অষ্টাদশ শতকের বাংলা
কলিকাতা অবরোধ
উদ্দেশ্য
The Subadar had a wish for a triumph, which he thought might be easily obtained; and he was greedy of riches, with which, in the imagination of the natives, Calcutta was filled. –Mill’s History, III, 147.
বাঙ্গালার ইতিহাসে দেখিতে পাওয়া যায়,–১৭৫৬ খৃষ্টাব্দের জুন মাসে সিরাজদ্দৌলা কর্তৃক কলিকাতা অবরুদ্ধ হইয়াছিল। অবরুদ্ধ হইয়াছিল, তাহা সত্য কথা। কিন্তু অবরুদ্ধ হইয়াছিল কেন, তাহার সকল কথা এখনও ইতিহাসে স্থান লাভ করিতে পারে নাই।
যে সকল কাগজ পত্রে তাহার পরিচয় লাভের উপায় ছিল, সকলের পক্ষে তাহার সন্ধান লাভের সম্ভাবনা ছিল না। সুতরাং সেকালের ইতিহাসে অনেক অনুমানের ছড়াছড়ি হইয়াছিল। তখনও ইতিহাস ইতিহাসরূপে লিখিত হইবার জন্য ব্যগ্র হয় নাই। কারণ, তখনও ইতিহাস ইতিহাস নহে; আখ্যায়িকা। সুতরাং সুপ্রসিদ্ধ ইতিহাস-লেখক জেমস মিলও অবলীলাক্রমে লিখিয়াছেন :
সুবাদারের মনে মনে একটা বিজয়োৎসবের সখ জন্মিয়াছিল; তিনি ভাবিয়াছিলেন, তাহা সহজেই সুসম্পন্ন হইবে; তিনি বড় অর্থলোলুপ ছিলেন; আর দেশের লোকেরও বিশ্বাস ছিল যে কলিকাতা বহু ধনরত্নে পরিপূর্ণ।
কলিকাতা আক্রমণের এই উদ্দেশ্যটি মিলের ইতিহাসে স্থান লাভ করিয়া অমর হইয়া রহিয়াছে, এবং সিরাজদৌলার খামখেয়ালীর একটি প্রধান দৃষ্টান্ত বলিয়াও পরিচিত হইয়া পড়িয়াছে। সেকালের ইংরাজ-লেখকগণ সিরাজ-চরিত্র সম্বন্ধে অনেক বিস্ময়কর জনরবে আস্থা স্থাপন করিতে ইতস্ততঃ করিতেন না; সুতরাং মিলের এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত তাঁহাদিগকে বিস্ময়াবিষ্ট করিতে পারে নাই।
সিরাজদৌলার শত্রুপক্ষের অভাব ছিল না। মুতাক্ষরীণ রচয়িতা নবাব গোলাম হোসেন খাঁ তাহার মধ্যে একজন। তিনি সিরাজদ্দৌলার অনেক কুকীৰ্ত্তির উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন। কিন্তু কলিকাতা অবরোধের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে তিনিও মিলের সিদ্ধান্তের অনুরূপ অলীক সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ না করিয়া, স্পষ্টাক্ষরে লিখিয়া গিয়াছেন :
রাজমহলে সিরাজদ্দৌলার নিকট সংবাদ আসিয়াছিল যে, নওয়াজিস মহম্মদ খাঁর ভূতপূৰ্ব্ব দেওয়ান রাজা রাজবল্লভের পুত্র কৃষ্ণবল্লভকে ধরিয়া আনিবার জন্য জাহাঙ্গীরনগর-ঢাকায় যে সকল প্রহরী প্রেরিত হইয়াছিল, তাহাদিগের চেষ্টা ব্যর্থ করিয়া কৃষ্ণবল্লভ কলিকাতায় পলায়ন করিয়াছেন; এবং তথাকার প্রধান পুরুষ ড্রেক সাহেব তাঁহাকে আশ্রয় দান করিয়াছেন। এই সংবাদ শ্রবণ করিয়া সিরাজদ্দৌলা শওকতজঙ্গের বিরুদ্ধে অভিযান পরিত্যাগ করিয়া, মুরসিদাবাদে প্রত্যাগমন করেন। তথা হইতে ড্রেক সাহেবের শাসনের জন্য অনেক কড়া চিঠিপত্র লিখিবার পর, পত্ৰব্যবহার অবশেষে যুদ্ধঘোষণায় পরিণত হয়; এবং সিরাজদ্দৌলা কলিকাতা আক্রমণের জন্য সেনা-সমাবেশ করেন।
ইংরাজ ইতিহাস-লেখকগণের গ্রন্থে মুসলমান ইতিহাস লেখকের এই উক্তি এখনও যথাযোগ্য উল্লেখ প্রাপ্ত হয় নাই; কলিকাতা আক্রমণকে সিরাজদ্দৌলার খামখেয়ালীর নিদর্শনরূপে বর্ণনা করিবার প্রবৃত্তিও সম্পূর্ণরূপে পরিত্যক্ত হয় নাই। কেবল ইংরাজ দপ্তরের উপর নির্ভর করিলেও, প্রকৃত তথ্যের আভাস প্রাপ্ত হওয়া যাইতে পারিত; কলিকাতা অবরোধের প্রকৃত কারণ আবিষ্কৃত হইতে পারিত। কিন্তু তথ্যাবিষ্কার চেষ্টা অপেক্ষা কাহিনী-রচনার চেষ্টাই অধিক উৎসাহলাভ করিয়াছিল; সেকালের ইতিহাস ন্যায় বিচারের জন্য লালায়িত ছিল না। কারণ, সিরাজদৌলার নামে যাহা কিছু প্রচারিত হইত, সে কালের ইউরোপীয়গণ তাহার সত্যমিথ্যা-নির্ণয়ের প্রয়োজন স্বীকার করিতেন না।
সিরাজদ্দৌলার অজ্ঞতার ও অবজ্ঞাপূর্ণ ঔদ্ধত্যের অনেক কাহিনী ইউরোপীয় সমাজে প্রচারিত হইয়া পড়িয়াছিল। অজ্ঞতার পরিচয় দিবার জন্য কেহ লিখিয়াছিলেন;–”সিরাজদ্দৌলা মনে করিতেন যে সমগ্র ইউরোপে দশ সহস্রের অধিক অধিবাসী নাই।”২ অবজ্ঞাপূর্ণ ঔদ্ধত্যের পরিচয় দিবার জন্য কেহ লিখিয়াছিলেন, যে সিরাজদ্দৌলা স্পষ্টই বলিতেন, “ইউরোপীয়গণকে শাসন করিবার জন্য আর কিছুরই দরকার নাই; কেবল–কেবল–এক জোড়া চটি জুতা!”৩
সিরাজদ্দৌলার এরূপ অজ্ঞতা এবং এতদুর অবজ্ঞাপূর্ণ ঔদ্ধত্য বর্তমান থাকিলে, মুতক্ষরীণ-রচয়িতা তাহার উল্লেখ করিতে ত্রুটি করিতেন না। ইংরাজ কিরূপ প্রবল শত্রু হইবে, বৃদ্ধ নবাব আলিবর্দী তাহা সিরাজকে পুনঃ পুনঃ বুঝাইয়া দিয়াছিলেন। সে কথা ইংরাজেরাও লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। কলিকাতা আক্রমণের পূৰ্ব্বে সিরাজদ্দৌলা ফরাসী ও ওলন্দাজের নিকট সাহায্য চাহিয়াছিলেন। সে কথাও ইংরাজদিগের নিকট অপরিচিত ছিল না। এইরূপ আচরণ অজ্ঞতার ও অবজ্ঞাপূর্ণ ঔদ্ধত্যের সাক্ষ্যদান করিতে পারে না। অর্থলোলুপতাই যে কলিকাতা আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিল, তাহা নিতান্ত রচা-কথা বলিয়াই প্রতিভাত হয়। প্রতিদ্বন্দ্বী শওকতজঙ্গের বিরুদ্ধে সৈন্যসামন্তসহ রণযাত্রা, রাজমহল হইতে সহসা প্রত্যাবর্তন, ও কলিকাতা আক্রমণের আয়োজন স্পষ্টই বুঝাইয়া দেয়, কলিকাতা আক্রমণের প্রকৃত উদ্দেশ্য যাহাই হউক, তাহা অর্থলোলুপতা বলিয়া স্বীকৃত হইতে পারে না।
কিছু দিনের জন্য ইংরাজ কলিকাতা হইতে তাড়িত হইয়াছিলেন;–কিছু দিনের জন্য কলিকাতার নাম পৰ্য্যন্ত লুপ্ত হইয়া, ‘আলিনগর” নাম প্রচলিত হইয়াছিল, কিছু দিনের জন্য সিরাজ-সেনাপতি মহারাজ মাণিকচাঁদ কলিকাতার শাসনকৰ্ত্তা হইয়াছিলেন। কিন্তু কিছু দিন মাত্র। তাহার পরই আবার ইংরাজ কলিকাতায় প্রত্যাবর্তন করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। তখন তাঁহাদের কোথায় কত ধনরত্ন লুণ্ঠিত হইয়াছে, তাহার তদন্ত করিয়া, তাঁহারাই লিখিয়া গিয়াছেন, কোম্পানীর মালগুদামে যাহা যেমন ছিল, তাহার প্রায় সমস্তই সেইরূপই সুরক্ষিত অবস্থায় ছিল,–মালপত্রের বিশেষ কোনও ক্ষতি হয় নাই। সিরাজদ্দৌলার অর্থলোলুপতা থাকিলে, তাহা নবাবী অর্থলোলুপতা হইত। সেকালের কলিকাতার পক্ষে সে অর্থলোলুপতা চরিতার্থ করিবার উপযুক্ত প্রলোভন উপস্থিত করা সম্ভব হইত না। সুতরাং জেমস মিল যে আনুমানিক কারণের উল্লেখ করিয়া কলিকাতা আক্রমণের উদ্দেশ্য অভিব্যক্ত করিয়া গিয়াছেন, তাহাকে প্রকৃত উদ্দেশ্য বলিয়া স্বীকার করা কঠিন।
তবে? তাহাই ত ইতিহাসের সমস্যা। ইংলণ্ডের পার্লেমেন্ট-মহাসভা এক অনুসন্ধান-সমিতি বসাইয়া, তাহার তথ্যানুসন্ধান করাইয়াছিলেন। যে সকল কাগজপত্রে প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যক্ত হইবার সম্ভাবনা, তাহার মধ্যে সিরাজদ্দৌলার পত্রই প্রধান স্থান অধিকার করিবার উপযুক্ত। সে সকল পত্র এখনও বর্তমান আছে; এখন তাহার অনুবাদও প্রকাশিত হইয়াছে। কেবল এখনও তাহা ইতিহাসে উল্লিখিত হয় নাই। যখন উল্লিখিত হইবে, তখন প্রচলিত ইতিহাসের অনেক কথাই রচা-কথা হইয়া দাঁড়াইবে।
“ইংরাজ তাড়াইব। আমার রাজ্য হইতে ইংরাজ তাড়াইবার তিনটি যুক্তিযুক্ত উদ্দেশ্য আছে। (১) প্রথম কারণ এই যে,–উহারা সুদৃঢ় দুর্গ নির্মাণ করিয়াছে; সুবৃহৎ পরিখা খনন করিয়াছে; তাহা বাদশাহী সাম্রাজ্যের চির-প্রচলিত আইন কানুনের সুপ্রতিষ্ঠিত বিধানাবলীর বিপরীত কাৰ্য। (২) দ্বিতীয় কারণ,–কোম্পানী বিনা শুল্কে বাণিজ্য করিবার জন্য ‘দস্তক” নামক যে পরোয়ানা পাইবার অধিকারী, উহারা তাহার অপব্যবহার করিয়া, অনধিকারীকে ‘দস্তকের’ ফললাভ করিতে দিয়া বাদশাহী কর্মচারী কৃতকার্য্যের নিকাশ দিবার দায়িত্ব হইতে অব্যাহতি লাভের মতলব করে, উহারা তাহাদিগকে নিজ অধিকার মধ্যে আশ্রয় দিয়া, ন্যায় বিচারের বাধা প্রদান করিতেছে।”৬
১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১লা জুন তারিখে রাজধানী মুকসুদাবাদ হইতে আরমানী বণিক খোঁজা বাজিদের নামে সিরাজদৌল্লা উল্লিখিত মৰ্ম্মে পত্র লিখিয়া, তাঁহার কলিকাতা-আক্রমণের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করিয়াছিলেন,–যত স্পষ্ট ভাষায় তাহা ব্যক্ত করা সম্ভব, তাহাই করিয়াছিলেন। নবাবের পক্ষে এত স্পষ্ট করিয়া উদ্দেশ্য ব্যক্ত করিবার প্রয়োজন ছিল না। খামখেয়ালী নবাবের পক্ষে কোন কথাই ব্যক্ত করিবার প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু এই পত্রে খামখেয়ালীর পরিচয় নাই,–নবাবী আত্মাভিমানেরও পরিচয় নাই। অজ্ঞতার পরিচয় নাই;–অবজ্ঞাপূর্ণ উদ্ধত্যেরও পরিচয় নাই। যাহা আছে, তাহা কৰ্ত্তব্যনিষ্ঠ দৃঢ়সংকল্প ন্যায়পরায়ণ শাসনকর্তার পরিচয় বলিয়াই উল্লিখিত হইবার যোগ্য। কেবল উদ্দেশ্যগুলি মিথ্যা হইলে,– অন্য কথা। এই পত্রে আরও লিখিত হইয়াছিল :
এই সকল কারণে, ইহাদিগকে তাড়াইয়া দিবারই প্রয়োজন উপস্থিত হইয়াছে। তবে যদি ইহারা এই সকল অন্যায় আচরণ দূর করিবার জন্য অস্বীকার করে, এবং নবাব জাফর খাঁর (মুরসিদকুলী খাঁর) আমলে অন্যান্য বণিক যে নিয়মে বাণিজ্য করিত, সেই নিয়মে বাণিজ্য করিতে সম্মত হয়, ক্ষমা করিব, দেশেও থাকিতে দিব। অন্যথা শীঘ্রই ইহাদিগকে তাড়াইয়া দিব।
ইহাতে আছে–শাসনের সঙ্গে ক্ষমার কথা, ন্যায়পরায়ণ নরপতির ন্যায়ানুমোদিত প্রশংসার কথা। এই পত্র খোঁজা বাজিদের নিকট প্রেরিত হইলেও, ইংরাজকে জানাইবার জন্যই প্রেরিত হইয়াছিল। ইহা এখন ইংরাজ-দপ্তর হইতে বাহির হইয়া জানাইয়া দিয়াছে,–ইংরাজেরা ইহা জানিতেন, পত্রখানিও প্রাপ্ত হইয়াছিলেন।
এই পত্র মুন্সীখানায় লিখিত হইয়া, সিরাজদ্দৌলার নিকট দস্তখতের জন্য প্রেরিত হইয়াছিল। অনেকে বলেন,–সিরাজদ্দৌলা ভাল লেখাপড়া জানিতেন না, –তাঁহার নাম দিয়া যে সকল পত্র প্রেরিত হইত, তাহাতে তাঁহার মুন্সীখানার বাহাদুরী আছে, তাঁহার বাহাদুরী থাকিতে পারে না। কিন্তু অনেক পত্রের ন্যায় এই পত্রের শেষেও সিরাজদ্দৌলা (দস্তখত করিবার সময়ে) কয়েকটি কথা নিজহস্তে লিখিয়া দিয়াছিলেন; যথা :
ইংরাজদিগকে পুঙ্ক্ষানুপুঙক্ষরূপে আমার এই সঙ্কল্পের কথা জানাইয়া দিবা। তাহারা যদি এই সকল সৰ্ত্ত পালন করিতে ইচ্ছা করে, তবে তাহারা থাকিতে পারে। অন্যথা এ দেশ হইতে তাহারা তাড়িত হইবে।
ইহাই এতদ্বিষয়ক প্রথম পত্র নহে। ১৭৫৬ খৃষ্টাব্দের ২৮ শে মে তারিখে রাজমহলের শিবির হইতে সিরাজদ্দৌলা আর একখানি পত্রে খোঁজা বাজিদকে জানাইয়া ছিলেন :
ইংরাজেরা আমার রাজ্যমধ্যে যে সুদৃঢ় দুর্গ নির্মাণ করিয়াছে, তাহা ভূমিসাৎ করা আমার সংকল্প হইয়া উঠিয়াছে। এই সংকল্প হইতে নিরস্ত রাখিবার উপযুক্ত আর কোনও কাৰ্য এক্ষণে উপস্থিত না থাকায় আমি এই অবসরটি সেই কাৰ্যেই নিয়োগ করিবার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হইয়াছি। এই কারণে, আমি রাজমহল হইতে প্রত্যাবর্তন করিতেছি। আমি যথাসাধ্য সত্বরতার সঙ্গে রণযাত্রা করিয়া যত শীঘ্র সম্ভব কলিকাতার সম্মুখে উপনীত হইব। যদি ইংরাজগণ আমার রাজ্যে বাস করিতে ইচ্ছা করে, তবে তাহাদিগকে অবশ্যই কয়েকটি কাৰ্য্য করিতে হইবে; –তাহাদের দুর্গ ভূমিসাৎ করিতে হইবে,–পরিখা বুজাইয়া ফেলিতে হইবে, নবাব জাফর খাঁর আমলে যে নিয়মে বাণিজ্য করিত, সেই নিয়মে বাণিজ্য করিতে হইবে। অন্যথা আমি যে রাজ্যের সুবাদার, তাহার সীমানা হইতে উহাদিগকে একেবারে তাড়াইয়া দিব। ইহা ঈশ্বরের ও পয়গম্বরগণের নামে শপথ করিয়া জানাইয়া রাখিতেছি।
সিরাজদ্দৌলার এই সকল চিঠিপত্র প্রকাশিত হইবার পর, পুরাতন কাহিনীর সংস্কার-সাধনের প্রয়োজন উপস্থিত হইলেও, শ্রীযুক্ত এস, সি, হিল তাহাকে একেবারে প্রত্যাখ্যান করিতে সম্মত হন নাই। তিনি বরং সিরাজদ্দৌলার পত্রোক্ত এই সকল কারণকে তাঁহার “অজুহাত” বলিয়া ব্যাখ্যা করিয়া,১০ যথার্থ উদ্দেশ্য
ব্যক্ত করিবার জন্য লিখিয়াছেন, ‘তাহা সিরাজদ্দৌলার খামখেয়ালী এবং অর্থ লোলুপতা।”১১ইহার কারণ উল্লেখ করিতে গিয়া, হিল সাহেব লিখিয়াছেন :
১ ইংরাজগণ সিরাজদ্দৌলাকে বাল্যকালে ইংরাজ-কুটীতে প্রবেশ করিতে দিতেন, কারণ তিনি বড় দৌরাত্ম্য করিতেন,–টেবিল চেয়ার ভাঙ্গিতেন, অথবা ইচ্ছামত উঠাইয়া লইয়া যাইতেন;
২ কলিকাতা ধনরত্নে পূর্ণ হইয়া উঠিয়াছিল, সেখানে ইংরাজগণ ধুমধামের সঙ্গে বিলাস ভোগ করিতেন, লোকেও তাহার কথা অতিরঞ্জিত করিয়া প্রচারিত করিত;
৩ সিংহাসনে আরূঢ় হইবার পূর্বে ফরাসীগণ সিরাজদ্দৌলাকে নজরানাদি দিয়া সম্বৰ্ধনা করিয়াছিলেন,–ইংরাজগণ তাহা করেন নাই।
শ্রীযুক্ত হিল সাহেব এই কৈফিয়তের অবতারণা করিবার সময়ে একটি কথা একেবারেই ভুলিয়া গিয়াছেন। ১৭৫৪ খ্রিস্টাব্দের ২০ ডিসেম্বর তারিখের কনসলটেসনে দেখা যায়,–সিংহাসনারূঢ় হইবার পূর্বে সিরাজদ্দৌলা ইংরাজদিগের নিকট উপহার উপটৌকন পাইয়াছিলেন;–পান নাই, ইহা সত্য কথা নহে।১২ একে হিল সাহেবের কৈফিয়ৎ সিরাজদ্দৌলার পত্রগুলির বিপরীত, তাহাতে আবার কৈফিয়ৎটি একটি অসত্য কথার উপর প্রতিষ্ঠিত! সুতরাং এই কৈফিয়ৎকে মানিয়া লইয়া পত্রগুলিকে অগ্রাহ্য করা কঠিন।
সে যাহা হউক, পত্রোক্ত অভিযোগগুলি সত্য হইলে, হিল সাহেবের কৈফিয়ৎ অপেক্ষা সমসাময়িক পত্রের উপরেই ভবিষ্যতের ইতিহাসলেখকগণকে অধিক নির্ভর করিতে হইবে। কৌতুকের বিষয় এই যে, পত্রোক্ত সকল অভিযোগকেই সত্য অভিযোগ বলিয়া স্বয়ং হিল সাহেবকেও প্রকারান্তরে স্বীকার করিতে হইয়াছে।
১৭৫৪ খৃষ্টাব্দ হইতে কর্ণেল স্পিক কলিকাতার উত্তর প্রান্তে একটি দুর্গ-প্রাকার নির্মাণের নক্সা প্রস্তুত করিয়া রাখিয়াছিলেন। নবাবের অনুমতি না লইয়াই, তাহা নির্মিত হইয়াছিল। মহারাষ্ট্র খাতেরও সংস্কারকাৰ্য্য আরব্ধ হইয়াছিল।যখন এই সকল কাৰ্য্য চলিতেছিল, তখন নবাব আলিবর্দী অন্তিম শয্যায় শয্যাগত, উত্থানশক্তি রহিত।
কোম্পানীর দোহাই দিয়া বিনা শুল্কে বাণিজ্য করিবার কথাও হিল সাহেবকে মানিয়া লইতে হইয়াছে। ইহাতে যে শুল্কের আয় ক্ষতিগ্রস্ত হইত, তাহার আলোচনা না করিলেও চলে।১৪
নবাবের কর্মচারিগণকে কলিকাতায় আশ্রয় দিয়া, ন্যায় বিচারে বাধা প্রদান করা হইত কিনা, সে বিষয়টির আলোচনা করিতে গিয়া, হিল সাহেব তাহাকে একটি “কঠিন এবং দুর্বোধ” কথা বলিয়াও, প্রকারান্তরে স্বীকার করিয়াছেন যে– কৃষ্ণদাসকে কলিকাতায় আশ্রয় দেওয়া হইয়াছিল। দেশের লোকে বলিত–তাহাই কলিকাতা আক্রমণের একমাত্র উদ্দেশ্য। ঢাকার ইংরাজ গোমস্তা ১৭৫৭ খৃষ্টাব্দের ২২ মার্চের একখানি চিঠিতে তাহার উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন।১৫
বাঙ্গালার বাণিজ্য বড় লাভজনক বাণিজ্য বলিয়া বিখ্যাত হইয়া উঠিয়াছিল। সে বাণিজ্যে কোম্পানী বাহাদুরের লাভ তেমন অধিক না হইলেও, কোম্পানী বাহাদুরের ছোট বড় সকল কর্মচারীর লাভের অঙ্ক বড় অধিক হইয়া উঠিয়াছিল। তাঁহারা কোম্পানী বাহাদুরের বাণিজ্যের শ্রীবৃদ্ধি করিতে আসিয়া, মনিবের আদেশ লঙঘন করিয়া, গোপনে গোপনে সকলেই পৃথক ভাবে কিছু কিছু বাণিজ্য করিতেন,–দেশের লোকের সাহায্যে, নবাব-দরবারের পাত্রমিত্রের গুপ্ত সহকারিতায়, তাঁহাদের এই বাণিজ্যে বিলক্ষণ অর্থাগম হইত। তাহার কারণ এই যে,–কোম্পানী বাহাদুরের পক্ষে বিনা শুল্কে বাণিজ্য করিবার যে বাদশাহী অধিকারপত্র প্রচলিত ছিল, তাহার দোহাই দিয়া, কোম্পানী বাহাদুরের কর্মচারীগণ নিজের মাল কোম্পানী বাহাদুরের মাল বলিয়া চালান দিয়া, বিনা শুল্কে বাণিজ্য চালাইতে অভ্যস্ত হইয়া উঠিয়াছিলেন। যে সকল প্রধান প্রধান ইংরাজ কর্মচারী মান্দ্রাজে ছিলেন, বঙ্গদেশে একবারও পদার্পণ করেন নাই, তাঁহারাও তাঁহাদের সহকারিগণের সহায়তায় বাঙ্গালা দেশের এই গুপ্ত বাণিজ্যে যযাগদান করিয়া অর্থোপার্জন করিতেন। ইহাতে রাজকোষের শুল্কের ক্ষতি হইত। সে কথা অস্বীকার করিবার উপায় ছিল না। কিন্তু পেটের দায় বড় দায়,–কোম্পানী বাহাদুর যে যৎসামান্য বেতনে কর্মচারী নিয়োগ করিতেন, তাহাতে কাহারও কুলাইবার সম্ভাবনা ছিল না।১৬ সুতরাং জানিয়া শুনিয়াও–পেটের দায়ে–ইংরাজ কর্মচারিগণ গুপ্ত বাণিজ্যে অর্থোপার্জন করিতেন। ধরা পড়িলে, অস্বীকার করা ভিন্ন অন্য উপায় ছিল না। এই ভাবে গুপ্ত বাণিজ্য চালাইবার জন্য ‘দস্তক’ নামক পরোয়ানা জাল করা ভিন্ন অন্য উপায় ছিল না; কোম্পানী বাহাদুরের মাল বলিয়া নিজের মাল চালাইবার জন্য জুয়াচুরী করা ভিন্ন অন্য উপায় ছিল না। সুতরাং জাল জুয়াচুরী-মিথ্যাকথা এরূপ গুপ্ত বাণিজ্যের নিত্য সহচর হইয়া উঠিয়াছিল। সিরাজদ্দৌলা ইহার গতিরোধ করিবার জন্য সংকল্প করিয়াছিলেন।
কলিকাতা অবরোধের কারণ যাহাই হউক,–সে কারণ যতই সত্য হউক,– কলিকাতা অবরোধই সিরাজদ্দৌলার কাল হইয়াছিল। সেকালের প্রকৃত ইতিহাস বুঝিতে হইলে, কলিকাতা অবরোধের ইতিহাস সংকলন আবশ্যক;–অন্ধকূপ কাহিনীর রহস্যভেদ করিতে হইলেও, কলিকাতা অবরোধের ইতিহাস সংকলন আবশ্যক। গভর্ণমেন্টের কৃপায়, ইংরাজ-দপ্তরের কাগজপত্র প্রকাশিত হওয়ায়, এক্ষণে নিরপেক্ষভাবে, বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে, সত্যানুসন্ধানের জন্য, সে ইতিহাস সংকলন করিবার পক্ষে পূৰ্ব্বাপেক্ষা অনেক সুযোগ উপস্থিত হইয়াছে।
মানসী ও মর্মবাণী, বৈশাখ, ১৩২২
তথ্যসূত্র
১ News came to Seradj-ed-dowlah at Rajmahal, that Kishunbohlub, son to Raja Rahdjbullub, heretofore Divan to Nevazish mahmedqhan, had given the slip to the guards that had been sent to Djehangirnngur Dacca to seize him, and had made his escape to Calcutta, where he was protected by Mr. Drake, the chief man of that town. On hearing this, Seradj-ed-dowlah gave up his design against Shaocat-djung, and returned to Murshid-abad; where, after writing many sharp letters and reprimands to Mr. Drake, the meesages and lierary correspondence ended in a declared war; and Seradj-ed-dowlah assembled an army against Calcutta-Cambray’s Reprint of Mustapha’s Mutakherin, Vol. 11. p. 188.
২ Scrafton’s Reflections, p. 58.
৩ Sirajuddowla had the most extravagant contempt for Europeans; “a pair of slippers,” he said, “is all that is needed to govern them.”– M. Law quoted in Hill’s Bengal in 1756-57. Vol. III. p. 176.
8 The hatmen would possess themselves of all the shores of Hindia — Cambray’s Reprint of Mustapha’s Mutakherin, Vol. 11, p. 163.
৫ Hill’s Bengal in 1756-57, Vol. I, p. 5.
৬ I have three substantial motives for exterpatnig the Engligh out of my country; one that they have built strong fortifications and dug a large ditch in the king’s dominions, contrary to the cstablished laws of the country. The second is, that they have abused the privilege of their DUSTUCKS by granting them to such as were no ways entitled to them, from which practices the king has suffered greatly in the revenue of his Coustoms. The third motive is, that they give protection to such of the King’s subjects as have by their behaviour, in the employs they were entrusted with, made themselves liable to be called to an account, and instead of givng them up on demand they allow such persons to shelter themselves within their bounds from the hands of justice–Hill’s Bengal in 1756-57, Vol. I, p. 4.
৭ For these reasons it is become requisite to drive them out. If they will promise to remove the foregoing; ‘complaints of their conduct, and will agree to trade upon the same terms as other merchants did in the times of the Nabab Jaffier Cawn, I will pardon their fault : and pemit their residence here : otherwise I will shortly expel that nation–Ibid.
৮ ইংরাজ দপ্তরে এই পত্রের যে ইংরাজী অনুবাদ আছে, তাহাতে এই পুনশ্চ অংশ সম্বন্ধে লিখিত আছে,–The following paragraph was wrote in the Nabob’s own hand at the bottom of the letter.
৯ It has been my design to level the English fortifications raised within my jurisdiction on account of their great strength. As I have nothing at present to divert me from the execution of that resolution, I am determined to make use of this opportunity; for which reason I am returning from Rajhmaul, and shall use the utmost expedition in my march that I may arrive before Calcutta as soon as possible. If the English are contented to remain in my country, they must submit to have their fort raised, their ditch filled up, and trade upon the same terms they did in the time of the Nabab Jaffier Cawn; otherwise I will expel them entirely out of the provinces of which I am SUBAH, which I swear to do before God and our Prophets.– Hill’s Bengal. Vol. I, p. 3.
১০ Lastly we come to the pretexts put forward by the Nawab for attacking the English-Hill’s Introduction to the Bengal in 1756-57, p. Liii.
১১ As to the particular reasons the most important were his vanity and his avarice.
১২ সিরাজদ্দৌলা, ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।
১৩ So As regards the forifications, it is quite clear that the British had exceeded their rights–Hill’s Bengal in 1756-57, Introduction, p. liv.
১৪ As regards the abuse of trade privileges, it must be confessed that the British had used the destucks or passes for goods free of customs in a way never contemplated by the FARMAN-Ditto. p. IV.
১৫ At the time of the seige of Calcutta the natives of Bengal generally asserted that the protection of Krisna Das was the sole cause of the war. –Hill’s Bengal in 1756, Vol. iii, p. 339.
