিল তিন-পুরুষ। |
শেষের কবিতা | ১৯২৯ | রোম্যান্টিক-মনস্তাত্ত্বিক কাব্যিক উপন্যাস। রবীন্দ্রনাথের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। |
মালঞ্চ | ১৯৩৪ | সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস। নরনারীর জটিল সম্পর্ক নিয়ে রচিত রবীন্দ্রনাথের একটি সংক্ষিপ্ত উপন্যাস। |
চার অধ্যায় | ১৯৩৪ | রাজনৈতিক উপন্যাস। এই উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ সশস্ত্র বিপ্লববাদের বিরুদ্ধে বিতৃষ্ণা প্রকাশ করায় বিতর্কের সৃষ্টি হয়। উৎপল দত্ত উপন্যাসটির নাট্যরূপ মঞ্চায়ন করেছিলেন। |
কবিতা
রবীন্দ্রনাথের কাব্য বহুবর্ণময়। তার কাব্য কখনও রক্ষণশীল ধ্রুপদি শৈলীতে, কখনও হাস্যোজ্জ্বল লঘুতায়, কখনও বা দার্শনিক গাম্ভীরে, আবার কখনও বা আনন্দের উচ্ছ্বাসে মুখরিত। এই কাব্যগুলির উৎস পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে রচিত বৈষ্ণব কবিদের পদাবলি সাহিত্য। রবীন্দ্রনাথের কাব্যে গভীর প্রভাব বিস্তার করেন উপনিষদ রচয়িতা ঋষিকবিগণ। এঁদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য হলেন ব্যাস।
এছাড়াও অতিন্দ্রীয়বাদী সুফি সন্ত কবীর ও ভক্তিবাদী কবি রামপ্রসাদের প্রভাবও তার কাব্যে লক্ষিত হয়। তবে রবীন্দ্রনাথের কবিতা সৃষ্টিশীলতা ও সৌকর্যের সর্বোচ্চ চূড়ায় উপনীত হয়, গ্রামীণ বাংলার লোকসঙ্গীতের সঙ্গে তার পরিচিতি লাভের পরই। এই সময় লালন শাহ সহ বাংলার বিশিষ্ট বাউল সংগীতস্রষ্টাদের সান্নিধ্যে আসেন কবি। বাউল সংগীতকে পুনরাবিষ্কার করে জনপ্রিয় করে তুলতে রবীন্দ্রনাথ বিশেষ ভূমিকা নেন। এই সব বাউল গান উনিশ শতকের কর্তাভজাদের গানের মতো অন্তর্নিহিত দৈবসত্ত্বার অনুসন্ধান ও ধর্মীয় ও সামাজিক গোঁড়ামির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কথা ছিল।
শিলাইদহে অবস্থানকালে তার গীতিকবিতার জন্য একটি শব্দবন্ধ তিনি গ্রহণ করেন বাউল পদাবলি থেকে – মনের মানুষ। ধ্যান করেন তার জীবন দেবতা-র। প্রকৃতি ও মানবচরিত্রের আবেগময় নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে এই যোগসূত্রটি পরমসত্ত্বার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। ভানুসিংহের নামাঙ্কিত কবিতাগুলিতেও কবি এই শৈলীর ব্যবহার ঘটান। রাধা ও কৃষ্ণের প্রণয়লীলাকে উপজীব্য করে লেখা এই কবিতাগুলি পরবর্তী সত্তর বছরে বারংবার সংশোধন করেছিলেন কবি।
১৯৩০-এর দশকে একাধিক পরীক্ষামূলক রচনায় তিনি বাংলা সাহিত্যে সদ্য আগত আধুনিকতা ও বাস্তবতাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী জীবনে রচিত আফ্রিকা ও ক্যামেলিয়া এই রকমই দুটি পরিচিত কবিতা। প্রথম দিকে সাধু ভাষায় কবিতা রচনা করলেও, পরবর্তীকালে কবিতার ভাষা হিসেবে বেছে নেনে মান্য চলিত বাংলাকে। তার অন্যান্য প্রসিদ্ধ কাব্যগ্রন্থগুলি হল: মানসী, সোনার তরী, বলাকা, ও পূরবী ইত্যাদি। সোনার তরী কবিতাটিতে কবি জীবন ও তার কীর্তির ক্ষণস্থায়ী অস্তিত্বের কথা বলেছেন। এই কবিতার শেষ পংক্তিদুটি অবিস্মরণীয় – “শূন্য নদীর তীরে রহিনু পড়ি/ যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।” সারা বিশ্বে রবীন্দ্রনাথের সর্বাপেক্ষা সুপরিচিত গ্রন্থটি হল গীতাঞ্জলি। এই কাব্যগ্রন্থটির জন্যই তিনি নোবেল পুরস্কার লাভ করেছিলেন। নিচে গীতাঞ্জলি কাব্যের ১২৫ সংখ্যক গানটি উদ্ধৃত হল:
“ | আমার এ গান ছেড়েছে তার সকল অলংকার তোমার কাছে রাখেনি আর সাজের অহংকার। অলংকার যে মাঝে প’ড়ে মিলনেতে আড়াল করে, তোমার কথা ঢাকে যে তার মুখর ঝংকার। তোমার কাছে খাটে না মোর কবির গরব করা– মহাকবি, তোমার পায়ে দিতে চাই যে ধরা। জীবন লয়ে যতন করি যদি সরল বাঁশি গড়ি, আপন সুরে দিবে ভরি সকল ছিদ্র তার। | ” |
এই কবিতাটির ইংরেজি অনুবাদ করেন রবীন্দ্রনাথই (Gitanjali, verse VII):
“My song has put off her adornments. She has no pride of dress and decoration. Ornaments would mar our union; they would come between thee and me; their jingling would drown thy whispers.” |
“My poet’s vanity dies in shame before thy sight. O master poet, I have sat down at thy feet. Only let me make my life simple and straight, like a flute of reed for thee to fill with music.” |
- সোনার তরী (১৮৯৪)
