কিছুদিন আগে ৪০তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশের পর অবাক করা কৃতিত্বের দাবি তোলেন আবদুল হাকিম নামে এক পুলিশ কনস্টেবল। তার ভাষ্য ছিল, কনস্টেবল পদে কর্মরত অবস্থাতেই বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পুলিশ ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন তিনি। চাকরি নামের সোনার হরিণ ধরতে লাখ লাখ তরুণ যখন ব্যতিব্যস্ত তখন আবদুল হাকিমের এ খবর দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আবদুল হামিদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন সবাই। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সবাই তাকে শুভেচ্ছা জানান।
দেশের বেশিরভাগ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় হাকিমের এমন “অভূতপূর্ব” সাফল্যগাঁথা। তবে দৈনিক আমাদের সময়ের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, হাকিম আসলে মিথ্যাচার করেছেন। জানা গেছে, উত্তীর্ণ হওয়া তো দূরের কথা, বিসিএস পরীক্ষাই দেননি ওই পুলিশ কনস্টেবল।
হাকিম দাবি করেছিলেন, ৪০তম বিসিএসে তিনি পুলিশ ক্যাডারে ৬৭তম স্থান অধিকার করেছেন। তবে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) তালিকায় সেই স্থান লাভ করা পরীক্ষার্থীর রোল নম্বর ১৬০০৪৩৯১, যা ছিল সিলেট অঞ্চল থেকে আবেদন করা পরীক্ষার্থী সঞ্জীব দেবের।
আর আবদুল হাকিম নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার শ্রীনগর ইউনিয়নের সায়দাবাদ গ্রামের বাসিন্দা। এ তথ্য জানার পর পুলিশ ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত সঞ্জীবের খোঁজ শুরু করে আমাদের সময়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সঞ্জীব দেব শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি) ইংরেজি বিভাগের ২০১২-১৩ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন। প্রথমবার বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিয়েই পুলিশ ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন তিনি।
সঞ্জীব দেব বলেন, ‘‘আমি পুলিশ ক্যাডারে উত্তীর্ণ হয়েছি। আমার অবস্থান ৬৭তম।’’ তার দেখানো প্রবেশপত্রেও এ তথ্যের সত্যতা পাওয়া গেছে।
এরপরেও কনস্টেবল হাকিমের দাবি, তিনিই ৪০তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফলে পুলিশ ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। মেধাতালিকায় ৬৭তম অবস্থান তার।
অতিরঞ্জিত দাবি করে এই পুলিশ সদস্য বলেন, ‘‘গুলশানে পোস্টিং থাকা অবস্থাতেই ভাইবা দেই। গত বছরের ২৩ মার্চ আমার ভাইবা অনুষ্ঠিত হয়। তবে এর কয়েকদিন পরই ৩০ মার্চ থেকে করোনাভাইরাসের কারণে ভাইবা পরীক্ষা স্থগিত করে পিএসসি।’’
৬৭তম অবস্থানে থাকা রোল নম্বরের পরীক্ষার্থীর ভাইবা হয়েছে গত ফেব্রুয়ারি মাসে। আর পিএসসির তালিকায় নাম থাকা সঞ্জীব দেবও জানালেন তিনি উল্লিখিত সময়েই ভাইবা দিয়েছেন। ২০২০ সালের ৪ থেকে ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় ৪০তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা।
আবদুল হাকিম বলছেন, তিনি ওই পরীক্ষায় অংশ নেন। কিন্তু তার ফেসবুক প্রোফাইল ঘেঁটে দেখা গেছে উল্টো চিত্র। ১ থেকে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত খাগড়াছড়ি, কক্সবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ানোর ছবি আপলোড করেন তিনি। যদিও বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ হওয়ার পরই এসব ছবি ফেসবুক থেকে সরিয়ে দিয়েছেন তিনি।