১৬ ১৭৫৬ খৃষ্টাব্দে কোম্পানীর কর্মচারীগণের কাহার কত মাসিক বেতন ছিল, তাহার একটি তালিকা (Hili’s Bengal in 1758-57, Vol. [I] pp 411-413) প্রকাশিত হইয়াছে। তাহাতে দেখা যায়,–কেবল গভর্ণর ড্রেকের বেতন ছিল দুই শত টাকা, হলওয়েল প্রভৃতি কৌন্সিলের মেম্বরগণের প্রত্যেকের বেতন ছিল চল্লিশ টাকা। প্রবীণ কুঠিয়ালগণের বেতন ছিল চল্লিশ টাকা। নবীনগণের বেতন ছিল ত্রিশ টাকা; ওরারেণ হেষ্টিংস প্রভৃতি ফ্যাকটরগণের প্রত্যেকের বেতন ছিল পনর টাকা, আর রাইটারগণের প্রত্যেকর বেতন ছিল পাঁচ টাকা! সকলেই কোম্পানী বাদাদুরের নিকট বাড়ী ও খোরাকী পাইতেন। রাইটারগণ ১৮ হইতে ২৪ বৎসর বয়স্ক ছিলেন; ফ্যাক্টরগণ ২২ হইতে ২৬ বৎসর বয়স্ক ছিলেন; প্রবীণ কুঠিয়ালগণ ২৬ হইতে ৩৩ বর্ষ বয়স্ক ছিলেন, আর স্বয়ং গভর্ণরের বয়ঃক্রম ছিল ৩৪ বৎসর। তিনি ১৫ বৎসর বয়সে ভারতবর্ষে আসিয়াছিলেন। কেবল হলওয়েলই সৰ্ব্বাপেক্ষা প্রবীণ ছিলেন, তাঁহার বয়ঃক্রম ৪৫ বৎসর হইয়াছিল। এই সকল অল্প শিক্ষিত অপরিণত বয়স্ক অত্যল্প-বেতনপ্রাপ্ত কোম্পানীর কর্মচারিগণ যাহা করিবার তাহাই করিতেন। তাঁহাদিগের বাল্যশিক্ষার অভাব, দূরদেশের অসংযত জীবনযাত্রা ও যৎসামান্য বেতন, তাঁহাদিগকে চরিত্ররক্ষায় সমর্থ করিতে পারিত, এরূপ সম্ভাবনা ছিল না। তাঁহারা স্বকাৰ্য্য-সমর্থনের জন্য যাহা লিখিয়া গিয়াছেন, তাহাই ইতিহাসের উপাদান! তাহা কতদূর নিঃসংশয়ে নির্ভরযোগ্য ইতিহাস এখনও তাহার বিচার করিতে প্রবৃত্ত হয় নাই।
অন্ধকুপহত্যা
সে অনেক দিনের কথা,–প্রায় কুড়ি বৎসরের কথা। তখন “সাধনা” বন্ধ হইয়া গেলে, সিরাজদ্দৌলা-শীর্ষক প্রবন্ধগুলি মাসে মাসে ‘ভারতী’তে প্রকাশিত হইত। যে মাসে অন্ধকূপহত্যা-কাহিনীর সমলোচনা প্রকাশিত হইবার কথা, সেই মাসের লেখাটি ডাকঘরের গোলযোগে হারাইয়া যায়। নকল ছিল না; “ভারতী” প্রকাশিত হইবারও বড় বিলম্ব ছিল না। অগত্যা সে লেখাটিকে আবার তাড়াতাড়ি লিখিয়া পাঠাইতে হইয়াছিল। পুস্তকাকারে প্রকাশিত “সিরাজদ্দৌলায়” তাহাই মুদ্রিত হইয়াছে।
তখন অন্ধকূপহত্যা-কাহিনী সম্বন্ধে তিনটি কথা বিশেষভাবে আলোচনা করিয়াছিলাম। (১) হলওয়েলের কাহিনীই অন্ধকূপহত্যার প্রধান কাহিনী, সে কাহিনী বিশ্বাস করা কঠিন। (২) মিথ্যা হইলে কথাই নাই,–সত্য হইলেও, তাহার জন্য সিরাজদ্দৌলাকে অপরাধী করা যায় না। (৩) উত্তরকালে অন্ধকূপহত্যার প্রতিহিংসাসাধনের জন্য পলাসীর যুদ্ধ সংঘটিত হইয়াছিল বলিয়া ইতিহাসে যে কাহিনী স্থানলাভ করিয়াছে, সমসাময়িক কাগজপত্রে তাহার উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায় না।
যখন ‘ভারতী’তে এই লেখা বাহির হয়, তখন অন্ধকূপহত্যার স্মৃতিস্তম্ভটি বৰ্ত্তমান ছিল না;–১৮২১ খৃষ্টাব্দে তাহা অপসারিত হইয়াছিল। সুতরাং তাহার কথাও লিখিতে হইয়াছিল।
তাহার পর অনেক বৎসর চলিয়া গিয়াছে, অনেক তথ্যানুসন্ধানের সূত্রপাত হইয়াছে,–গভর্ণমেন্টের উদ্যোগে ও ব্যায় বাহুল্যে তিনখণ্ড বৃহৎ পুস্তকে সমসাময়িক কাগজপত্র মুদ্রিত ও প্রকাশিত হইয়াছে, এবং লর্ড কর্জনের বদান্যতায় অন্ধকূপহত্যার একটি স্মৃতিস্তম্ভও নির্মিত হইয়াছে।
এত কালের পর আবার অন্ধকূপহত্যা কাহিনীর সত্যমিথ্যার আলোচনার সূত্রপাত হইয়াছে। এবার শ্রীযুক্ত জে, এইচ, লিটল সাহেব ইংরাজীতে একটি প্রবন্ধ লিখিয়া জানাইয়া দিয়াছেন,–’অন্ধকূপহত্যা-কাহিনী একটা প্রকাণ্ড ধাপ্পাবাজী!”
ইহাতে আবার হৈ চৈ পড়িয়া গিয়াছে। সংবাদপত্রে অনেক সমালোচনা ও প্রতিবাদ প্রকাশিত হইতেছে, এবং কলিকাতা ঐতিহাসিক সমিতি একটি বিচার সভায় ইহার আলোচনার ব্যবস্থা করিয়া লিটল সাহেবকে ও তৎসঙ্গে আমাকেও আমন্ত্রণ করিয়াছেন। এই বিচারসভার ব্যবস্থা নূতন যুগের নূতন ব্যবস্থা, ঐতিহাসিক তথ্যানুসন্ধানের সরল পথ অবলম্বন করিবার লালসা-বিজ্ঞাপক প্রশংসনীয় ব্যবস্থা।
সিরাজদ্দৌলা শীর্ষক প্রবন্ধে “ভারতী”তে যাহা প্রকাশিত হইয়াছিল, তাহার মধ্যে দুইটি কথা সৰ্ব্ববাদিসম্মতরূপে স্বীকৃত হইয়া গিয়াছে। সিরাজদ্দৌলার অপরাধ ছিল না,–প্রতিহিংসা-সাধনের জন্যই পলাসীর যুদ্ধ সংঘটিত হয় নাই,–এই দুইটি কথা যে সৰ্ব্ববাদিসম্মতরূপে স্বীকৃত হইয়াছে, তাহার প্রধান প্রমাণ নূতন স্মৃতিস্তম্ভ। পুরাতন স্মৃতিস্তম্ভে যে ফলক-লিপি সংযুক্ত ছিল, তাহাতে এই দুইটি কথা উল্লিখিত ছিল। নূতন স্মৃতিস্তম্ভে যে ফলক-লিপি সংযুক্ত হইয়াছে, তাহাতে এই দুইটি কথা স্থান লাভ করিতে পারে নাই।
ইহা ইতিহাসের পক্ষে অল্প লাভ নয়।
আরও একটি লাভের কথা এই যে, হলওয়েল পুরাতন স্মৃতিস্তম্ভে যাঁহাদিগের অন্ধকূপে নিহত হইবার কথা ক্ষোদিত করাইয়া গিয়াছিলেন, নূতন স্মৃতিস্তম্ভ রচনার সময়ে তথ্যানুসন্ধানে জানা গিয়াছে,–তাঁহাদের মধ্যে কেহ কেহ দুর্গজয়ের পূৰ্বে বা সমসময়ে দুর্গরক্ষাৰ্থ প্রাণত্যাগ করেন, তাঁহাদের পক্ষে অন্ধকূপে নিক্ষিপ্ত হইবার সময় ছিল না! সুতরাং হলওয়েলের মৃতের তালিকা যে সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাসযোগ্য নহে, সে কথাও প্রকারান্তরে স্বীকৃত হইয়াছে। হলওয়েল ঢাকার হত্যা-কাহিনী রচনা করিয়া ছিলেন,–তাহা যে সর্বৈব মিথ্যা, সমসাময়িক ইংরাজ দরবার তদন্ত করিয়া, সরকারী রিপোর্টে সে কথা লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। সুতরং এখন যাঁহারা অন্ধকূপহত্যা কাহিনীকে সত্য বলিয়া বিশ্বাস করিতেছেন, তাঁহারাও একবাক্যে বলিতেছেন,–”হলওয়েলের সকল কথা সত্য নহে।”
ঐতিহাসিক তথ্যানুসন্ধান এইরূপে ক্রমে ক্রমে অন্ধকূপ হত্যা কাহিনীর বিরোধী নানা কথা স্বীকার করিবার পর, শ্রীযুক্ত লিটল সাহেব তাহাকে শেষ ধাক্কা দিয়া প্রবন্ধ রচনা করিয়াছেন। তাঁহার প্রবন্ধ বঙ্গ-ভাষায় অনূদিত হইবার যোগ্য হইলেও কেহ এ পর্যন্ত তাহার আলোচনামাত্রও করেন নাই।
শ্ৰীযুক্ত লিটল একটি নূতন কথা শুনাইয়াছেন। তিনি আদ্যন্ত সমস্ত ঘটনার আলোচনা করিয়া বলিয়াছেন,–যে-সকল ইংরাজ বীরপুরুষ দুর্গরহ্মার্থ প্রাণ বিসৰ্জন করিয়া, ইংরাজের পরাজয়কেও বিজয়-গৌরবে গৌরবান্বিত করিয়া গিয়াছেন, ইংরাজ লেখকগণ অন্ধকূপহত্যা-কাহিনী বিশ্বাস করিতে গিয়া, তাঁহাদিগের পুণ্য স্মৃতিকে অপমানিত করিতেছেন! ইহা অনুমান মাত্র হইলেও, ইহার অনুকূলে যে সকল কথা বলা যাইতে পারে, শ্রীযুক্ত লিটল তাহার উল্লেখ করিয়া, বিষয়টির পুনরালোচনার পথ উন্মুক্ত করিয়া দিয়াছেন। এতদিনের পর ইতিহাস ইংরাজ বীরপুরুষগণের আত্মবিসর্জনের মহিমা-কীৰ্ত্তনের জন্য ব্যগ্র হইয়া উঠিয়াছে।
এই ইংরাজ-লেখক অধুনা-প্রকাশিত সমস্ত কাগজপত্রের সহায়তায় যেরূপ নিপুণতার সঙ্গে বিষয়টির আলোচনা করিয়াছেন, তাহা মুক্তকণ্ঠে প্রশংসিত হইবার যোগ্য। হলওয়েলের করুণ কাহিনীকেই প্রধান অবলম্বন করিয়া, এই লেখক প্রচুর সমালোচনা কৌশলে দেখাইয়া দিয়াছেন,–সে কাহিনী লৌকিক কাহিনী হইতে পারে না,–তাহা যে নিতান্ত রচা-কথা, কাহিনীর মধ্যেই তাহার অনেক প্রমাণ প্রচ্ছন্ন হইয়া রহিয়াছে। হলওয়েলের রচনাভঙ্গী ভুক্তভোগীর অকৈতব রচনাভঙ্গী নহে,–তাহা আখ্যায়িকা-লেখকের সুকৌশল-বিন্যস্ত কৃত্রিম রচনাভঙ্গী। তাহার সাহায্যে কারাকক্ষের যে-সকল বর্ণনা লিখিত হইয়াছে, তাহাও অন্ধকার রজনীর যন্ত্রণাপূর্ণ কারা-কক্ষের বন্দীগণের নয়ন-গোচর হইবার সম্ভাবনা ছিল না!
অধুনা যে-সকল কাগজপত্র প্রকাশিত হইয়াছে তাহার সাহায্যে দেখিতে পাওয়া গিয়াছে,–অনেক ইংরাজ দুর্গ-জয় কালে বীরের ন্যায় দেহ বিসর্জন করিয়াছিলেন। ইহাদের মৃত্যু-কাহিনী দুর্গবাসী অন্যান্য ইংরাজ সহযোগিগণ বিলাতে লিখিয়া পাঠাইয়াছিলেন। যাঁহারা এইরূপে দুর্গরহ্মার্থ প্রাণ বিসর্জন করেন, তাঁহাদের নামও অন্ধকূপে নিহত ব্যক্তিগণের তালিকাভুক্ত করিয়া, হলওয়েল কাহিনী রচনা করিয়াছিলেন। এই তথ্য এত দিন অপ্রকাশিত ছিল; ইহা এখন হলওয়েলের কাহিনীকে আরও সংশয়পূর্ণ করিয়া তুলিয়াছে।
হত্যা-কাহিনী ধীরে ধীরে গঠিত হইয়া উঠিয়াছিল। কি উদ্দশ্যে হলওয়েল এই কাহিনী-রচনায় ব্যাপৃত হইয়াছিলেন, কি উদ্দেশ্যে এই কাহিনীর প্রতিবাদ করিবার জন্য সেকালের কেহ কোনরূপ চেষ্টা করেন নাই, শ্ৰীযুক্ত লিটল তৎসম্বন্ধে ষ্টেটসম্যান পত্রে এক সুদীর্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশিত করিয়াছেন।
অন্ধকূপহত্যা-কাহিনী ইউরোপীয়গণের মধ্যে প্রচারিত হইলেও, দেশের লোকে তাহার বিন্দুবিসর্গ জানিত না। অন্য স্থানের লোকের কথা দূরে থাকুক, খাস কলিকাতার লোকেরাও তাহা জানিত না চন্দননগরের ফরাসী ও হুগলীর ওলন্দাজ যাহা জানিয়াছিলেন, তাহাও স্বাধীনভাবে জানিতে পারেন নাই,–”হলওয়েল কোম্পানীর” নিকট হইতেই তাঁহারা ইহার কথা অবগত হইয়াছিলেন। সুতরাং তাঁহাদের কাগজপত্রে ইহার যাহা কিছু উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়, তাহা জানা কথা নহে, শোনা কথা;–আখ্যায়িকা-রচয়িতা হলওয়েলের নিকট হইতে শোনা কথা!
এই সকল কারণে, হলওয়েলের কাহিনীর সমালোচনা করিতে গিয়া হয় তাহাকে বিনা বিচারে সত্য বলিয়া গ্রহণ করিতে হইবে, না-হয় বিচার করিয়া সন্দেহপূর্ণ বলিয়া পরিত্যাগ করিতে হইবে। যাঁহারা এই কাহিনী এখনও গ্রহণ করিবার পক্ষপাতী, তাঁহারাও মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিতেছেন যে,–হলওয়েলের কহিনী সৰ্বাংশে সত্য হইতে পারে না। একজন স্পষ্টই লিখিয়াছেন :
কলিকাতার দুর্গ-জয়কালে অনেকে প্রাণ বিসর্জন করিয়াছিল, ইহা সত্য কথা। যদি তাহারা অন্ধকূপ-কারাগারে প্রাণ বিসৰ্জন করিয়া থাকে, তবে হলওয়েলের কাহিনী সৰ্বাংশে সত্য না হইলেও, একেবারে মিথ্যা হইতে পারে না।
এখন ইতিহাসের সকল তর্ক এই “যদির” উপর আসিয়া দাঁড়াইয়াছে।
ভারতী, বৈশাখ, ১৩২৩
তথ্যসূত্র
১ Hill’s Bengal in 1756-57.
২ Bengal Past and Present, Vol, XI.
.
লালপল্টন*
প্রথম পরিচ্ছেদ – বাঙ্গালীর কলঙ্ক
The native Bengalees are generally stigmatised as pusillanimous and cowardly, but it should not be forgotten, that, at an early period of our military history in India, they almost entirely formed several of our battalions, and distinguished themselves as brave and active soldiers.
–Walter Hamilton rom.
বাঙ্গালীর ইতিহাস নাই। সেই জন্য, বাঙ্গালীর বাহুবলের পরিচয় বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে। সচরাচর প্রচলিত ইতিহাসে ‘ভীরু ও কাপুরুষ” বলিয়া বাঙ্গালীর ললাটে যে কলঙ্করেখা দেখিতে পাওয়া যায়, তাহাই জনসমাজে সুপরিচিত হইয়া উঠিয়াছে।
যাঁহারা বাঙ্গালীর কলঙ্ক রটনা করিয়া গিয়াছেন, তাঁহারা কোনরূপ প্রমাণ প্রয়োগ করেন নাই। পরনিন্দা স্বভাবতঃই নিতান্ত মুখরোচক; বোধ হয় সেই জন্যই লোকে তাঁহাদের কথা বিনা প্রমাণে গলাধঃকরণ করিয়া আসিতেছে!
এতদিন পরে এই সকল কথার প্রতিবাদ করা নানা কারণে কঠিন হইয়া উঠিয়াছে। এখন আর বিনা প্রমাণে একটি কথাও বলিবার উপায় নাই। সে প্রমাণও তেমন আয়াসলভ্য নহে! যাহা সেকালের মুদ্রাযন্ত্রের কল্যাণে জনসমাজে প্রকাশিত হইয়াছিল, তাহা কালক্রমে দুষ্প্রাপ্য হইয়া উঠিয়াছে;–যাহা প্রকাশিত হয় নাই, তাহা বিলাতে চলিয়া গিয়াছে। অগত্যা বাঙ্গালীকে মাথা পাতিয়া অনেক অলীক কলঙ্ক বহন করিতে হইতেছে!
“ইংরাজে না মানিলে আমাদের যশও মঞ্জুর নয়,”–ইহা সকলেরই ধারণা হইয়া উঠিয়াছে। কিন্তু ইহা নব্যবঙ্গের পক্ষে নিতান্ত অস্বাভাবিক কুরুচি বলিয়া ধিক্কার দেওয়া যায় না। এইরূপ হইবারই কথা। পাঠশালা হইতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ শিখর পর্যন্ত সকল স্থানে–বাঙ্গালীর কাপুরুষত্বের কথাই বিবিধ ছন্দোবন্ধে কর্ণোপান্তে ধবনিত হইয়া আসিতেছে! বাল্যশিক্ষার সহিত যে সংস্কার তরুণ হৃদয়ে বদ্ধমূল হয়, তাহা কালক্রমে লতা পল্লবে ফুল ফলে বিকশিত হইয়া উঠাই স্বাভাবিক। সুতরাং এখন আর লোকে সযত্নকণ্ঠস্বীকৃত ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোন নূতন কথা বিনা প্রমাণে গ্রহণ করিতে সম্মত হইবে কেন? সে প্রমাণও ইংরাজের নিকট হইতে সংগ্রহ করিয়া দিতে হইবে;–তাঁহারা যদি আমাদের যশ গাহিয়া থাকেন, তবেই তাহা মঞ্জুর!
বাঙ্গালীর কাপুরুষত্বের কলঙ্ক ভঞ্জন করিবার জন্য ওয়ালটার হামিল্টনের উক্তিই যথেষ্ট হইত। তিনি বাঙ্গালীর প্রশংসাবাদের জন্য গ্রন্থ রচনা করেন নাই। তাঁহার পুস্তকের সর্বত্র বাঙ্গালীর কত কুৎসা কত নিন্দা দেখিতে পাওয়া যায়;–পড়িতে পড়িতে মনে হয় বুঝি তাঁহার পুস্তক অবলম্বন করিয়াই মেকলে বাঙ্গালীকে জাল জুয়াচুরী ও মিথ্যাকথার অবতার বলিয়া রটনা করিয়া গিয়াছেন!২ এরূপ গ্রন্থকার যখন বাঙ্গালীকে ভীরু ও কাপুরুষ বলিয়া কলঙ্কিত না করিয়া, তাহাদের বীরকীৰ্ত্তির বিষয়ে সাক্ষ্যদান করিয়া গিয়াছেন, তখন অন্যান্য প্রমাণ অনুসন্ধান না করিলেও চলিত। কিন্তু ওয়ালটার হামিল্টন যে কথার উপর নির্ভর করিয়া বাঙ্গালীর যশ গাহিয়া গিয়াছেন, তাহা ঐতিহাসিক সত্য বলিয়া গ্রহণ করা কর্তব্য কি না, সে বিষয়ে যখন বিতর্ক উপস্থিত হওয়া বিচিত্র নহে, তখন তাঁহার উক্তির মূলানুসন্ধান করাই কৰ্ত্তব্য।
ভারতভাগ্যবিধাতা সেনাপতি ক্লাইব যাহাদের সহায়তা লাভ করিয়া আপন নাম চিরস্মরণীয় করিয়া গিয়াছেন, সচরাচর প্রচলিত ইতিহাসে তাহারা ক্লাইবের “লালকুত্তিওয়ালা” অথবা Clive’s Red coats বলিয়াই পরিচিত। তাহাদের বীরকীর্তির ইতিহাস সংকলিত হয় নাই; যাহা কিছু সংকলিত হইয়াছিল, তাহাও দুষ্প্রাপ্য হইয়া উঠিয়াছে। এখন নূতন করিয়া তাহাদের ইতিহাস সংকলন করিতে হইলে “ইংরাজ রাজত্বের আদি যুগ” বিশেষ ভাবে অনুশীলন করা আবশ্যক।
“ইংরাজ রাজত্বের আদি যুগ” এখনও নিবিড় তমসাচ্ছন্ন। আমাদের মত গৃহচত্তরাবদ্ধ বাঙ্গালীর পক্ষে তাহা “বিশেষভাবে অনুশীলন” করা সহজসাধ্য নহে। বহুমানাস্পদ শ্রীযুক্ত রমেশচন্দ্র দত্ত মহাশয় রাজকাৰ্য্য হইতে অবসর গ্রহণ করিয়া ইংলণ্ডীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতেতিহাসের অধ্যাপনা কার্যে নিযুক্ত হইয়াছেন। তাঁহার অমৃতময়ী লেখনী এই কার্যে নিযুক্ত হইলে কথঞ্চিৎ আশা পূর্ণ হইতে পারে। ভারতবর্ষে বৃটীশরাজশক্তি কিরূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছে, তাহার প্রকৃত ইতিহাস আজিও লিখিত হয় নাই। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম অধ্যাপক শ্ৰীযুক্ত সি, আর, উইলসন এম, এ, মহোদয় “ইংরাজ রাজত্বের আদি যুগ”
অনুশীলন করিতে বসিয়া সম্প্রতি এই কথাই স্বীকার করিতে বাধ্য হইয়াছেন। তিনি বলেন,-–”বৈজ্ঞানিক সত্যানুসন্ধান পদ্ধতি অবলম্বন করিতে হইলে, প্রত্যেক কার্যের কারণ নির্দেশ করিতে হয়। ইংরাজেরা কিরূপে ভারতবর্ষে অধিকার বিস্তার করিতে সক্ষম হইলেন, তাহা বর্তমান যুগের একটি প্রধানতম ঐতিহাসিক ব্যাপার। কিন্তু এখনও যে তাহার কার্যকারণ শৃঙ্খলাবদ্ধ কোন রূপ ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত দেখিতে পাওয়া যায় না, তাহা কি নিতান্ত বিস্ময়ের বিষয় নহে? বৃঢ়ীশাধিকৃত ভারত সাম্রাজ্যের ইতিহাস এখনও সংকলিত হয় নাই। এখনও কেহ বুঝাইয়া দিতে পারেন নাই–পর্তুগীজ, ফরাসি, ওলন্দাজ থাকিতে ইংরাজ ভারতভূপতি হইলেন কেন? বোম্বে মান্দ্রাজ থাকিতে বঙ্গদেশ হইতে ইংরাজরাজশক্তির অভ্যুদয় হইল কেন?
এই ঐতিহাসিক সমস্যার আলোচনা করিতে হইলে সর্বাগ্রে বাঙ্গালীর কথাই আলোচনা করিতে হইবে। বাঙ্গালীকে “ভীরু ও কাপুরুষ” বলিয়া ইতিহাস রচনা করিয়া রাখিলে, এই সমস্যার প্রকৃত সিদ্ধান্ত কদাচ আবিস্কৃত হইবে না। বর্তমান যুগের একজন সুযোগ্য ইংরাজ ইতিহাস লেখক বহুপূৰ্ব্বে ইহার সংক্ষিপ্ত উত্তর লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। আমরাই যে ভারতবর্ষে ইংরাজ রাজত্ব সংস্থাপন করিবার মূল, ইহাই তাঁহার সিদ্ধান্ত। প্রমাণ প্রয়োগ করিয়া এই সিদ্ধান্ত কতদূর সত্য তাহা বুঝাইয়া দিতে পারিলেই বাঙ্গালীর কলঙ্ক মোচন হইতে পারে।
আজ কাল বাঙ্গালী রণভীরু কাপুরুষ বলিয়াই সৰ্ব্বত্র পরিচিত। ইহা কাহারও অস্বীকার করিবার উপায় নাই। কিন্তু বাঙ্গালী যে চিরদিন রণভীরু কাপুরুষ বলিয়া পরিচিত ছিল না,–সে কথাও অস্বীকার করিবার উপায় নাই। তাহা প্রমাণ করিবার জন্য বহ্বায়াসপূর্ণ ঐতিহাসিক গবেষণার প্রয়োজন হয় না।
হিন্দুরাজত্বের কথা ছাড়িয়া দিলে, বাঙ্গালার সামরিক ইতিহাস প্রধানতঃ পাঁচ অধ্যায়ে বিভাগ করিতে হয়। বর্তমান জ্ঞানোজ্জ্বল নবযুগের অভ্যুদয় হইবার পূৰ্ব্বে বঙ্গদেশে এরূপ দীর্ঘস্থায়ী শান্তিসুখ দেখিয়ে পাওয়া যাইত না;–নিত্য কলহ, নিত্য বিদ্রোহ, নিত্য আক্রমণ, নিত্য আত্মরক্ষা,–এইরূপ নিত্য বিপ্লবে বঙ্গভূমি কত না বিপর্যস্ত হইত! বাঙ্গালার ইতিহাসের সেই বহুবিপ্লবময় পাঁচটি অধ্যায়, (১) হিন্দু ও পাঠান সংঘর্ষ, (২) পাঠানশাসন, (৩) পাঠান ও মোগল সংঘর্ষ, (৪) মোগলশাসন, (৫) মোগল ও ইংরাজ সংঘর্ষ,–এইরূপে অভিহিত করিলে অসঙ্গত হইবে না। এই পাঁচ অধ্যায়ের প্রত্যেক পৃষ্ঠাই কত রণকোলাহল কাহিনীতে পরিপূর্ণ!
যে সকল বিজয়োন্মত্ত পাঠান-সেনা বিহার বিপর্যস্ত করিয়া অসিহস্তে বঙ্গদেশে প্রথম পদবিক্ষেপ করে, তাহাদের “সপ্তদশ অশ্বারোহী’ কটাক্ষে বঙ্গভূমি করতলগত করিতে পারে নাই। বাঙ্গালীরা বহুবার পাঠান সেনার আক্রমণবেগ প্রতিহত করিবার আয়োজন করিয়াছিল; অবশেষে যখন পাঠান শাসন প্রবর্তিত হইল, তখনও সমগ্র বঙ্গভূমি পদানত হয় নাই। পাঠানকে সুবর্ণরেখাপারে চিরনিৰ্বাসিত করিবার জন্য মোগল অশ্বারোহী কতবার পাঠানের পশ্চাদ্ধাবন করিয়াছিল; অবশেষে যখন মোগল-শাসন প্রতিষ্ঠালাভ করিল, তখনও সমগ্র বঙ্গভূমি মোগলকে যথারীতি কর প্রদান করে নাই। মোগলশাসন উৎখাত করিয়া ফেলিতে,–অর্থাৎ সিরাজদ্দৌলার সিংহাসনে মীরজাফরকে বসাইয়া দিতে, সমধিক সমরকৌশলের প্রয়োজন হয় নাই; তথাপি মোগলরাজ্যে বৃটীশ রাজশক্তি সুসংস্থাপিত করিয়া অরাজকতার মূলোচ্ছেদ করিতে বহু বীর সন্তানকে শত সমরক্ষেত্রে আত্মবিসৰ্জন করিতে হইয়াছে।
এই ঐতিহাসিক যুগপঞ্চকে বহিঃশত্রুর অভিযানে এবং অন্তর্বিপ্লবের আলোড়নে বঙ্গভূমি বহুধা জর্জরিত হইয়াছে। কখন পার্বত্য-সেনা, কখন মগ ফিরিঙ্গি, কখন বা বর্গী আসিয়া, ঘন ঘোর হুহুঙ্কারে বাঙ্গালার স্বর্ণশীর্ষ শস্যসম্পৎ পদবিদলিত করিয়া চলিয়া গিয়াছে! অন্তর্বিপ্লবের শান্তিসাধন করিতে, বহির্বিপ্লবের গতিরোধ করিয়া শস্যভাণ্ডার সুরক্ষিত করিতে বাঙ্গালীকে বহুবার সামরিক ব্যাপারে লিপ্ত হইতে হইয়াছে।
সে সকল সামরিক ব্যাপারে বাঙ্গালী ভিন্ন কাহারা আসিয়া সম্মুখ সমরে আত্মরক্ষার জন্য দেহ বিসৰ্জন করিত? বাঙ্গালী কৰ্ম্মকার ভিন্ন কাহারা আসিয়া তীর, বর্ষা, টাঙ্গি, তরবারি, বন্দুক, কামান, বারুদ ও গোলা প্রস্তুত করিয়া দিত?
বাঙ্গালী কেমন নিপুণহস্তে দুর্গ নির্মাণ করিয়া পরিখাপরিশোভিত দুর্গমূল হইতে কামানে অনল বর্ষণ করিতে করিতে শত্রুসেনার মুণ্ডচ্ছেদ করিতে পারিত, মহম্মদপুরের ধবংশাবশেষের মধ্যে বাঙ্গালী কায়স্থ কুলভূষণ “বিশ্বাস ভাসোদ্ভবকুলকমলে ভাসকো ভানুতুল্যঃ” সীতারাম রায়ের দুর্গ প্রাচীরে এখনও তাহার কিছু কিছু পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়। বাঙ্গালী জনার্দন কর্মকার বাঙ্গালী তত্ত্বাবধায়ক হরবল্লভ দাসের অধীনে কেমন দৃঢ়কায় কামান নিৰ্মাণ করিতে পারিত, “জাহানকোষা” নামক ঐতিহাসিক কামানফলকে এখনও তাহা খোদিত রহিয়াছে।
আজকাল বাঙ্গালীর পুরাতত্ত্বানুসন্ধানের জন্য কিছু কিছু আয়োজন আরব্ধ হইয়াছে। বোধ হয় সেই জন্য “প্রদীপ” প্রজ্বলিত হইয়াই ঐতিহাসিক গহ্বর মুখে সংস্থাপিত হইয়াছে। তথাপি সত্যানুরোধে বলিতে হইবে,–এই গহ্বর বড়ই ভষ্মস্তূপ নিহিত, বড়ই তিমিরাবগুণ্ঠিত, বড়ই দুর্গম,–স্থানে স্থানে দুর্গন্ধ এত অধিক যে, নাসারন্ধ্র জ্বলিয়া যায়!
বাঙ্গালীরা কি সূত্রে কোন সময় হইতে সামরিক ব্যাপার হইতে অবসর প্রাপ্ত হইয়া কালক্রমে রণপরান্মুখ হলকর্ষণ নিপুণ নিরন্ন কৃষক সমিতিতে পরিণত হইয়া পড়িয়াছে, তাহা সবিশেষ কৌতূহলাত্মক ঐতিহাসিক সমস্যা! বৰ্ত্তমান শতাব্দির প্রারম্ভেই বাঙ্গালীর বাহুবল বিলুপ্ত হইবার সূত্রপাত হয়। ওয়ালটার হামিল্টন বলেন, কোম্পানী বাহাদুর সিপাহী সংখ্যা হ্রাস করায়, অনেক বাঙ্গালী আক্ষেপ করিয়া বলিয়াছে যে, কোম্পানীর আমলে পড়িয়াই তাহাদের অন্ন উঠিয়া গেল!
কোম্পানীর আমলে সিপাহী সংখ্যা হ্রাস প্রাপ্ত হইয়াই যে বাঙ্গালী সমর শিক্ষা পরিত্যাগ করিয়াছে তাহাই একমাত্র কারণ নহে। সেকালে বাঙ্গালীর পক্ষে নায়ক, হাবিলদার, জমাদার, মনসবদার, কিল্লাদার ও সিপাহসালার প্রভৃতি সর্বপ্রকার সেনানায়কের পদে প্রতিষ্ঠিত হইবারই সম্ভাবনা ছিল। কোম্পানীর আমলে পড়িয়া বাঙ্গালী কেন, কালা আদমী মাত্রেরই, উচ্চপদ পাইবার আশা নির্মূল হইয়া গেল! মাসিক চারি টাকা বেতনের পদাতিক হওয়া অপেক্ষা হলকর্ষণ করাই বাঙ্গালীর নিকট অধিকতর লাভজনক বিবেচিত হইল। ইহা আমাদিগের কথা নহে;– ওয়ালটার হামিল্টনের গ্রন্থে ইহারও পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়।
বৰ্ত্তমান শতাব্দির কথা যাহাই হউক, গত শতাব্দির মোগল ও ইংরাজ সংসর্গে যে বাঙ্গালীরা উভয় পক্ষেই অস্ত্র ধারণ করিয়াছিল, তাহার প্রমাণ এখনও বিলুপ্ত হয় নাই। নবাব সরকারে বাঙ্গালী সেনা ও সেনানায়কের অভাব ছিল না;–বাঙ্গালী ব্রাহ্মণ মহারাজ নন্দকুমার, বাঙ্গালী কায়স্থ মহারাজ দুর্লভরাম, বাঙ্গালী বৈদ্য মহারাজ রাজবল্লভ, বাঙ্গালী মুসলমান মহাবীর মীরমদন যে সিরাজদ্দৌলার সরকারে সেনানায়কের কাৰ্যে নিযুক্ত ছিলেন, সচরাচর প্রচলিত ইতিহাসেও তাহার উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। “নবাবী আমলের হিন্দু সেনাপতিদিগের” কিৰ্ত্তী-কাহিনী পৃথক সংকলিত হইতেছে; তাহা প্রকাশিত হইলে বাঙ্গালীর ললাটকলঙ্ক কিয়দংশে অপসারিত হইবে।১০ ইংরাজ সরকারে বাঙ্গালীদিগের পক্ষে সেনানায়কের উচ্চ পদবীতে আরোহণ করিবার ব্যবস্থা ছিল না; তথাপি ইংরাজ
সরকারে বাঙ্গালী সেনা কিরূপ প্রভুপরায়ণতা, অকুতোভয়তা, ও সময় সহিষ্ণুতার পরিচয় রাখিয়া গিয়াছে, বর্তমান প্রবন্ধে কেবল তাহাই আলোচিত হইবে। তাহাতেই বিষপ হীবর এবং ওয়ালটার হামিল্টনের উক্তির যাথার্থ প্রকটিত হইবে।
প্রদীপ, মাঘ, ১৩০৪
তথ্যসূত্র
* ‘প্রদীপের’ প্রথম সংখ্যায় অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়কে লক্ষ্য করিয়া যে ঐতিহাসিক তত্ত্বালোচনার জন্য ইঙ্গিতে অনুরোধ জানান হয়, তদুত্তরে লিখিত।
১ ‘প্রদীপের’ প্রথম সংখ্যায় উল্লিখিত কথাগুলি ‘ইণ্ডিয়ান মিরর’ পত্রিকা হইতে উদ্ধৃত হইয়াছে, এবং উহা ওয়ালটার হামিল্টন কৃত ১৮১৫ খৃষ্টাব্দের ‘বৃটীশ ইণ্ডিয়া গেজেটিয়ার’ পুস্তকের উক্তি বলিয়া কথিত হইয়াছে। উক্ত নামধেয় কোন পুস্তক আছে কিনা জানি না। উদ্ধৃত বাক্যাবলী ওয়ালটার হামিল্টন কৃত ১৮২০ খৃষ্টাব্দে SafTO A Geographical, Statistical and Historical Description of Hindostan and Adjacent countries নামক পুস্তকের প্রথম খণ্ডের সপ্তম পরিচ্ছেদের ৯৫ পৃষ্ঠায় লিখিত আছে। আমরা উক্ত পুরাতন পুস্তক হইতে উদ্ধৃতাংশ সংকলন করিয়া দিলাম।
২ In the moral Scale the Bengalese Hindus must be allowed to rank very low, being destitute in a wonderful degree of the qualities which contribute to dignify the human race, and in Europe form the Standard by which men are estimated. –Walter Hamilton’s Description of Hindostan, Vol. I, III
৩ William’s Bengal Native Infantry.
8 It is the duty of the Scientific enquirer to show the causes of every event. Is it not then strange that we are still without any adequate explanation of one of the greatest events of modern history, the English conquest of India. … The history of British India has yet to be written. We have yet to understand why the English conquered India and not the Portuguese French or Dutch. We have yet to understand why it was from Bengal, not from Madras or Bombay, that the English dominion took its rise. –Wilson’s Early Annals of the English in Bengal, Vol. I, Preface.