- চিত্রা (১৮৯৬)
- চৈতালি (১৮৯৬)
- গীতাঞ্জলি (১৯১০)
- বলাকা (১৯১৬)
- পূরবী (১৯২৫)
- মহুয়া
- কল্পনা (১৯০০)
- ক্ষণিকা (১৯০০)
- পুনশ্চ (১৯৩২)
- পত্রপুট (১৯৩৬)
- সেঁজুতি (১৯৩৮)
- ভগ্নহৃদয় (১৮৮১)
সোনার তরী
সোনার তরী কাব্যগ্রন্থের প্রকাশকাল ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দ (১৩০০ বঙ্গাব্দ)। কাব্যগ্রন্থটি কবি দেবেন্দ্রনাথ সেনের প্রতি উৎসর্গিত। এই কাব্যের অনেকগুলি কবিতার সঙ্গে পদ্মাপাড়ের পল্লিপ্রকৃতির গভীর যোগ বিদ্যমান। সমগ্র গ্রন্থটি বাংলা কাব্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রোম্যান্টিক কাব্য সংকলন। রবীন্দ্রনাথের নিজের ভাষায়, “আমার বুদ্ধি এবং কল্পনা এবং ইচ্ছাকে উন্মুখ করে তুলেছিল এই সময়কার প্রবর্তনা, বিশ্বপ্রকৃতি এবং মানবলোকের মধ্যে নিত্য সচল অভিজ্ঞতার প্রবর্তনা। এই সময়কার কাব্যের ফসল ভরা হয়েছিল সোনার তরীতে।” “সোনার তরী” (কাব্যের নামকবিতা) কবিতাটিতে কবি জীবন ও তার কীর্তির ক্ষণস্থায়ী অস্তিত্বের কথা বলেছেন। এই কবিতার শেষ পংক্তিদুটি অবিস্মরণীয় – “শূন্য নদীর তীরে রহিনু পড়ি/ যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।”
এই কাব্যের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কবিতা হল “সোনার তরী”, “বিম্ববতী”, “সুপ্তোত্থিতা”, “বর্ষাযাপন”, “হিং টিং ছট”, “বৈষ্ণবকবিতা”, “দুই পাখি”, “যেতে নাহি দিব”, “বসুন্ধরা”, “নিরুদ্দেশ যাত্রা” ইত্যাদি।
বলাকা
বলাকা কাব্যগ্রন্থের প্রকাশকাল ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দ। গ্রন্থটি কবি উৎসর্গ করেছিলেন উইলিয়াম পিয়রসনকে। ১৯১৫-১৬ সালে কবির কাব্যগ্রন্থ নামক কাব্যসংকলনেও এটি অন্তর্ভুক্ত হয়। এটি রবীন্দ্রনাথের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ। এই কাব্যগ্রন্থে দেখা যায় পূর্ববর্তী গীতাঞ্জলি-পর্বের ঈশ্বরানুভূতি ও অতীন্দ্রিয় চেতনা থেকে মুক্ত হয়ে কবি একটি স্বতন্ত্র জগৎ সৃষ্টি করেছেন। “যৌবনের জয়গান, চলমান বিশ্বের অনিঃশেষ যাত্রা, ভাষার বর্ণাঢ্য উজ্জ্বলতা ও ছন্দের অপ্রতিহত প্রবাহ বলাকার বৈশিষ্ট্য।”
এই কাব্যগ্রন্থের উল্লেখযোগ্য কবিতাগুলি হল “সবুজের অভিযান”, “শঙ্খ”, “ছবি”, “শা-জাহান”, “বলাকা” ইত্যাদি।
ছোট গল্প
রবীন্দ্রনাথের জীবনের “সাধনা” পর্বটি (১৮৯১–৯৫) ছিল সর্বাপেক্ষা সৃষ্টিশীল পর্যায়। তার গল্পগুচ্ছ গল্পসংকলনের প্রথম তিন খণ্ডের চুরাশিটির গল্পের অর্ধেকই রচিত হয় এই সময়কালের মধ্যে। এইসব গল্পে পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলির প্রতি রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটেছে। আধুনিক ধ্যানধারণা সম্পর্কে মতামত প্রকাশ করেছেন তিনি। আবার কখনও মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের বৌদ্ধিক বিশ্লেষণকে করে তুলেছেন গল্পের মূল উপজীব্য। “সাধনা” পর্বে রচিত প্রথম দিককার গল্পগুলিকে রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন এক স্বতঃস্ফূর্ত জীবনীশক্তির বহিঃপ্রকাশ। পতিসর, সাজাদপুর ও শিলাইদহ সহ পারিবারিক জমিদারির বিভিন্ন অংশে ঘুরে সাধারণ গ্রামবাসীদের সঙ্গে মেলামেশা করে তাদের জীবন থেকেই এই সব গল্পের উপাদান সংগ্রহ করেন রবীন্দ্রনাথ। সমকালীন ভারতের দরিদ্র জনগণের জীবনের প্রতি এক গভীর অন্তদৃষ্টি এই সব গল্পে নিহিত হয়ে আছে। আর তাই গল্পগুলি ভারতীয় সাহিত্যে একক স্থানের অধিকারী।
“কাবুলিওয়ালা” এক শহুরে লেখকের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা এক কাবুলি মেওয়াওয়ালার গল্প। এই গল্পের একস্থানে ফুটে উঠেছে ভারতের বদ্ধ নগরজীবন থেকে ছুটি নিয়ে সুদূর বনপর্বতে মুক্ত স্বাধীন জীবনযাপনের এক আকুল আকাঙ্ক্ষা: “এখন শুভ্র শরৎকাল। প্রাচীনকালে এই সময়ে রাজারা দিগ্বিজয়ে বাহির হইতেন। আমি কলিকাতা ছাড়িয়া কখনো কোথাও যাই নাই, কিন্তু সেই জন্যই আমার মনটা পৃথিবীময় ঘুরিয়া বেড়ায়। আমি যেন আমার ঘরের কোণে চিরপ্রবাসী, বাহিরের পৃথিবীর জন্য আমার সর্বদা মন কেমন করে। একটা বিদেশের নাম শুনিলেই অমনি আমার চিত্ত ছুটিয়া যায়, তেমনি বিদেশী লোক দেখিলেই অমনি নদী পর্বত অরণ্যের মধ্যে একটা কুটিরের দৃশ্য মনে উদয় হয়, এবং একটা উল্লাসপূর্ণ স্বাধীন জীবনযাত্রার কথা কল্পনায় জাগিয়া ওঠে।” গল্পগুচ্ছ সংকলনের অন্য গল্পগুলির অনেকগুলিই রচিত হয়েছিল রবীন্দ্রজীবনের সবুজ পত্র পর্বে (১৯১৪–১৭; প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত পত্রিকার নামানুসারে)।
রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ বাংলা কথাসাহিত্যের এক অন্যতম জনপ্রিয় গ্রন্থ। এই গ্রন্থের একাধিক গল্প অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র ও নাটক। সত্যজিৎ রায়ের চারুলতা রবীন্দ্রনাথের বিতর্কিত ছোটোগল্প (মতান্তরে অনু-উপন্যাস) নষ্টনীড় অবলম্বনে নির্মিত। চলচ্চিত্রায়িত অপর একটি ছোটোগল্প হল অতিথি। এই গল্পে এক গ্রাম্য জমিদারের সঙ্গে নৌকায় সাক্ষাৎ হয় তারাপদ নামে এক ব্রাহ্মণ বালকের। ছেলেটি জানায় সে বাড়ি থেকে পালিয়ে এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দয়াপরবশ হয়ে জমিদার তাকে দত্তক নেয় এবং শেষ পর্যন্ত আপন কন্যার সঙ্গে ছেলেটির বিবাহ দিতে উদ্যোগী হন। কিন্তু বিয়ের আগের রাতেই আবার পালিয়ে যায় তারাপদ।
স্ত্রীর পত্র গল্পটি বাংলা সাহিত্যে নারী স্বাধীনতার স্বপক্ষে লেখা একটি প্রথম যুগের সাহসী পদক্ষেপ। একটি চিরন্তন পুরুষতান্ত্রিক মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের গৃহবধূ মৃণাল পুরী ভ্রমণের সময় একটি চিঠি লেখে। এই চিঠিতেই প্রকাশিত হয়েছে সমগ্র গল্পটি। নিজের জীবনের সব সংগ্রাম ও বঞ্চনার উল্লেখ করে শেষাবধি গৃহে না ফেরার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে সে। স্বামীকে সে জানিয়ে দেয়, আমিও বাঁচবো, এই বাঁচলুম।
হৈমন্তী গল্পে রবীন্দ্রনাথ আঘাত করেছেন হিন্দু বিবাহ সংস্কার ও ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভণ্ডামিকে। তুলে ধরেছেন বিবাহিত বাঙালি রমণীর জীবন্মৃত অবস্থাটি। দেখিয়েছেন কেমন করে হৈমন্তী নামে এক সংবেদনশীল যুবতীকে তার স্বাধীনতাস্পৃহার জন্য শেষ পর্যন্ত প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়। এই গল্পের শেষ লাইনে গল্পকার সরাসরি রামের জন্য সীতার আত্মত্যাগের হিন্দু আদর্শটিকে আক্রমণ করেন।
মুসলমানীর গল্প নামক গল্পটিতে হিন্দু-মুসলমান বিরোধের মূল কারণগুলি অনুসন্ধান করেছেন রবীন্দ্রনাথ। অন্যদিকে দর্পহরণ গল্পে এক সাহিত্যিক-খ্যাতিলোভী উচ্চাকাঙ্ক্ষী যুবকের চিত্র এঁকে তিনি তার আত্মসচেতনারই পরিচয় দেন। স্ত্রীকে ভালবাসলেও এই যুবক স্ত্রীর নিজস্ব সাহিত্যিক সত্ত্বাটিকে রুদ্ধ করতে চায়। কারণ তার মতে সাহিত্য নারীসুলভ নয়। জানা যায়, কৈশোর ও প্রথম যৌবনে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং নারী সম্পর্কে এই রকম ধারণাই পোষণ করতেন। তবে দর্পহরণ গল্পে শেষ পর্যন্ত উক্ত যুবকটি তার স্ত্রীর প্রতিভা স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়। রবীন্দ্রনাথের অনেক ছোটোগল্পের শেষ লাইন বাংলা ভাষায় প্রবাদপ্রতিম। এগুলি মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য জীবিত ও মৃত গল্পটির সমাপ্তি: কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নাই।
- বামা
- রাজপথের কথা
- দেনা পাওনা
- পোস্টমাস্টার
- গিন্নি
- সুভা
- ব্যবধান
- তারাপ্রসন্নের কীর্তি–
- খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন
- সম্পত্তি-সমর্পণ
- দালিয়া
- কঙ্কাল
- মুক্তির উপায়
- ত্যাগ
- একরাত্রি
- একটা আষাঢ়ে গল্প
- জীবিত ও মৃত
- স্বর্নমৃগ
- রীতিমত নভেল
- জয়পরাজয়
- কাবুলিওয়ালা
- মহামায়া
- রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা
- ঠাকুরদা
- দানপ্রতিদান
- সম্পাদক
- মধ্যবর্তনী
- অসম্ভব কথা
- শাস্তি–
- একটি ক্ষুদ্র পুরাতন গল্প
- সমাপ্তি
- সমস্যাপূরণ
- খাতা
- অনধিকার প্রবেশ
- মেঘ ও রৌদ্র
- প্রায়শ্চিত
- বিচারক
- নিশীথে
- আপদ
- দিদি
- মানবঞ্জন
- প্রতিহিংসা
- অতিথি
- দুরাশা
- পুত্রযজ্ঞ
- ডিটেকটিভ
- অধ্যাপক
- রাজটিকা
- মনিহারা
- দৃষ্টিদান
- সদর ও অন্দর
- উদ্ধার
- ফেল
- শুভদৃষ্টি
- উলুখরের বিপদ
- প্রতিবেশিনী
- দর্পহরন
- মাল্যদান
- কর্মফল
- গুপ্তধন
- মাষ্টার মশায়
- রাসমনির ছেলে
- হালদার গোষ্ঠী
- হৈমন্তী
- বোষ্টমী
- স্ত্রীর পত্র
- ভাইফোটা
- শেষের রাত্রি
- অপরিচিতা
- তপস্বনী
- পাত্র ও পাত্রী
- নামঞ্জুর গল্প
- সংস্কার
- বলাই
- চিত্রকর
- চোরাই ধন
- রবিবার
- শেষ কথা
