আহ্ জীবন ! জীবন কত সুন্দর। এই সুন্দর জীবনের গল্প আমরা হরহামেশায় প্রকাশ করি মুখে মুখে আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। মুদ্রার এক পিঠ যদি হয় জীবন সুন্দর, তো উল্টো পিঠে আছে জীবনের সংগ্রাম, কষ্ট, ব্যর্থতা, গ্লানি। জীবন নামের মুদ্রার ভাল দিকটা দেখে আমরা অভ্যস্ত।
কখনও উল্টো দিকটা দেখতে চাই না কিংবা মনে করতেও চাইনা আর এই জন্যই হয়ত এত বৈষমতা। পাঠক আপনাদের এমন একজনের জীবনের গল্প জানাবো, পড়া শেষে আপনারাই ঠিক করে নিবেন এই মানুষটিকে কোন সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করবেন। সংগ্রামী নাকি অবিচারের স্বীকার।
ফরিদপুর জেলার রাজবাড়ী উপজেলার ভবানীপুর গ্রামে ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ললিতা রানী। পিতা খোকন ও মাতা উমা রানী‘র ঘর আলোকিত করে তিনি এসেছিলেন পৃথিবীতে।
এখন রোদে পুড়ে শরীরের রং তামাটে বর্ণ ধারণ করেছে। কিছুটা ঝুলে গেছে তাঁর গাল দুটি, কুঁচকে গেছে শরীরের চামড়া। মাথায় চুল গুলো অনেকটা শরতের মেঘের মত সাদা।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মাত্র ১৩ বছর বয়সী একটি মেয়ে নিজেকে সুরক্ষিত রেখে জীবন যুদ্ধে জয় যুক্ত হয়েছিলেন।
পিতা-মাতার মৃত্যুর পর তার ঠাঁই হয়েছিল ফুপুর সংসারে।কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ফুপুর মৃত্যুর পরে সংগ্রামী এই অভিনেত্রীকে ভিটাছাড়া হতে হয়। কপালে জোটেনি লেখাপড়া।জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে যুক্ত হয়েছিলেন যাত্রাদলে।
অত্যন্ত মেধাবী ও স্মরণশক্তি ভালো থাকায় যাত্রার সংলাপ খুব দ্রুতই মুখস্ত করতে পারতেন। সহকর্মী এক অভিনেতার সঙ্গে জীবন সংসার শুরু করেছিলেন তিনি।১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে দেশ স্বাধীনের পরে স্বামী-সন্তান নিয়ে নাটোরের উত্তর পটুয়াপাড়া এলাকায় চলে আসেন।
সেই সময়ে মঞ্চ কাপানো উত্তরবঙ্গের সেরা অভিনেত্রীদের মধ্যে তিনি তার নামটি উল্লেখযোগ্য স্থানে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই সুখ কপালে বেশিদিন জোটেনি তার।স্বামীর মৃত্যুর পরে জীবনে নেমে আসে অন্ধকার।সুস্পষ্ট দরাজ কণ্ঠে এখনো উচ্চারিত হয় শব্দ। তবে যাত্রাশিল্প বিলুপ্ত হওয়ার পরে কর্মহীন হয়ে পড়েন তিনি।
একমাত্র সন্তান বিয়ে করে নিজের সংসারে আলাদা জীবন যাপন করে। ললিতা এখন নাটোর পৌরসভার উত্তর পটুয়াপাড়া বাসস্ট্যান্ডের পাশে সরকারি মাটিতে একটি ঝুপড়ি ঘরে একাকী জীবন যাপন করছেন। পেটের দায়ে বেসরকারি ক্লিনিকে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করেন।
সাংস্কৃতিক অঙ্গনে যে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন এখন নিঃসঙ্গ ললিতাকে দেখভাল করার জন্য কাছে নেই কেউ।একসময় অভিনয় দক্ষতা দিয়ে মঞ্চ মাতাতেন যিনি যার সংলাপ শুনে মুহুর্মুহু করতালি পড়তো।এখন সংলাপ নেই, মঞ্চ নেই, করতালিও নেই, অছে শুধু শূন্যতা আর শূন্যতা।
ললিতা রানী আক্ষেপ করে জানান, ‘জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এমন পরিণতি হবে স্বপ্নেও যদি বুঝতে পারতাম, তাহলে স্বামী-সন্তান আর সংসারের পিছনে আমার উপার্জিত অর্থ কিছুই ব্যয় করতাম না। নিজের জন্যই সঞ্চয় করে রাখতাম।’
মুক্তিযোদ্ধ চলাকালীন সময়ের কথা জানতে চাইলে তিনি প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যান তবে এ বিষয়ে তিনি জানান, তাদের বাড়িতে অনেক মুক্তিযোদ্ধা আসা-যাওয়া করতেন, থাকতেন, খাওয়া-দাওয়া করতেন।
বয়স্ক ভাতার জন্য স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম কাউন্সিলর বলেছেন বয়স্ক ভাতা পাওয়ার বয়স আমার হয় নাই। অসচ্ছল সংস্কৃতিক শিল্পী হিসেবেও আবেদন করেছিলাম, যার কোনো প্রতি উত্তর পাইনি।’
এই কথাগুলো কি আমাদের সামাজিক দায়িত্ব বা বিবেকবোধকে ঢেকে দিতে পারে ? কেন একজন বৃদ্ধা অভিনয়শিল্পী পেটের ক্ষুধা মিটানোর জন্য পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করবে ? কেনইবা ছেলে মুখ ফিরিয়ে নিবে আর কেন আজও সরকারী সহযোগিতা বা বয়স্ক ভাতা পান না ললিতা ? এর সহজ কোন উত্তর কি আমাদের কাছে আছে?
আমাদের কি ললিতাদের খোঁজ করা উচিত ছিলনা এত দিন? ললিতার জীবনের অনেক গল্পই আবছা হয়ে গেছে তার স্মৃতির পাতা থেকে। আবছা আবছা কোন কথা বলেন আবার ভুলে যান। দিন যায় মাস গড়িয়ে হয় বছর।ললিতা জীবনের প্রায় শেষ প্রান্তে চলে যাচ্ছেন ধীরে ধীরে, তবুও জীবন চালাতে করছেন কর্ম।
সমাজ আজ বড়ই ব্যস্ত। কারই বা সময় আছে আমাদের সমাজের ললিতাদের নিয়ে চিন্তা করার। চেতনাধারী বা বুদ্ধিজীবী সমাজ কথার বুলি ছুটিয়ে সমাধান করেন সব সমস্যার।অথচ তাদের শত ব্যস্ততার ফাঁক গলে সমাজের কোণে অবহেলায় পড়ে থাকেন ললিতারা।
মৃত্যুর আগে একবার কি হা হা করে প্রানখুলে হাসতে পারবেন ললিতা ? নাকি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিবেন। ললিতাদের দীর্ঘশ্বাসের ভার বহন করতে পারব তো আমরা ? নাকি বয়ে নিয়ে যেতে হবে প্রজম্ম থেকে প্রজম্ম…