Malleson’s Decisive Battles of India.
৬ ‘সাহিত্যে প্রকাশিত ‘সীতারাম’ শীর্ষক ঐতিহাসিকচিত্রে এই দুর্গের মানচিত্র প্রদত্ত হইয়াছে।
৭ শ্ৰীযুক্ত নিখিলনাথ রায় বি, এ সংকলিত “মুরশিদাবাদ কাহিনী” নামক ঐতিহাসিক চিত্রে এই কামানের চিত্র ও বিশেষ বিবরণ প্রদত্ত হইয়াছে।
৮ With a particular class of the natives it is a very general complaint, that they can uot now procure a livelihood in the British Provinces. They allege that under former governments, the number of troops entertained, and the various description of servants required for state and the revenue collections, afforded means of employment which are now lost; the troops and officers under the British Government being circumscribed to the Smallest possible Scale. –Walter Hamilton’s Description of Hindostan, Vol. I.P 91.
৯ No native (of Bengal) has any motive to distinguish himself greatly in the army, as he can not rise higher than a Soubahdar, a rank inferior to an Ensign. — Wialter Hamilton’s Dascription of Hindostan, vol. I. 91.
১০ বহরমপুর কলেজের সুযোগ্য শিক্ষক বন্ধুবর শ্রীযুক্ত কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় বি, এ সংকলিত “নবাবী আমলে হিন্দু কর্মচারী” শীর্ষক একটি সারবান ঐতিহাসিক প্রবন্ধ “সাহিত্য” পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তাঁহারই লেখনী সম্প্রতি ‘নবাবী আমলে হিন্দু সেনাপতি’ শীর্ষক আর একটি ঐতিহাসিক প্রবন্ধ সংকলনে নিযুক্ত রহিয়াছে। কালীপ্রসন্ন বাবুর প্রগাঢ় ইতিহাসানুরাগ, অতুল অধ্যবসায় ও ঐতিহাসিক লুপ্তোদ্ধারে আন্তরিক যত্ন, বঙ্গসাহিত্যসমাজে সুপরিচিত। তাঁহার প্রবন্ধ প্রকাশিত হইলে অনেক বিলুপ্ত কাহিনী আবার সৰ্ব্বজনপরিচিত হইয়া উঠিবে।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – বাঙ্গালীর বরকন্দাজ
Hitherto the native troops employed at Calcutta, when required, designated Buxarries,’ were nothing more than Barkundaz, armed and equipped in the usual native manner.
-Brooms’s History of the Rise and Progress of the Bengal Army.
ইংরাজেরা যখন বাঙ্গালাদেশে প্রথম পদার্পণ করেন, তখন তাঁহারা খাঁটি বণিক; বাণিজ্য ব্যাপারে যৎকিঞ্চিৎ উপার্জন করাই একমাত্র লক্ষ্য ছিল।
এই লক্ষ্য সাধন করিবার জন্য ১৬৩৩ হইতে ১৬৬০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত তাঁহারা দেশীয় রাজশক্তির আশ্রয় ও অনুকম্পার উপরেই সমধিক নির্ভর করিতেন।
দেশীয় রাজশক্তির অনুগ্রহের মূল্য ছিল। তজ্জন্য ইংরাজবণিককে সময়ে সময়ে বহুবিধ উপঢৌকন হস্তে রাজদ্বারে উপনীত হইতে হইত। কিন্তু এত করিয়াও নিরুদ্বেগ হইবার উপায় ছিল না!
দিল্লীর বাদশাহ অনুকম্পা প্রকাশে বাণিজ্যের অনুমতি প্রদান করিলে, বাঙ্গালার নবাব অনুমতি প্রদান করিতে চাহিতেন না; নবাব সম্মত হইলেও, হুগলীর ফৌজদার সম্মত হইতেন না! নবাবকে দরবারের পাত্রমিত্রগণের মনস্তুষ্টি সাধন করিতে অনেক অপব্যয় করিতে হইত; এবং তাহাতে কিছুমাত্র ইতস্ততঃ করিলে, তৎক্ষণাৎ বাণিজ্য বন্ধ হইয়া পড়িত।
ইংরাজেরা লাভের লোভে বাঙ্গালাদেশের নানাস্থলে বাণিজ্যালয় খুলিয়া অনেক টাকা ‘দাদন” করিয়া বসিয়াছিলেন। নবাবদরবারের সহিত মনোমালিন্য উপস্থিত হইলে, তাঁহাদের সর্বনাশ সংঘটিত হইবার উপক্রম হইত।
সেকালের বাঙ্গালী রাজা বা জমিদারবর্গ বাহুবলে বাহুবল পরাস্ত করিবার জন্য সাধ্যমত সেনাপিলন করিতেন; এবং সেই জন্য নবাবগণ সহসা তাঁহাদিগকে মুঠার মধ্যে আনিতে পারিতেন না। ইহাদের দৃষ্টান্ত দেখিয়া, ইংরাজেরাও কথঞ্চিৎ বাহুবলের পরিচয় দিবার সংকল্প করিলেন।
ইংলণ্ডেশ্বরের অনুমতি অনুসারে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী ভারতবাণিজ্যের একাধিপত্য লাভ করিয়াছিলেন। কালক্রমে অনেক স্বাধীন ইংরাজ বণিকও ভারতবর্ষে বাণিজ্য করিতে অগ্রসর হইয়াছিলেন। ইহাতে সৰ্ব্বদা কলহ বিবাদ উপস্থিত হইয়া ইষ্টইণ্ডিয়া কোম্পানীর সমূহ অনিষ্ট হইত। তজ্জন্য তাঁহারা বাহুবলে আত্মরক্ষা করিয়া বাণিজ্য প্রতিষ্ঠা করিবার আশায় ইংলণ্ডেশ্বরের শরণাপন্ন হন।
১৬৬১ হইতে ১৬৮৪ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত কর্ত্তব্য নির্দেশ করিতেই কাটিয়া গেল। অবশেষে ১৬৮৫ খৃষ্টাব্দে ইংলণ্ডেশ্বর দ্বিতীয় জেমসের অনুজ্ঞা লাভ করিয়া ইংরাজবণিক সমিতি বাহুবলে আত্মশক্তির প্রতিষ্ঠা করিয়া বাণিজ্য বিস্তার করিবার আয়োজন করিলেন।
ইংলণ্ড হইতে একদল সেনা প্রেরিত হইল; তাহার কতক সমুদ্রপথে নিরুদ্দেশ হইয়া গেল, কতক পথক্লেশে পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হইল, অত্যল্পসংখ্যক “গোরালোগ” বঙ্গদেশে উপনীত হইতে পারিল;–কিন্তু কোম্পানীর প্রচুর অর্থ অপব্যয় হইয়া গেল!
কোম্পানীর বাণিজ্য বিস্তারের জন্য ইংলণ্ড হইতে যে সেনাদল প্রেরিত হইত, তাহার প্রত্যেক সেনা সংগ্রহ করিতে তিনশত টাকার উপর ব্যয় হইত!° সৰ্ব্বদা এরূপ বহুব্যয়সাধ্য সেনা সংগ্রহ করা অসম্ভব বলিয়া কোম্পানী বহুসংখ্যক সেনা আনয়ন করিতে পারিতেন না। দশ বৎসর এইরূপ উপায়ে বাণিজ্য বিস্তার করিতে গিয়া কোম্পানীর বিস্তর ক্ষতি হইল!
আমরা যে সময়ের কথা বলিতেছি, তৎকালে বাঙ্গালীদিগের মধ্যে সেনা এবং সেনানায়কের অভাব ছিল না। যে সকল হিন্দু মুসলমান মোগল-রাজ-সংসারে সামরিক কার্যে নিযুক্ত হইতেন, তাঁহাদের মধ্যে বাঙ্গালীর সংখ্যা নিতান্ত অল্প ছিল না। বাঙ্গালী ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈদ্য, কায়স্থ প্রভৃতি ভদ্রসন্তানেরাও লাঠি তরবারি ব্যবহার করিতে জানিতেন এবং নিম্ন শ্রেণীর হিন্দু মুসলমানের মধ্যে হলকর্ষণে জীবিকার্জন করা অপেক্ষা তরবারি চালনায় জীবিকার্জনের প্রবৃত্তি প্রবল হইয়া উঠিয়াছিল। এরূপ অবস্থায় ইংরাজদিগের পক্ষে ‘কালা আদমীর’ বাহু বলের আশ্রয় গ্রহণ করা কঠিন হইল না। ইহারা কোম্পানীর সরকারে ভাত কাপড় এবং মাসে চারি টাকা বেতনে নিযুক্ত হইতে লাগিল; সম সাময়িক কাগজ-পত্রে দেখিতে পাওয়া যায় যে, “তৎকালে দেশীয় পদাতিক সেনা কুত্রাপি ইহার অধিক বেতন পাইত না।”
ইংরাজেরা যে সময়ে ব্যয় সংক্ষেপ করিবার জন্য দেশীয় সেনা সংগ্রহের ব্যবস্থা করিলেন, তৎসমসময়ে একটি আকস্মিক বিপ্লব উপস্থিত হইয়া তাঁহাদের এই অভিনব সামরিক নীতি আরও দৃঢ়বদ্ধ হইয়া গেল।
মোগল রাজশক্তির শাসন-শিথীলতার অবসর লাভ করিয়া সভাসিংহ নামক বর্ধমান অঞ্চলের জনৈক বাঙ্গালী জমিদার উৎকল নিবাসী পাঠান সর্দার রহিম খাঁর সহায়তা গ্রহণ করিয়া স্বাধীন রাজ্য সংস্থাপন করিবার আশায় ভাগীরথীর উভয় তীরস্থ সম্পন্ন গ্রাম নগরগুলি লুণ্ঠন করিতে করিতে মুরশিদাবাদ, মালদহ বিপর্যস্ত করিয়া রাজমহল পৰ্য্যন্ত করতলগত করিয়া ফেলিলেন। বাঙ্গালার মোগল রাজধানী তখনও ঢাকা হইতে মুরশিদাবাদে উঠিয়া আইসে নাই; সুতরাং সহসা বিদ্রোহ নিবারণে সুবিধা হইল না। কলিকাতার ইংরাজ, চুঁচুঁড়ার ওলন্দাজ এবং চন্দননগরের ফরাসি বণিকগণ আপন আপন বাণিজ্য স্থান সুরক্ষিত করিবার আশায় দেশীয় বরকন্দাজ নিয়োগ করিতে আরম্ভ করিলেন, এবং নবাবের অনুমতির উপলক্ষ করিয়া দুর্গ নির্মাণে অগ্রসর হইলেন। এইরূপে চুঁচুঁড়ায়, চন্দননগরে এবং কলিকাতার বিদেশীয় বণিকজাতির দুর্গরচনার সূত্রপাত হইল।
যাহারা ইংরাজের বাণিজ্য রক্ষার জন্য কলিকাতার বৃটীশ দুর্গে প্রথম পদক্ষেপ করিয়াছিল, তাহাদের মধ্যে গোরার সংখ্যা অধিক ছিল না। কেবল কলিকাতা রক্ষার জন্যই বরকন্দাজ নিয়োগ করা হইয়াছিল, এই জন্য কলিকাতা রক্ষা পাইল বটে, কিন্তু ইংরাজদিগের মালদহের বাণিজ্যালয় লুণ্ঠিত হইয়া গেল।
ইংরাজেরা কলিকাতায় দুর্গ নির্মাণ করিবার সময় হইতেই নগর রক্ষার ভার তাঁহাদের স্কন্ধে নিপতিত হইয়াছিল। তৎকালে ডিহী কলিকাতা, বাজার কলিকাতা, গোবিন্দপুর ও সুতানটি নামক চারি ভাগে ভারত সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ রাজধানী বিভক্ত হইয়াছিল, এবং প্রত্যেক ভাগে এক একটি স্বতন্ত্র কাছারী সংস্থাপিত হইয়াছিল। এই সকল কাছারীতে নগর রক্ষার জন্য পাইক ও বরকন্দাজ থাকিত এবং তাহাদের মধ্যে বাঙ্গালী গোয়ালাদিগের সংখ্যাই অধিক ছিল। সেকালের বাঙ্গালী গোয়ালাগণ শৌর্য, বীৰ্য্য ও সমর-কৌশলের জন্য এরূপ খ্যাতিলাভ করিয়াছিল যে, বর্তমান শতাব্দির প্রারম্ভ পৰ্য্যন্তও গোয়ালা বরকন্দাজ নিয়োগের জন্য ইংরাজদিগের সবিশেষ আগ্রহ ছিল। তাঁহাদের বাণিজ্যবিষয়ক কাগজ পত্রের মধ্যে এখনও তাহার পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়।
যুদ্ধকলহের সম্ভাবনা উপস্থিত হইলে, ইংরাজেরা কালাসিপাহীর দল বৃদ্ধি করিতেন, শান্তির সময়ে ব্যয় সংক্ষেপ করিবার জন্য কেবল গোরাদল বাহাল রাখিয়া বাঙ্গালীদিগকে পদচ্যুত রিতেন। কিন্তু শান্তির সময়েও ইংরাজদুর্গে দুই চারিজন বাঙ্গালী সৈনিক না থাকিত তাহা নহে।
সম্রাট আরঙ্গজীবের মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই ভারত সিংহাসন লইয়া তুমুল গৃহকলহ উপস্থিত হয়। তৎকালে বিদেশীয় বণিকসমিতির কার্যকলাপ পরিদর্শন করা কাহারও লক্ষ্য ছিল না; সকলেই আপনাপন পদগৌরব রক্ষা করিবার জন্য ও নূতন বাদশাহের শুভদৃষ্টি লাভ করিবার জন্য ব্যাকুল হইয়া উঠিয়াছিলেন। দেশ একরূপ অরাজক হইয়া পড়িয়াছিল। ইংরাজেরা সেই সুযোগে তাড়াতাড়ি দুর্গ সংস্কার করিতে আরম্ভ করেন। দেশে যখন শান্তি সংস্থাপিত হইল, মুর্শিদাবাদের নবাবদরবার তখন পুনরায় ইংরাজদিগের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করিবার অবসর প্রাপ্ত হইলেন। নবাব বিংশতিসহস্র মুদ্রা ‘নজর’ তলব করিয়া পাঠাইলেন, এবং ইংরাজের বাণিজ্য তরণীর গতায়াত রুদ্ধ করিয়া দিলেন। এই উপলক্ষে ইংরাজেরা পুনরায় বাঙ্গালী বরকন্দাজ নিয়োগ করিতে বাধ্য হইলেন। তাঁহারা বাহুবলে নৌকা বন্ধন-মুক্ত করিবার জন্য যে সেনাদল পাঠাইয়া ছিলেন, তন্মধ্যে বাঙ্গালী গোলন্দাজ থাকার প্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া যায়।
অধ্যাপক সি, আর, উইলসন এম, এ, মহোদয় বিলাতের জীর্ণ দপ্তর হইতে এই সকল পুরাতত্ত্ব বহু যত্নে উদ্ধার করিয়া ঐতিহাসিক তত্ত্বালোচনার পথ কিয়দংশে সহজ করিয়া দিয়াছেন; তাঁহার প্রকাশিত পুস্তকগুলি যদি আমাদের দেশের শিক্ষিত সমাজে সমাদর লাভ করে, তাহা হইলে অনেক পুরাতত্ত্ব সংকলিত হইবার সম্ভাবনা আছে।
সেকালের বাঙ্গালীরা যে কেবল স্থল-যুদ্ধেই বাহুবলের পরিচয় প্রদান করিত তাহা নহে; জলযুদ্ধেও তাহাদের উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। মোগল রাজ্যের জলযুদ্ধের জন্য শ্রীহট্টে রণতরণী নির্মিত হইত;১২ ঢাকায় জলযুদ্ধোপযোগী নৌসেনা সুরক্ষিত হইত এবং তাহার ব্যয় নির্বাহাৰ্থ “জায়গীর নৌয়ারা” নামে পৃথক কতকগুলি পরগণা নির্দিষ্ট হইত। এই নৌসেনাদলে কতকগুলি বঙ্গজ পর্তুগীজ নাবিকও প্রবেশ লাভ করিয়াছিল,১৪ এবং অনেক বাঙ্গালী ধীবর বঙ্গোপসাগরসম্মিলনের নিকট নদীমুখ রক্ষাৰ্থ নিযুক্ত হইয়াছিল। বাঙ্গালী ধীবরগণের
সহায়তায় ভাগীরথীবক্ষে পোত আনয়ন করা বহুব্যয়সাধ্য ব্যাপার বলিয়া ইংরাজেরা ১৬৬৮ খৃষ্টাব্দের সমকালেই ‘পাইলট’ প্রথার সূচনা করেন।১৫ কিন্তু এই ‘পাইলট’ দলের মধ্যেও বাঙ্গালীকে গ্রহণ করিতে হইয়াছিল। যাহারা তোপখানায় বা ‘পাইলট’-পোতে কাজ করিত, ইংরাজের ইতিহাসে তাহারা ‘লস্কর’ নামে পরিচিত; ইহারা অদ্যাপিও ইংরাজ-জাহাজে নিযুক্ত থাকিয়া পৃথিবীর নানা দেশে গমনাগমন করিতেছে। ইংরাজেরা যে ‘পাইলটদল’ গঠন করেন, তন্মধ্যে ১৭০৪ খৃষ্টাব্দের কাগজ পত্রেও ২৬ জন লস্করের কথা দেখিতে পাওয়া যায়।১৬।
বাঙ্গালীর সহায়তা লাভ করিয়া ইংরাজেরা জলে স্থলে বাণিজ্য বিস্তারের সুবিধা পাইয়াছিলেন; এবং বিলাতের ‘কোর্ট অব ডিরেকটার’ এই প্রথার উৎসাহ বৰ্ধন করায়, ইংরাজসরকারে অনেক বাঙ্গালী সেনাদলে নিয়োগ প্রাপ্ত হইতেছিল। ইহার পর যখন বর্গীর হাঙ্গামায় বঙ্গদেশে হুলস্থুল পড়িয়া গেল, তখন ইংরাজেরা পুনরায় সেনাদল বৃদ্ধি করিতে বাধ্য হইলেন। আবার বহুসংখ্যক বাঙ্গালী বরকনদাজ নিয়োগ প্রাপ্ত হইল। এতদুপলক্ষে বিলাতে ‘কোর্ট অব ডিরেক্টার’ হইতে যে পত্র আগত হইয়াছিল, তাহাতেও ইহার পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়।১৭
এই সকল বঙ্গীয় বরকন্দাজ বা লস্করগণ যে প্রাণপণে ইংরাজের বাণিজ্য রক্ষা করিত, ইংরাজদিগের সামরিক ইতিহাসে তাহার আনুসঙ্গিক প্রমাণের অভাব নাই। বর্গীর হাঙ্গামায় বাঙ্গালা দেশের অনেক গ্রাম নগর উৎসাদিত হইয়াছিল, কিন্তু কলিকাতার কিছুমাত্র ক্ষতি হয় নাই; বরং লোকে নিরাপদ হইবার জন্য কলিকাতায় ধন রত্ন লইয়া পলায়ন করিতে আরম্ভ করিয়াছিল।১৮
যাহারা এইরূপে ইংরাজের বাণিজ্য রক্ষা করিত, সেকালের ইতিহাসে তাহারা ‘বরকন্দাজ’ অথবা Buxarries, অথবা ‘লস্কর’ অথবা ‘কালা আদমী’ নামে পরিচিত। ইহারা দেশীয় পরিচ্ছদ পরিয়া, লাঠি, তরবারি ও বন্দুক ধারণ করিয়া দেশীয় প্রথায় কর্তব্যপালন করিত, এবং প্রয়োজন হইলে ইংরাজের লবণের মর্যাদা রক্ষার্থ অকাতরে মাথা পাতিয়া দিতেও ইতস্ততঃ করিত না!
সিরাজদ্দৌলা কলিকাতা আক্রমণ করিবার সময়ে ইংরাজদিগের সেনাবল অধিক ছিল না; তাহারা ১৭৫৬ খৃষ্টাব্দের ৭ই জুন অবগত হইলেন যে, সিরাজদ্দৌলা সত্য সত্যই কলিকাতা আক্রমণ করিবার জন্য সসৈন্যে যুদ্ধযাত্রা করিতেছেন। তখন তাহারা আত্মরক্ষাৰ্থ অতিমাত্র ব্যাকুল হইয়া ওলন্দাজ ও ফরাসিদিগের নিকট সেনা ভিক্ষা করেন, এবং তাহাতে বিফলমনোরথ হইয়া নগরবাসী আরমানী ফিরিঙ্গিদিগকে সেনাদলে গ্রহণ করেন। তৎকালে আরমানী ও ফিরিঙ্গি সেনা সোলার টুপী মাথায় দিয়া বেড়াইত বলিয়া লোকে তাহাদিগকে ‘টুপীওয়ালা’ বলিত, ইংরাজেরা বলিতেন–”Topasses” ইহাদের সাহস এবং প্রভুভক্তির পর কাহারও বিশ্বাস ছিল না। সেইজন্য ইংরাজেরা অবশেষে বাঙ্গালী বরকন্দাজ সেনা বৃদ্ধি করিয়া পোনের শত বাঙ্গালী ঠিকা সিপাহী নিয়োগ করিয়াছিলেন।১৯
বাঙ্গালীর কলঙ্কের কপাল! পরবর্তী যুগের ইংরাজ ইতিহাস লেখক কাপ্তান ব্রুম স্বপ্রণীত সামরিক ইতিহাসে অৰ্ম্মির ইতিহাস দ্বিতীয় খণ্ডের ৫৯ পৃষ্ঠার দোহাই দিয়া লিখিয়া গিয়াছেন যে, “যদিও ১৫০০ ঠিকা পদাতিক নিযুক্ত করা হইয়াছিল তথাপি তাহাতে কি হইবে? তাহাদের সাহস বা প্রভুপরায়ণতার উপর বিশ্বাস স্থাপন করিবার উপায় ছিল না!”২০
বলা বাহুল্য যে এই শ্রেণীর ইংরাজ ইতিহাস লেখকগণ যেরূপ সত্যনিষ্ঠার পরিচয় রাখিয়া গিয়াছেন, তাহাতে তাঁহাদের কথার প্রতিবাদ করা নিষ্প্রয়োজন। ইহারা যেখানে কোনরূপ প্রমাণ প্রয়োগ না করিয়া বাঙ্গালীর কলঙ্ক রটনা করিয়া গিয়াছেন, তাহার প্রতিবাদ করাও অসম্ভব। কিন্তু ইহারা যেখানে প্রমাণ প্রয়োগ করিতে বসিয়াছেন, সেখানেই এইরূপ একটা না একটা “গলদ” বাহির হইয়া পড়ে!–ইহাতে কি নাসারন্ধ্র সত্যই জ্বলিয়া যায় না? আমাদের ইতিহাস এইরূপ কত দুর্গন্ধে পরিপূর্ণ হইয়া রহিয়াছে, কে তাহার সংখ্যা নির্ণয় করিবে? অথচ সেই সকল অলীক কাহিনী মুখে মুখে বিস্তৃতি লাভ করিয়া সৰ্ব্বত্র ঐতিহাসিক সত্য বলিয়াই সমাদর লাভ করিয়াছে।
বরকন্দাজদিগের ইতিহাসে ইহাই শেষ যুদ্ধ। ইহার পর কর্ণেল ক্লাইব বঙ্গদেশে শুভাগমন করিয়া বরকন্দাজ দলের পদোন্নতির সূত্রপাত করিয়া দিলেন। তাঁহার আদেশে দেশীয় পরিচ্ছদ উঠিয়া গিয়া “লাল কুৰ্ত্তি” প্রচলিত হইল, লাঠি শোটা তিরোহিত হইয়া সঙ্গীণ বন্দুক চিরসহচর হইল,–সেই সঙ্গে বরকন্দাজ নামও উঠিয়া গিয়া “লাল পল্টন” নাম সৰ্ব্বত্র প্রচারিত হইয়া পড়িল।২১
“লাল পল্টনের” ইতিহাস ইংরাজ-রাজশক্তি বিস্তারের বিচিত্র ইতিহাসের সহিত একসূত্রে গ্রথিত। কলিকাতার পুনরুদ্ধারের পর হইতে “দেওয়ানী সনন্দ” লাভ না করা পর্যন্ত, ইংরাজেরা যেখানে যত যুদ্ধে২২ শত্রুসেনার সম্মুখবর্তী হইয়াছেন, সেখানেই “লাল পল্টন” বৰ্তমান! তাহার অধিকাংশ সমরক্ষেত্রেই বামে দক্ষিণে “লাল পল্টন” দণ্ডায়মান হইয়া মুষ্টিমেয় গোরাদলকে মধ্যস্থলে রাখিয়া বীরবিক্রমে বৃটীশবিজয় বৈজয়ন্তীর গৌরব রক্ষা করিয়াছে; এবং যুদ্ধাবসানে যখন হতাহতের সংখ্যা নির্ণীত হইয়াছে, তখনই দেখা গিয়াছে যে হতাহতের মধ্যে “লাল পল্টনের” সংখ্যাই অধিক।
যাহারা কোম্পানীর লবণ খাইয়া গত সমরক্ষেত্রে আত্মবিসর্জনের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রাখিয়া পুণ্যলোকে চিরপ্রস্থান করিয়াছে, তাহাদের বীরকীৰ্ত্তির ইতিহাস সংকলন করিতে পারিলে কেবল যে বিষপ হীবর এবং ওয়ালটার হামিল্টনের উক্তির যাথার্থ প্রকটিত হইবে তাহাই নহে;–তাহাতে কিয়ৎপরিমাণে বাঙ্গালীর অযথা কলঙ্ক, অপসারিত হইয়া বাঙ্গালীরা হৃদয়শোণিত ঢালিয়া দিয়া কত ক্লেশে ইংরাজ রাজত্বের ভিত্তিমূল দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত করিয়া দিয়াছে, তাহাও কিয়ৎপরিমাণে প্রকাশিত হইবে।
প্রদীপ, মাঘ, ১৩০৪
তথ্যসূত্র
১ The first period in this history lasts from 1633 to 1660, during which the English take up a position in the protection of the Indian Government. –Wilson’s Early Annals of the English in Bengal, Vol. I Preface.
২ If the Settlements hesitated, or refused to comply with the Nabab’s demands, their trade, throughout the Province, was immediately stopped.
-Orme’s History of Indostan, Vol. II. p. 11.
৩ The Company in the year 1685 determined to try what condescensious the effect of arms might Produce; and with the approbation of King Tames the Second, fitted out two fleets.–Orme, Vol. I.p. 11.
8 Every recruit sent from England cost the Company 30. — Bruce’s Annals of the East India Company, Vol. III. p.162.
৫ The pay of the soldiers were (?) fixed at 4 Rupees per month independent of their clothing and rations, which Sir John (Goldssborough) “considered to be a more ample allowance, than the troops of any other establishment in India received.–Broom’s Bengal Army, Vol. I.p. 27.
৬ On the commencement of these disturbances, the several European establishments entertained a number of native soldiers for the protection of their property, and professing themselves friends of the local government, solicited permission to put their factories in a state of defence against the insurgents; to this request the Nawab replied in general terms directing them to defend themselves; when they taking, for granted what was not positively forbidden, hastened to ercct walls of masonry with bastions or teanking towers at the angles, around their several factories, and thus originated the fortifications of Chinsura, Chandernagore, and Calcutta. — Broom’s Bengal Army, Vol, 1.p. 28.
৭ During all this time, the insurgents were gradually gaining head; they had taken possession of Rajemahal and Malda at which latter place the English factory was plundered,–Ibid.
৮ It is ordered that one chief peon, and forty five peons, two chobdars, and twenty Gowalas be taken into pay. –Consultations, 16th February. 1704.
৯ Shaw Allum being now entire victor and sole king, and we having a prospect of peaceable times, it is agreed that we reduce the Soldiery to less number, i.e.–
1 Captain. 1 Ensign. 60 Soldiers. 66 Drummers and Corporals included. 66 The Second Company. 1 Master of Arms. 2. Portuguese Armourers. 2. Bengal Armourers. 137 Men in all”
-Consultations, 31st March, 1709.
১০ The Emperor being dead and how being the properest time to strengthen our Fort, whilst there is an interregnum and no one likely to take notice of what we are doing, it is therefore agreed that we make two regular bastions to the waterside to answer those to the land
-Consultations, 28th April, 1707.
১১ Therefore they resolve to write to the Governor of Hugli and “acquaint him that if the boats of goods that are stopped are not cleared, we will not let any of the Moor’s ships pass.” They also agree that they will send up forty soldiers and thirty black gunners to clear the ‘boats that are stopped higher up the country.” and that Mr. Spencer and Ensign Dalibar go to command them. –Consultations, 1st December, 1709.
১২ Formerly large boats were built here for the Royal Mogal fleet stationed at Dacca.–Walter Hamilton’s Description of Hindostan, vol. I.p. 193.
১৩ Grant’s Analysis of Finances of Bengal.
১৪ For the support of this fleet the land revenue of Voveral Districts was assigned, amounting to 30,000 Rupees per month, being the expence of the boats and their crews, of whom nearly 1000 were country-born portuguese. –Walter Hamilton’s Descrption of Hindostan, Vol. 1.p. 185.
১৫ Bruce’s Annals of the East India Company, Vol. II.
১৬ Professor C.R. Wilson’s Early Annals of the English in Bengal, Vol. I. p. 347.
১৭ We entirely apuprove of the necessary precaution taken on the Marhatta’s invasion, to prevent surprise by hiring a number of Lascars.
-Letter from the Court of Directors, dated 21st March, 1743.
১৮ With the exception to a few instances of plunder at the out factories, and the occasional stoppage of boats coming down the river with goods, the English suffered little by the invasion of the Marhattas; on the contrary, they were in reality gainers, for the security of the Settlement induced members to come and reside in the town.–Broom’s Bengal Army, Vol, I. p. 41.
১৯ সমসাময়িক ইতিহাস লেখক অৰ্ম্মি স্বপ্রণীত ইতিহাসের দ্বিতীয় খণ্ডের ৫৯ not for FS737ga :–”No resource therefore remained but in their own force which was indeed very inadequate to the contest; for althongh the regular garrison consisted of 264 men, and the inhabitants serving as militia were 250, in all, 514 men, yet only 174 of this number were Europeans, and of these not ten had ever seen any other than the service of the parade; the rest were Topasses, — Armenians and Portuguese inhabitants,–on whose faith or spirit no reliance could be placed. The number of Buxarries, or Indian matchlockmen, were therefore augmented to 1500.”
২০ Such was the state of the town, and the nature of the preparations for defence; to which, it must be added, that the peons or Buxarries, as they were then generally called, were increased to 1500 in number; — but little defendance was be placed on their courage or fidelity.– Broom’s Bengal Army, Vol. I. p. 55.
২১ Such was the origin of the First Regiment of Bengal Native Infantry, called from its equipment the “Lall Pultun” or “Red Regiment,” a name which it long maintained. — Broom’s Bengal Army.