- ল্যাবরেটরী
- প্রগতিসংহার
- শেষ পুরস্কার
- পণরক্ষা
- ক্ষুধিতপাষাণ
- যজ্ঞেশ্বরের যজ্ঞ
- দুর্বুদ্ধি
- ছুটি
নাটক (গীতিনাট্য,কাব্যনাট্য,নৃত্যনাট্য,সাংকেতিক নাটক,সামাজিক নাটক,প্রহসন)
- প্রকৃতির প্রতিশোধ (১৮৮৪)
- বিসর্জন
- বৈকু্ন্ঠের খাতা, প্রহসন
- হাস্যকৌতুক, প্রহসন
- ব্যঙ্গকৌতুক, প্রহসন
- শারদোৎসব, সাংকেতিক নাটক
- গুরু
- বসন্ত (গীতিনাট্য-কাজী নজরুলকে উৎসর্গ করেন)
- চিরকুমার সভা
- গৃহপ্রবেশ
- নটরাজ
- শেষ রক্ষা
- নবীন
- শাপমোচন
- শ্যামা (১৯৩৯), নৃত্যনাট্য
- নলিনী
- মালঞ্চ
- গোড়ায় গলদ, প্রহসন
- মালিনী
- মুকুট
- ফাল্গুনী
- অরূপরতন
- ঋণশোধ
- শোধবোধ, সামাজিক
- শেষ বর্ষণ
- পরিত্রাণ
- বাঁশরি, সামাজিক
- শ্রাবণগাথা
- মুক্তির উপায়
- কালমৃগয়া, গীতিনাট্য
- রাজা ও রাণী (১৮৮৯)
- কালের যাত্রা
- মুক্তধারা (১৯২২)
- রক্তকরবী (১৯২৬), সাংকেতিক নাটক
- নটীর পূজা (১৯২৬), (নৃত্যনাট্য)
- তপতী (রাজা ও রাণী-র পরবর্তী সংস্করন)
- রুদ্রচন্ড (কাব্যনাট্য), (১৮৮১)
- চিত্রাঙ্গদা (১৮৯২), কাব্যনাট্য
- বাল্মীকিপ্রতিভা (১৮৮১), গীতিনাট্য
- মায়ার খেলা (১৮৮৮), গীতিনাট্য
- প্রায়শ্চিত্ত (১৯০৯), সাংকেতিক
- রাজা (১৯১০), সাংকেতিক
- অচলায়তন (১৯১১), সাংকেতিক নাটক
- ডাকঘর (১৯১২), সাংকেতিক
- তাসের দেশ (১৯৩৩)
- চন্ডালিকা (১৯৩৩),
- চন্ডালিকা (১৯৩৮), নৃত্যনাট্য
প্রবন্ধ সমূহ
- কালান্তর
- বিবেচনা ও অবিবেচনা
- লোকহিত
- লড়াইয়ের মূল
- কর্তার ইচ্ছায় কর্ম
- ছোট ও বড়ো
- বাতায়নিকের পত্র
- শক্তিপূজা
- শিক্ষার মিলন
- সত্যের আহবান
- চরকা
- স্বরাজ সাধন
- শূদ্র ধর্ম
- রায়তের কথা
- বৃহত্তর ভারত
- হিন্দু মুসলমান
- স্বামী শ্রদ্ধানন্দ
- রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্রনৈতিক মত
- হিজলী ও চট্টগ্রাম
- প্রচলিত দণ্ডবিধি
- নারী
- কন্গ্রেস
- দেশনায়ক
- মহাজাতি-সদন
- নবযুগ
- প্রলয়ের সৃষ্টি
- আরোগ্য
- সভ্যতার সংকট
- মানুষের ধর্ম
- পঞ্চভুত
ভ্রমণ কাহিনী
- য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র (১৮৮১)
- য়ুরোপ প্রবাসীর ডায়রী (১৮৯১)
- রাশিয়ার চিঠি (১৯১৯)
- পারস্যে (১৯১৯)
- জাপান যাত্রী (১৯৩১)
জীবনীমূলক
- চরিত্রপূজা (১৯০৭)
- জীবনস্মৃতি (১৯১২)
- ছেলেবেলা (১৯৪০)
- আত্নপরিচয় (১৯৪৩)
পত্র-সাহিত্য
- ছিন্নপত্র
সঙ্গীত
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন স্বনামধন্য সংগীতস্রষ্টা ও বিশিষ্ট চিত্রকর। তিনি প্রায় ২৫০০০টি গান রচনা করেন। রবীন্দ্রসংগীত নামে পরিচিত এই গীতিগুচ্ছ বাংলার সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। রবীন্দ্রনাথের গান তার সাহিত্যের সঙ্গেও অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত – তার বহু কবিতা যেমন গানে রূপান্তরিত হয়েছে, তেমনই তার উপন্যাস, গল্প বা নাটকেও বিশিষ্ট ভূমিকা নিয়েছে তার গান। তার গানের মূল উৎস হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীতের ঠুমরি শৈলী।
প্রথম জীবনে লেখা করুণ ব্রাহ্ম ধর্মসঙ্গীত থেকে ছদ্ম-কামোদ্দীপক লঘু সঙ্গীত – রবীন্দ্রনাথের গান সকল প্রকার মানবিক আবেগকেই সুরবদ্ধ করেছে। বিভিন্ন প্রকার শাস্ত্রীয় রাগের সুরগত সৌন্দর্যকে প্রতিফলিত করেছে এই গানগুলি। কখনও কখনও কোনো নির্দিষ্ট রাগের তান ও ছন্দকে বিশ্বস্ততার সঙ্গে অনুসরণ করেছে। আবার কখনও রচনার সৃষ্টিসৌকর্যকে উজ্জ্বল করে ফুটিয়ে তোলার জন্য তিনি ব্যবহার করেছেন একাধিক রাগের উপাদান।
শুধু হিন্দুস্তানি সংগীতই নয়, রবীন্দ্রনাথের গানে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে কর্ণাটিক শাস্ত্রীয় সংগীত, বাংলা লোকসঙ্গীত এমনকি ইংরেজি ব্যালাড ও স্কটিশ লোকগীতিও। ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী প্রদত্ত একটি তালিকা অনুসারে, রবীন্দ্রনাথের ভাঙা গান, অর্থাৎ, অপরের সঙ্গীত থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে রচিত গানের সংখ্যা ২৩৪। স্বরচিত কবিতা ছাড়াও রবীন্দ্রনাথ সুর দেন বিভিন্ন বেদগান এবং বিদ্যাপতি, গোবিন্দদাস, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অক্ষয়কুমার বড়াল ও সুকুমার রায়ের গীতিকবিতাতেও। ভারতের জাতীয় স্তোত্র বন্দেমাতরম-এর সুরও রবীন্দ্রনাথই দেওয়া।
