একটি ফাইনাল যে রকম হওয়ার প্রয়োজন ছিল ঠিক সে রকমটিই হয়েছে। শেষ বল পর্যন্ত গড়িয়েছে ম্যাচ। চরম নাটকীয়তা আর টানটান উত্তেজনা, শেষ ওভারে ক্ষণে ক্ষণে হয়েছে দৃশ্যপট পরিবর্তন। পরে শেষ হাসি হেসেছে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানস। ফরচুন বরিশালকে মাত্র ১ রানে হারিয়ে জিতে নিয়েছে বঙ্গবন্ধু বিপিএল। এটি ছিল তাদের তৃতীয় শিরোপা। বিপরীতে বরিশালের কাছে অধরাই থেকে গেলো শিরোপা। এবার নিয়ে তিনবার ফাইনালে উঠে তারা কোনোবারই চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। কুমিল্লার ৯ উইকেটে করা ১৫১ রানের জবাব দিতে গিয়ে বরিশাল ৮ উইকেটে করে ১৫০ রান।
শেষ ওভারে বরিশালের প্রয়োজন ছিল ১০ রানের। অধিনায়ক ইমরুল কায়েস তার কোনো অপশন না থাকাতে তরুণ শহীদুল ইসলামের হাতে বল তুলে দিয়েছিলেন। দলনেতার সেই আস্থার প্রতিদান দিয়েছেন শহীদুল। ক্রিজে বরিশালের তৌহিদ হৃদয় ও আফগান মুজিব উর রহমান। প্রথম বলে কোনো রান আসেনি। পরের দুই বলে আসে এক করে। চতুর্থ বল আম্পায়ার ওয়াইড দেন। কুমিল্লা রিভিউ নেয়। অনেকক্ষণ বিভিন্ন অ্যাংগেল থেকে ক্যামেরার দৃশ্য দেখে তৃতীয় আম্পায়ার গাজী সোহেল ওয়াইড বলই ঘোষণা দেন। ৩ বলে প্রয়োজন ৭ রানের। পরের বলে তৌহিদ ২ রান নিলে ব্যবধান কমে আসে ২ বলে ৫ রানে। পঞ্চম বল ছক্কা হাঁকাতে গিয়ে তৌহিদ ক্যাচ তুলে দেন স্কয়ার লেগে। কিন্তু তানভীর ইসলাম ক্যাচ ধরতে না পারলে রান আসে ২। ফলে শেষ বলে প্রয়োজন পড়ে ৩ রানের। ২ রান নিলে খেলা গড়াবে সুপার ওভারে, কিন্তু এক্সটা কাভারে খেলে তৌহিদ আর ২ রান নিতে পারেননি। লিটন তাকে রান আউট করে দিলে তৃতীয়বার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আনন্দে মেতে উঠেন কুমিল্লার খেলোয়াড়রা।
কুমিল্লা জুয়া খেলেছিল সুনিল নারিনকে দিয়ে। বরিশাল তা খেলেছে সৈকত আলীকে দিয়ে। প্রথম তিন ম্যাচ ( ৩৯, ১৫, ০) খেলার পর আর তিনি খেলার সুযোগ পাননি। ফাইনালে সুযোগ পেয়ে করেন বাজিমাত। আগের তিন ম্যাচে ইনিংসের উদ্বোধন করেছিলেন। ফাইনালে তিনে ব্যাট করতে নেমে খেলেন ৩৪ বলে ১ ছক্কা ও ১১ চারে ৫৮ রানের ইনিংস। ফিফটি করেন ২৬ বলে। তিনি এমন ইনিংস খেলেছেন যখন দ্বিতীয় ওভারেই হার্ডহিটার ব্যাটসম্যান মুনিম শাহরিয়ার কোনো রান না করেই ফিরে যান। তার ব্যাটিংয়ের সময় আড়াল পড়ে গিয়েছিলেন গেইল। সৈকত যখন ৩৪ বল খেলে ৫৮ রান করে তানভীরে বলে ইমরুল কায়েসের হাতে ধরা পড়ে ফিরে আসেন, তখন গেইলের রান ছিল ১৮ বলে ১৩ রান। গেইল ৩১ বলে ৩৩ রান করে আউট হওয়ার পর বরিশাল ধীরে ধীরে জয়ের দিতে হাঁটতে থাকে। কিন্তু সাকিব (৭), নুরুল হাসান সোহান (১৪), ব্রাভো (১) দ্রুত বিদায় নিলে তারা চাপে পড়ে যায়। শেষ ৩ ওভারে প্রয়োজন পড়ে ২৫ রানেন। এ সময় দারুণভাবে ম্যাচে ফিরে আসে কুমিল্লা। ব্যাট হাতে ঝড় তোলা সুনিল নারিন ১৮ নম্বর ওভারের প্রথম বলেই ব্রাভোকে আউট করার পর মাত্র ২ রান দেন। পরের ওভারে মোস্তাফিজ নাজমুল হোসেন শান্তকে (১২) ফিরিয়ে দিয়ে রান দেন ৬। তারপর খেলা গড়ায় শেষ ওভারে। প্রয়োজন পড়ে ১০ রানের। যা করতে এসে চরম নাটকীয়তা তৈরি করে শেষ বল পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলেন শহীদুল।