২২ ‘ভারতী’তে প্রকাশিত ‘মীর কাসিম’ ও ‘সাহিত্যে প্রকাশিত মীরজাফর’ শীর্ষক ঐতিহাসিক চিত্রে এই সকল যুদ্ধের আমূল বিবরণ ক্রমশঃ প্রদত্ত হইতেছে।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ – বাঙ্গালীর বাহুবল
বাঙ্গালী স্বভাবতঃ শান্তিপ্রিয়। কিন্তু তাহা বলিয়া বাহুবলের নিতান্ত অভাব ছিল না। হিন্দু ও পাঠান সংঘর্ষের সূচনা হইতে ইংরাজ রাজত্বের আদিযুগ পর্যন্ত তাহার পৰ্য্যাপ্ত প্রমাণ দেখিতে পাওয়া যায়।
সপ্তদশ পাঠান অশ্বারোহী কটাক্ষে বঙ্গবিজয় সুসম্পন্ন করিয়াছিল,–ইহাই বাঙ্গালীর কাপুরুষত্বের নিদর্শন সরূপ সৰ্ব্বত্র উদ্ধৃত হইয়া থাকে। কিন্তু এই জনাপবাদ সম্পূর্ণ অমূলক; অন্যের কথা দূরে থাকুক, মুসলমান ইতিহাস লেখকেরাও এরূপ কথা লিখিয়া যায় নাই। তাঁহারা কেবল এই পৰ্যন্তই বলিয়া গিয়াছেন যে, এক বৎসরের মধ্যেই বঙ্গদেশ মুসলমানের পদানত হইয়াছিল। কিন্তু তাঁহাদের এই উক্তিকেও ঐতিহাসিক সত্য বলিয়া গ্রহণ করা যায় না।
এক বৎসর কেন,–১২০৩ হইতে ১৫৮০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনশত সাতাত্তর বৎসরেও পাঠানেরা সমগ্র বঙ্গভূমির হিন্দু সাম্রাজ্যের উপর অধিকার বিস্তার করিতে পারেন নাই। বঙ্গদেশের একাংশ মাত্রেই পাঠান শাসন প্রবর্তিত হইয়াছিল; অপরাংশে বাঙ্গালীর বাহুবল অক্ষুণ্ণ প্রতাপে স্বদেশের স্বাধীনতা রক্ষা করিতে সক্ষম হইয়াছিল।
পাঠানশাসন সময়ে বাঙ্গালা দেশ দুই ভাগে বিভক্ত হইয়া পড়িয়াছিল; একভাগে হিন্দু, অপর ভাগে মুসলমন শানক্ষমতা পরিচালনা করিতেন, কিন্তু পাঠানেরা যে অংশ করতলগত করিয়াছিলেন, তাহার কোন স্বতন্ত্র নামকরণ না করায়, ইতিহাসে সেই একাংশ মাত্রই সমগ্র বাঙ্গলারাজ্যের স্থান অধিকার করিয়া বসিয়াছে। ইহাতে লোকের মনে এমন ভ্রম জন্মিয়া গিয়াছে যে, নব্যবঙ্গের কত সুলেখক কবিতা বা উপন্যাস রচনাকালে স্বদেশপ্রীতি জাগাইয়া তুলিবার জন্য ১২০৩ খৃষ্টাব্দ হইতে সমগ্র বঙ্গভূমির স্বাধীনতা ধবংশের কালগণনা করিয়া কত না অশ্রু বিসর্জন করিয়া গিয়াছেন!
১২০৩ হইতে ১৫৮০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্তই সাধারণতঃ পাঠান শাসনকাল গণিত হইয়া থাকে। এই সুদীর্ঘ কালেও বাঙ্গালার অধিকাংশ জনপদে হিন্দু-স্বাধীনতা বর্তমান ছিল; পাঠানেরা কেবল মধ্যবঙ্গের সংকীর্ণ জনপদে অধিকার বিস্তার করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন।
পাঠানেরা বাঙ্গালাদেশের যে সকল জনপদে অধিকার বিস্তার করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন, তাহার ইতিহাসও দুই ভাগে বিভক্ত। ১২০৩ হইতে ১৩৪০ খৃষ্টাব্দ পৰ্য্যন্ত পাঠান বিজিত অংশ দিল্লীর পাঠান সম্রাটদিগের রাজ্যভুক্ত থাকিয়া পাঠান রাজপ্রতিনিধি দ্বারা শাসিত হইত। পাঠান শাসনের পূৰ্বাৰ্ধকালকে সেই জন্য প্রকৃত পাঠানশাসন বলা যায় না; তখনও হিন্দুর সহিত পাঠানের সংঘর্ষ নিরস্ত হয় নাই।
কালক্রমে এই যুদ্ধকলহ শান্তিলাভ করিয়া বঙ্গভূমি হিন্দু মুসলমানের জন্মভূমি বলিয়া পরিচিত হইয়াছিল; কিন্তু তখন আর বাঙ্গালাদেশের পাঠানবিজিত অংশও দিল্লীশ্বরের অধিকারভুক্ত রহিল না, তাহা স্বাধীন হইয়া উঠিল। দিল্লীশ্বর এই রাজ্যচ্যুতির গতি রোধ করিতে আসিয়া বাঙ্গালার হিন্দু মুসলমানের সম্মিলিত বাহুবলের নিকট নতশির হইয়া পলায়ন করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন!
এইরূপে বঙ্গদেশে স্বাধীন পাঠান-শাসন প্রবর্তিত হইলে কেবল যে পাঠান ভূপতিগণই নিরন্তর সিংহাসনে উপবেশন করিয়া হিন্দু মুসলমানের উপর রাজদণ্ড পরিচালনা করিয়াছিলেন, তাহাও সত্য নহে। যখন যাঁহার বাহুবল প্রবল হইত, তিনিই তখন গৌড়াধিপতি হইয়া সিংহাসনে আরোহণ করিতেন। এইরূপে কখন হিন্দু, কখন মুসলমান, কখন বা হাবশী ক্রীতদাস পৰ্য্যন্তও গৌড়াধিপতির রাজসিংহাসন অলঙ্কৃত করিয়া গিয়াছেন। ১৩৮৫ হইতে ১৪০৮ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত এয়োবিংশ বর্ষ বাঙ্গালা দেশের পাঠান বিজিতাংশ হিন্দু রাজা কংস ও তৎপুত্র চেক্সপ্লের শাসনাধীন হইয়াছিল। চেক্সল্ল মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করিয়া বাংলার ইতিহাসে জালালুদ্দীন নামে অদ্যাপি পরিচিত হইয়া রহিয়াছে।
মোগল গৌরবরবি মহাত্মা আকবর শাহের শাসন সময়ে মহারাজ টোডরমল্লের প্রতিভাগুণে বাংলাদেশের কিয়দংশে মোগলশাসনে প্রবর্তিত হয়; কিন্তু টোডরমল্ল স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করায় মোগলপতাকা উৎখাত হইয়া পড়িয়াছিল। মহারাজ মানসিংহ পুনরায় মোগলশাসন প্রবর্তিত করিয়া ১৫৮৯ হইতে ১৬০৫ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত সপ্তদশ বর্ষ বঙ্গদেশ শাসন করিয়াছিলেন।
মানসিংহকেও অনেক যুদ্ধ যুঝিতে হইয়াছিল, এবং তাঁহার সময়েও বঙ্গদেশের উত্তর পূর্বাংশের অধিকাংশ জনপদ মোগলের পদানত হয় নাই। মানসিংহ বাঙ্গালী হিন্দু মুসলমানের বাহুবলের পরিচয় পাইয়াছিলেন; বাঙ্গালী কায়স্থ কুলতিলক মহারাজ প্রতাপাদিত্য বাঙ্গালীর বাহুবলের যেরূপ পরিচয় দিয়াছিলেন, তাহা অদ্যাপি অনেকের বিস্ময়ের বিষয় হইয়া রহিয়াছে।
মোগল শাসনে বাঙ্গালীর বাহুবল অবসন্ন না হইয়া নানা কারণে উত্তরোত্তর প্রবল হইয়া উঠিয়াছিল। যে সকল মুসলমান বীরপুরুষেরা বাঙ্গালা দেশে জায়গীর প্রাপ্ত হইয়াছিলেন, তাঁহাদের এবং মহারাজ মানসিংহের ক্ষত্রিয় সেনার বংশধরগণ বাঙ্গালা দেশে বসতি করিয়া বাঙ্গালীর বাহুবল বৃদ্ধি করিয়া দিয়াছিলেন।
বাঙ্গালাদেশের মধ্যে বিষ্ণুপুর ও বীরভূমি বাহুবলের জন্য সবিশেষ বিখ্যাত হইয়া উঠিয়াছিল। মোগল শাসনের অধঃপতন দিনে বাঙ্গালী রাজা ও জমিদারবর্গ বাহুবলে আত্মরক্ষা করিবার জন্য বহুল পরিমাণে সেনাপোষণ করিতেন। বর্গীর হাঙ্গামায় ব্যতিব্যস্ত হইয়া নবাব আলিবর্দী এই সকল সেনার সহায়তা গ্রহণ করিতেন এবং বাঙ্গালীর বাহুবল সম্বল করিয়াই অনেকবার মহারাষ্ট্রদলনে কৃতকাৰ্য্য হইয়াছিলেন।৩।
সিরাজদ্দৌলা কলিকাতা অধিকার করিবার পর কিছুদিন পর্যন্ত ইংরাজদিগকে যৎপরোনাস্তি নাস্তানাবুদ হইতে হইয়াছিল! তাঁহাদের বাণিজ্য ব্যবসায় বন্ধ হইয়া গিয়াছিল; কলিকাতা ও মফস্বল কুঠির ইংরাজ কর্মচারীগণ ফলতার বন্দরে সম্মিলিত হইয়া নিরন্তর হা হুতাশে কালযাপন করিতেছিল।
এই সময়ে ফরাসি সমরশঙ্কায় ইংরাজেরা এতদূর ব্যাকুল হইয়া উঠিয়াছিলেন যে, মান্দ্রাজের ইংরাজমণ্ডলী কলিকাতার ধবংসবার্তা শ্রবণ করিয়াও সহসা কোন প্রতিকারের পথ আবিষ্কার করিতে পারেন নাই। অবশেষে অনেক তর্কবিতর্কের পর বাঙ্গালার বাণিজ্য ব্যবসায় পুনঃসংস্থাপনার্থ সেনাপতি ক্লাইব এবং ওয়াটসনের উপর কাৰ্য্যভার ন্যস্ত হয়।
ক্লাইব এবং ওয়াটসন ১৭৫৬ খৃষ্টাব্দের ১৬ই অক্টোবর ৯০০ গোরা এবং ১২০০ তেলেঙ্গা সিপাহী লইয়া মাদ্রাজের বন্দরে পোতারোহণ করেন। তৎকালে মাদ্রাজের ইংরাজ দরবার পুনঃ পুনঃ বুঝাইয়া দিয়াছিলেন যে, ফরাসি-সমরশঙ্কা প্রবল হইয়া উঠিতেছে; যত শীঘ্র সম্ভব বাঙ্গালার গোলযোগের মূলোচ্ছেদন করিয়া ক্লাইবকে সসৈন্যে মান্দ্রাজে প্রত্যাবর্তন করিতে হইবে।
প্রতিকূল পবন পীড়নে “কম্বরল্যাণ্ড’ এবং ‘মারলররা’ নামক দুইখানি রণপোত বঙ্গোপসাগরে নিরুদ্দেশ হইয়া গেল; অবশিষ্ট রণপোতারোহী অত্যল্প সেনার সমভিব্যাহারে ক্লাইব এবং ওয়াটসন বঙ্গদেশে উপনীত হইলেন।
এই সকল কারণে ক্লাইব বঙ্গদেশে পদার্পণ করিযা মাত্র সেনাবল বৃদ্ধি করিতে সমুৎসুক হন। ইহাতে তাঁহার ভবিষ্যসৃষ্টির পরিচয় প্রাপ্ত হইয়া ইংরাজ লেখকগণ তাঁহাকে অজস্র ধন্যবাদ প্রদান করিয়া গিয়াছেন।
ক্লাইব কিন্তু নিতান্ত নিরূপায় হইয়াই বাঙ্গালা দেশে সেনা সংগ্রহের সংকল্প করিয়াছিলেন। এরূপ উপায় অবলম্বন না করিলে তাঁহাকে অচিরে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করিতে হইত। ক্লাইবের একখানি পত্রে দেখিতে পাওয়া যায় যে, কলিকাতা দুর্গ রক্ষার ব্যবস্থা করিতে পারিলেই তিনি মাদ্রাজে প্রত্যাবর্তন করিবেন বলিয়া স্থির সংকল্প করিয়াছিলেন।
কলিকাতা ও তন্নিকটবর্তী স্থানে যুদ্ধ ব্যবসায়ী লোকের অভাব ছিল না। ক্লাইব ইহাদিগের মধ্যে বাছিয়া বাছিয়া তিন চারি শত লোক লইয়া ১৭৫৭ খৃষ্টাব্দের জানুয়ারী মাসে প্রথম দল “লাল পল্টন” গঠন করেন। ইহারা শৌর্য্যে বীর্য্যে কাহারও নিকট হীন না হইলেও, সমরকৌশলে সুশিক্ষিত গোরাসৈন্যের নিকট দাঁড়াইতে পারিত না। এই অভাব দূর করিবার জন্য ক্লাইব ইহাদিগকে ইউরোপীয় প্রথায় সমরকৌশল শিক্ষা দিবার আয়োজন করেন।
স্বাভাবিক শৌর্যবীর্য্যের সহিত শিক্ষালব্ধ সমরকৌশল মিলিত হইয়া ক্লাইবের “লাল পল্টনকে” অল্পদিনের মধ্যেই দেশবিখ্যাত করিয়া তুলিয়াছিল। ইহাদের দৃষ্টান্তের অনুকরণ করিয়া বোম্বাই এবং মাদ্রাজ প্রদেশেও উত্তরকালে বহুসংখ্যক দেশীয় সিপাহী সেনা সংগৃহীত হইয়াছিল।
এই লাল পল্টন দলে যাহারা প্রবেশ লাভ করিয়াছিল তন্মধ্যে দুই চারি জন জাঠ এবং রাজপুতেরও উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। ইহা হইতেই কেহ কেহ সিদ্ধান্ত করিয়া বসিয়াছেন যে, “লাল পল্টনে” একজনও বাঙ্গালী প্রবেশ লাভ করে নাই। এরূপ একদেশদর্শী সঙ্কীর্ণ মতের প্রতিবাদ করা শোভা পায় না। যে সময়ে “লাল পল্টনের” অ্যুদয় হয়, তৎকালে ইংরাজদিগের পক্ষে উত্তর পশ্চিমাঞ্চল হইতে সেনা সংগ্রহ করিয়া আনিবার সম্ভাবনা ছিল না। তাঁহারা সিরাজদ্দৌলার বিরুদ্ধে খড়গধারণ করিবার সময়ে তাঁহার অগোচরে কলিকাতায় বসিয়াই তাড়াতাড়ি “লাল পল্টন” সংগ্রহ করিয়াছিলেন;-বাঙ্গালী ভিন্ন আর কাহারা আসিয়া সেই অত্যল্প সময়ের মধ্যে পল্টনদল বৃদ্ধি করিবে?
লাল পল্টনের সিপাহী সেনার শৌর্যবীর্য ও সমরকৌশলের কথা ইতিহাসে সমুচিত সমাদর লাভ করে নাই, তাহার প্রধান কারণ বাঙ্গালী সাহিত্য-সেবকদিগের ঐতিহাসিক তত্ত্বালোচনায় অপরিসীম ঔদাস্য! সদাশয় বৃটিশ বণিকসমিতি কিন্তু তাহাদের বীরকীৰ্ত্তির সমুচিত পুরস্কার প্রদান করিবার জন্য উত্তরকালে হতাবশিষ্ট জরাপালিত রুগ্ন সিপাহীগণকে মালদহ প্রদেশে ৩৩৮০ বিঘা নিষ্করভূমি প্রদান করিয়া গিয়াছিলেন; এখন তাহা মসিজীবী কুসীদ ব্যবসায়ী দুৰ্ব্বল বাঙ্গালীর বিলাস বাসনা চরিতার্থ করিবার জন্য নীরবে হলচালনা সহ্য করিতেছে!
প্রদীপ, ফাল্গুন ১৩০৪
তথ্যসূত্র
১ After the capture of Gour, the Mahomedans were unable to extend their dominion over the whole Hindoo Kingdom of Bengal, not only towards the North and East. But even towards the West; nor did they obtain possession of the whole, as it is constituted at present, until a late period of the Mogul Government. –Walter Hamilton’s Description of Hindoostan, Vol. I, 115.
২ Stewarts’ History of Bengal.
৩ At the time when the Nabab was engaged in conflict with the Marhattas he quested his dependent kings to give him every support in their power. Accordingly the Raja of Bisbnupur despatched a band of his bravest heroes to the assistance of the Nabab. By their valour the Marhattas were subdued; and from that time, the Rajah of Bisnupur was the most renowned of the tributary kings of the Nabab. –W.W. Hunter’s Statistical Accounts of Bengal, Vol. IV. p. 233.
8 Orme’s Indostan, Vol. II.
৫ Another point to which clive turned his attention, with that wonderful discrimination and foresight which peculiarly marked his character, was the organisation of an efficient Native regualar force. — Broome ́s Bengal Army, Vol. I, 92.
৬ Sir John Malcolnis Lord Clive, Vol. I.
৭ This system which was soon found to answer admirably, was speedily imitated at the other Predidencies of Bombay and Madas. — Broome’s Bengal Army, Vol. I p.93.
৮ In the corps then and subsequently raised in and about Calcutta, were to be found Pathans Rosillas, a few Jaths, some Rajpoots and even Brahmins. — Captain Broome’s Bengal Army, Vol. I.p. 93.
৯ A plot of ground Mouza Mohunpur, within pergana Shikarpur, containing about 3380 bigas or 1127 acres, was asigned in the time of Lord Cornwalis for the support of an invalid Sepoy establishment. The lands wehre thus apportioned :-1 Jamadar 200 bighas. 2 habildars at 120 bighas. 3 Naiks at 120 bighas, 33 Sepoys at 80 bighas. –W. W. Hunter’s Statistical Account of Bengal, Vol. VII. p. 83.
চতুর্থ পরিচ্ছেদ – বাঙ্গালীর প্রভুভক্তি
Whilst the Bengal Army continues in existence, so long should his (Clive’s) name be mentioned by its members, with reverence and affection, as its founder, supporter and best friend. –Captain Arthur Broome.
কাৰ্য্যোদ্ধার করিতে হইলে কাৰ্যসাধনোপযোগী পাত্র নির্বাচন করিতে হয়। ইহাতেই প্রতিভার প্রকৃত শক্তি প্রকাশিত হইয়া থাকে। লাল-পল্টনের গঠনকার্যে ক্লাইবের প্রতিভা এইরূপে প্রকাশিত হইয়াছিল।
ক্লাইব অত্যল্প সেনা সমভিব্যাহারে বঙ্গদেশে উপনীত হইয়াছিলেন। “মারলবরা” নামক পথভ্রষ্ট রণপোত কলিকাতায় উপনীত হইবার পরেও তাঁহার সেনাদল সমধিক পুষ্টিলাভ করিতে পারে নাই। ১৭৫৭ খৃষ্টাব্দের প্রারম্ভে ৭০০ ইউরোপীয় পদাতিক, ১০০ ইউরোপীয় গোলন্দাজ এবং ১৫০০ কালাসিপাহী ভিন্ন ক্লাইবের পৃষ্ঠরক্ষার্থ আর কোন সেনাদল বর্তমান ছিল না। ইহাদের মধ্যে তিনশত লোক নবসংগৃহীত লাল-পল্টনভুক্ত বাঙ্গালী সিপাহী; তাহারা তখন ইউরোপীয় সমর কৌশল শিক্ষা করিতেছিল।
কলিকাতার পুনরুদ্ধার সাধন করিবামাত্র ইংরাজেরা বাহুবলের পরিচয় দিবার জন্য হুগলী লুণ্ঠন করিয়া আসিয়াছিলেন। সিরাজদ্দৌলা তাহাতে উত্যক্ত হইয়া ইংরাজদিগকে শিক্ষা দিবার অভিপ্রায়ে সসৈন্যে কলিকাতা আক্রমণ করেন। ২রা ফেব্রুয়ারী সিরাজবাহিনী কলিকাতার নিকটবর্তী হইলে, ক্লাইব তাঁহার গতিরোধ করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। সে চেষ্টা ফলবতী হইল না; বরং সেনাপতি ক্লাইবের ক্ষুদ্র সেনাদল এবং পার্শ্বচরদিগের মধ্যে অনেকে পঞ্চত্ব লাভ করিলেন।
অতঃপর নিশারণে সিরাজদ্দৌলার সর্বনাশ করিবেন বলিয়া ক্লাইব আর একবার চেষ্টা করিয়া দেখিয়াছিলেন। ইহাতেও তাঁহার মনস্কামনা সফল হইল না; বহুসংখ্যক ইংরাজ-সেনা পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইল; অবশেষে বৃটীশ বাহিনীকে দুর্গাভিমুখে পলায়ন করিতে হইল!
এই উভয় যুদ্ধেই বঙ্গীয় লাল-পল্টন উপস্থিত ছিল না; তাহারা তখনও সংখ্যায় নগণ্য এবং রণকৌশল শিক্ষায় নিযুক্ত ছিল। নিশারণে লাল-পল্টনের উপর ইংরাজ শিবির রক্ষার ভার নিক্ষিপ্ত হইয়াছিল; সেই জন্য তাহারা কাশীপুরে ইংরাজশিবিরে প্রহরীর কাৰ্যে নিযুক্ত ছিল।
সিরাজবাহিনীর গতিরোধ করিতে না পারিয়া ক্লাইব সিরাজদ্দৌলার সহিত সন্ধি সংস্থাপন করেন। ইহারই নাম “আলিনগরের সন্ধি।” ইহার জন্য সমসাময়িক ইংরাজদিগের নিকট ক্লাইবকে নানারূপ গঞ্জনা লাভ করিতে হয়।
আলিনগরের সন্ধির পূৰ্ব্ব পৰ্য্যন্ত ইংরাজগণ যে বাহুবলে বলীয়ান বলিয়া অহঙ্কার করিতে পারেন নাই, এই সকল ঐতিহাসিক ঘটনাই তদ্বিষয়ের প্রধান প্রমাণ। অতঃপর আত্মপক্ষ সবল করিবার জন্য ক্লাইবের বিলক্ষণ উৎকণ্ঠা উপস্থিত হইয়াছিল। মান্দ্রাজ হইতে সেনাদল প্রাপ্ত হইবার সম্ভাবনা ছিল না; বিলাত হইতেও বহুসংখ্যক গোরা পল্টন আসিবার আশা ছিল না। অগত্যা বঙ্গদেশে সেনা সংগ্রহ করা ভিন্ন উপায়ান্তর ছিল না।
ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বিলাতের অধ্যক্ষ সভার সভাপতি মিঃ পেইন ক্লাইবকে যে পত্র লিখেন, তাহাতে স্পষ্টই দেখিতে পাওয়া যায় যে, কোম্পানী বাহাদুর ইংলণ্ড, স্কটলণ্ড, আয়র্লণ্ড এবং জর্মণি দেশে সেনা সংগ্রহের চেষ্টা করিয়াও সফলকাম হইতে পারেন নাই; অবশেষে তাঁহাদের দুর্গতি দর্শনে ইংলণ্ডেশ্বর কৃপা-পরবশ হইয়া এক সহস্র গোরা পদাতিক সংগ্রহ করিয়া দিতে চাহিয়াছিলেন। এই গোরা পদাতিকও ভারতবর্ষে শীঘ্র উপনীত হইবার সম্ভাবনা ছিল না!
এই সকল কারণে ১৭৫৭ এবং ১৭৫৮ খৃষ্টাব্দে ক্লাইব চারিদল “লাল-পল্টন” গঠন করেন। ইহার প্রথম, দ্বিতীয় এবং চতুর্থ দল কলিকাতায় সংগৃহীত বঙ্গবাসী সিপাহী, এবং তৃতীয় দল পাটনায় সংগৃহীত ভোজপুরিয়া সিপাহী। পলাশির যুদ্ধের পূৰ্ব্বে প্রথম দল এবং পলাশির যুদ্ধের পরে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ দল “লাল পল্টন” গঠিত হইয়াছিল।
ক্লাইব প্রথম সংখ্যক “লাল-পল্টন” গঠন করিবার পর হইতে ইংরাজেরা উত্তরোত্তর সকল যুদ্ধেই জয়যুক্ত হইতে লাগিলেন। চন্দননগর অধিকারে এবং পলাশির যুদ্ধাভিনয়ে বঙ্গীয় লাল-পল্টন বীরত্ব প্রদর্শনে ত্রুটি করে নাই।
কোন কোন ইতিহাস-লেখক পলাশির যুদ্ধকে যুদ্ধ বলিয়া বর্ণনা করেন নাই; তাঁহারা বলেন, উহা যুদ্ধাভিনয় মাত্র। যাহাই হউক, উক্ত যুদ্ধাভিনয়ক্ষেত্রে যাহারা ইংরাজপক্ষে অস্ত্রধারণ করিয়াছিল, তন্মধ্যে বঙ্গীয় প্রথম সংখ্যক লাল-পল্টন বর্তমান ছিল বলিয়া আজ পর্যন্তও বঙ্গীয় প্রথম সংখ্যক কালা সিপাহীরা রণপতাকায় “পলাশির” নাম ব্যবহার করিয়া আসিতেছে।
পলাশির যুদ্ধের পর ইংরাজদিগের কপাল ফিরিয়া গেল; তাঁহারা সিরাজদ্দৌলার আমলে যে সকল পাত্র-মিত্রের কৃপা কটাক্ষের আশায় সসম্ভ্রমে দণ্ডায়মান হইতেন, তাঁহারাই ইংরাজের কৃপাভিক্ষার জন্য ক্লাইবের কণ্ঠলগ্ন হইয়া পড়িলেন। অবস্থা-বিবর্তনে ইংরাজের স্কন্ধে গুরুতর কর্তব্যভারও নিক্ষিপ্ত হইল। পশ্চিমে পাটনা অঞ্চলে রাজা রামনারায়ণ, দক্ষিণে মেদিনীপুর অঞ্চলে রাজা রামরাম সিংহ, উত্তরে পূর্ণিয়া অঞ্চলে অখিল সিংহ এবং পূৰ্ব্বে ঢাকা অঞ্চলে আহমানী খাঁ বাহুবলে বলীয়ান হইয়া মীর জাফরের অধীনতা স্বীকার করিতে অসম্মত হওয়ায়, পলাশির যুদ্ধের পরিণাম ফল নষ্ট হইবার উপক্রম হইয়া উঠিল। এই সময়ে ক্লাইব অনন্যোপায় হইয়া (১৭৫৭ খৃষ্টাব্দের আগষ্ট মাসে) দ্বিতীয় দল “লাল-পল্টন” গঠন করিলেন।
প্রথম এবং দ্বিতীয় সংখ্যক “লালপলটন” ক্লাইবেরই দক্ষিণ ও বাম বাহুর ন্যায় তাঁহার আজ্ঞাকারী হইয়া যে সকল বীরকীৰ্ত্তি সংস্থাপন করিয়াছিল তাহা দুই ভাগে বিভক্ত। অন্তৰ্বিপ্লবের শান্তিসাধন করিয়া মীর জাফরের সিংহাসন আপন্মুক্ত করিতে যে সকল ইংরাজসেনা জীবন বিসর্জন করে তন্মধ্যে প্রথম এবং দ্বিতীয় সংখ্যক “লাল পলটন’ই প্রধান; ফরাশিশক্তি চূর্ণবিচূর্ণ করিয়া সমুদ্রোপকূলে মান্দ্রাজ হইতে কলিকাতা পর্যন্ত যাহারা ইংরাজরাজশক্তি প্রতিষ্ঠিত করিয়া দেয়, তন্মধ্যেও প্রথম এবং দ্বিতীয় সংখ্যক “লাল পলটনই” প্রধান।
দ্বিতীয় সংখ্যক লালপল্টন ১৭৫৭ খৃষ্টাব্দের অক্টোবর মাসেই যুদ্ধোপযোগী শিক্ষালাভ করে। তখন হইতে প্রথম ও দ্বিতীয় সংখ্যক বঙ্গীয় সিপাহীদল বাংলার ইতিহাসে সৰ্ব্বত্র গৌরবান্বিত হইয়া উঠিল।
নবাব আলিবর্দী যখন সরফরাজ খাঁকে নিহত করিয়া সিংহাসনে আরোহণ করেন, তৎকালে সরফরাজের দুইটি শিশু সন্তান বর্তমান ছিল। তন্মধ্যে কনিষ্ঠের নাম আহমানী খাঁ। তিনি পলাশির যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই বাহুবলে ঢাকার সিংহাসন অধিকার করিবার আয়োজন করিয়াছিলেন। তাঁহার চেষ্টা সফল হইলে মীরজাফর এবং ইংরাজগণকে সমূলে বিনষ্ট হইতে হইত। আহমানী খাঁ গোপনে গোপনে ঢাকা আক্রমণ করিবার আয়োজন করিয়াছিলেন। তৎকালে ঢাকায় দুই শত মাত্র সিপাহী থাকিত। তাহাদিগকে পরাজয় করিয়া সিংহাসন অধিকার করা কিছুমাত্র কঠিন হইত না। কিন্তু ইংরাজেরা ইহার সন্ধান লাভ করিবামাত্র প্রথম সংখ্যক লাল-পল্টনের একদল সিপাহী ঢাকা অঞ্চলে প্রেরণ করায় ঢাকার বিদ্রোহ সহজেই শান্তিলাভ করিল।
পাটনার বিদ্রোহ সহজে নিবারিত হইল না; তজ্জন্য ক্লাইবকে স্বয়ং সসৈন্যে পাটনা যাত্রা করিতে হইল। এই বিদ্রোহ নিবারিত না হইলে যে ইংরাজেরা বহুদিন বাংলা দেশে তিষ্ঠিতে পারিবেন না, দুর্ভাগ্যক্রমে অল্প লোকেই সে কথা হৃদয়ঙ্গম করিতে সক্ষম হইলেন। ক্লাইবের অধীনে যে সকল রাজকীয় গোরাদল ছিল তাহারা পাটনা যাত্রা করিতে একেবারেই অসম্মত হইল!
অ্যাডমিরাল ওয়াটসন তাঁহার জাহাজী গোরাদল পাটনায় পাঠাইবার অনুমতি করিয়াছিলেন; কিন্তু ক্লাইব তাহা গ্রহণ করিলেন না। তিনি বীরোচিত দৃঢ়তার সহিত রাজকীয় গোরাদলকে প্রত্যাখ্যান করিয়া কোম্পানীর বেতনভোগী সেনা লইয়াই পাটনা যাত্রা করিলেন। এই সময় ক্লাইব ওয়াটসনকে যে পত্র লিখিয়াছিলেন তাহাতে কোম্পানীর সেনাদলের প্রভুভক্তির পরিচয় প্রদত্ত হইয়াছিল। ক্লাইবের পত্রখানি এইরূপ :
Notwithstanding your offer of putting the King’s detachment under my command on this expedition, I am sorry to inform you I can not accept it without prejudicing the service; for all the officers (Captain Weller and Captain Coote excepted) had expressed by a letter a disinclination to go upon it. Under these circumstances, I think it is better for the Company to be served by those who are willing, and may he attached to their service, than by persons who seem to have lost all remembrance of what they owe to them.
ক্লাইভ যে ক্ৰোধান্ধ হইয়া এইরূপ পত্র লিখিয়াছিলেন, তাহাতে সন্দেহ নাই; কিন্তু তাঁহার ক্রোধেরও বিশেষ কারণ ছিল। সিরাজদ্দৌলার পরাজয় সাধনের পর ফরাসি সেনানায়ক মসিয় লাসের পশ্চাদ্ধাবনের জন্য মাদ্রাজী কালা সিপাহী ও গোরা পল্টন লইয়া মেজর কূট পাটনা অঞ্চলে গমন করিয়াছিলেন। তৎকালে গোরা এবং মাদ্রাজী কালা সিপাহীগণ বিদ্রোহী হইয়া মেজর কূটকে বিলক্ষণ বিপদে ফেলিয়া দিয়াছিল। মেজর সাহেব গোরাদলের মতি পরিবর্তনের কোন সুলক্ষণ না দেখিয়া তাহাদিগকে পথিমধ্যে বিশ্রামের আদেশ প্রদান করিয়া মাদ্রাজী কালা সিপাহী লইয়াই অগ্রসর হইয়াছিলেন । কিন্তু তাহারাও আর অগ্রসর হইবে না বলিয়া সকলে একবাক্যে অস্ত্রত্যাগ করিয়াছিল!৬
ক্লাইব এই সকল কারণে রাজকীয় গোরাদল এবং মাদ্রাজী সিপাহী পরিত্যাগ করিয়া কোম্পানীর বেতনভোগী প্রভুভক্ত সেনাদল লইয়া যুদ্ধযাত্রা করিয়াছিলেন। যাহারা এই যুদ্ধযাত্রায় ক্লাইবের অনুগমন করে তাহারা কোম্পানীর গোরাপল্টন এবং প্রথম ও দ্বিতীয় সংখ্যক বঙ্গীয় লালপল্টন। সামরিক ইতিহাসে দেখিতে পাওয়া যায় যে এই উপলক্ষে ৫৫০ গোরা এবং প্রথম ও দ্বিতীয় সংখ্যক লাল পল্টনভুক্ত ১৫০০ সিপাহী ক্লাইবের অনুগমন করিয়াছিল!
১৭৫৮ খৃষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে পাটনা প্রদেশে শান্তি সংস্থাপিত হইযা মাত্র ক্লাইব পাটনা রক্ষাৰ্থ তৃতীয়সংখ্যক লাল-পল্টন গঠন করিয়া প্রথম ও দ্বিতীয় সংখ্যক লালপল্টন সমভিব্যাহারে কলিকাতায় প্রত্যাবর্তন করেন। তৃতীয় সংখ্যক লাল পল্টনে বাঙ্গালী ছিল না; ভোজপুর অঞ্চলের লোক লইয়া এই পল্টনদল গঠিত হইয়াছিল। এই পল্টনদল মীরকাসিমের আমলে পাটনা অঞ্চলেই বিনাশপ্রাপ্ত হয়।
ক্লাইব লাল-পল্টনের প্রভুভক্তি ও সমর-নিপুণতার পরিচয় প্রাপ্ত হইয়া কলিকাতায় প্রত্যাবর্তন করিবার পর ১৭৫৮ খৃষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে চতুর্থদল লাল-পল্টন গঠন করেন।
অতঃপর তৃতীয় দল লাল-পল্টন পাটনায় এবং চতুর্থদল বঙ্গদেশে নিযুক্ত রাখিয়া প্রথম ও দ্বিতীয় সংখ্যক লাল পল্টনকে মাদ্রাজ অঞ্চলে প্রেরণ করা হইয়াছিল তাহারা কোম্পানীর লবণের মর্যাদা রক্ষার্থে সমুদ্রপথে মাদ্রাজযাত্ৰা করিতেও ইতস্ততঃ করে নাই।১০
প্রদীপ, চৈত্র, ১৩০৪
তথ্যসূত্র
১ In nothing does the power of genius more strikingly display itself
than in the selection of persons most fit to be employed, and in the application of their peculiar talents to the work for which they are suited. –Sir John Malcolm’s Memoirs of Lord Clive, Vol. I. p. 323.