রবীন্দ্রসঙ্গীতের আবেগময়ী শক্তি ও সৌন্দর্যের আকর্ষণ বাঙালি সমাজে অমোঘ। মডার্ন রিভিউ পত্রিকায় এই প্রসঙ্গে লেখা হয়, “বাংলায় এমন কোনো শিক্ষিত গৃহ নেই যেখানে রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়া বা অন্ততপক্ষে গাওয়ার চেষ্টা করা হয় না… এমনকি অশিক্ষিত গ্রামবাসীরাও তাঁর গান গেয়ে থাকেন।” দি অবজার্ভার-এর আর্থার স্ট্রেঞ্জওয়েজ তার মিউজিক অফ হিন্দুস্তান রচনায় অবাঙালিদের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীতের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন, এই গানগুলি হল “vehicle of a personality … [that] go behind this or that system of music to that beauty of sound which all systems put out their hands to seize.”
বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত আমার সোনার বাংলা ও ভারতের জাতীয় সঙ্গীত জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে রবীন্দ্রনাথেরই রচনা। তিনিই একমাত্র ব্যক্তিত্ব যিনি দুটি রাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীতের স্রষ্টা। এছাড়াও, বিশিষ্ট সেতার বাদক বিলায়েৎ খান, সরোদিয়া বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ও আমজাদ আলি খানের বাদনশৈলীকেও বিশেষভাবে প্রভাবিত করে রবীন্দ্রসংগীত। গীতবিতান সংকলনে সংগৃহীত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের সব গান।
চিত্রকলা
ষাট বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ চিত্রাঙ্কণ শুরু করেন। চিত্রকলায় তার কোন প্রথাগত বা আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছিল না। খেলার ছলেই তিনি আঁকতে শুরু করেছিলেন, তারপর একসময় তা’নেশায় পরিণত হয়। রবীন্দ্রনাথের ছবিগুলোকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত, মুখমণ্ডল বা মুখাবয়বের ছবি ; দ্বিতীয়ত, অদ্ভুত কাল্পনিক প্রাণীর ছবি ; তৃতীয়ত, প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি। এর বাইরেও ছবি আছে ; কিন্তু অধিকাংশ ছবি উল্লিখিত তিনটির যে কোন একটি ভাগে পড়ে যায়। রবীন্দ্রনাথের আঁকা আত্মপ্রতিকৃতিও একাধিক। এমনকী “ফিমেইল ন্যুডও” তিনি এঁকেছেন। মুখাবয়ব বা মুখমণ্ডল আঁকার প্রতি তার বিশেষ পক্ষপাত ছিল। কোন কোন ছবিতে এমন কিছু বিষয়বস্তু আছে যা অভারতীয়,যেমন অপেরার মতো নাটকীয় দৃশ্য, খ্রিষ্টিয় নানের অবয়ব ইত্যাদি।
রবীন্দ্রনাথ ছবি এঁকেছেন অদ্ভুতভাবে ; তার কাগজের মাপ ঠিক ছিল না ; ঠিক ছিল না রংয়ের। ভালো মানের সামগ্রী না-হওয়ায় বেশ কিছু ছবি অপুনরুদ্ধারণীয়ভাবে নষ্ট হয়ে গেছে। কখনো কলম, কখনো পেন্সিল, কখনো তুলি এমনকী ওভারকোটের হাতায় রং মাখিয়ে পর্যন্ত এঁকেছেন। এভাবেই আড়াই হাজারেরও বেশি ছবি এঁকেছেন তিনি। আত্মপ্রত্যয়ের অভাব ছিল : ফলে, মহৎ ছবি সৃষ্টির চেয়ে অঙ্কনটি আদৌ ছবি হচ্ছে কি-না তাই নিয়ে তিনি সদা ভাবিত ছিলেন: “ছবিটা ছবি হলো কিনা” সেটাই দেখতে বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
দক্ষিণ ফ্রান্সের একদল শিল্পীর উৎসাহে তিনি প্যারিসে প্রথম তার ছবির প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। এরপর সারা ইউরোপে সফলভাবে প্রদর্শিত হতে থাকে তার চিত্রাবলি। ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে প্যারিসের পিগ্যাল আর্ট গ্যালারিতে তার প্রথম শিল্প প্রদর্শনীর সময় থেকেই রবীন্দ্রনাথের ছবি আলোচনা ও সমালোচনার বিষয়বস্তু। কবিতা ও গানের আঙ্গিকে রবীন্দ্রনাথ যে কথা বলতে পারেন নি, সেই অসৌন্দর্য, কিম্ভূত আর অসুরেরই প্রকাশ তার চিত্রকলা।
রবীন্দ্রনাথের চিত্রশৈলীর বৈশিষ্ট্য ছিল নান্দনিকতার অত্যাশ্চর্য প্রদর্শনী ও বর্ণময়তা। প্রিমিটিভ আর্টে যে পরিশীলনহীন প্রাকৃত শক্তি দেখা যায়, তার ছবিতে সেই শক্তির স্ফূরণ লক্ষ্য করা যায়; দেখা যায় জ্যামিতিক আকার, কৌণিকতা, রঙের উগ্রতা। এডভার্ড মুঙ্খ বা এমিল্ নোলদের অঙ্কনরীতিরও ছায়াসম্পাত আছে রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু ছবিতে। অবশ্য কারো কারো মতে তার ছবিতে প্রোটানোপিয়া (বর্ণান্ধতা) বা বিশেষ কিছু রঙের প্রতি (রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে লাল-সবুজ) অযথার্থ প্রয়োগের উদাহরণেরও দেখা মেলে।