এর আগে কুমিল্লার ইনিংসকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। একটি ব্যাটিং পাওয়ার প্লে, আরেকটি বাকি ইনিংস। কিংবা সুনিল নারিনের আউট হওয়ার আগে-পরে। ব্যাটিং পাওয়ার প্লেতে কুমিল্লার রান ছিল ২ উইকেটে ৭৩। সেখানে বাকি ১৪ ওভারে রান আসে ৭ উইকেট হারিয়ে মাত্র ৭৮।
বরিশাল ফাইনাল পর্যন্ত এসেছে বোলিং শক্তিতে বলীয়ান হয়ে। সেই বরিশালের বিপক্ষে সুনিল নারিনের তাণ্ডব ছিল অবিশ্বাস্য। তার ব্যাটিং দেখে মনে হয়েছে আগের ম্যাচে চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের বিপক্ষে যেখানে শেষ করেছিলেন, আজ সেখান থেকেই শুরু করেছেন। যে বরিশালের বোলিংই আসল শক্তি, তাদের বিপক্ষে এ রকম আক্রমণ অব্যাহত থাকে কী করে। তাই কুমিল্লার তাণ্ডব ছিল সুনিল নারিন আউট না হওয়া পর্যন্ত। তিনি যখন ২৩ বলে ৫টি করে চার-ছয় মেরে টানা দ্বিতীয় ফিফটি তুলে নিয়ে ৫৭ রানে আউট হয়ে যান, তারপর আর সেই ধারা ধরে রাখা সম্ভব হয়নি দলের বাকি ব্যাটসম্যানদের। এই ম্যাচে সুনিল ফিফটি করেন ২১ বলে। দ্বিতীয় কোয়ালিফায়ারে করেছিলেন ১৩ বলে। সুনিল নারিন আউট হওয়ার পর পটাপট পড়তে থাকে উইকেট। ১ উইকেটে ৬৯ রান থেকে দলের সংগ্রহ পরিণত হয় ৬ উইকেটে ৯৫। ৫.১ ওভারে ২৬ রানে নেই ৫ উইকেট। এ সময় কুমিল্লার অলআউট হওয়ার শঙ্কা জাগে। কিন্তু তা আর হতে দেননি মঈন আলী ও আবু হায়দার রনি। এই দুই জন ৮.৪ ওভারে ( ৫২ বল) ৫৪ রান যোগ করে দলের রানকে ফাইটিং পর্যায়ে নিয়ে যান। সুনিল নারিন আউট হওয়ার পর যেমন কুমিল্লার ইনিংসে ধস নেমেছিল, তেমনি ৩২ বলে ৩৮ রান করে মঈন আলী আউট হওয়ার পর শেষের ১১ বল কাজে লাগাতে পারেনি কুমিল্লা। এ সময় ৩ উইকেট হারিয়ে মাত্র ২ রান সংগ্রহ করে। আবু হায়দার করেন ২৭ বলে ১৯ রান।
বরিশাল কিভাবে ম্যাচে ফিরেছে তার একটা উদাহরণ হতে পারেন মুজিব উর রহমান। এই আসরে যিনি উইকেট পাওয়ার চেয়ে ব্যাটসম্যানদের ক্রিজে আটকে রাখার দিকেই বেশি সচেতন ছিলেন। সেই মুজিবর উর রহমানের প্রথম ওভারেই সুনিল নারিন ১৮ রান তুলে নেন। সেখানে মুজিব পরের তিন ওভারে রান দেন মাত্র ১২। উইকেট নেন দুইটি ডু প্লেসি ও আরিফুল হকের। শুধু মুজিব উর রহমান কেন? শফিকুলও ফিরেছেন মুজিবের মতো করেই। তিনিও ইনিংস প্রথম ওভার মুজিব করার পর করতে এসে ১৮ রান দিয়েছিলেন। বাকি তিন ওভারে রান দেন ১৩, উইকেট নেন ২টি। পরপর দুই বলে আবু হায়দার ও শহীদুল ইসলামকে আউট করে হ্যাটট্রিকের সম্ভাবনাও জাগিয়ে তুলেছিলেন। অবশ্য এই দু’জন নিজেদের ফিরে পাওয়ার আগে দলকে আসল পথ দেখান দলনেতা সাকিব। দুই ওভারে ৩৬ রান আসার পর সাকিব তৃতীয় ওভার করতে এসে মাত্র ৪ রান দিয়ে লিটনকে ফিরিয়ে দেন (৪)। এতে করে বোলাররাও যেন আত্মবিশ্বাস ফিরে পান। ব্রাভো পরের ওভার দেন ৬ রান। যদিও সাকিবের পরের ওভারে সুনিল নারিন আবার ১৬ রান তুলে নেন। মেহেদি হাসান রানার বলে আউট হওয়ার আগে প্রথম বলেই ছক্কা হাঁকিয়েছিলেন। পরের বল ছক্কা মারতে গিয়ে লং অনে নাজমুল হোসেন শান্তর হাতে ধার পড়েন। তার ক্যাচ ধরে শান্তর সে কি নৃত্যানন্দ। তাদের বোলিং তোপে পড়ে ২৫ বলে কোনো চার-ছক্কা মারতে পারেননি কুমিল্লার ব্যাটসম্যানরা। বোলাররা নিজেদের ফিরে পাওয়াতে সাকিব পাঁচ বোলার দিয়েই কোটা শেষ করান।