২ ইহার বিস্তৃত বিবরণ ‘সিরাজদ্দৌলা’ শীর্ষক ঐতিহাসিক চিত্রে প্রদত্ত হইয়াছে।
৩ After being disappointed in various attempts for raising recruits in Germany, Ireland, Scotland and England, His Majesty has been pleased to order us a battalion of about 1000 men out of the new regiments Mr. Payne’s letter to Clive, dated 11 November, 1757.
8 Clive’s letter to Admiral Watson.
৫ During the whole of this march the Europeans hade xpressed great discontent, and latterly began to evince a very mutinous spirit, — Broome’s Bengal Army, Vol. I. 170.
৬ Having determined to continue his pursuit of the Fench party, Major Coote had paraded the troops in the afternoon, preparatory to a march, when the Sipahis in a body laid down their arms, and refused to proceed further, — Broome’s Bengal Army, vol. I. p. 173.
৭ The detachment under his command now consisted of little more than 550 Europeans, including the company of Artillery with a detail of Lascars attached, and the 1st and 2nd Battalions of Sipahis, amounting to about 1500 men.–Broome ́s Bengal Army, Vol. I. p. 191.
৮ Broome’s Bengal Army, Vol. I, p. 199.
৯ Ditto, Vol I, p. 205
১০ Orme’s Indostan, Vol. II.
পঞ্চম পরিচ্ছেদ – সমুদ্রযাত্রা
This is the first occasion on which the Bengal Sipahis were required to serve beyond sea, and not the slighitest objection appears to have been made, on their part, to so doing-Captain Broome.
মীরজাফরের সৌহার্দগুণে ইংরাজেরা বঙ্গদেশ হইতে ফরাসিদিগকে বহিষ্কৃত করিয়া আত্মশক্তি সুবিস্তৃত করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন। ফরাসিরাও ইতিপূর্বে নিজামের সৌহার্দগুণে ইংরাজদিগকে বহিষ্কৃত করিয়া “উত্তর সরকার” নামক বঙ্গোপসাগর কূলের ১৭০০০ মাইল পরিমিত বিস্তীর্ণ জনপদে ফরাসিরাজ্য সংস্থাপন করিয়া চিল্কা হ্রদ হইতে কৃষ্ণাতীর পর্যন্ত ফরাসির জয়পতাকা উড্ডীন করিয়া দিয়াছিলেন।
বঙ্গদেশে ইংরাজ ও দাক্ষিণাত্যে ফরাসি,–এই দুই প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতবর্ষে আত্মাধিকার সংস্থাপন করিবার জন্য লালায়িত; এরূপ ক্ষেত্রে কেহ কাহারও নিকট হীন হইতে চাহিতেন না। ইহার জন্য উভয়ের মধ্যে সৰ্ব্বদাই কলহ বিবাদ উপস্থিত হইত।
দেশের লোকে দশের জন্য ভাবিত না, দেশের জন্যও হায়! হায়! করিয়া সভাসমিতি আহ্বান করিত না; মোগলসাম্রাজ্যের অধঃপতনকাল নিকট দেখিয়া সকলেই,–যে কোনোরূপে হউক,–আপনার গণ্ডী বুঝিয়া লইবার জন্যই লালায়িত হইত! সেই উদ্দেশ্যে সকলেই ফরাসি অথবা ইংরাজ এতদুভয়ের একদলের শরণাগত হইতে আরম্ভ করিয়াছিল, এবং তৎসূত্রে বিদেশীয় বণিকসমিতি দেশের লোকের গৃহবিবাদের সূক্ষ্মছিদ্রপথ দিয়া ধীরে ধীরে ভারত সাম্রাজ্যে আত্মাধিকারের মূল প্রবিষ্ট করাইয়া দিবার সুবিধা পাইতেছিল! এইরূপে ফরাসিরা নিজাম-দরবারে এবং ইংরাজেরা নবাব-দরবারে সর্বেসর্বা হইয়া উঠিয়াছিলেন; দাক্ষিণাত্যে ফরাসিবীর মারকুইস-ডি-বুশী, এবং বঙ্গদেশে লেফটেনেন্ট কর্ণেল ক্লাইব দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হইয়া তাঁহাদের শুভদৃষ্টি লাভ করিবার জন্য সকলেই উদগ্রীব হইয়া উঠিয়াছিল।
১৭৫৩ হইতে ১৭৫৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ছয় বছর দাক্ষিণাত্যে ফরাসিশক্তি এতদূর বৰ্দ্ধিত হইয়া উঠিয়াছিল যে, ফরাসি সেনানায়ক মসিয় মোরার্সি ১৫০ ইউরোপীয় এবং ২৫০০ কালা সিপাহী লইয়া মছলিপত্তনের দুর্গে বসিয়া “উত্তর-সরকার’ প্রদেশের বিস্তীর্ণ জনপদে ফরাসিশাসন সংস্থাপন করিতেছিলেন;–বিজয়নাগ্রামের জমিদার বিজয় রামরাজী ফরাসির শুভদৃষ্টি লাভ করিয়া ফরাসিরাজ্যের ইজারাদার হইয়া ফরাসির রাজ্যবিস্তারের সহায়তা করিতেছিলেন। প্রজা সুখে ছিল; রাজী সাহেবও সুশাসন করিতেন; সুতরাং উক্ত জনপদের প্রজাপুঞ্জ ফরাসির অনুরক্ত হইয়া উঠিতেছিল!
১৭৫৮ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে সহসা ইহার পরিবর্তন ঘটিবার সূত্রপাত হইল। তখনও কৃষ্ণা নদীর দক্ষিণে স্থানে স্থানে ইংরাজদিগের বাণিজ্যালয় বর্তমান ছিল; সেগুলিও কুক্ষিগত করিবার জন্য ফরাসিদিগের লোভ উপস্থিত হইল। বিখ্যাত ফরাসি সেনাপতি লালী বহু সংখ্যক ইউরোপীয় সেনা সমভিব্যাহারে ভারতবর্ষে পদার্পণ করিয়া এই নীতির সূত্রপাত করিলেন। তাঁহার আদেশে মসিয় মোরাসিঁকে মছলিপত্তন ছাড়িতে হইল, মারকুইস বুশীকে হায়দ্রাবাদের নিজাম দরবার হইতে চিরবিদায় গ্রহণ করিতে হইল;–অধিকাংশ সৈন্যসামন্তসহ এই সকল পুরাতন রাজকর্মচারীগণকে নূতন রাজ্য সংস্থাপনার্থ কৃষ্ণানদীর দক্ষিণস্থ প্রদেশে লালীর সহায়তা সাধনের জন্য গমন করিতে হইল; “উত্তর সরকার প্রদেশের শাসনভার মারকুইস-ডি-কনফ্লাঁ নামক নবাগত ফরাসি সেনানায়কের উপর সমর্পিত হইল। ইতিহাস লেখকেরা বলেন, ইহাই ফরাসির অধঃপতনের মূল।
বিজয় রামের স্বর্গারোহণের পর আনন্দরাজ গজপতি উত্তর সরকারের ফরাসিরাজ্যের ইজারাদার হইয়াছিলেন। তিনি এই সুযোগে স্বাধীনতা লাভ করিবার জন্য ব্যাকুল হইয়া ইংরাজাদিগের শরণাপন্ন হইলেন, এবং ফরাসির অধীনতা স্বীকার করিয়া ভিষকপত্তন নামক বঙ্গোপসাগরকূলের বন্দরে ইংরাজের রণপতাকা উড্ডীন করিয়া দিলেন।
আনন্দরাজ গজপতি যখন কলিকাতার ইংরাজদরবারে দূত প্রেরণ করেন, বঙ্গদেশের অন্তর্বিপ্লব তখনও সম্পূর্ণরূপে শান্তি লাভ করে নাই। এরূপ অবস্থায় দরবারের সদস্যগণ কলিকাতা হইতে সেনা প্রেরণ করিতে সাহসী হইলেন না। কর্ণেল ক্লাইব তখন কলিকাতার কর্তা; কিন্তু তিনি এমন সুযোগ সহজে পরিত্যাগ করিতে সম্মত হইলেন না।
ফরাসিবীর লালী কৃষ্ণানদীর দক্ষিণস্থ সমস্ত জনপদ হইতে ইংরেজদিগকে বহিষ্কৃত করিয়া দিয়া তাহাদের মান্দ্রাজের কেল্লাপর্যন্তও ধূলিসাৎ করিয়া ফেলিবেন, এইরূপ জনরব প্রবল হইয়া উঠিয়াছিল। মান্দ্রাজের ইংরেজ-দরবারও তজ্জন্য ব্যাকুল হইয়া উঠিয়াছিল। ক্লাইব বুঝাইলেন,–এরূপ ক্ষেত্রে আত্মরক্ষার জন্যই সেনা প্রেরণ করা আবশ্যক; আনন্দরাজের সহায়তা করিলে উভয় উদ্দেশ্যেই সিদ্ধ হইবে।
অনেক বাদানুবাদের পর ক্লাইবের মতই প্রবল হইল। কিন্তু কলিকাতায় সেনা কোথায়? রাজকীয় গোরা এবং মাদ্রাজী সিপাহীরা ইতিপূর্বে বিদ্রোহাচরণ করিয়াছিল–তাহাদিগকে বিশ্বাস কী? চারিদল লাল-পন্টন এবং কোম্পানীর বেতনভোগী কয়েক শত গোরা মাত্রই ক্লাইবের সম্বল; তন্মধ্যে তৃতীয় এবং চতুর্থ দল লাল-পল্টনের শিক্ষাকার্য তখনও সমাপ্ত হয় নাই! এরূপ অবস্থায় সেনা প্রেরণের কথা স্থির হইলেও কাহাকে প্রেরণ করা হইবে, তাহা সহসা স্থির হইতে পারিল না।
অবশেষে ক্লাইভ কোম্পানীর বেতনভোগী ৪৭০ গোরা এবং প্রথম ও দ্বিতীয় সংখ্যক লাল-পল্টনের ১৯০০ সিপাহী সমভিব্যাহারে কর্ণেল ফোর্ডকে যুদ্ধযাত্রা করিবার আদেশ প্রদান করিলেন। ইহাই ক্লাইবের চরিত্রের গুণ, এবং ইহাই তাঁহার চরিত্রের দোষ। যাহা অন্য লোকে সাহস পাইত না, ভালো হউক বা মন্দ হউক, ক্লাইভ তাহাতে কদাচ পশ্চাদপদ হইতেন না। তিনি এ যাত্রা কীরূপ অসীম সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন তাহা স্মরণ করিলেও স্তম্ভিত হইতে হয়; কর্ণেল ফোর্ড দাক্ষিণাত্যে গমন করিলে বাঙ্গালা দেশ রক্ষা করিবার উপযুক্ত সেনাবল ছিল না, অথচ সেই সময়ে শাহজাদা বাংলা বিহার আক্রমণ করিতে অগ্রসর হইতেছিলেন।
যাহারা কর্ণেল ফোর্ডের সহিত সমুদ্রপথে যুদ্ধযাত্রা করিবার আদেশ প্রাপ্ত হইল; উত্তরকালে তাহাদের উল্লেখ করিয়া ক্লাইভ মান্দ্রাজের প্রধান সেনাপতি কর্ণেল লরেন্সকে লিখিয়াছিলেন–”Colonel Forde is in the Deckan with a very fine detachment of men.”২ লাল-পল্টনের জন্মদাতা কর্ণেল ক্লাইভের এই প্রশংসাবাক্য অতিশয়োক্তি নহে; তিনি পাটনায় গমনাগমন উপলক্ষে স্বয়ং প্রথম ও দ্বিতীয় সংখ্যক লালপল্টন চালনা করিয়া তাহাদের শৌর্য বীর্যের পরিচয় পাইয়াই এরূপ কথা লিখিয়া গিয়াছিলেন।
বঙ্গীয় সিপাহী সেনার পক্ষে ইহাই সর্বপ্রথম সমুদ্রযাত্রা। তাহারা ভীরু এবং কাপুরুষ হইলে অনায়াসেই নানারূপ আপত্তি উত্থাপন করিয়া ক্লাইভের সংকল্প সাধনের বাধা জন্মাইতে পারি, কিন্তু সাময়িক ইতিহাস-লেখক কাপ্তান ব্রুম স্পষ্টাক্ষরে লিখিয়া গিয়াছেন যে, সিপাহীরা কিছুমাত্র ইতস্তত করে নাই। ইহা লাল পল্টনের গৌরবের কথা তাহাতে সন্দেহ নাই।
আজ এ সকল কথা নিতান্ত স্বপ্ন-কাহিনী বলিয়া বোধ হয়; কিন্তু সেকালের ইতিহাসে দেখিতে পাওয়া যায় যে, সেনাদল যাহার লবণ গ্রহণ করিত, তাহার লবণের মর্যাদা রক্ষার জন্য অনেক অকাৰ্য কুকাৰ্য্য সাধন করিতেও ইতস্ততঃ করিত না; অন্যান্য প্রদেশের ন্যায় বঙ্গদেশে এই ভাব বড়োই প্রবল হইয়া উঠিয়াছিল। বঙ্গীয় লালপল্টনের মধ্যে এই ভাব বর্তমান না থাকিলে বাঙ্গলার ইতিহাস হয়ত সম্পূর্ণ বিভিন্নভাবে লিখিত হইত।
১৭৫৮ খ্রিস্টাব্দে ১২ অক্টোবর বঙ্গীয় “লাল-পল্টন” জাহাজে আরোহণ করিল; জাহাজ সেই দিনই কলিকাতা ছাড়িয়া সমুদ্রাভিমুখে ধাবিত হইল। ইতিমধ্যে আনন্দরাজ গজপতি নিজেও সৈন্য সামন্ত সংগ্রহ করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন, এবং ভিষকপত্তনে সমবেত সেনাদলের রসদ সংগ্রহের আয়োজনে নিযুক্ত হইয়াছিলেন। ২০শে অক্টোবর ভিষকপত্তনের সমুদ্র সৈকতে “ক্লাইভের লালকুৰ্ত্তিওয়ালারা” বৃটিশ বিজয়বৈজয়ন্তী সুবিস্তৃত করিয়া মহোল্লাসে জাহাজ হইতে অবতরণ করিল।
লালপল্টন জাহাজে আরোহণ করিবার পূৰ্বেই ইংরাজদূত আনন্দরাজের সভায় উপনীত হইয়াছিলেন; সেখানে যুদ্ধের সমস্ত কথাবার্তা এবং লাভালাভের বিষয় আলোচিত হইয়া সন্ধিপত্র লিখিত হইতেছিল। কর্ণেল ফোর্ড উপনীত হইলে, উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমে, এইরূপ সন্ধিপত্র স্বাক্ষরিত হইল, যথা :
First : The Raja to pay the extra expense of the army, during the time they should act together, (amounting to Rupees 50,000 per mensem) and allow the officers double batta (amounting to Rupees 6000 per mensem) to be paid when he should be put in possession of Rajmahendry.
Second : The Raja to possess all the inland country belonging to the country powers, but the company to retain all the sea-coast from Vizigapattam to Masulipattam, with the several ports and towns on that line.
Third : No treaty for the subsequent disposal or restitution, whether of the Raja’s or company’s possessions, to be made without the consent of both parties.
All plunder and prize-money to be equally divided.
এই সন্ধিসূত্রে ইংরাজদিগের পক্ষে এক তীরে দুইটি শিকার হস্তগত করিবার সম্ভাবনা হইল;-বঙ্গোপসাগরতীরে যে সকল ইংরাজ বাণিজ্যালয় ফরাসিপীড়নে চূর্ণ বিচূর্ণ হইয়া গিয়াছিল, তাহা পুনঃসংস্থাপিত হইবার সম্ভাবনা হইল, ফরাসিশক্তি নির্মূল করিতে পারিলে ইংরাজের পক্ষে ভারতসাম্রাজ্যে একাধিপত্ব বিস্তার করিবার সম্ভাবনা রহিল।
ইহাই প্রকৃতপক্ষে ইংরাজের ভাগ্যোন্নতির নিদান; ‘লাল পল্টনের’ প্রভুভক্তি এবং বাহুবলে সন্দিহান হইলে ক্লাইব তাহাদিগকে সমুদ্রপথে প্রেরণ করিতে সাহসী হইতেন না এবং ইংরাজের এই ভাগ্যোন্নতিও এরূপ অনায়াসলভ্য হইতে পারিত না।
যাহারা জীবন বিসর্জন করিয়া ইংরাজের ভাগ্যোন্নতির সূত্রপাত করিয়া দিয়াছিল, তাহারা কেহই আর ইহলোকে বর্তমান নাই! তাহাদের বীরকীৰ্ত্তির জন্য বৃটিশ-রাজশক্তি সুসংস্থাপিত হইয়াছে; কিন্তু ইতিহাসে সে বীরকীৰ্ত্তি সমুচিত সমাদর লাভ করিতে পারে নাই! ইংরাজ ইতিহাস লেখকেরা নখাগ্রগণনীয় গোরাদলের শৌর্যবীর্যের কথা যেরূপ বিস্তৃতভাবে লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন, তাহাতে “লাল পল্টনের” নাম যেন সমুদ্রে বুদ্বুদবৎ বিলীন হইয়া গিয়াছে। “প্রদীপের” ক্ষীণ রশ্মিতে “লাল পল্টনের” ঐতিহাসিক চিত্র সমুজ্জ্বল বর্ণে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিবার সম্ভাবনা নাই; ইহা কেবল অস্পষ্ট ছায়াচিত্রের ন্যায় প্রতীয়মান হইবে মাত্র! তথাপি এই অস্পষ্ট চিত্র দর্শনে যদি কাহারও ইতিহাসানুরাগ বর্ধিত হইয়া অনুসন্ধিৎসা জাগাইয়া তুলিতে পারে, তবে একদিন না একদিন স্বদেশীয় ইতিহাস লেখকের অধ্যাবসায় বলে “লাল পল্টনের” প্রকৃত ইতিহাস জনসমাজে পরিচিত হইয়া উঠিতে পারে!
প্রদীপ, বৈশাখ, ১৩০৫
তথ্যসূত্র
১ The rent was moderate, enforced without rigour; accurate accounts were prepared, and most of the hereditary officers, if not those possessing rentfree lands, were confirmed in their property,–facts which do Bussy and his nation great honor.–Captain Grant Duff.
২ Cliver letter to Col. Lawrence dated Calcutta, the 25th December, 1758.
৩ Cambridge’s war in India, vol-I, 271-272
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – লাল-পল্টনের কীর্তিক্ষেত্র
He succeeded because hedared; he dared, because he had full reliance, first, on himself, on the coolness and ealmness with which he could, in the storm of battle, direct a well-thought-out movement; and, secondly on the troops who had shown themselves during their service in Bengal, amenable to the guidance of a skilful leader. –Col. Malleson.
রাজা আনন্দরাজ গজপতি বাহুবলে ভিষকপত্তন অধিকার করিয়া দুর্গ-প্রাচীরে বৃটিশ-পতাকা উড্ডীন করিয়া দিবার পর, ফরাসি সেনাপতি লালী সেনানায়ক কনফ্লাঁকে পুনঃ পুনঃ উত্তেজনা করিয়া পত্র লিখিয়াছিলেন; কনফ্লাঁর কিঞ্চিত্রও প্রত্যুৎপন্নমতি থাকিলে, লালপল্টন ভিষকপত্তনে অবতরণ করিবার বহুপূৰ্বেই ফরাসি সেনা সমুদ্রোপকূল অধিকার করিয়া ফেলিতে পারিত;–হয়ত আনন্দরাজের যুদ্ধসজ্জা অঙ্কুরেই বিনাশপ্রাপ্ত হইয়া ফরাসিশক্তি পুনরায় প্রতিষ্ঠা লাভ করিত। কনফ্লাঁর আলস্য বশতই তাহা হইতে পারিল না! তিনি লালীর পুনঃ পুনঃ উত্তেজনা বশতঃ যখন রাজমহেন্দ্ৰীতে উপনীত হইলেন, তখন আর আনন্দরাজকে বশীভূত করিবার উপায় রহিল না;–তখন বৃটিশের রণবাদ্য বাজিয়া উঠিয়াছে, তালে তালে পা ফেলিতে ফেলিতে বৃটিশবাহিনীর গোরা ও কালা সিপাহীরা বঙ্গোপসাগরকূলে অগ্রসর হইয়াছেন। অগত্যা কনফ্লাঁ রাজমহেন্দ্রীর ২০ ক্রোশ দূরে ৫০০ ইউরোপীয় সেনা, ৫০০০ কালা সিপাহী, ৫০০ কালা অশ্বারোহী লইয়া ইংরাজের আক্রমণ পথের গতিরোধ করিবার আশায় শিবির সন্নিবেশ করিতে বাধ্য হইলেন।
১৭৫৮ খৃষ্টাব্দের ৩রা ডিসেম্বর সেনাপতি ফোর্ড সসৈন্যে ফরাসি শিবিরের সম্মুখবর্তী হইলেন। তিনি চারিদিক পৰ্যবেক্ষণ করিয়া শত্রুশিবির সহসা আক্রমণ করিতে সাহস পাইলেন না; দুই ক্রোশ দূরে চম্বল নামক গ্রামে সসৈন্যে শিবির সংস্থাপন করিলেন।
উভয় পক্ষেই রণসজ্জার ত্রুটি ছিল না; পল্টনসংখ্যাও প্রায় সমান, রণকৌশল শিক্ষাতেও কেহ কাহারও অপেক্ষা হীন নহে। এরূপক্ষেত্রে কেবল যে ইংরাজ সেনাপতিই শত্রুশিবির আক্রমণ করিতে ভীত হইয়াছিলেন তাহা নহে; ফরাসি সেনাপতিও সাহস করিয়া অগ্রসর হইতে পারেন নাই! এই ভাবে উভয়ে উভয়ের সম্মুখবর্তী হইয়াও চারি দিবস পর্যন্ত কোন পক্ষই কামানে অগ্নিসংযোগ করিলেন!
অবশেষে ৮ই ডিসেম্বর পরস্পরের অজ্ঞাতসারে উভয় সেনাপতিই আক্রমণ করিবার উপযোগী আয়োজন করিতে আরম্ভ করিলেন। ফরাসিরা চম্বলের বৃটিশশিবির আক্রমণ করিবার কল্পনা করিতেছিলেন, ঠিক সেই সময়ে ইংরাজ সেনাপতিও চম্বল পরিত্যাগ করিয়া কণ্ডুর নামক তিন মাইল দূরবর্তী স্থানে সেনাসমাবেশ করিবার উদ্যোগ করিতেছিলেন। যথাকালে সংকল্প সাধন করিতে পারিলে, ফরাসিরা চম্বলে উপনীত হইয়া শত্রুসেনার সন্ধান পাইতেন না, তাঁহাদিগকে আরও অগ্রসর হইয়া করে উপনীত হইতে হইত। কিন্তু আনন্দরাজের সেনাসজ্জায় কয়েক ঘন্টা বিলম্ব ঘটিল বলিয়া ইংরাজেরা যখন চম্বল ত্যাগ করিতেছেন ঠিক সেই সময়ে ফরাসিরা আসিয়া সহসা আপতিত হইলেন।
ফোর্ড সসৈন্যে কণ্ডুরের দিকে কিয়দূর অগ্রসর হইয়াছিলেন, আনন্দরাজের সেনা চম্বলেই ছিল; সুতরাং প্রত্যুষে শত্রুসেনা সহসা শিবিরাক্রমণ করায় আনন্দরাজের পল্টনদিগের মধ্যে তুমুল কোলাহল উপস্থিত হইল; তাহারা এ সময়ে আক্রমণবেগ প্রতিহত করিবার জন্য প্রস্তুত ছিল না; সুতরাং আক্রান্ত হইতে না হইতেই ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়িতে লাগিল। ফোর্ড তাহাদের সহায়তা সাধনের জন্য প্রত্যাবর্তন করিতে পারিলেন না; অগত্যা আনন্দরাজ সসৈন্যে দ্রুতগতিতে ফোর্ডের অনুগমন করিতে বাধ্য হওয়ায় ফরাসি সেনা প্রবল পরাক্রমে চম্বল অধিকার করিয়া ফেলিল, এবং এত সহজে যুদ্ধজয় করিয়াছে ভাবিয়া অহঙ্কারে আস্ফালন করিতে লাগিল। তাহারা জানিত যে আনন্দরাজের সেনাদল সম্পূর্ণ অশিক্ষিত, সকলে বন্দুক ব্যবহার করিতেও জানিত না, তীর, বর্ষা, টাঙ্গি, তরবারি এবং ধনুর্বাণ লইয়াও অনেকে পল্টনদলে প্রবেশ করিয়াছিল। সুতরাং আনন্দরাজকে দেখিয়া ভীত হইবার কারণ ছিল না। ইংরাজদিগকে দেখিয়াও ফরাসিদিগের ভয় হয় নাই; কারণ, তাহারা শুনিয়াছিল যে ইংরাজের সিপাহীদল নূতন গঠিত হইয়াছে, তাহারা এখনও যুদ্ধকৌশল শিক্ষা করিতে পারে নাই। সহজে চম্বল অধিকার করায় ফরাসি পল্টন দলে সকলেই ভাবিয়াছিল যে তাহারা যাহা শুনিয়া আসিয়াছিল তাহাই সত্য;-ইংরাজের ফৌজ যুদ্ধক্ষেত্রে মুহূৰ্ত্ত মাত্রও তিষ্ঠিতে পারিবে না। এই ভ্রান্তবিশ্বাসই ফরাসিসেনার সৰ্ব্বনাশের কারণ হইল। তাহারা ক্ষণমাত্র বিলম্ব না করিয়া করাভিমুখে ধাবিত হইল, এবং বৃটিশবাহিনী করগ্রামে প্রবেশ না করিতেই ফরাসির কামান ভীম কলরবে গর্জন করিয়া উঠিল!
বেলা ৮৷৷ ঘটিকার সময়ে সহসা শত্রুসেনা সম্মুখে উপনীত দেখিয়া ইংরাজ সেনাপতি তৎক্ষণাৎ সেনাসমাবেশ করিয়া সম্মুখযুদ্ধের জন্য বদ্ধপরিকর হইলেন।
ইংরেজ সেনাপতি গোরাদলকে মধ্যস্থলে রাখিয়া বামে ও দক্ষিণে “লাল পল্টনের” সিপাহীদিগকে দণ্ডায়মান হইতে বলিলেন, এবং তাহাদের পার্শ্বদেশে আনন্দরাজের অশিক্ষিত সেনাদলকে স্থাপন করিয়া দিলেন; কামানগুলি পল্টন দলের বামে দক্ষিণে উন্মুক্ত স্থানে বিন্যস্ত হইল। এই ভাবে সেনা সমাবেশ করিয়া ইংরাজ সেনাপতি একটী ভুট্টার ক্ষেত্রের নিকট দিয়া অগ্রসর হইতে লাগিলেন; –ক্ষেত্ৰটী মধ্যস্থলে পতিত হওয়ায় সমুন্নত ভুট্টা বৃক্ষে গোরাদল আবৃত হইয়া রহিল, বামে দক্ষিণে উন্মুক্ত প্রান্তরে কাতার বাঁধিয়া লালপল্টন দণ্ডায়মান হইল। সুচতুর ইংরাজ সেনাপতি এইরূপে বিচিত্র ব্যুহ রচনা করিবামাত্র লাল পল্টনের সিপাহীদলকে রণপতাকা বিস্তার করিবার আদেশ প্রদান করিলেন। তাহাদের প্রত্যেক দলের হস্তে কতকগুলি ছোট ছোট পতাকা দেওয়া হইয়াছিল, সেই সকল পতাকা মৃত্তিকায় প্রোথিত করিয়া যখন লাল-পল্টনের সিপাহী সেনা বহুদূর ব্যাপিয়া দণ্ডায়মান হইল, তখন ইংরাজ সেনাপতির কৌশল সফল হইল!
সে কালের ইংরাজ ও ফরাসিদিগের মধ্যে দাক্ষিণাত্যে অনেক যুদ্ধ কলহ উপস্থিত হইয়াছিল। এই সকল যুদ্ধে উভয় পক্ষেই কালা সিপাহী থাকিত; কিন্তু তাহাদিগকে ইউরোপীয় সেনার ন্যায় রক্তাম্বরে সুসজ্জিত করিবার ব্যবস্থা ছিল না; তাহারা শ্বেত পরিচ্ছদ পরিধান করিয়া কখন বা দেশীয় প্রথায় অঙ্গাবরণ করিয়া, যুদ্ধক্ষেত্রে উপনীত হইত। ক্লাইব বঙ্গদেশে আসিয়া এই প্রথার পরিবর্তন করিয়াছিলেন; এবং বাঙ্গালী সিপাহীদিগের ধুতি চাদর ঘুচাইয়া লাল কুৰ্ত্তির ব্যবস্থা করিয়াছিলেন; একথা মান্দ্রাজ অঞ্চলে কেহ জানিত না। আজ ক্লাবের ব্যবস্থায় ফরাসি-সেনাপতির মতিভ্রম ঘটিল।
ফরাসিরা যখন চাহিয়া দেখিল যে, বামে এবং দক্ষিণে বহুদূর বিস্তৃত হইয়া লাল কুৰ্ত্তিওয়ালা পল্টনশ্রেণী দণ্ডায়মান হইয়াছে, তখন তাহারা মনে করিল উহারা সকলেই “গোরা লোগ” এবং উহাদিগকে হটাইতে পারিলেই রণজয় সুসম্পন্ন হইবে! ইংরাজব্যুহের কেন্দ্র ভূমিতে ভুট্টাক্ষেত্রের অন্তরালে যে গোরাদল দণ্ডায়মান রহিয়াছে,–সে কথা কেহ জানিতে পারিল না, এরূপ ঘটনা যে আদৌ সম্ভব, এমন কথাও কাহারও মস্তিষ্কে প্রবেশ করিল না! তাহারা মহা কলরবে ব্রিটিশ ব্যুহের বাম বাহু আক্রমণ করিল। লাল পল্টনের সিপাহী সেনা উপর্যুপরি প্রচণ্ড পীড়নে ধরাশায়ী হইতে লাগিল; কিন্তু আজ তাহাদের সেনাপতি যে অদ্ভুত সমরকৌশলের পরিচয় দান করিতে বসিয়াছেন, তাহাতে ব্যক্তিগত সমরকৌশল প্রদর্শনের বা বাহুবল বিস্তারের উপায় নাই! সেনাপতির ব্যুহ রচনার কৌশল এইরূপ যে, বাম ভাগের লাল-পল্টনকে শত্রু সেনার আক্রমণ বেগে পশ্চাতে হটিয়া আসিতে হইবে, শত্রু সেনা সহজে রণজয় করিবার আশায় যেমন সম্মুখে অগ্রসর হইতে থাকিবে, অমনি দক্ষিণ পার্শ্বের সিপাহী এবং ভুট্টাক্ষেত্ৰস্থ গোরাদল ঘিরিয়া ফেলিয়া শত্রু সেনার পরাজয় সাধন করিবে। কাৰ্যেও তাহা হইল! বাম পার্শ্বস্থ লাল-পল্টন হটিয়া যাইতেছে দেখিয়া ফরাসি সেনা তাহাদের সমর কৌশল বুঝিতে পারিল না; তোপখানা পশ্চাতে ফেলিয়া রাখিয়া তাহারা ছত্রভঙ্গ ভাবে মার মার রবে বামভাগ বিধবস্ত করিয়া লাল-পল্টনের অধিকৃত স্থানে আসিয়া উপনীত হইল। সেখানে পদার্পণ করিবামাত্র তাহাদের মতিভ্রম দূর হইল; তখন আর দাঁড়াইবার স্থান নাই, তখন আর সেনানায়কের উত্তেজনায় কর্ণপাত করিবার অবসর নাই, তখন আর রণকৌশল প্রদর্শন করিবার কিছুমাত্র সম্ভাবনা নাই;–তখন ছত্রভঙ্গ ফরাসি সেনা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করিতে বাধ্য হইল!*
শত্রু সেনা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করিবামাত্র গোরাদল সহ লাল পল্টনের সিপাহী সেনা তাহাদের উপর আপতিত হইল। ফরাসি সেনা বহু ক্লেশে তোপখানার নিকট সমবেত হইল বটে, কিন্তু একবার কি দুইবার কামানে অগ্নি সংযোগ করিতে না করিতেই লাল-পল্টন তাহাদের কামানের উপর আসিয়া পড়িল। যুদ্ধের প্রথম উপক্রমে দ্বিতীয় সংখ্যক লাল-পল্টন সেনা নায়কের ন্যূহ রচনার কৌশলে পশ্চাদ পদ হইতে বাধ্য হইয়াছিল; এখন তাহার প্রতিশোধ লইবার জন্য উন্মত্তের ন্যায় শত্রু শিবির আক্রমণ করিল। ইংরেজ-সেনাপতি আর তাহাদের গতিরোধ করিলেন না; ফরাসিরা আর তাহাদিগকে বাধা প্রদান করিতে পারিল না; যুদ্ধাবসানে শত্রুশিবির ইংরাজের হস্তগত হইল, ফরাসীসেনা–নতশিরে পলায়ন করিতে বাধ্য হইল, বাদ্যোদ্যমে রণভূমি পরিপূরিত হইয়া উঠিল। ফরাসিদিগের পটমণ্ডপ ও তোপখানা ইংরাজের করতলগত হইল; প্রত্যুষে যে শিবির ফরাসি সেনার
আস্ফালন ভরে টলমল করিয়া উঠিয়াছিল, সায়াহ্নে সেখানে লাল-পল্টনের অট্টহাস্য ধবনিত হইয়া উঠিল! তখন সকলেই বুঝিতে পারিল–
“It was with design that that officer (Forde) had placed his red coated Cipahis in a position to attract the first attack of the French.”