রবীন্দ্রনাথ অবশ্য একাধিক শৈলী আয়ত্ত্ব করেছিলেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য উত্তর নিউজিল্যান্ডের লোকশিল্প, কানাডার পশ্চিম উপকূলের (ব্রিটিশ কলম্বিয়া) হাইদা খোদাই চিত্রশিল্প, এবং ম্যাক্স পেচস্টেইনের কাঠখোদাই। নিজের হস্তাক্ষরের ক্ষেত্রেও রবীন্দ্রনাথ শিল্পসচেতন ছিলেন। সাধারণ রেখাঙ্কণের সৌন্দর্যায়ণ, কাটাকুটি, সাধারণ ছন্দোময় নকশার মাধ্যমে পাণ্ডুলিপিতে শব্দগুলির শৈল্পিক উপস্থাপনার মাধ্যমে তিনি বহু অপূর্ব নকশাচিত্র অঙ্কণ করেন।
রাজনৈতিক মতাদর্শ ও শিক্ষাচিন্তা
রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চিন্তাধারাটি অত্যন্ত জটিল। তিনি সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করেন ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের সমর্থন করেন। ১৮৯০ সালে প্রকাশিত “মানসী” কাব্যগ্রন্থের কয়েকটি কবিতায় রবীন্দ্রনাথের প্রথম জীবনের রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তাভাবনার পরিচয় পাওয়া যায়। হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র মামলার তথ্যপ্রমাণ ও পরবর্তীকালের বিভিন্ন বিবরণী থেকে জানা যায় যে রবীন্দ্রনাথ গদর ষড়যন্ত্রের কথা শুধু জানতেনই না, বরং এই ষড়যন্ত্রে জাপানি প্রধানমন্ত্রী তেরাউচি মাসাতাকি ও প্রাক্তন প্রিমিয়ার ওকুমা শিগেনোবুর সাহায্যও প্রার্থনা করেছিলেন।
অন্যদিকে ১৯২৫ সালের একটি প্রবন্ধে স্বদেশী আন্দোলনকে “চরকা-সংস্কৃতি” বলে বিদ্রুপ করে রবীন্দ্রনাথ কঠোর ভাষায় তার বিরোধিতা করেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ তার চোখে ছিল “আমাদের সামাজিক সমস্যাগুলির রাজনৈতিক উপসর্গ”। এই কারণে বৈকল্পিক ব্যবস্থা হিসেবে তিনি বৃহত্তর জনসাধারণের স্বনির্ভরতা ও বৌদ্ধিক উন্নতির ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেন। ভারতবাসীকে অন্ধ বিপ্লবের পন্থা ত্যাগ করে বাস্তবসম্মত উপযোগমূলক শিক্ষার পন্থাটিকে গ্রহণ করার আহ্বান জানান।
এই ধরনের মতবাদ অনেককেই বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। ১৯১৬ সালের শেষ দিকে সানফ্রানসিকোর একটি হোটেলে অবস্থানকালে একদল ভারতীয় চরমপন্থী রবীন্দ্রনাথকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিল। কিন্তু নিজেদের মধ্যে মতবিরোধের কারণে তাদের পরিকল্পনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতার ভূমিকা অবশ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি নাইটহুড বর্জন করেন। লর্ড চেমস্ফোর্ডকে তিনি জানালেন, “আমার এই প্রতিবাদ আমার আতঙ্কিত দেশবাসীর মৌনযন্ত্রণার অভিব্যক্তি।” রবীন্দ্রনাথের কবিতা “চিত্ত যেথা ভয়শূন্য” ও গান “একলা চলো রে” রাজনৈতিক রচনা হিসেবে জনমানসে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। “একলা চলো রে” গানটি গান্ধীজির বিশেষ প্রিয় ছিল। গান্ধীজির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ছিল অম্লমধুর। অস্পৃশ্যদের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে গান্ধীজি ও আম্বেডকরের মধ্যে যে বিরোধের সূত্রপাত হয় তার সমাধানেও রবীন্দ্রনাথ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। ফলে গান্ধীজিও তার “আমরণ” অনশন প্রত্যাহার করে নেন।
রবীন্দ্রনাথের “তোতাকাহিনী” গল্পের উপজীব্য একটি খাঁচায় আবদ্ধ পাখি। পাখিটিকে প্রতিদিন বলপূর্বক পুঁথির শুকনো পাতা খাওয়ানো হত। শেষ পর্যন্ত পাখিটি মারা যায়। এই গল্পে লেখক বিদ্রুপ করেন বিদ্যালয়ের মুখস্তসর্বস্ব শিক্ষাব্যবস্থাকেই। ১৯১৭ সালের ১১ অক্টোবর ক্যালিফোর্নিয়ার সান্টা বারবারা ভ্রমণের সময় এই সব চিন্তাধারণার ফলস্রুতিতে রবীন্দ্রনাথ এক নতুন ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা করেন। শান্তিনিকেতনে তার আশ্রমটিকে দেশ ও ভূগোলের গণ্ডীর বাইরে ভারত ও বিশ্বকে এক সূত্রে বাঁধার এক বিশ্ব পাঠকেন্দ্রে পরিণত করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন তিনি।