আবদুল হাকিম বলেন, ‘‘২০১০ সালে সায়দাবাদ উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক সম্পন্ন করেছি। এরপর রায়পুরা কলেজ থেকে ২০১২ সালে শেষ করি উচ্চমাধ্যমিক। ২০১২-১৩ সেশনে ভর্তি হই নরসিংদী সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। এর কিছুদিন পর পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকরি হয়।’’
২০১৩ সালে পুলিশে যোগদান করার পর প্রথমে গাজীপুরে শিল্প পুলিশে পোস্টিং হয় হাকিমের। ২০১৫ সালে বদলি হয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশে (ডিএমপি) আসেন, পোস্টিং হয় পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট (পিওএম) বিভাগে। সেখানে থাকা অবস্থায়ই নরসিংদী সরকারি কলেজ থেকে ২০১৬ সালে স্নাতক শেষ করেন তিনি।
কনস্টেবল হাকিমের ভাষ্য, ‘‘দুই বছরের ব্যবধানে ২০১৮ সালে পাবলিক সার্ভিস কমিশনে আবেদন করি। প্রিলিমিনারিতে কৃতকার্য হওয়ার পর পর্যায়ক্রমে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিই। চলতি বছরের ৩০ মার্চ ৪০তম বিসিএসের ফলে পুলিশ ক্যাডারের মেধাতালিকায় ৬৭তম হিসেবে জায়গা করে নিই।’’
শুধু তাই নয়, নরসিংদী সরকারি কলেজ থেকে ২০১৬ সালে স্নাতকে উত্তীর্ণের দাবি জানান হাকিম। অথচ আমাদের সময় পত্রিকার অনুসন্ধানে ওই বছরের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে উত্তীর্ণদের তালিকায় তার নাম নেই। এমনকি ২০১২-১৩ সেশনের শিক্ষার্থীদের তালিকায়ও তার নাম খুঁজে পাওয়া যায়নি।
কলেজটির বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১২-১৩ সেশনে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরা অনার্স শেষ করেছেন ২০১৭ সালে। ওই বছর কলেজটি থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক উত্তীর্ণ তিন শিক্ষার্থী জানান, আবদুল হাকিম নামে কেউ তাদের সহপাঠী ছিলেন না। তবে সিনিয়র বা জুনিয়র কেউ এ নামে থাকতে পারেন।
এ বিষয়ে নরসিংদী সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘‘শুনেছি আবদুল হাকিম নামে আমাদের এক শিক্ষার্থী পুলিশ ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে।’’
তিনি কোন ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন জানতে চাইলে ওই শিক্ষক বলেন, ‘‘২০১৩-১৪ সালের হতে পারে। তবে খাতা না দেখে শিওর (সঠিক) বলা যাবে না।’’
জানতে চাওয়া হয় ‘‘পিএসসির তালিকা অনুযায়ী আপনি পুলিশ ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হননি। ৬৭তম হয়েছেন দাবি করলেও ওই পজিশন সঞ্জীব দেব নামের একজনের। এছাড়া নরসিংদী সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে ২০১৬ সালে পাশ করা তালিকায়ও আপনার নাম নেই। অথচ আপনার দাবি, আপনি ওই কলেজ থেকে ২০১৬ সালে স্নাতক পাশ করেছেন। তাছাড়া বিসিএস লিখিত পরীক্ষার সময় আপনি যে ঢাকার বাইরে ছিলেন, সে তথ্য প্রমাণও রয়েছে। আর ভাইবা অনুষ্ঠিত হয়েছে ফেব্রুয়ারিতে, কিন্তু আপনি দাবি করেছেন, মার্চের ২৩ তারিখে ভাইবা দিয়েছেন। এ বিষয়ে আপনার বিস্তারিত বক্তব্য দরকার।’’
কলে সাড়া দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে মেসেজ দিলেও আবদুল হাকিম বারবার সংযোগ বিচ্ছিন্ন দেন। রাত ৯টার পর সাংবাদিকের নম্বরটি তার মোবাইলের ব্লক লিস্টে রেখে দেন।