এই যুদ্ধে যে সকল দেশীয় সিপাহী ইংরেজপক্ষে অস্ত্র ধারণ করিয়াছিল, তাহারা এ দেশের সাময়িক ইতিহাসে প্রথম ও দ্বিতীয় সংখ্যক লাল-পল্টন এবং মাদ্রাজ সিপাহী নামে পরিচিত। মাদ্রাজী সিপাহীরা সংখ্যার অল্প ছিল, এবং তাহারা কোন পল্টন ভুক্ত হয় নাই।
প্রথম এবং দ্বিতীয় সংখ্যক লাল-পলটনের বাহুবলেই যে এই যুদ্ধ জয় সুসম্পন্ন হইয়াছিল, ইংরাজ লিখিত সাময়িক ইতিহাসেও তাহার কিছু কিছু পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়। প্রথম সংখ্যক লাল পল্টনের অধিনায়কের নাম কাপ্তান নক্স, দ্বিতীয় সংখ্যক লাল-পল্টনের অধিনায়কের নাম কাপ্তান ম্যাকলিন;–এই দুইজন সেনানায়কের নাম বাঙ্গালী পল্টনের নিকট অতীব প্রিয় হইয়া উঠিয়াছিল।
ভুট্টাক্ষেত্রের অন্তরাল হইতে বাহির হইবার পর গোরাদল যথেষ্ট শৌর্য বীৰ্য্য প্রদর্শন করিয়াছিল, কিন্তু তখনও প্রথম সংখ্যক লালপল্টনের শৌর্যবীর্যের উপরেই যে যুদ্ধ জয় নির্ভর করিতেছিল সে কথা কাপ্তান ব্রুম স্বপ্রণীত ইতিহাসে এইরূপে লিপিবদ্ধ করিয়াছেন :
The day, if not completely gained, was at least secured from reverse by the possesion of the enemy’s Field Artillery and the flight of their European Batalion; but much yet depended on the conduct of the first Native Battalon. When the European Battalion advanced, its fieldpieces had been left with this corps, encouraged by which support, and the ‘spirit of their ghllant Commander, Captain Knox, the Sipahis, though opposed by nearly four times their own number, stood their ground nobly; taking advantage of the cover of some embankments in their front they kept up a warm fire upon the enemy, –to which the latter replied with great spirit, until they saw their own European Baltalion driven from the guns and in disorderly flight, when they also began to retreat।
কণ্ডূরের যুদ্ধে ফরাসি সেনা যে প্রথমসংখ্যক লাল পল্টনের অনলবর্ষণেই যুদ্ধভূমি হইতে পলায়ন করিতে বাধ্য হইয়াছিল, ইহা সিপাহীদিগের পক্ষে সবিশেষ গৌরবের কথা। এই যুদ্ধে তাহারা ইংরাজের মুখোজ্জল করিতে গিয়া একশত হত এবং একশত আহত হইয়াছিল;কিন্তু এই যুদ্ধের নাম পৰ্য্যন্তও ইতিহাস হইতে বিলুপ্ত হইতে বসিয়াছিল। ধন্য প্রতিভাসম্পন্ন ম্যালিসনের লেখনী! কর্ণেল ম্যালিসনের কৃপাতেই ইহার বিস্তৃত কাহিনী জনসমাজে পরিকীর্তিত হইয়া করের নামও ভারতীয় মহাযুদ্ধগুলির মধ্যে সন্নিবিষ্ট হইয়াছে!
কণ্ডুর এখন মাদ্রাজ প্রদেশের অন্তর্গত; বোধ হয় অনেক কৃতবিদ্য বাঙ্গালীও মানচিত্রে তাহার স্থান নির্দেশ করিতে পারেন না। কিন্তু কর্তৃরই বাঙ্গালী লালপল্টনের সৰ্ব্বপ্রধান কীৰ্ত্তিক্ষেত্র!
বঙ্গীয় সেনাদলের ইতিহাস সঙ্কলন করিতে বসিয়া সুবিখ্যাত ঐতিহাসিক অৰ্ম্মি হইতে কর্ণেল ম্যালিসন পৰ্য্যন্ত যত ইংরাজ লেখক কর্তৃরযুদ্ধের উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন, সকলেই ইহাকে একবাক্যে মহাযুদ্ধ বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন।
কাপ্তান ব্রুম বরং আক্ষেপ করিয়া লিখিয়া গিয়াছেন যে, এই যুদ্ধের জন্য যাহারা জীবন বিসর্জন করিয়াছিল এবং যাহারা ইহার গৌরবে গৌরবান্বিত হইয়াছিল তাহাদের রণপতাকায় “করের” নাম লিখিত না হইয়া যাহারা ইহাতে কিছুমাত্র লিপ্ত ছিল না সেই মাদ্রাজী গোরা পল্টনের পতাকায় “কপুরের” নাম লিখিত রহিয়াছে।
প্রদীপ, জৈষ্ঠ, ১৩০৫
তথ্যসূত্র
১ Forde, after reconnoitering the French position, came to the opinion that it was too strong to be attacked.–Malleson’s Decisive Battles of India, p. 86.
২ The partial success achieved by the French guns was fatal to Conflans. Ignorant of the exact state of affairs, he became confirmed in his belief of the truth of the story told him by the deserters, that the English force was composed of raw levies.–Malleson’s Decisive Battles of India, p. 88.
৩ Colonel Forde, probably with a view of leading the enemy into the very error into which they fell, ordered the Sipahi Battalions to furl their small colours of which one was allowed to each Company, and to lay them on the ground. — Broom’s Bengal Army, Vol. I. 216-217.
8 It was the first time that the French had met native soldiers so attired.–Malleson’s Decisive Battles of India, p. 89.
* লাল পল্টনের কীৰ্ত্তিক্ষেত্ৰ “করের” যুদ্ধ কাহিনী যাঁহার° আমূল অধ্যয়ন করিতে ইচ্ছা করেন, তাঁহারা নিম্নলিখিত পুস্তকাবলী হইতে অনেক সহায়তা লাভ করিবেন। যথা–
Orme’s Indostan, Cambridge’s War in India, Grose’s Voyage to the East Indies, Broome’s History of the Rise and Progress of the Bengal Army, and Malleson’s Decisive Battles of India.
এই সমস্ত ইতিহাসে লাল-পল্টনের বিশেষ পরিচয় না দিয়া সাধারণতঃ “সিপাহী” নাম প্রদান করায় তাহাদের বীর-কীৰ্ত্তি সুস্পষ্টরূপে অঙ্কিত হইতে পারে নাই; ব্রুম সাধারণ সিপাহী নাম ব্যবহার না করিয়া কোন সংখ্যক পল্টন এবং কাহার পরিচালনাধীন তাহার বিস্তৃত বিবরণ প্রদান করিয়া গিয়াছেন। এজন্য ব্রুমের ইতিহাস অবলম্বন করিয়া করের যুদ্ধ কাহিনী পাঠ করিলে কোনরূপ গোলযোগ ঘটিবে না।
৫ Malleson’s Decisive Battles of India, p. 93.
৬ Broom’s Bengal Army, Vol. I. p. 218.
৭ Malleson’s Decisive Battles of India.
৮ Thus ended the battle of Condore, one of the most brilliant actions on military record; which, however, is generally but little known or mentioned in the service, and by a strange chance, not one of the corps employed have ever received any distinction for this most important victory. Whilst the First Madras European Fusiliers, of which not an officer or man, excepting Captain Callender, was present, have the word “Condore” emblazoned on their colours and appointments. The corps properly entitled to this distinction are the present First Bengal European Fusiliers, the First Regiment of Bengal Native Infantry, and the Bengal Artillery; the Second Native Battalion is no longer in existence, and the Madras Sipahis present was never organised as a regular Corps. — Captain Broome’s Benga Army, Vol. I.p. 220.
সপ্তম পরিচ্ছেদ – লাল-পল্টনের জয়মাল্য
When the whole of the attendant circumstances are considered, the numerical Superiority of the enemy, –the strength of the place, and the disadvantages under which the English force was laboring,–as also the great importance of the conquest,–few achievements on Indian record can be compared with this brilliant affair, which is surely deserving of commemoration. –Captain Arthur Broome.
কণ্ডূরের কীৰ্ত্তি-ক্ষেত্র হইতে বিজয়োৎফুল্ল হৃদয়ে অগ্রসর হইয়া মছলিপত্তনের দুর্গ জয় করিয়া লালপল্টনের সিপাহী সেনা যে জয়মাল্য অর্জন করিয়াছিল, ইতিহাস লেখকেরা তাহাকে সৰ্ব্বথা অতুলনীয় বলিয়া বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন!
ফরাসিরা দাক্ষিণাত্যের নিজাম-দরবারে প্রভুত্ব বিস্তার করিয়া ইংরাজদিগের উচ্ছেদসাধনে বদ্ধপরিকর হইয়াছিলেন; ইংরাজ সেনাপতি বাহুবলে ফরাসির উচ্ছেদসাধনের জন্য সসৈন্যে রাজমহেন্দ্রীর দিকে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। কাপ্তান নক্সের প্রথম সংখ্যক লালপল্টন রাজমহেন্দ্ৰী অধিকার করিবার জন্য প্রেরিত হইয়াছিল; তাহাদের লালকুৰ্ত্তি দেখিয়াই ফরাসিরা রাজমহেন্দ্ৰী হইতে পলায়ন করিতে আরম্ভ করিলেন;–পঞ্চদশজন ফরাসি পলায়নের আশায় গোদাবরী তীরে দুর্গমূলে নৌকার জন্য প্রতীক্ষা করিতেছিল, তাহাদিগকে বন্দী করিয়া লালপল্টন একরূপ বিনাযুদ্ধেই দুর্গাধিকার করিল।
ইংরাজেরা রাজমহেন্দ্ৰীতে শিবির সন্নিবেশ করিলেন; ফরাসিরা মছলিপত্তনের বিখ্যাত দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করিলেন। ইংরাজ সেনাপতি দেখিলেন যে, মছলিপত্তন অধিকার করিতে না পারিলে ফরাসিরা আবার প্রবল হইয়া উঠিবেন; তাহার কিছু কিছু লক্ষণও দেখা যাইতে লাগিল; পণ্ডিচেরী হইতে মসিয় মোরার্সি তিনশত ইউরোপীয় সেনা লইয়া কনফ্লাঁকে সাহায্য দান করিবার জন্য সমুদ্রপথে যাত্রা করিলেন; নিজাম সসৈন্যে স্থলপথে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। আনন্দরাজ ইহা বুঝিতে পারিলেন না; তাঁহাকে রসদ যোগাইতে হইতেছে বলিয়া তিনি যুদ্ধে ক্ষান্ত হইবার জন্যই পরামর্শ দিতে লাগিলেন। অবশেষে ইংরাজ সেনাপতির মতই প্রবল হইল। বৃটীশ বাহিনী ১৭৫৯ খৃষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারী মাসে রাজমহেন্দ্ৰী হইতে বহির্গত হইয়া মছলিপত্তনের সম্মুখে আসিয়া শিবির সন্নিবেশ করিল।
মছলিপত্তনের সম্মুখে আসিয়া ইংরাজ সেনাপতির বদনমণ্ডল চিন্তাক্লিষ্ট বিষণ্ণ মূর্তি ধারণ করিল। দুর্গটি সুদৃঢ়; পরিখা গভীর,–প্রাচীর দৃঢ়োন্নত, তদুপরি একাদশটি বুরুজ, দক্ষিণে সমুদ্রের খাড়ি, পূৰ্বোত্তরে কেবল সৈকতশায়ী বালুকাপ;–মধ্যে মধ্যে বহুবিধ নালা, খাল, এবং পয়ঃপ্রণালী বৰ্ত্তমান। এইরূপ সুরক্ষিত সুদৃঢ় দুর্গে সুশিক্ষিত ফরাসি সেনাকে অবরোধ করাই কত কঠিন; কোন রূপে অবরোধ করিতে পারিলেও দুর্গ জয় করা অসম্ভব! তাহাতে যত সময় লাগিবে, ততদিনে হয়ত নিজাম অথবা মোরার্সি আসিয়া ইংরাজ-সেনার পৃষ্ঠদেশ আক্রমণ করিবেন!
এরূপ ক্ষেত্রে বিপদের উপর বিপদ আসিয়া চাপিয়া পড়িতে লাগিল; রসদ বন্ধ হইয়া গেল, তঙ্কা ফুরাইয়া গেল; গোরা পল্টন অস্ত্র ত্যাগ করিয়া পলায়ন করিতে চাহিল;–ইংরাজ সেনাপতির মস্তকে আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল!
বিপদে ধৈৰ্য্য এবং বৈরনিৰ্যাতনে অতুল অধ্যবসায় কর্ণেল ফোর্ডের স্বাভাবিক গুণ বলিয়া ইতিহাসে পরিচিত; তিনি ধৈর্য্যচ্যুত হইলেন না; বৈরনিৰ্যাতনের কল্পনা পরিত্যাগ করিলেন না; গোরাদলকে স্তুতি মিনতিতে সন্তুষ্ট করিলেন, সিপাহীগণকে উৎসাহবাক্যে উত্তেজিত করিলেন, এবং অবিচলিত অধ্যবসায়ে দুর্গোপরি অনল বর্ষণ করিতে লাগিলেন।
ইংরাজ সেনা যেরূপ অবস্থায় পতিত হইয়াছিল, তাহাতে জাহাজে উঠিয়া সমুদ্রপথে পলায়ন করা ভিন্ন আর উপায় ছিল না। ইংরাজ-সেনাপতি সেরূপ উপায়ে প্রাণ রক্ষা করা অপেক্ষা দুর্গ জয় করিবার জন্য প্রাণ বিসর্জন করিতেই কৃতসংকল্প হইলেন। এই সময়ে প্রকাশ হইল যে, আর দুইদিন মাত্র যুদ্ধ করিবার উপযুক্ত বারূদ আছে, অবশিষ্ট সমস্তই নিঃশেষ হইয়া গিয়াছে।
এরূপ ক্ষেত্রে গোরাদল বিদ্রোহী হইয়া উঠা বিচিত্র নহে; কিন্তু লালপল্টন যে তাহাদের অনুকরণ করে নাই, তাহাই সমধিক বিস্ময়ের বিষয়! যাহারা এরূপ নিদারুণ দুঃখ কষ্ট এবং নিরাশার মধ্যেও সেনাপতির আজ্ঞাবৰ্ত্তী থাকিয়া তাঁহার সহিত প্রভুর কাৰ্যে জীবন বিসর্জন করিতে প্রস্তুত হইয়াছিল, তাহাদের বীরকীৰ্ত্তি যথার্থই স্বর্ণাক্ষরে লিখিত হইবার উপযুক্ত নহে কি?
কর্ণেল ফোর্ড কিছুমাত্র বিচলিত না হইয়া নিশাযোগে দুর্গ আক্রমণের ব্যবস্থা করিতে বসিলেন; সকলেই বুঝিল যে, এইবার অসম্ভবের সঙ্গে সংগ্রাম করিবার জন্য জীবন বিসর্জন করিতে হইবে!তথাপি সেনাদল ভীত হইল না।
দুর্গাক্রমণের প্রণালী এইরূপ স্থির হইল যে, রাজা আনন্দরাজ গজপতি তাঁহার সেনাদল লইয়া দুর্গদ্বারের সম্মুখে উপনীত হইবেন, কাপ্তান নক্স প্রথমসংখ্যক লাল পল্টন লইয়া দক্ষিণপশ্চিম বুরুজের নিকট সমবেত হইবেন; অবশিষ্ট সেনা দুইদলে বিভক্ত হইয়া উত্তরপূৰ্ব্ব বুরুজের নিকট প্রাচীরারোহণের চেষ্টা করিবে; রজনী দ্বিপ্রহরের ঘন্টা ধবনিত হইবামাত্র প্রত্যেক দল একসঙ্গে আক্রমণ করিবে।
সেদিন সায়ংকালে সকলেই আহারাদি শেষ করিয়া নীরবে নিঃশব্দে অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত হইল; রজনী দশ ঘটিকার পর একে একে নির্দিষ্ট স্থানাভিমুখে যাত্রা করিতে আরম্ভ করিল। যাত্রা করিবামাত্রই সকলে বুঝিল, আজ মন্ত্রের সাধন কিম্বা শরীর পতন। পথ নাই, আলোক নাই, সম্মুখে বিস্তীর্ণ সমুদ্রসৈকত ধূধূ করিতেছে, মধ্যে মধ্যে খাস ও নালা পথরোধ করিয়া প্রবাহিত হইতেছে, উপরে নীল নভস্তলে তারকার ক্ষীণ জ্যোতি মৃদুমন্দ হাস্যের ন্যায় প্রতিভাত হইতেছে, সম্মুখে বিপুলদেহে দুর্গপ্রাচীর দণ্ডায়মান, প্রাচীরাভ্যন্তরে বহুশত বীরসন্তান নির্ভয়ে নিদ্রামগ্ন!
কাপ্তান নক্সের লালপল্টনদিগকেই সর্বাগ্রে অগ্রসর হইতে হইল। তাহারা ফিরিল না; বেলাভূমি অতিক্রম করিয়া নালার জলে নামিয়া পড়িল, জানু পর্যন্ত ডুবিল, কটিদেশ পর্যন্ত ডুবিল, অবশেষে বক্ষ পৰ্যন্ত জলস্পর্শ হইল;–তথাপিও একজনও ফিরিয়া চাহিল না; নালা পার হইয়া নিঃশব্দে আপনাপন সঙ্কেতভূমিতে দণ্ডায়মান হইল।
ফরাসি-দুর্গে কেহ ইহার বিন্দুবিসর্গও জানিতে পারিল না; সেনাপতি নিদ্রামগ্ন, সেনাদল অচেতন, কেবল প্রহরিগণ ইতস্ততঃ পদচারণ করিয়া বেড়াইতেছিল। দুর্গের প্রহরী এক, দুই, তিন, চারি করিয়া গণিয়া গণিয়া বারটা বাজাইয়া দিল, এক, দুই, তিন, চারি করিয়া বারটা পৰ্য্যন্ত ঘন্টাধবনি দুর্গপ্রাচীরে প্রতিধবনিত হইয়া নৈশনীরবতায় মিলাইয়া গেল; এমন সময়ে কাপ্তান নক্সের লালপল্টনের কামান ভীমকলরবে গর্জন করিয়া উঠিল; সঙ্কেতধবনি শ্রবণ করিবামাত্র সিংহদ্বারের নিকট আনন্দরাজ গজপতির সেনাদল মহোল্লাসে সিংহনাদ করিয়া উঠিল;– সুপ্তোঙ্খিত ফরাসী-সেনা সহসা উভয় দিক হইতে শত্রুসেনার আক্রমণ লক্ষ্য করিয়া ছত্রভঙ্গ হইয়া সেই সেই দিকেই ছুটিতে লাগিল;–তখন প্রকৃত আক্রমণকারিগণ পূৰ্বোত্তর কোণে ধীরে ধীরে প্রাচীরারোহণ করিতে লাগিল।
চারিদিকেই সমরানল জ্বলিয়া উঠল; কোন দিকে কৃত্রিম আক্রমণ আর কোন দিকে প্রকৃত আক্রমণ,-কাহার সাধ্য যে সহসা তাহা নির্ণয় করিতে পারে? ফরাসি সেনাপতি হতবুদ্ধি হইয়া পড়িলেন, মুহূর্তে আদেশ পরিবর্তন করিতে লাগিলেন, তুমুল কোলাহলে দুর্গবাসিগণ জাগরিত হইয়া ইতস্ততঃ ছুটিয়া বেড়াইতে লাগিল; সেই অবসরে ইংরাজসেনা দুর্গ প্রাচীরের কিয়দংশ অধিকার করিয়া ফেলিল। তখন আর শক্ৰমিত্র চিনিয়া লইবার উপায় রহিল না; চারিদিকে শত শত শত্রু মিত্র কাতারে কাতারে ধরাশায়ী হইতে লাগিল!
দুইটি বঙ্গীয় রণবাদক–উভয়েই অল্পবয়স্ক,–মেজর ইয়র্কের উভয় পার্শ্বে রণডঙ্কা বাজাইতে বাজাইতে দুর্গ প্রবেশ করিয়াছিল। দুর্গদ্বারে আসিয়া সকলেই থমকিয়া দাঁড়াইল, কেবল সেই দুইটি রণবাদক আর ইয়র্ক প্রবেশ করিলেন; শত্রুসেনার প্রচণ্ড পীড়নে একটি গোলাতে তিনজনেরই মৰ্ম্মস্থান ছিন্ন হইয়া গেল; দর্শকেরা চাহিয়া দেখিল যে, আহত রণবাদকদ্বয় তখনও মহোৎসাহে ডঙ্কা-নিনাদে মত্ত রহিয়াছে; ধরাধরি করিয়া বাহিরে আনিতে না আনিতে তিনজনেরই প্রাণবায়ু বাহির হইয়া গেল!
ইংরাজ-সেনাদলে অনেকেই ধরাশায়ী হইতে লাগিল; কিন্তু তথাপি আক্রমণবেগ প্রতিহত হইল না; বন্যাস্রোতের ন্যায় তরঙ্গের পর তরঙ্গে গোরা এবং লাল-পল্টন দুর্গমধ্যে প্রবেশ করিতে লাগিল; উন্মত্ত পিশাচের ন্যায় বিকট সিংহনাদ করিয়া অন্ধকারে শত্রুসেনার উপর আপতিত হইতে লাগিল;–এমন সময়ে সহসা তুৰ্য্যধবনি হইল, সহসা রণকোলাহল শান্তিলাভ করিল, সকলে বিস্মিতহৃদয়ে শুনিতে পাইল যে ফরাসি সেনাপতি সসৈন্যে আত্মসমর্পণ করিয়াছেন, দুর্গজয় সুসম্পন্ন হইয়াছে!
প্রভাতে ইংরাজের রণকৌশল প্রকাশিত হইয়া পড়িল; প্রভাতের তরুণ তপন লাল পল্টনের বীরকীৰ্ত্তি উদ্ভাসিত করিয়া তুলিল; দুই সহস্র ইংরাজসেনা, তাহার অধিকাংশই লাল পল্টনের বাঙ্গালী সিপাহী,–তাহাদের বাহুবলে পরাস্ত হইয়া তাহাদের হস্তে বহুসহস্র ফরাসি সেনা বন্দী হইয়াছে, ইহা ইতিহাসে লিখিত হইলেও সহসা বিশ্বাস করিতে সাহস হয় না। এমন দুর্গজয় কয়জনের ভাগ্যে ঘটিয়াছে। যাহারা এইরূপে প্রতিকূল অবস্থায় পতিত হইয়াও মছলিপত্তনের দুর্গজয় করিয়াছিল–হ্যায়! তাহাদের স্বদেশের কোন কবিই তাহাদের বীরকীৰ্ত্তি চিরস্মরণীয় করিয়া দিলেন না।
প্রদীপ, আষাঢ়, ১৩০৫
তথ্যসূত্র
১ Their sole hope was to escape. The sight of the red-coated Sipahis, undistinguishable from Europeans, deprived them of whatever nerve they had till then retained. — Malleson’s Decisive Battles of India, p.94.
২ When they saw, for they could not help seeing, that their hard earned prize monay had disappeared that nothing was left, that their food was bad and insufficient, that they were engaged upon an impossible enterprise, — They, too, lost heart. On the 19th the European troops broke into open mutiny. and, turning out with their arms, threatened to march away,– Malleson’s Decisive Battles of India, 10.
৩ As the party led by Captain Knox, comprised entirely of Sipahis, seven hundred in number, destined to wade through the swamp and attack the South-west angle, had a longer distance to traverse, they started first —-Malleson’s Decisive Battles of India, p. 105.
৪ এই কাহিনী ম্যালিসন এবং ব্রুম উভয়েই বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন। স্বদেশের সমসাময়িক লোকে ইতিহাস লিখিলে এমন কত কাহিনী সংকলিত হইতে পারিত। ইংরাজ রণবাদক হইলে হয়ত তাহাদের নামে মছলিপত্তনের দূর্গদ্বারে জয়স্তম্ভ নির্মিত হইত।
৫ এসকল কীৰ্ত্তিকাহিনী এখন ঐতিহাসিক গহ্বরে পুরাতনের চিতাভস্মরাশিতে আবৃত হইয়া রহিয়াছে। কিন্তু এ সকল কথা যখন লোকসমাজে পরিচিত ছিল, ওয়ালটার হ্যাঁমিল্টন সেই সময়ে গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন বলিয়া তাঁহাকে সত্যানুরোধে সাধারণ জনাপবাদের প্রতিবাদ করিয়া বাঙ্গালীর সমরকৌশলের সাক্ষ্যদান করিতে হইয়াছিল। ইতিহাস আলোচনা করিলে সকলকেই স্বীকার করিতে হইবে হ্যাঁমিল্টন যাহা লিখিয়াছ গিয়াছেন, তাহার এক বর্ণও মিথ্যা নহে!
মন্বন্তর
“সাতাত্তরের মন্বন্তরের” কথা ইতিহাসের জীর্ণস্তরে মিশিয়া গিয়াছিল; আবার কিন্তু কালের চিতা জ্বলিয়া উঠিয়াছে! আবার পঞ্চনদ হইতে পূৰ্ব্ববাঙ্গলার সীমান্তদেশ, সমগ্ৰ আৰ্য্যাবর্ত, হা অন্ন! হা অন্ন! রবে হাহাকার করিয়া উঠিয়াছে! ভারতবাসীর উপেক্ষিত বিষাদব্যাকুলতায় এবার ভারতেশ্বরীর সিংহাসন চঞ্চল হইয়াছে;–প্রকৃতিপুঞ্জের জীবনরক্ষার জন্য তাড়িত-বার্তা সমাগত হইতেছে; সুনিপুণ রাজকর্মচারিগণ বিনিদ্র-নয়নে রাশি রাশি পুরাতন রাজদপ্তর কণ্ঠস্থ করিয়া প্রজার প্রাণরক্ষার জন্য দীর্ঘাতিদীর্ঘ মন্তব্যলিপির রচনা করিতেছেন। সহানুভূতির অবধি নাই; সান্ত্বনার অন্ত নাই;–কিন্তু হায়! তথাপি কালের চিতা ধীরে ধীরে প্রধুমিত হইয়া উঠিতেছে।
বাঙ্গালা দেশ দরিদ্র দেশ;–যে দেশের শিল্প বাণিজ্য অন্তর্হিত হইয়া তাঁতি কৰ্ম্মকার হাহাকার করিতেছে; কোটী কোটী নরনারী কেবলমাত্র বিদেশের কল্যাণে কোনরূপে লজ্জারক্ষা করিয়া “প্রায়োপবেশন” অভ্যাস করিতে বাধ্য হইতেছে; তাহার প্রতি বৎসরের ইতিহাসই দুঃখদৈন্যের বিষাদকাহিনী! রাজপুরুষেরা সে কথা স্বীকার করিতে অসম্মত; কিন্তু সকলেই দেখিতেছেন যে, বাঙ্গালী দিন দিন কত অন্নহীন হইয়া পড়িতেছে! এই “হা অন্ন! হা অন্ন!” রব বাঙ্গালীর চিররুগ্ন জীবনের অসাধ্য পুরাতন ব্যাধির ন্যায় অঙ্গগ্রহে পরিণত হইয়াছে, ইহার উপর আবার দুর্ভিক্ষ! কাজেই বাঙ্গালী আবার আতঙ্কে শিহরিয়া উঠিতেছে, আবার ‘সাতাত্তরের মন্বন্তরের’ বিষাদ-স্মৃতি জাগিয়া উঠিতেছে!
বাঙ্গালা দেশ কৃষি-প্রধান;-ধান্যই একমাত্র ধন, সম্পদ, বল, ভরসা। এক সময়ে এ দেশের মৃগহ্বরে অত্যুজ্জ্বল হীরকখণ্ড উৎপন্ন হইত;–ইহা কবির কল্পনা নহে, ঐতিহাসিক সত্য! ১ এক সময়ে এ দেশের নদ নদী স্বর্ণরেণু বহন করিত;–ইহাও কবি-কল্পনা নহে, ঐতিহাসিক সত্য!’২ একসময়ে এ দেশের শিল্পভাণ্ডারে বিদেশে বহন করিবার জন্য নানা দিগদেশের বণিকসমিতি জলে স্থলে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এ উহার পণ্যভাণ্ডার লুণ্ঠন করিত,–ইহাও কবি-কল্পনা নহে, ঐতিহাসিক সত্য! এ সকল কিন্তু বহুদিনের বিলুপ্ত কাহিনী। পরবর্তী যুগে ইংরেজেরা যখন সসম্ভ্রমে বণিকবেশে শনৈঃ শনৈঃ বঙ্গদেশে পদবিক্ষেপ করিতে আরম্ভ করেন, তখন আর ভূগর্ভ রত্ন প্রসব করিত না, ৪ সেই স্বর্গরাজ্যের মোগল শাসনকর্তা নবাব শায়েস্তা খাঁ রাজধানী ঢাকা নগরীর পশ্চিম তোরণদ্বার চিররুদ্ধ করিয়া, তাহার উপর লিখিয়া গিয়াছিলেন যে, “আমার শাসন সময়ে টাকায় ৮ মন চাউল বিক্রীত হইল; ভবিষ্যৎ শাসনকর্তা এইরূপ সুলভ জীবিকার সংস্থান করিতে না পারিলে, এই তোরণদ্বার উন্মোচন করিবার চেষ্টা করিবেন না।”৫ শায়েস্তা খাঁর সেই জয়স্তম্ভদ্বার সরফরাজ খাঁর শাসনসময়ে যশোবসন্ত সিংহের যশোগৌরব ঘোষণা করিয়া সগর্বে আর একবার উন্মুক্ত হইয়াছিল! তাহার পর হইতে যে সকল ঘটনাপ্রবাহে ৮ মন ৮ সেরে পরিণত হইয়াছে, যাঁহারা স্বহস্তে সেই দুঃখদুর্দশার ইতিহাস গঠন করিয়া তুলিয়াছেন, তাঁহাদিগের নিকট সে কথা আর নূতন করিয়া বর্ণনা করিবার প্রয়োজন নাই। “সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা মাতা” বলিয়া আর বঙ্গভূমিকে অভিবাদন করা শোভা পায় না। মাতা এখন “সুইস পাষাণ’, অথবা মিশরের দগ্ধ মরুর ন্যায় অনুব্বর; বাঙ্গালী এখন উদরানের জন্য হাহাকার করিয়া বেড়াইতেছে! সত্যই যে এমন করিয়া বাঙ্গালীর কপাল পুড়িয়াছে, “সাতাত্তরের মন্বন্তরেই” তাহার প্রথম পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়; সেই জন্য ‘মন্বন্তরের” কথা বাঙ্গালী ভুলিয়াও ভুলিতে পারিতেছে না।
পলাশির যুদ্ধে ইংরাজ বাঙ্গালীর সমবেত শক্তি মোগল প্রতাপ পদদলিত করিয়াছিল, কিন্তু তথাপি মোগলের নাম বঙ্গদেশ হইতে একেবারে বিলুপ্ত হয় নাই। মীর কাশিমের পরাজয়ে মোগল শক্তির পরাজয় সম্পূর্ণ হইল। সেই সময়ে ভারতভাগ্যবিধাতা লর্ড ক্লাইব বিলাতের বণিক-সমিতিকে লিখিয়া পাঠাইলেন :
আরও কিছু দিন দেশীয় শক্তির পদানত হইয়া স্বেচ্ছাচারী শাসনকর্তৃগণের লুণ্ঠন ও নির্যাতন সহ্য করিয়া সামান্য বণিকের ন্যায় এ দেশে অবস্থান করিব, কিম্বা এখন হইতেই তরবারি হস্তে কোম্পানীর ক্ষমতারক্ষা ও রাজ্যবিস্তারে অগ্রসর হইব? কোন পথ অবলম্বন করিব, তাহার মীমাংসা করিবার সময় উপস্থিত হইয়াছে। পরিণামে কি হইবে, জানি না; কিন্তু একবার যখন শত্রুতার সৃষ্টি করিয়া এত দূর অগ্রসর হইয়াছি, তখন প্রত্যেক যুদ্ধে, প্রত্যেক মন্ত্রণায়, আমাদিগের ধন সম্পদ সংকটাপন্ন হইয়া উঠিবে। কোম্পানীর শাসন দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত করাই এখন একমাত্র সদুপায়।
এই সদুপায় অবলম্বন করিবার জন্য কোম্পানী বাহাদুর বঙ্গ, বিহার, উড়িষ্যার দেওয়ানী সনন্দ গ্রহণ করিয়া রাজস্বসংগ্রহে অগ্রসর হইলেন। বিলাতের কর্তৃপক্ষ লিখিতে লাগিলেন যে,–”রাজস্বসংগ্রহ ভিন্ন শাসন ও বিচার বিভাগে যেন কদাচ হস্তক্ষেপ করা না হয়। সুতরাং কোম্পানীর কর্মচারিগণ শাসনকার্য্যে হস্তক্ষেপ না করিয়া শোষণকার্যে অগ্রসর হইলেন। এক বৎসরের মধ্যেই চারি দিকে হাহাকার পড়িয়া গেল; কোম্পানী বাহাদুরেরও লাভ হইল না, লাভ হইল কেবল কোম্পানীর কর্মচারীদিগের। তাঁহারা ১৮৬৬ সালের মধ্যেই লিখিয়া পাঠাইলেন যে,–”জমীদারগণ বহুবর্ষের রাজস্ব অনাদায় রাখিয়া নানারূপ কলকৌশলে গবর্মেন্টের প্রাপ্য রাজকর আত্মসাৎ করিয়া যেরূপ মহা অপকারসাধন করিতেছেন, তাহা নিবারণ করিবার বিধান না করিলে, দেওয়ানীর আয়ে রাজস্বসংগ্রহের ব্যয়ভারেরও সংকুলন হইবে না!” সুতরাং আত্মরক্ষার জন্য জমীদারবংশ ধবংস করিয়া একের জমিদারী অন্যের নিকট উচ্চমূল্যে বিক্রয় করিবার প্রস্তাব উঠিতে লাগিল; কিন্তু লর্ড ক্লাইব স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করায়, জমীদারবংশ আপাততঃ শান্তিলাভ করিলেন।
ক্লাইব স্বদেশে চিরপ্রস্থান করিয়াও হতভাগিনী বঙ্গভূমির স্নেহমমতা বিস্মৃত হইতে পারিলেন না; যাঁহারা বঙ্গভাগ্য শাসন করিতেছিলেন, তাঁহাদের শিক্ষা দীক্ষার জন্য লিখিয়া পাঠাইলেন যে :
দেওয়ানী সনন্দ পাইয়া কোম্পানী বাহাদুরই দেশের রাজা হইয়াছেন; নবাবের আর কোনও ক্ষমতাই নাই,–তিনি কেবল পুরাতন পদগৌরবের ছায়াতলে কালযাপন করিতেছেন! কিন্তু তথাপি এই নাম এবং এই ছায়াকে আমরা যে সত্যই অন্তরের সঙ্গে শ্রদ্ধা করিয়া থাকি, এইরূপ ভাবে কাৰ্য্য করা আমাদের পক্ষে প্রয়োজন হইয়া উঠিয়াছে।১০
এই রাজনীতির কল্যাণে বঙ্গদেশে যে অরাজকতার সূত্রপাত হইল, ইতিহাসে তাহারই নাম Double Government; যিনি নামে শাসনকর্তা, কাজে তাঁহার কিছু মাত্র ক্ষমতা থাকিল না; যাঁহারা কাৰ্যতঃ প্রভু, তাঁহাদের কিছু মাত্র দায়িত্ব রহিল না;–বঙ্গভূমি শীঘ্রই অভিনব মহাবিপ্লবে বিপর্যস্ত হইতে লাগিল! কি ইংরাজ, কি মুসলমান,–কেহই প্রজারক্ষার জন্য ব্যস্ত হইলেন না; অস্তপথাবলম্বী মোগল প্রতাপ সায়াহ্নের শীতলরশ্মি বিকীরণ করিতে করিতে মেঘান্তরালে ডুবিয়া পড়িতে লাগিল; নবোদিত পূর্ণচন্দ্রের ন্যায় উত্থানোন্মুখ বৃটিশ প্রতিভা কেবল বিরহবেদনাই বর্ধিত করিতে লাগিল! ইংরেজেরা বাণিজ্যলোভে প্রজাসাধারণকে পদদলিত করিতে লাগিলেন; তাঁহাদের অপরাধের কথা অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণীকৃত হইতে লাগিল;–কিন্তু হায়। প্রজার রোদনে কেহই কর্ণপাত করিলেন না! জমীদারদল মান সম্ভ্রম এবং জমীদারী-রক্ষার জন্য ইংরেজের করুণাকটাক্ষের আশায়, তাঁহাদের সহিত ঘনিষ্ঠতা সংস্থাপন করিতে লাগিলেন;-জলে স্থলে বাঙ্গালীর কষ্টসঞ্চিত শস্য ভাণ্ডার প্রকারান্তরে লুষ্ঠিত হইতে আরম্ভ হইল।
একজন বিখ্যাত ইতিহাসলেখক লিখিয়া গিয়াছেন যে : কোম্পানীর ইংরাজ কর্মচারিগণ যে সকল দেশীয় গোমস্তা নিযুক্ত করিয়াছিলেন, তাহারা এতই উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছিল যে, নবাব এবং রাজপুরুষদিগকেও গ্রাহ্য করিত না;–প্রজাপীড়ন করিত, সৰ্ব্বস্ব লুণ্ঠন করিত, আবার স্বয়ং বিচারক সাজিয়া শাস্তি প্রদান করিত! এত করিয়াও তাহাদের ক্ষুৎক্ষামোদর পূর্ণ হইত না।১১
দোষ কাহার, তাহার বিচার করা নিষ্প্রয়োজন;-বর্ধমান, মেদিনীপুর এবং চট্টগ্রাম ইংরাজকবলে, চবিবশ পরগণা কোম্পানীর খাস তহশিলে, এবং অবশিষ্ট স্থান মহম্মদ রেজা খাঁর নায়েবীর শাসনাধীন;–এইরূপ ভাবে নূতন শাসন প্রচলিত হইল।
কিছু দিন এইরূপ শোষণকাৰ্য্য চলিতে না চলিতেই বাঙ্গালীর অদৃষ্টাকাশ ঘনতমসাচ্ছন্ন হইয়া উঠিল।
কিছু দিন এইরূপ শোষণকাৰ্য্য চলিতে না চলিতেই বাঙ্গালীর অদৃষ্টাকাশ ঘনতমসাচ্ছন্ন হইয়া উঠিল! সে মেঘ বঙ্গদেশের ক্ষেত্রে ক্ষেত্রে গ্রামে নগরে প্রাসাদে কুটীরে–সৰ্ব্বত্র প্রবলপ্রতাপে যেরূপ ভাবে অশনিবর্ষণ করিয়া গিয়াছে, শত যুদ্ধেও সেরূপ সৰ্ব্বনাশ সংঘটিত হয় নাই। ইতিহাসে ইহারই নাম “সাতাত্তরের মন্বন্তর।”
বর্গীর হাঙ্গামার শত লুণ্ঠনেও বঙ্গভূমি কাঙ্গালিনী হয় নাই; সিরাজশাসনের সূচনা হইতে মীর কাশীমের অধঃপতন পৰ্যন্ত যে সকল প্রবল রাজবিপ্লবে বঙ্গভূমি উপর্যুপরি বিধবস্ত হইতেছিল, তাহাতেও প্রজাপুঞ্জ গৃহবিচ্যুত হয় নাই; ফিরিঙ্গীর গোমস্তা মহাশয়দিগের নির্দয় নিপীড়নেও শস্যক্ষেত্র তৃণকন্টকে সমাচ্ছন্ন হয় নাই; –কিন্তু এই দৈবদুর্বিপাকে সোনার বাঙ্গালা চিরদিনের মত লৌহমূর্তি ধারণ করিল! ইহাই সেই সৰ্ব্বজীবভৈরব মহামন্বন্তর।
বাঙ্গালী অন্নগত-প্রাণ; সুতরাং হলচালনাই তাহার একমাত্র সৌভাগ্যসোপান। এই সৌভাগ্য, আকাশের মেঘ এবং নদ নদীর জলপ্লাবনের উপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে। মেঘ যথাকালে বারিবর্ষণ করিলে, নদ নদী প্রয়োজনানুরূপ জলধারা বহন করিয়া আনিলে, সামান্য শ্রমেই বঙ্গীয় কৃষকের কুটীর-প্রাঙ্গণ ধনধান্যে পরিপূর্ণ হইয়া যায়! সে তাহার বৎসরের অন্নগ্রাস সঞ্চয় করিয়া, অবশ্যদেয় রাজকর পরিশোধ করিয়া, পুত্র কলত্র লইয়া যথাসম্ভব নিরুদ্বেগে আর এক বৎসর জীবনধারণ করে। কিন্তু দেবতা বিমুখ হইলে, এক বৎসরেই বহু বৎসরের সুখ সৌভাগ্য ভস্ম হইয়া যায়!
১৭৬৮ খৃষ্টাব্দের প্রারম্ভে যে সকল কৃষকসন্তান আশা ও উৎসাহের সহিত গ্রাম্য সঙ্গীত গান করিতে করিতে ক্ষেত্রে ক্ষেত্রে হলকর্ষণে নিযুক্ত হইয়াছিল, উপযুক্ত বর্ষণভাবে, সুসময়ে জলসেচ না পাইয়া, শীঘ্রই তাহাদের আশা ও উৎসাহ উৎকণ্ঠায় পরিণত হইল। হৈমন্তিক ধান্য নষ্ট হইয়া গেল, অগ্নিমূল্য সৰ্ব্বত্র প্রচলিত হইতে লাগিল। তখনও বাঙ্গালী কৃষকের “গৃহস্থালী” ছিল; তাহা এখনকার ন্যায় শূন্যভাণ্ডে পরিণত হয় নাই; সুতরাং এক বৎসরের অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি প্রভৃতি আকস্মিক বিপৎপাতে বঙ্গীয় কৃষক এখনকার মত হাহাকার করিত না! প্রত্যেক গৃহস্থালীতেই অন্ততঃ তিন বৎসরের আহাৰ্য্য ও বীজধান্য সঞ্চিত থাকিত; সুতরাং কোনও এক বৎসর সহসা অগ্নিমূল্য প্রচলিত হইলেও, তাহাতে কৃষকপল্লী হাহাকার করিত না। এক বৎসর নিরাশ হইয়া পর বৎসরের ফসলের আশায় আবার কৃষককুল হলকর্ষণ করিল; কিন্তু আকাশের দিকে চাহিয়া চাহিয়া বৎসর চলিয়া গেল;–১৭৬৯ খৃষ্টাব্দেও শস্যের আশা নির্মূল হইল।
এবার অভূতপূৰ্ব্ব বিপৎপাতের আশঙ্কায় কৃষককুল আতঙ্কিত হইয়া উঠিল। রাজপুরুষেরা ইংরাজদিগের নিকট সে কথা নিবেদন করিলেন, দীন দুঃখীরা কিছু কিছু অন্ন কষ্ট সহ্য করিতে লাগিল;–কিন্তু ইংরাজ দেওয়ান অথবা তাঁহাদিগের মুসলমান নায়েব, কেহই সে দিকে দৃষ্টিপাত করিলেন না! রাজস্ব–রাজস্ব রাজস্ব,–ইহাই কেবল তাঁহাদের একমাত্র চিন্তার বিষয় হইয়া উঠিয়াছিল; সুতরাং রাজস্বসংগ্রহের কিছুমাত্র ত্রুটি হইল না!
রাজপুরুষেরা মন্বন্তরের কথা কানে তুলিতে সম্মত না হইলেও, চারি দিক হইতে কেবল সেই এক কথাই তাঁহাদিগের কর্ণকুহর পরিপূর্ণ করিতে লাগিল। উত্তর, দক্ষিণ, পূৰ্ব্ব, পশ্চিম,সকল দিক হইতেই হাহাকারে দেশ প্রতিধবনিত হইতে লাগিল! প্রদেশীয় ফৌজদার ও জমীদারগণ ভগ্নহৃদয়ে সেই দুঃখদৈন্যের করুণ কাহিনী রাজদ্বারে বহন করিতে লাগিলেন! যখন কালের চিতা ধূ ধূ করিয়া জ্বলিয়া উঠিল, তখন সুপ্তোত্থািতের ন্যায় ইংরাজ দেওয়ান এবং তাঁহাদিগের মুসলমান নায়েব সহসা চমকিয়া উঠিলেন;–ইংরাজ সেনার অন্ন সংস্থানের জন্য ছলে বলে কৌশলে যথাসাধ্য চাউল ধান গোলাজাত করিয়া, পুনরায় নিপুণহস্তে রাজস্ব সংগ্রহে নিযুক্ত হইলেন।
রাজস্বসংগ্রহে এরূপ নিৰ্ম্মম কঠোরতা প্রচলিত হইল যে, রাজা ও জমীদারবর্গ চিন্তাকূল হইয়া উঠিলেন। যথাকালে রাজস্বপ্রদানে শিথিলতা করিলে পৈতৃক রাজ্য, ধন, মান, সম্ভ্রম,–কিছুই যে অধিকদিন জমীদারবংশের গৌরব রক্ষা করিবে না, সে কথা সকলেই আকারে ইঙ্গিতে বুঝিতে পারিয়াছিলেন। তথাপি তাঁহারা কিছু দিনের অবসর পাইবার জন্য রাজদ্বারে কাকুতি মিনতি জানাইতে ত্রুটি করিলেন না। সে কথায় কেহ কর্ণপাত করিল না! তখন আত্মরক্ষার জন্য জমীদারগণও নির্মমহৃদয়ে করসংগ্রহে নিযুক্ত হইলেন। কৃষক পল্লীতে হাহাকার পড়িয়া গেল; দুই বৎসরের শস্যনাশেও তাহারা সম্বলহীন হয় নাই, কিন্তু এবার রাজকরপরিশোধের জন্য তাহাদের কষ্টসঞ্চিত ক্ষুধার অন্নেও হস্তক্ষেপ করিতে হইল,–বীজধান্য পৰ্য্যন্তও বিক্রীত হইতে লাগিল! ইহাই যে মন্বন্তরের প্রধান এবং প্রকৃত দুর্দশার কারণ, তখন কিন্তু কেহই সে বিষয়ে দৃষ্টিপাত করিলেন না।
১৭৭০ খৃষ্টাব্দের সূচনা হইতেই চারি দিকে কালের চিতা জ্বলিয়া উঠিল; অন্নাভাবের সঙ্গে মহামারী মিলিত হইয়া গ্রাম নগর উৎসন্ন করিতে আরম্ভ করিল। মহম্মদ রেজা খাঁ আর নীরব থাকিতে পারিলেন না; তিনিও ইংরাজ প্রভুর নিকট দেশের দুর্দশার কথা নিবেদন করিতে আরম্ভ করিলেন। রাজা, জমীদার ও রাজপুরুষগণ যেরূপ প্রাণের ব্যাকুলতায় রাজদ্বারে ক্রন্দন করিতে লাগিলেন, তাহাতে আশানুরূপ ফল ফলিল না। কোম্পানীর কর্মচারীগণ তরুণ জীবনে অর্থোপার্জনের জন্য আত্মীয় স্বজনগণও প্রিয়তম জন্মভূমির স্নেহনীড় পরিত্যাগ করিয়া এ দেশে শুভাগমন করিয়াছেন; এ দেশে আসিয়া কোম্পানীদত্ত সামান্য বেতনে তাঁহাদের গ্রাসাচ্ছাদনই চলিত না; সুতরাং সকলেই গোপনে গোপনে স্বনামী বিনামী বাণিজ্য ব্যবসায়ে ইচ্ছানুরূপ অর্থোপার্জন করিতেন!১২ সকলেই ইহা জানিতেন। কিন্তু স্বার্থসাধনের জন্য কেহই ইহার গতিরোধ করিতেন না। বিলাতের কর্তৃপক্ষ ইহার মূলোচ্ছেদ করিবার জন্য কত তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ করিয়াছেন, কত তর্জনগজ্জনপূর্ণ আদেশলিপি পাঠাইয়াছেন;–কিন্তু কেহই তাহার মর্যাদা রক্ষা করে নাই।১৩ দেশময় মহামন্বন্তর জাগিয়া উঠিলে, এই সকল শ্বেতাঙ্গ সওদাগর-গোষ্ঠীর পক্ষে রাতারাতি বড়মানুষ হইবার সহজ পথ আবিষ্কৃত হইল। তাঁহারা বাহুবলে সুলভ মূল্যে অনুসঞ্চয় করিয়া, তাহাই আবার ইচ্ছানুরূপ অগ্নিমূল্যে বিক্রয় করিতে আরম্ভ করিলেন। দুর্ভিক্ষের গতিরোধ করিবার জন্য কোনরূপ আয়োজন করা দূরে থাকুক, বরং দুর্ভিক্ষ যত দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহাই ইহাদের লক্ষ্য হইয়া উঠিল।
পাটনার শাসনকর্তা মহারাজ সিতাব রায় লিখিয়া পাঠাইলেন যে :
অন্নাভাবের কথা আর কি লিখিব? পাটনার ন্যায় সমৃদ্ধ মহানগরীর প্রকাশ্য রাজপথে প্রত্যহ পঞ্চাশ জন হতভাগার মৃতদেহ ধুলিবিলুণ্ঠিত হইতেছে!
নদীয়া, বর্ধমান, এবং অন্যান্য প্রদেশ হইতেও এইরূপ সংবাদ আসিতে লাগিল। পূর্ণিয়ার মহম্মদ আলি খাঁ, বিষ্ণুপুরের নবকিশোর, যশোহরের অজাগরমল্ল, রাজমহলের প্রতাপ রায় প্রভৃতি ফৌজদারগণ, প্রতিদিন এই ভীষণ হত্যাকাণ্ডের শোচনীয় সংবাদে রাজপুরুষগণকে উত্যক্ত করিয়া তুলিলেন;–অবশেষে মুর্শিদাবাদ এবং কলিকাতার রাজপথ লোকে লোকারণ্য হইয়া উঠিল। উদরান্ন সংগ্রহ করিবার আশায়, কৃষাণ কৃষাণীরা পুত্র কন্যার হাত ধরিয়া রুক্ষকেশে, শুষ্ককণ্ঠে, শূন্য ভাণ্ড লইয়া রাজদ্বারে সমবেত হইতে লাগিল। স্থানে স্থানে অন্নছত্র প্রতিষ্ঠিত হইল, সদাশয় ধনকুবেরগণ কেহ কেহ অর্থসাহায্য প্রদান করিতে আরম্ভ করিলেন; কিন্তু হায়! চারি দিকে যে মহামন্বন্তরের চিতাকুণ্ড জ্বলিয়া উঠিয়াছিল, সমস্ত জাহ্নবীজলও তাহা শীতল করিতে পারিল না। ক্রমশঃ জীবিতের হাহাকারের সঙ্গে মুমূর্মুর অস্ফুট আৰ্তনাদ মিলিত হইয়া রাজপথ মহাশ্মশানে পরিণত হইল।
একজন বর্ণনানিপুণ ইংরাজ লেখক লিখিয়া গিয়াছেন যে :
বাঙ্গালী এমন শান্তস্বভাব যে, আকস্মিক বিপৎপাতেও সে সহসা ধৈৰ্য্যচ্যুত হয় না! অদম্য হৃদয়বেগ এমন সম্পূর্ণরূপে সংযত করা অভ্যস্ত হইয়াছে যে, বাঙ্গালীর ক্রোধাগ্নিও সুসংযত;–তাহার প্রবল উত্তাপে হৃদয়স্তর দগ্ধ হইয়া গেলেও বাঙ্গালী সহসা সে কথা দন্তুস্ফুট করিতে চাহে না! ইহাদের কৃতজ্ঞতাও সেইরূপ;–শীতল শান্তিসলিলধারার ন্যায় বংশের পর বংশ বাঙ্গালীর কৃতজ্ঞতাস্রোত প্রবাহিত হইয়া থাকে; কিন্তু একদিনের জন্যও তাহা বাহ্যাড়ম্বরে প্রকাশিত হয় না! পারিবারিক ব্যাপারেই বাঙ্গালীর আত্মগোপনচেষ্টা সমধিক জয়লাভ করিয়াছে। ১৮৬৬ খৃষ্টাব্দের দুর্ভিক্ষে কত অন্নহীন সম্ভ্রান্ত মহিলাদিগকে চেষ্টা করিয়াও ভিক্ষাগ্রহণে সম্মত করিতে পারা যায় নাই! কত দরিদ্র পরিবার ধীরে ধীরে মৃত্যুক্রোড় আশ্রয় করিয়াছে,তথাপি একদিনের জন্যও তাহাদের হাহাকার বাহিরের লোকের কর্ণগোচর হয় নাই!১৪
১৭৭০ খ্রিস্টাব্দের নিদারুণ গ্রীষ্মকালে শত শত লোকে কালকবলে পতিত হইতে আরম্ভ করিল। কৃষকেরা গোমহিষাদি বিক্রয় করিল, কৃষিযন্ত্রাদি হস্তান্তরিত করিল, বীজধান্য পর্যন্তও দুর্ভিক্ষে দগ্ধ হইয়া গেল;–অবশেষে তাহারা পুত্র কন্যা বিক্রয় করিতে আরম্ভ করিল। কিন্তু হায়! অল্পদিনের মধ্যেই ক্রেতার সংখ্যা হ্রাস প্রাপ্ত হইল!
যতদিন বৃক্ষলতা এবং তৃণপত্র অবশিষ্ট ছিল, তত দিন তাহাতেও কত লোকে জঠরজ্বালার নিবারণ করিল;–অবশেষে জুন মাসে মুরশিদাবাদের রোসবেল্ট সাহেব সংবাদ পাঠাইলেন যে, “জীবিতেরা মৃতদেহ ভক্ষণ করিতে আরম্ভ করিয়াছে!” যেখানে রাজধানী বা প্রধান নগর, সেখানেই প্রতিদিন বন্যাতাড়িত জলপ্রবাহের ন্যায় জনস্রোত প্রবেশ করিতে লাগিল;–অনাহার অনিদ্রার সহিত মহামারী মিলিত হইল! জীবিত ও জীবন্থত নরনারী বালক বালিকা মৃতদেহের সহিত মিলিত হইয়া স্কুপে স্থূপে রাজপথ অবরোধ করিয়া ফেলিল! মৃতের সৎকার, পরমাত্মীয়ের সামাজিক অন্ত্যেষ্টিপদ্ধতি একেবারে পরিত্যক্ত হইল! কাক, শকুনি, শৃগাল, কুকুর যে দেশের প্রকৃতি-নিযুক্ত শবখাদক, তাহারাও আত্মকাৰ্য্য সুসম্পন্ন করিতে অশক্ত হইয়া উঠিল!
একজন সমসাময়িক সহৃদয় ইংরাজ কবি মুরশিদাবাদের পথে ঘাটে এই সকল হৃদয়বিদারক শ্মশানচিত্র পরিদর্শন করিয়া হৃদয়ের আবেগে ইংরাজি-সাহিত্যে যে সকরুণ কবিতা লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন,–যত দিন মানবহৃদয় পরপীড়ার করুণ বিলাপে অশ্রুবর্ষণ করিতে বিস্মৃত না হইবে, তত দিন তাহা মন্বন্তরের করুণকাহিনী জাগরূক করিয়া রাখিবে! কবি লিখিয়াছেন :
এখনো স্মৃতির চক্ষে দেখি সেই ছায়া, এখনও শুনি যেন শকুনি-নিঃস্বন
শীর্ণ অঙ্গ, লুপ্ত চক্ষু, প্রাণহীন কায়া! শৃগাল-চীৎকার সহ কুকুর-গর্জন!
এখনও শুনি যেন পাতিয়া শ্রবণ, অবারিত দিবালোকে ঘেরি চারিধার
মাতৃ-আর্তনাদ সহ শিশুর রোদন! শব ধরি কাড়াকাড়ি করে অনিবার!
এখনও জাগে যেন প্রাণের ভিতর সে ভীষণ দৃশ্যপট করিতে বর্ণন
হতাশের হাহাকার, মর্মভেদী স্বর! মানব-লেখনী স্তব্ধ,–সরে না বচন!
শব সহ শবাকার মুমূর্ষ জীবন কত বর্ষ গত–আরো কত বর্ষ যাবে;
অগরিত স্থূপাকার; ভীষণ দর্শন! তবু সে স্মৃতির রেখা কভু না মুছিবে!১৫
ইহার এক বর্ণও মিথ্যা নহে। সত্যই সে ভীষণ কাহিনীর বর্ণনা করিতে গিয়া মানব-লেখনী অবসন্ন হইয়া পড়ে! এই মহামন্বন্তরে বঙ্গদেশের যে কি অভূতপূর্ব সর্বনাশ সংঘটিত হইয়াছিল, কেবল পরবর্তী ইতিহাসই তাহা কিয়ৎপরিমাণে হৃদয়ঙ্গম করাইতে সক্ষম।
বিধাতার মঙ্গলময় নিয়মে ঝটিকার অবসানে শান্তির ন্যায়, দুর্ভিক্ষের অবসানে অনুকূল পবন যথাকালে বারিধারা বহন করিয়া আনিল। কিন্তু হায়! বাঙ্গালার বিজন বনে হলকর্ষণ করিবে কে? হলকর্ষণক্ষম কৃষকপরিবার জীবিত নাই;–এক তৃতীয়াংশেরও অধিক লোক অকালে জীবন বিসর্জন করিয়াছে! যাহারা জীবিত, তাহারাও শোকে দুঃখে ম্রিয়মাণ, অনাহারে অনিদ্রার জীর্ণ শীর্ণ, গো মহিষ, কৃষিযন্ত্র, এবং বীজধান্যের অভাবে নিরুপায়! এবার চারি দিক হইতেই আশঙ্কার উচ্চরোল উঠিল! ভারতে ও বিলাতে বঙ্গীয় কৃষকের মলিন মুখের দিকে অনেকের স্নেহদৃষ্টি পতিত হইতে লাগিল। রাজস্বসংগ্রকারী রাজকর্মচারিগণও হতাশনয়নে শূন্যময় ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়া হা হুতাশে ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন! এত দিন ধনকুবেরদিগের সৌধপাদমূলে নিরন্ন কাঙ্গাল কৃষক ‘হা অন্ন! হা অন্ন!’ করিয়া জীবন বিসর্জন করিতেছিল; এখন কৃষকহীন বঙ্গভূমির কুবেরসন্তানগণ ভবিষ্যতে রাজকরসংগ্রহের উপায়ান্তর না দেখিয়া, হাহাকার করিতে আরম্ভ করিলেন! সুতরাং শীঘ্রই অনুসন্ধান আরব্ধ হইল!
বিপদে পড়িয়া ইংরাজেরাও স্বীকার করিলেন যে, “তাঁহারা এত দিন এ দেশকে জন কতক উদ্যমশীল ইংরাজ-বণিকের পণ্যশালা বলিয়াই বুঝিয়া রাখিয়াছিলেন; এ দেশে যে কোটি কোটি নরনারী বাস করিতেছে, তাহা কেবল আকস্মিক ঘটনামাত্র বলিয়াই ধারণা হইয়াছিল। কিন্তু হায়! বিপদে পড়িয়া সকলেই বুঝিলেন যে, বাঙ্গালীই বঙ্গদেশের সকল সুখসৌভাগ্যের মূল। এ দেশে আসিয়া ধনোপার্জন করিতে হইলে বাঙ্গালীর সুখ দুঃখে উদাসীন হইলে চলিবে না!” বিধাতার মঙ্গলবিধানে মন্বন্তরের ন্যায় মহা অমঙ্গল হইতেও এ দেশের ভবিষ্যৎ কল্যাণের সূচনা হইল; বাঙ্গালীর সুখ দুঃখের প্রতি বিলাতের কর্তৃপক্ষের প্রখর দৃষ্টি নিপতিত হইবার সূত্রপাত হইল!
কাহার দোষে লক্ষ লক্ষ নরনারী অকালে কাল-কবলে জীবন বিসর্জন করিল, অদৃষ্টবাদী বঙ্গবাসী আর তাহার তথ্যানুসন্ধানের জন্য কোনরূপ উদ্বেগ প্রকাশ করিল না। কিন্তু বিলাতের অনুসন্ধানলোলুপ বৃটিশ সওদাগর ওয়ারেণ হোস্টিংসকে ভারতশাসনকার্যে বরণ করিয়া, ভবিষ্যতের কল্যাণের জন্য অতীতের দুঃখ দৈন্যের মূলানুসন্ধানে নিযুক্ত হইলেন!
১৭৭১ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে বিলাতের ডিরেক্টারগণ লিখিয়া পাঠাইলেন যে : যাঁহারা কিয়ৎপরিমাণেও মন্বন্তরের গতিরোধ করিবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করিয়াছেন, তাঁহাদিগকে অজস্র ধন্যবাদ। কিন্তু যাঁহারা এরূপ বিপদের দিনেও পরপীড়ন করিয়া অর্থোপার্জন করিয়াছেন, তাঁহাদিগের প্রতি আন্তরিক ঘৃণা প্রদর্শন করিতে বাধ্য হইলাম। ইংরাজেরা বাঙ্গালা দেশে আসিয়া ধান চাউলের ব্যবসায় খুলিয়া সমুদায় শস্য গোলাজাত করিয়াছিলেন বলিয়াই যে এরূপ ভয়ঙ্কর অন্নকষ্ট উপস্থিত হইয়াছিল, তাহা সত্য কথা; কিন্তু তজ্জন্য আমরা কাহাকেও কিছু বলিতে চাহি না। তাঁহারা যে নিরন্ন কৃষকপরিবারকে বাহুবলে বীজধান্য পর্যন্ত বিক্রয় করিতে বাধ্য করিয়া, তদ্বারা আপনারা অর্থোপার্জন করিয়াছেন, তাহাই আমাদিগের ঘৃণাপ্রদর্শনের প্রধান কারণ! এই সকল হৃদয়হীন ইংরেজাধম অর্থলোলুপ ব্যবসায়িগণ যে আমাদিগেরই উচ্চপদস্থ কর্মচারীমাত্র, তাহা বুঝিতে আমাদিগের কিছুমাত্র ইতস্ততঃ হয় নাই!১৬।
হেষ্টিংস আসিয়া যখন মুলানুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইলেন, তখন আরও কত শোচনীয় কাহিনী প্রকাশিত হইতে লাগিল! তিনি লিখিলেন যে :
এত বড় মহামন্বন্তরেও রাজস্বসংগ্রহে কিছুমাত্র শিথিলতা করা হয় নাই। এক তৃতীয়াংশ কৃষক জীবন বিসর্জন করিয়াছে, কৃষিকার্য বিলুপ্তপ্রায় হইয়াছে, কিন্তু তথাপি দুর্ভিক্ষশেষে পূর্ববৎ অক্ষুগ্ন-প্রতাপে রাজকর সংগৃহীত হইতেছে! যে সকল কারণে সর্বনাশ হইয়াছে, তন্মধ্যে ইহাও একটি প্রধান কারণ বলিতে হইবে। সেকালে ‘নাজাই জমা’ নামে একটি রাজকর প্রচলিত ছিল;–স্বগ্রামের কোন কৃষক মৃত কি পলায়িত হইলে, বর্তমান প্রজাদিগকে তাহার দেয় রাজকর অংশানুসারে পূরণ করিয়া দিতে হইত;–ইহারই নাম ‘নাজাই জমা!’ এই নিয়ম প্রচলিত থাকায় প্রজারা সহজে পলায়ন করিতে পারিত না; কেহ পলায়ন করিবার চেষ্টা করিলেও, প্রতিবেশীরাই প্রতিবন্ধক হইয়া দাঁড়াইত, কর-সংগ্রাহক রাজকর্মচারিগণ ভূস্বামীকে প্রতারণা করিয়া রাজকর আত্মসাৎ না করে,–প্রজা থাকুক আর না-থাকুক, রাজার রাজস্বসংগ্রহে কিছুমাত্র ত্রুটি না হয়, এই জন্য ‘নাজাই জমার’ প্রচলন হইয়াছিল। সুখের দিনে ইহাতে কাহারও ক্ষতি বৃদ্ধি হয় নাই; কিন্তু মন্বন্তরের সময়ে ইহাতেই অনেকের সর্বনাশ হইয়াছিল।১৭
কিরূপ ভাবে রাজকর সংগৃহীত হইয়াছিল, সরকারী কাগজপত্রে এখনও তাহার নিদর্শন বর্তমান রহিয়াছে। ১৭৬৮ খ্রিস্টাব্দে শস্যনাশ ও দুর্ভিক্ষের পূর্বসূচনা; ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে দুর্ভিক্ষে ঘনীভূত হইয়া, ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে মন্বন্তর আনয়ন করে। এই তিন বৎসর কিরূপ অপ্রতিহতপ্রভাবে ইংরাজ দেওয়ান শুভপূণ্যাহান্তে রাজকর সংগৃহীত করিয়াছিলেন, নিম্নে তাহার তালিকা প্রদত্ত হইল :
১৭৬৮ খ্রিস্টাব্দ … … … …. ১৫২৫৪৮৫৬
১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দ … … … … ১৩১৪৯১৪৮
১৭৭০ খ্রিস্টাব্দ … … … … ১৪০০৬০৩০
১৭৬৮/১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে রাজস্ব প্রদান করিবার জন্য প্রজাদিগকে সর্বস্বান্ত হইতে হইয়াছিল;–১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে যখন মন্বন্তর পূর্ণমাত্রায় প্রচলিত, তখনও পূর্ণমাত্রায় রাজকর সংগৃহীত হইয়াছিল! লোকের সর্বনাশ ঘটিতে যাহা কিছু অবশিষ্ট ছিল, ১৭৭১ খ্রিস্টাব্দে তাহাও সুসম্পন্ন হইল! দেশে কৃষক নাই; ক্ষেত্রে হলকর্ষণ নাই; জমিদারিতে কপর্দক আদায় হইবার উপায় দেখা যায় না; অথচ ইংরাজ-রাজ এই দুর্বৎসরে পাকেচক্রে জমিদারদিগের নিকট হইতে ১৫৩৩৩৬৬০৷৷ রাজকর আদায় করিয়া লইলেন! এই উপলক্ষে এ দেশের অধিকাংশ রাজা জমিদার সর্বস্বান্ত ও ঋণগ্রস্ত হইয়া পড়িলেন!
যে সকল রাজা ও জমিদার রাজস্বদানে অশক্ত হইলেন, তাঁহাদের রাজ্যভোগ বিলুপ্ত হইয়া গেল;–কেহ কেহ কারাগারে নিক্ষিপ্ত হইলেন, কাহারও কাহারও পুত্র কলত্র পথে পথে রোদন করিয়া বেড়াইতে লাগিল! দুর্ভিক্ষাবসানে বর্ধমানের বৃদ্ধ মহারাজ ভগ্নহৃদয়ে ইহলোক হইতে অবসর গ্রহণ করিলেন;–তাঁহার ইতিহাস-বিশ্রুত অক্ষয় ভাণ্ডার এরূপ অর্থশূন্য হইয়া পড়িয়াছিল যে, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য স্বর্ণ রৌপ্যের তৈজসপত্র বিক্রয় করিয়াও ক্রিয়া সম্পন্ন হইল না; উপরন্তু গবর্মেন্টের নিকট ঋণ গ্রহণ করিতে হইল! নদিয়ার রাজেন্দ্র কৃষ্ণচন্দ্র ভূপবাহাদুর কোনরূপে প্রাণে প্রাণে পরিত্রাণলাভ করিলেন, কিন্তু এই সূত্রেই তাঁহার রাজ্যনাশের সূচনা হইল! বীরভূমির মহম্মদ জামা খাঁ তরুণ যুবক, এক বৎসরও রাজ্যভোগ করেন নাই;–তাঁহাকে ঋণদায়ে কারাগারে গমন করিতে হইল! বিষ্ণুপুরের বৃদ্ধ মহারাজ দামোদর সিংহ কলিকাতার গোকুল চন্দ্র মিত্রের নিকট লক্ষ মুদ্রা ঋণ গ্রহণ করিয়া পৈতৃক বিগ্রহ মদনমোহন ঠাকুর বন্ধক দিয়াও নিষ্কৃতি পাইলেন না;–তাঁহাকেও পলিতকেশে কারাগারে গমন করিতে হইল!১৮
এই মহাবিপ্লবে দীনপালিনী রানি ভবানীকেও নানারূপ লাঞ্ছনা ভোগ করিতে হইয়াছিল! তাঁহার সুশাসনকৌশলে রাজসাহীর বিস্তীর্ণ জনপদ তাঁহার হস্তচ্যুত হইল না; কিন্তু সহজে রাজস্ব প্রদান না করিলে তাঁহাকেও যে রাজ্যচ্যুত হইতে হইবে, এ কথা পুনঃপুনঃ ঘোষণা করা হইল! কাঙ্গাল সন্তানের দুঃখ দৈন্যে স্নেহময়ী জননীর ন্যায় রাণী ভবানী চিরদিন অমোচন করিয়াছেন; চিরদিন তাঁহার স্নেহধারায় বঙ্গবাসী নরনারী দুঃখে কষ্টে সান্ত্বনা লাভ করিয়াছে;–সুতরাং মহামন্বন্তরে তিনি নীরবে হাহাকার শ্রবণ করিতে পারিলেন না! অকাতরে মুক্তহস্তে রাজভাণ্ডার শূন্য করিয়া প্রজারক্ষা করিতে গিয়া, প্রশংসার পরিবর্তে রানি ভবানীকে রাজস্বদানের জন্য পুনঃ পুনঃ তাড়না সহ্য করিতে হইল! দিনাজপুরাধিপতি মহারাজ বৈদ্যনাথ দুর্ভিক্ষশেষে হৃতসর্বস্ব হইয়া, ১৭৭১ খ্রিস্টাব্দে ১৩৭০৯৩২ টাকা আদায়ের রাজস্বের মধ্যে ১২০০০০০ টাকা পরিশোধ করিয়া, অবশিষ্ট রাজস্বপ্রদানের জন্য কয়েক মাস অবসর প্রার্থনা করিয়াছিলেন; এই অপরাধে তাঁহার প্রতি আদেশ হইল যে, “রাজা যদি কোম্পানির প্রাপ্য পূর্ণ রাজস্ব প্রদান করিতে শিথিলতা করেন, তবে তাঁহাকে রাজ্যত্যাগ করিয়া ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির ন্যায় কলিকাতায় আগমন করিতে হইবে!” প্রতিবেশীর দুর্দশার সমাচার অবগত হইয়া রাণী ভবানী আর উচ্চবাচ্য করিতে সাহস পাইলেন না;–যেরূপ দিন কাল পড়িয়াছে, তাহাতে রাজ্যরক্ষা করিতে গিয়া তাঁহাকেও রাজভাণ্ডার শূন্য করিতে হইল!
রাণী ভবানী কিরূপ সুকৌশলে রাজ্যরক্ষা করিয়া লক্ষ লক্ষ নরনারীর অন্নজলের সংস্থান করিয়া দিয়াছিলেন, সে কথা কেবল ইংরাজের জীর্ণ দপ্তরে কীটদষ্ট হইতে লাগিল; “সবিশেষ প্রতিভাশালিনী” বলিয়া শূন্যগর্ভ প্রশংসাবাণী লাভ করিয়াই তাঁহাকে সন্তুষ্ট হইতে হইল! দুর্ভিক্ষের সূচনায় বুদ্ধিমতী মহারাণী অনুসঞ্চয়ের চেষ্টা করিয়া রাজকোষ শূন্যপ্রায় করিয়াছিলেন। রাজসাহীর ইংরাজ কালেকটার রৌস সাহেব লিখিয়া গিয়াছিলেন যে :
দেশে কিরূপ দুর্দশা উপস্থিত হইয়াছে, কেবল একটিমাত্র ঘটনার উল্লেখ করিলেই তাহা সুপ্রকাশিত হইবে! রাজসাহী অঞ্চলের লোকে বোধ হয় কখনও অন্য স্থান হইতে ধান চাউলের আমদানী করে নাই;–এবার তাহাও করিতে হইয়াছে।
রাণী ভবানী প্রজারক্ষার জন্য মুর্শিদাবাদ এবং দিনাজপুর হইতে অগ্নিমূল্যে চাউল ধান ক্রয় করিয়া স্বরাজ্যে তাহাই টাকায় আঠার সের মূল্যে বিক্রয় করাইয়াছিলেন; এবং লোকে যখন সত্য সত্যই মৃত্যুমুখে পতিত হইতে লাগিল, তখন চারি দিকে অন্নছত্র খুলিয়া অকাতরে অন্নদান করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। রাজভাণ্ডার হইতে রাজস্ব প্রদান করিয়া, জলহীন স্থানে জলাশয় খনন করাইয়া, অন্নহীন নরনারীকে অন্নজল বিতরণ করিয়া, রুগ্নশয্যাপার্শ্বে ঔষধ পথ্য প্রেরণ করিয়া, রাণী ভবানী কিরূপ সেবাব্রত গ্রহণ করিয়াছিলেন, কেবল একটিমাত্র কথায় তাহা হৃদয়ঙ্গম হইবে;”রাজধানী মুর্শিদাবাদে যখন টাকায় তিন সের চাউল, ভবানীর অন্নছত্রে তখন লক্ষ লক্ষ নরনারী অন্নজল উপভোগ করিতেছিল!” এই পুণ্যকাহিনী বর্ণনা করিবার জীবিত সাক্ষী বর্তমান নাই; কিন্তু বাঙ্গালীর ইতিহাসে এমন ‘অন্নপূর্ণার অবতার” কেহ কখন দেখে নাই, দেখিবে না! সাতাত্তরের মন্বন্তরের অবসানে মাতা অন্নপূর্ণাকেও অন্নহীনা হইয়া উত্তরকালে গবর্মেন্টের মাসিক বৃত্তির উপর নির্ভর করিয়া, কাঙ্গালিনীর ন্যায় গঙ্গাতীরে জীবন বিসর্জন করিতে হইয়াছিল! যখন তাঁহার দেহাবসান হইল, তখন ভিক্ষাপাত্র লইয়া তাঁহার হৃতসর্বস্ব নামাবশিষ্ট নাটোরাধিপতি পৌত্র কুমার বিশ্বনাথ রায় বাহাদুর ইংরাজ গবর্মেন্টের নিকট যে আবেদনপত্র প্রেরণ করিয়াছিলেন, তাহার বিবরণ সরকারি পুস্তকে১৯ এইরূপ লিখিত আছে:
“Letter from collector of Murshidabad, transmitting a petition from Kumar Biswa Nath Rai, praying assistance of Government towards defraying the expense of the funeral obsequies of his deceased grand mother, the late Rani Bhabani.”-”Letter to collector of Murshidabad in reply declining to recommend the application of Kumar Biswa Nath Rai to be complied with.”
সাহিত্য, কার্তিক, ১৩০৩
তথ্যসূত্র
১ Ain-Akbari.
২ Tavernier’s Travels.
৩ Danver’s Portuguese in India.
8 I never saw a country in which provisions were so cheap.–Travels of Iben-Batuta.
৫ It is related that during his Government, grain was so cheap that rice was sold at the rate of 640 lbs weight for the rupee. –Stewart, p. 203.
৬ The gate had continued closed to this time; when Jeswont Roy, having succeeded in reducing the price of grain to Shaista Khan’s standard, ordered it to be opened. –Stewart, p. 268.
৭ The time now approaches when we may be able to determine with some degree of certainty, whether our remaining as Merchants, subjected to the jurisdiction, encroachments and insults of the country Government, or the supporting your privileges and possessions by the sword, are likely to prove most beneficial to the Company, & c.–Clive’s letter to Court, September 3, 1765, para 21.
৮ Court’s letter, 17 May, 1766.
৯ Without the greatest care being taken to prevent Zamindars from carrying in long balances, and defrauding the Government under various pretences, your collections would soon dwindle to a sum insufficient to defray their own charges.–er Letto Court, 8 September, 1766.
১০ Clive’s letter to the Select Committee, 1767.
১১ Mill’s History, Vol. III.
১২ When youth embark in your service, at the age of 15 or 16, it can not be reasonable supposed they set out with any fixed principles of moral rectitude. –Holwell’s India Tracts, p. 426.
১৩ Orders against it transmitted to your President and Council of Fort William from the year 1702 to 1756, each of these orders directing, on detection, immediate dismission from the service, and the aggressor to be sent to England on the first returnin ship, but notwithstanding these orders, and the utmost vigilance of your Council abroad to prevent this practice, it was found impossible. –A Defence of Mr. Vansittart’s Conduct in concluding the treaty of Commerce.
১৪ Hunter’s Annals of Rural Bengal.
১৫ স্যার জন সোর; অনুবাদিত।
১৬ Court’s letter, August, 1771.
১৭ Hasting’s letter, 3 November, 1772.
১৮ Hunter’s Annals of Rural Bengal.
১৯ Bengal MSS Records, Vol. IV.
গোলাম হোসেন
একজন বিখ্যাত ইংরাজ ঐতিহাসিক লিখিয়া গিয়াছেন, “ইংলণ্ড একটি ক্ষুদ্র দ্বীপ, তথাপি তাহার প্রত্যেক পল্লীর স্বতন্ত্র ইতিহাস লিখিত হইয়াছে; ভারতবর্ষ এত বড় বিস্তৃত দেশ, অথচ ইহার প্রধান প্রধান বিভাগেরও ইতিহাস দেখিতে পাওয়া যায় না!” আমরা যে স্বদেশের ইতিহাসের অভাবে বিদেশীয়গণের নিকট এইরূপ উপহাস্পদ হইয়া উঠিয়াছি, তাহাতে সন্দেহ নাই। আমরা ইতিহাস লিখি না; কেউ লিখিলেও তৎপ্রতি সম্যক সমাদর প্রদর্শন করি না; কি পুরাতত্ত্ব, কি আধুনিকতত্ত্ব, আমাদিগের নিকট সকল তত্ত্বই সমভাবে উপেক্ষিত হইতেছে! আজ কাল বঙ্গ সাহিত্যের নবজীবনোন্মেষে কাব্য উপন্যাসাদির দিন দিন শ্রীবৃদ্ধি হইতেছে; কিন্তু উপযুক্ত অনুরাগের অভাবে এ দেশের ইতিহাস এখনও অনাদৃত পড়িয়া রহিয়াছে! যাহা কিছু ইতিহাস বলিয়া পরিচিত, তাহার অধিকাংশই বিদেশীয় লেখক মহোদয়দিগের বিকৃত সিদ্ধান্তের অন্ধ অনুবাদমাত্র।
বাঙ্গালী যে চিরদিনই ইতিহাসের প্রতি এইরূপ অশ্রদ্ধা প্রকাশ করিয়া আসিয়াছে, তাহা বলিতে পারা যায় না। মোগল সাম্রাজ্যের অভ্যুদয়ে ভারতবর্ষের বিবিধ প্রদেশে ইতিহাসসংকলনের সবিশেষ উৎসাহবৃদ্ধির পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়। তৎকালে রাজানুকম্পায়, অথবা ইতিহাসানুরাগে, অনেক কৃতবিদ্য প্রতিভাশালী সাহিত্যসেবক এ দেশের পুরাতন ও আধুনিক ইতিহাসের সংকলনে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। এই সকল ইতিহাস তৎকাল প্রচলিত সুললিত পারস্য ভাষায় গ্রথিত; মুদ্রাযন্ত্রের প্রচলন না থাকায় হস্তাক্ষরনিবদ্ধ হইয়া স্থানে স্থানে সযত্নে রক্ষিত হইয়াছিল। তন্মধ্যে কোনো কোনো গ্রন্থ এখন আদ্যন্ত মুদ্রিত হইয়াছে; কিন্তু পারস্যভাষানুশীলনে শিথিলতা উপস্থিত হওয়ায়, সে সকল পুরাতন ইতিহাস আমাদিগের অজ্ঞাত হইয়া রহিয়াছে; আমরা অনেক পাশ্চাত্য গ্রন্থের অনুবাদ করিয়াছি, কিন্তু স্বদেশের একখানি ইতিহাসেরও অনুবাদ প্রকাশিত হয় নাই!
এই সকল ইতিহাসের কোন কোন অংশ ইংরাজিতে অনুবাদিত হইয়াছে; কোন কোন গ্রন্থ মূল পারস্য ভাষায় মুদ্রিত হইয়াছে; এবং কোন কোন গ্রন্থের হস্তলিপিগুলি এখনও নীরবে কীটদষ্ট হইতেছে! পলাশীর যুদ্ধাবসানে দুই জন সমসাময়িক মুসলমান ইতিহাসলেখক পারস্যভাষায় লিখিত দুইখানি সুবিস্তৃত ইতিহাস রচনা করিয়া গিয়াছেন; এক খানির নাম, ‘সায়র-উল-মুতক্ষরীণ”; অপরখানির নাম, “রিয়াজ-উস-সালাতিন’।
“সায়র-উল-মুতক্ষরণের” লেখক নবাব আলিবর্দীর অনুগত অন্তরঙ্গ; তিনি কিছুদিন পূর্ণিয়ার নবাব সাইয়েদ আহমদের এবং তৎপুত্র কুক্ৰিয়াসক্ত শওকতজঙ্গের রাজসভার শোভাবর্ধন করিয়া, শওকতজঙ্গের পরাজয় ও অকালমৃত্যুর পর, নবাব সিরাজদ্দৌলার অন্নে প্রতিপালিত হইয়া, যথাক্রমে মীরজাফর এবং কোম্পানী বাহাদুরের অনুকম্পায় অনুগ্রহবৃত্তি লাভ করিয়া, ১৭৮৩ খৃষ্টাব্দে “মুতক্ষরীণ” সমাপ্ত করেন। এই গ্রন্থে মোগল সম্রাটদিগের সর্বশেষ সাত জন বাদশাহের রাজত্বকাহিনী, অর্থাৎ ১৭০৬ হইতে ১৭৮০ পর্যন্ত, যাবতীয় ঘটনা বিবৃত হইয়াছে। হাজি মুস্তাফা নাম-ধারী এক জন ফরাসী পণ্ডিত ইহার সৰ্ব্বপ্রথম ইংরাজি অনুবাদক। দ্বিতীয় অনুবাদক, ভারতবর্ষের প্রথম গভর্নর জেনারেল, প্রথিতনামা ওয়ারেন হেষ্টিংসের প্রাইভেট সেক্রেটারী, কাপ্তেন স্কট। লক্ষৌ-নিবাসী মুন্সী নওলকিশোর ইহার উর্দু অনুবাদক; বিগস সাহেব আর একখানি ইংরাজি অনুবাদের সূচনা করিয়াছিলেন, তাহা অসমাপ্ত। বাঙ্গলা ভাষায় একখানিমাত্রও অনুবাদ প্রকাশিত হয় নাই!
“রিয়াজ-উস-সালাতিনের” লেখক এক জন দরিদ্র সাহিত্যসেবক; তিনি বহু যত্নে যে সুবৃহৎ ইতিহাস সংকলন করিয়া গিয়াছেন, তাহা অদ্যাপি তাঁহার কীৰ্ত্তিস্তম্ভরূপে বিরাজ করিতেছে! এই গ্রন্থ সুবিখ্যাত এসিয়াটিক সোসাইটির যত্নে মুদ্রিত হইয়াছে; কিন্তু কি ইংরাজি, কি বাঙ্গলা, কোন ভাষায় অনুবাদিত হয় নাই। এই প্রবন্ধের শিরোভাগে যে মহাত্মার নাম লিখিত হইয়াছে, সেই গোলাম হোসেন এই পুরাতন ইতিহাসের লেখক।
“মুতক্ষরীণ বাঙ্গলা দেশের আনুপূর্বিক ইতিহাস নহে; কিন্তু “রিয়াজ” অতি পুরাকাল হইতে ইংরাজাধিকার পর্যন্ত বহু শত বৎসরের আনুপূর্বিক সুবৃহৎ ইতিহাস। স্বাধীন অনুসন্ধানতৎপরতায়, পুরাতন প্রচলিত হস্তলিখিত ইতিহাস হইতে যথাযোগ্য সহায়তা গ্রহণে, এবং নিরপেক্ষ সত্যানুরাগের জন্য, “রিয়াজ” সবিশেষ প্রশংসা লাভ করিয়াছে। ষ্টুয়ার্ট সাহেব ইহারই সন্ধান লাভ করিয়া স্বরচিত বাঙ্গলার ইতিহাস সংকলনের আভাস প্রাপ্ত হন। দুঃখের বিষয়, এরূপ প্রতিভাশালী পুরাতত্ত্বানুসন্ধাননিপুণ স্বদেশীয় ইতিহাসলেখক, তাঁহার স্বদেশীদিগের নিকট এখনও সমুচিত সমাদয় লাভ করেন নাই!
গোলাম হোসেন দরিদ্র গৃহস্থ; দরিদ্রের ন্যায় কায়ক্লেশেই জীবন যাপন করিয়া গিয়াছেন। কিন্তু তাঁহার অতুলকীৰ্ত্তি “রিয়াজের” প্রতি যদি কখনও তাঁহার স্বদেশীয় সাহিত্যসমাজের কৃপাদৃষ্টি পতিত হইতে পারে, তবে কেহই তাঁহাকে যথাযোগ্য সমাদর প্রদর্শন করিতে কুণ্ঠিত হইবেন না। তিনি কোন দেশে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, তদ্বিষয়ে এখন আর কোনরূপ নিঃসন্ধিগ্ধ মীমাংসা করা সহজ নহে। বাদশাহ বা নবাবদিগের আমলে, নানা দিগদেশের কৃতবিদ্য মুসলমানগণ বাঙ্গলাদেশে শুভাগমন করিতেন; অনেকে এ দেশেই চিরনিবাস সংস্থাপন করিয়া, এ দেশেই জীর্ণ কঙ্কাল বিসৰ্জন করিয়া গিয়াছেন! এই হিসাবে তাঁহারা সকলেই বাঙ্গালী। রিয়াজ-উস-সালাতিনের লেখকও এই হিসেবে বাঙ্গালী ছিলেন। বাঙ্গলা দেশে জীবন যাপন করিয়া, বাঙ্গলা দেশের ইতিহাস সংকলন করিয়া, বাঙ্গলা দেশের নিভৃত নিকেতনে অস্থিপঞ্জর ভূগর্ভে নিহিত রাখিয়া, যে মহাত্মা অমরধামে গমন করিয়াছেন, তিনি যে দেশেই জন্মগ্রহণ করুন না কেন, যখন তাঁহার দেহাবসান হয়, তখন তিনি বাঙ্গালী বলিয়াই পরিচিত ছিলেন; তাঁহার বংশ-প্রবাহ বর্তমান থাকিলে, তাঁহারাও আজ বাঙ্গালী বলিয়াই আত্মপরিচয় প্রদান করিতেন।
অতি পুরাকাল হইতে বাঙ্গলা দেশের গৌড় জনপদের নাম দেশ বিদেশে ধবনিত হইয়া উঠিয়াছিল; তাহার ঐশ্বৰ্য্যগর্বের অপ্রতিহত আকর্ষণে বহু দূরদেশাগত পরিব্রাজকগ তথায় সসম্ভ্রমে পদার্পণ করিতে বাধ্য হইতেন; গৌড়াধিপতি হিন্দু, বৌদ্ধ এবং পাঠান বাদশাহদিগের বিজয়বৈজয়ন্তী দূর দূরান্তরে প্রোথিত হইত; গৌড়ের গৌরব সকল প্রদেশেই পরিচিত হইয়া উঠিয়াছিল। বৌদ্ধমতাবলম্বী পালবংশীয় বিখ্যাত নরপতিগণের পাদপীঠ বলিয়া, হিন্দুধর্মানুরাগী সুর ও সেন বংশীয় সৰ্বজন সুপরিচিত গৌড়াধিপতি-গণের কীৰ্ত্তিকাহিনীর লীলাক্ষেত্র বলিয়া, ইসলামধর্মানুপ্রাণিত বিজয়োন্নত্ত পাঠান বাদশাহদিগের শতসৌধবিভূষিত বিহারভূমি বলিয়া, গৌড়ের ইতিহাসবিখ্যাত বিক্ষিপ্ত ভগ্নাবশিষ্ট সুচিত্রিত ইষ্টকরাশি এখনও পুরাতত্ত্বানুসন্ধাননিপুণ পরিব্রাজকগণের বিস্ময়ের বস্তু হইয়া রহিয়াছে! গৌড়ের গৌরবের দিন তিরোহিত হইয়া গিয়াছে, কিন্তু হিন্দু কিরূপ প্রশান্ত হৃদয়ে বিশাল জলাশয় খনন করিয়া অকাতরে জলদান করিত, মুসলমান কিরূপ অক্লান্ত অধ্যবসায়ে অত্যুন্নত সিংহদ্বার রচনা করিয়া তাহার উপর ইসলামের গৌরবপতাকা সুবিস্তৃত করিত, চারুশিল্পাদর্শে রাজধানীর উচ্চ অট্টালিকারাজি কিরূপ গঠনগৌরবে লোকলোচনের আনন্দ বর্ধন করিত, তাহার শেষ নিদর্শন এখনও একেবারে বিলুপ্ত হয় নাই! এইখানে হিন্দুর বাহুবলে বৌদ্ধদল পরাজিত, এইখানে পাঠানের লৌহদণ্ডাঘাতে হিন্দুদেবমন্দিরচূড়া ধূলিবিলুণ্ঠিত; এইখানে আদিশূরের আতিথ্যসকার গ্রহণার্থ পঞ্চগোত্রীয় পঞ্চ ব্রাহ্মণের প্রথম পদার্পণ; এইখানে। বেণীসংহার রচয়িতা ভট্টনারায়ণের, মন্ত্রণাকুশল হলায়ুধের, সংসারবিরাগী দবিরখাশ এবং সাকর মল্লিকের বিস্ময়বিজড়িত পদচিহ্ন বুঝি আজও ধূলিপটলের সহিত নীরবে একীকৃত হইয়া রহিয়াছে! এ সকল বহু দিনের কথা। অপেক্ষাকৃত আধুনিক সময়েও গৌড়জনপদের গৌরবের অভাব ছিল না। ইউরোপীয় বণিকেরা এখানে আসিয়া যে সকল বাণিজ্যালয় সংস্থাপন করেন, তন্নিকটবর্তী গ্রামসমূহের বিবিধবিচিত্রশিল্পবিদ্যাবিশারদ গৌড়ীয় তন্তুবায়গণ ইউরোপের নগরে নগরে ভারতবর্ষীয় পট্টবস্ত্র প্রেরণ করিয়া অকাতরে অর্থোপার্জন করিতেন। তদুপলক্ষে পুরাতন এবং আধুনিক মালদেহ শিক্ষা, শিল্প ও বাণিজ্যের যথেষ্ট শ্রীবৃদ্ধি হইয়া উঠিয়াছিল। এখন আর তাহার পূর্ব গৌরব বর্তমান নাই; এখন মালদহের অধিবাসীদিগের নিকট তাঁহাদের প্রিয়তম জন্মভূমি কেবল ফজলী-প্রসূতি বলিয়াই অধিকতর সমাদৃত; তাঁহারা দেশ বিদেশে সেই অমৃত-ফল বিতরণ করিয়াই সমধিক আত্মগৌরব লাভ করিতেছেন! কিন্তু হায়! মালদহের কৃতবিদ্য অধিবাসিগণ যদি স্থানীয় ইতিহাসের সঙ্কলনে যত্নবান হইতেন, তবে তাঁহারা অনায়াসে প্রমাণ করিয়া দিতে পারিতেন যে, মালদহই গৌড়ীয় সাধু ভাষার জন্মভূমি; মালদহই বাঙ্গলা শিক্ষার প্রথম প্রচারক্ষেত্র; মালদহেই কেরী সাহেবের যত্ননুরাগে সর্বপ্রথম বাঙ্গলা মুদ্রাযন্ত্র সংস্থাপিত হইয়া কালক্রমে শ্রীরামপুরে উঠিয়া গিয়াছিল! এই সকল পুরাতন এবং আধুনিক গৌরবের মধ্যে আর একটি প্রধান গৌরব, “রিয়াজ-উস সালাতিন”; এই সুবিখ্যাত বাঙ্গলার ইতিহাসখানিও মালদহেই রচিত হইয়াছিল।
গোলাম হোসেন দরিদ্র হইয়াও প্রতিভাবলে সমসাময়িক সুধীসমাজে সবিশেষ পরিচিত হইয়া উঠিয়াছিলেন। তাঁহার পূর্বজীবনের ইতিহাসে বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে। মালদহের সদরস্টেশন ইংলিশ বাজারের দাঁতব্য চিকিৎসালয় যে ভূমিখণ্ডের উপর দণ্ডায়মান, সেই স্থানে গোলাম হোসেনের বসতিবাটী বৰ্তমান ছিল। তিনি জজ উডনী সাহেবের অধীনে ডাক-মুন্সীর কাৰ্য্যে নিযুক্ত থাকিয়া জীবিকার্জন করিতেন, এবং অবসরসময়ে পুরাতত্বানুসন্ধান করিয়া রিয়াজ রচনা করিতেন। রিয়াজের আভ্যন্তরিক প্রমাণ দেখিয়া বোধ হয়, তিনি পূৰ্বাচাৰ্যদিগের সঙ্কলিত তাবৎ প্রাচীন পুস্তক সংগ্রহ করিয়া, এবং গৌড় জনপদের ভগ্নাবশিষ্ট প্রস্তর-ফলকাদির পাঠোদ্ধার করিয়া রিয়াজ সঙ্কলন করিয়াছিলেন। তাঁহার সংগৃহীত ফলকলিপির অনুলিপি ও অনুবাদ প্রকাশ করিয়া, কত লোকে সভ্যসমাজে যশোগৌরব লাভ করিয়া গিয়াছেন, কিন্তু গোলাম হোসেনের নাম তাঁহার স্বদেশীয়দিগের কাছেও অপরিচিত হইয়া উঠিয়াছে।
মালদহের সদর স্টেশন ইংলিশ বাজারেই ১২৩৩ হিজরী ১৮১৭ খৃষ্টাব্দে গোলাম হোসেনের মৃত্যু হয়। তাঁহার কোনো সন্তান সন্ততি ছিল না; থাকিলেও তাঁহারা হয় ত পৈতৃক ইতিহাসানুরাগের উত্তরাধিকারী হইতেন কি না সন্দেহ। কিন্তু গোলাম হোসেন তাঁহার ইতিহাসানুরাগের উত্তরাধিকারী রাখিয়া গিয়াছিলেন।
পাটনা প্রদেশের রাঢ়-নিবাসী আবদুল করিম নামক এক জন সাহিত্যানুরাগী মুসলমান যুবক, গোলাম হোসেনের শিষ্যত্ব গ্রহণ করিয়া, মালদহ অঞ্চলে মুন্সী’ হইয়া উঠিয়াছিলেন। মুন্সী আবদুল করিম, কিছুদিন নাএব নাজিরের পদে ও সর্বশেষ মোক্তারী ব্যবসায়ে নিযুক্ত হইয়া জীবিকার্জন করিয়াছিলেন। ইহারও কোন সন্তান সন্ততির সংবাদ পাওয়া যায় না। ইহার প্রধান ছাত্রের নাম “ইলাহি বক্স-অল হুসেনী-আঙ্গরেজাবাদী।” তিনি শেষ জীবনে মালদহ স্কুলের পারস্যশিক্ষকের পদে নিযুক্ত থাকিয়া, বৃদ্ধবয়সে ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে পরলোক গমন করিয়াছেন। মালদহের আধুনিক পরিব্রাজকদিগের মধ্যে অনেকেই ইহাকে দর্শন করিয়াছেন;–কারণ, ইনিই মালদহের পুরাকীর্তিদর্শনেচ্ছু পরিব্রাজকগণের একমাত্র চিরসহচর বলিয়া পরিচিত ছিলেন। ইলাহি বক্স কেবল এই কাৰ্যেই জীবন ক্ষয় করেন নাই; তিনিও গোলাম হোসেনের পদানুসরণ করিয়া একখানি সুবৃহৎ ইতিহাস রচনা করিয়া গিয়াছেন; তাঁহার নাম “খুরশিদজাহাননামা।” এই গ্রন্থ পৃথিবীর ইতিহাস! ইহাতে বাঙ্গলাদেশের বিশেষ বিবরণ এবং পৃথিবীর যাবতীয় সভ্য জনপদের সংক্ষিপ্ত বৃত্তান্ত প্রদত্ত হইয়াছে। ইলাহী বক্স এই পুরাতত্ত্বগ্রন্থকে এরূপ আন্তরিক অনুরাগের সহিত সযত্নে রক্ষা করিতেন যে, কলিকাতার এসিয়াটিক সোসাইটি বহুযত্নেও তাঁহার নিকট হইতে ইহা গ্রহণ করিতে পারেন নাই। মহাত্মা বিভারিজ এই গ্রন্থের কিয়দংশের নকল লইয়া এক সারসঙ্কলন প্রকাশ করিয়াছেন। মূল গ্রন্থ এখন মালদহ-নিবাসী জনৈক কৃতবিদ্য মুসলমান যুবকের নিকট রক্ষিত হইয়াছে;-ইলাহী বক্সের অযোগ্য বংশধরগণ এই অল্পদিনের মধ্যেই তাঁহার পুস্তকালয়ের পুরাতন হস্তলিখিত বহুমূল্য দপ্তরগুলি নষ্ট করিয়া ফেলিয়াছেন।
মালদহে একটি মুসলমান সভা বৰ্তমান আছে; মালদহের সাহিত্যানুরাগী নব্যসম্প্রদায়ের আন্তরিক অনুরাগে একটি সাধারণ পাঠাগার প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। এই উভয় সভার উৎসাহী সদস্যগণ যদি ‘রিয়াজ-উস-সালাতীনের’ রচয়িতা গোলাম হোসেনের স্মৃতিসমাদর রক্ষা করিতে চেষ্টা করেন, ইহারা অনায়াসেই তাহা সুসম্পন্ন করিতে পারেন। ইহাদিগের নগরপ্রান্তেই “চক কোব্বান আলি” নামক স্থানে গোলাম হোসেনের সমাধি উপেক্ষায় জীর্ণ হইতেছে। সেই সমাধির জীর্ণ সংস্কার করিয়া, মালদহের কৃতবিদ্য বন্ধুগণ যদি ‘রিয়াজ-উস-সালাতিনের’ একখানি বঙ্গানুবাদ প্রচার করেন, তবে তাঁহাদিগের যত্নে বাঙ্গালীর একটি প্রধান কলঙ্ক ধৌত হইয়া যায়।
সাহিত্য, ফাল্গুন, ১৩০৩
তথ্যসূত্র
১ Every county, almost every parish, in England, has its annals; but in India, vast provinces, greater in extent than the British Islands, have no individual history whatever I” –Sir W. W. Hunter.
২ Finished in 1783.–Stewart.
৩ An English translation of this has, I understand, become published in Calcutta, by Mustapha, a Freach Mussulman, –Col.Scott’s History of Bengal, Preface.
8 I am indebted to it (Ryaz Ussalateen) for the idea of writing this work, and for the general out-line. –Stewart.
৫ It may be noticed here that Ghulam Husain was a native of Zaidpur in Oude.H. Beveridge, C.S. এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ হইবার উপায় নাই। এই ক্ষুদ্র প্রবন্ধে সে সকল তর্ক তুলিয়া কি হইবে?
৬ Noticing the Charitable Dispensary, the author observes that here used to be the house of Ghulam Husain,–H. Beveridge, C.S.
৭ The old man was so attached to his book, that he refused to let it out of his sight,–H. Beveridge, C.S.
৮ The Khurshid Jahan Numa of Sayyad Habi Bakhsh al Husaini Angrezabadi, –By H. Beveridge, I.C.S. (Retired.)