বিশ্বভারতী নামাঙ্কিত তার এই বিদ্যালয়ের শিলান্যাস হয় ১৯১৮ সালের ২২ অক্টোবর। ১৯২২ সালের ২২ ডিসেম্বর উদ্বোধন হয় এই বিদ্যালয়ের। এই বিদ্যালয়ে সনাতন ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার ব্রহ্মচর্য ও গুরুপ্রথা-র পুনঃপ্রবর্তন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এই বিদ্যালয়ের জন্য অর্থসংগ্রহ করতে কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন তিনি। নোবেল পুরস্কারের অর্থমূল্য হিসেবে প্রাপ্ত সম্পূর্ণ অর্থ তিনি ঢেলে দেন এই বিদ্যালয়ের পরিচালনে। শান্তিনিকেতনের অধ্যক্ষ ও শিক্ষক হিসেবেও অত্যন্ত ব্যস্ত থাকতেন তিনি। সকালে ছাত্রদের ক্লাস নিতেন এবং বিকেল ও সন্ধ্যায় তাদের জন্য পাঠ্যপুস্তক রচনা করতেন। ১৯১৯ সাল থেকে ১৯২১ সালের মধ্যে বিদ্যালয়ের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে তিনি একাধিকবার ইউরোপ ও আমেরিকা ভ্রমণ করেন।
প্রভাব
বিংশ শতাব্দীর বাঙালি সংস্কৃতিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাব অত্যন্ত ব্যাপক। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ তথা দার্শনিক অমর্ত্য সেন রবীন্দ্রনাথকে এক “হিমালয়প্রতিম ব্যক্তিত্ব” ও “গভীরভাবে প্রাসঙ্গিক ও বহুমাত্রিক সমসাময়িক দার্শনিক” হিসেবে বর্ণনা করেছেন। বত্রিশ খণ্ডে প্রকাশিত রবীন্দ্র রচনাবলী বাংলা সাহিত্যের একটি বিশেষ সম্পদ হিসেবে পরিগণিত হয়।
রবীন্দ্রনাথকে “ভারতের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি” হিসেবেও বর্ণনা করা হয়ে থাকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মবার্ষিকী “পঁচিশে বৈশাখ” ও প্রয়াণবার্ষিকী “বাইশে শ্রাবণ” আজও বাঙালি সমাজে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে পালিত হয়ে থাকে। এই উপলক্ষে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি, শান্তিনিকেতন আশ্রম ও শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে প্রচুর জনসমাগম হয়। শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথ-প্রবর্তিত ধর্মীয় ও ঋতুউৎসবগুলির মাধ্যমেও তাকে শ্রদ্ধা নিবেদনের রীতি অক্ষুণ্ণ আছে। এছাড়াও বিভিন্ন উৎসবে ও অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া বা রবীন্দ্ররচনা পাঠের রেওয়াজও দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। এগুলি ছাড়াও কবির সম্মানে আরও কতকগুলি বিশেষ ও অভিনব অনুষ্ঠান পালন করা হয়। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় রাজ্যের আরবানাতে আয়োজিত বার্ষিক “রবীন্দ্র উৎসব”, কলকাতা-শান্তিনিকেতন তীর্থ-পদযাত্রা “রবীন্দ্র পথপরিক্রমা” ইত্যাদি।
জীবদ্দশাতেই ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও পূর্ব এশিয়ায় প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ইংল্যান্ডে ডার্টিংটন হল স্কুল নামে একটি প্রগতিশীল সহশিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান স্থাপনে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন তিনি। অনেজ জাপানি সাহিত্যিককে তিনি প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে ইয়াসুনারি কাওয়াবাতার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। রবীন্দ্রনাথের গ্রন্থাবলি অনূদিত হয় ইংরেজি, ওলন্দাজ, জার্মান, স্প্যানিশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায়। চেক ভারততত্ত্ববিদ ভিনসেন্স লেনসি সহ একাধিক ইউরোপীয় ভাষায় তার গ্রন্থ অনুবাদ করেন।
ফরাসি নোবেলজয়ী সাহিত্যিক আন্দ্রে জিদ্, রাশিয়ান কবি আনা আখমাতোভা, প্রাক্তন তুর্কি প্রধানমন্ত্রী বুলেন্ত একেভিত, মার্কিন ঔপন্যাসিক জোনা গেইল সহ অনেকেই অনুপ্রেরণা লাভ করেন রবীন্দ্রনাথের রচনা থেকে। ১৯১৬-১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে দেওয়া তার ভাষণগুলি বিশেষ জনপ্রিয়তা ও প্রশংসা পায়। তবে কয়েকটি বিতর্ককে কেন্দ্র করে ১৯২০-এর দশকের শেষদিকে জাপান ও উত্তর আমেরিকায় তার জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়। কালক্রমে বাংলার বাইরে রবীন্দ্রনাথ “প্রায় অস্তমিত” হয়ে পড়েছিলেন।
চিলিয়ান সাহিত্যিক পাবলো নেরুদা ও গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল, মেক্সিকান লেখক অক্টাভিও পাজ ও স্প্যানিশ লেখক হোসে অরতেগা ওয়াই গ্যাসেৎ, থেনোবিয়া কামপ্রুবি আইমার, ও হুয়ান রামোন হিমেনেথ প্রমুখ স্প্যানিশ-ভাষী সাহিত্যিকদেরও অনুবাদের সূত্রে অনুপ্রাণিত করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯১৪ থেকে ১৯২২ সালের মধ্যে হিমেনেথ-কামপ্রুবি দম্পতি রবীন্দ্রনাথের বাইশটি বই ইংরেজি থেকে স্প্যানিশে অনুবাদ করেছিলেন। দ্য ক্রেসেন্ট মুন (শিশু ভোলানাথ) সহ রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু রচনার বিস্তারিত পর্যালোচনা ও স্প্যানিশ সংস্করণ প্রকাশও করেছিলেন তারা। উল্লেখ্য, এই সময়েই হিমেনেথ “নগ্ন কবিতা” (স্প্যানিশ: «poesía desnuda») নামে এক বিশেষ সাহিত্যশৈলীর উদ্ভাবন ঘটান।
রবীন্দ্রনাথের মূল বাংলা কবিতা পড়েননি এমন বহু পাশ্চাত্য সাহিত্যিক ও সাহিত্য সমালোচক রবীন্দ্রনাথের গুরুত্ব অস্বীকারও করেছিলেন। গ্রাহাম গ্রিন সন্দিগ্ধচিত্তে মন্তব্য করেছিলেন, “ইয়েটস সাহেব ছাড়া আর কেউই রবীন্দ্রনাথের লেখাকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেন না।” রবীন্দ্রনাথের সম্মানের কিছু পুরনো লাতিন আমেরিকান খণ্ডাংশ সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে। নিকারাগুয়া ভ্রমণের সময় সালমান রুশদি এই জাতীয় কিছু উদাহরণ দেখে অবাক হন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামাঙ্কিত স্মারক ও দ্রষ্টব্যস্থল
বাঙালি কবি, লেখক, সুরকার, দার্শনিক এবং চিত্রশিল্পী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামানুসারে নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর নামকরণ করা হয়েছে।
পুরস্কার
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্য পুরস্কার
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আন্তর্জাতিক পুরস্কার
- রবীন্দ্র পুরস্কার
- ঠাকুর রত্ন ও ঠাকুর পুরস্কার
উৎসব
- রবীন্দ্রজয়ন্তী
- ঠাকুর আন্তর্জাতিক সাহিত্য ও শিল্প উৎসব
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
- রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা, ভারত।
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মেডিক্যাল কলেজ
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ কার্ডিয়াক সায়েন্সেস, কলকাতা, ভারত
- রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, সিরাজগঞ্জ, বাংলাদেশ।
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্ববিদ্যালয়, হোজাই, আসাম, ভারত
- রবীন্দ্র মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়, কোর্টপাড়া, কুষ্টিয়া, বাংলাদেশ।
- রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়, কেরানীগঞ্জ, ঢাকা, বাংলাদেশ
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাবিদ্যালয়, ত্রিপুরা, ভারত
- রবীন্দ্র মহাবিদ্যালয়
- ঠাকুর গভর্নমেন্ট কলেজ অব এডুকেশন
- ঠাকুর ইন্টারন্যাশনাল স্কুল
- পশ্চিমবঙ্গ রবীন্দ্র মুক্ত বিদ্যালয় পরিষদ
- ঘাটাল রবীন্দ্র শতবার্ষিকী মহাবিদ্যালয়
- দমদম মতিঝিল রবীন্দ্র মহাবিদ্যালয়
- ঠাকুর বাল নিকেতন সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুল
- ঠাকুর বিদ্যানিকেতন, তালিপরম্ব
ভবন
- ঠাকুর থিয়েটার
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মেমোরিয়াল অডিটোরিয়াম, শ্রীলঙ্কা
- রবীন্দ্র পরিষদ
- রবীন্দ্রতীর্থ
- বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
- রবীন্দ্র নজরুল কলা ভবন, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ
- রবীন্দ্র লাইব্রেরি, আসাম বিশ্ববিদ্যালয়
- রবীন্দ্র ভারতী, হায়দ্রাবাদ
- রবীন্দ্র কালক্ষেত্র, ব্যাঙ্গালোর
- রবীন্দ্রসদন, কলকাতা
সেতু
- রবীন্দ্র সেতু, কলকাতা
স্থান
- রবীন্দ্র সরোবর
- ঠাকুর হিল
- টেগোর গার্ডেন মেট্রো স্টেশন
- টেগোরটাউন
- আর.টি. নগর
- ঠাকুরোভা, প্রাগ , চেক প্রজাতন্ত্র
- রেহভ ঠাকুর, তেল আবিব, ইসরাইল
জাদুঘর
- রবীন্দ্র ভারতী জাদুঘর, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি, কলকাতা
- ঠাকুর স্মৃতি জাদুঘর, শিলাইদহ কুঠিবাড়ি, কুষ্টিয়া
- রবীন্দ্র স্মৃতি জাদুঘর, শাহজাদপুর কাছারি বাড়ি, সিরাজগঞ্জ
- রবীন্দ্র ভবন জাদুঘর, শান্তিনিকেতন
- রবীন্দ্র সংগ্রহশালা, মংপু (কালিম্পংয়ের কাছে)
- পতিসর রবীন্দ্র কাছারিবাড়ি, আত্রাই, নওগাঁ
- পিঠাভোগ রবীন্দ্র স্মৃতি সংগ্রহশালা, খুলনা
- দক্ষিণডিহি রবীন্দ্র কমপ্লেক্স, খুলনা
জীব প্রজাতি
- Barapasaurus tagorei
বিনোদন
ওয়েব সিরিজ
- রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি