১৯৯৫ সালে আমি বেশ ছোট। বাবা, মা, বড় ভাই-বোন সহ পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছে ১৯৭১সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সেই সব দিনগুলোর স্মৃতিচারণ শুনেছি বারংবার। শুনেছি পাকি সৈন্যদের নির্মম নৃশংস নিষ্ঠুর ও অমানবিক অত্যাচারের কথা। শুনেছি কিভাবে পাকিস্তানী সৈন্যরা এবং এই ভুখন্ডে বসবাসকারী তাদের দোসর রাজাকার, আল বদর, আল শামস… গং মানুষ হত্যা করেছে! ত্রিশ লাখ মানুষের জীবনের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা। শুনেছি বেঁচে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন সংগ্রামের কথা। মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়ে চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন। শুনেছি কিশোর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের কথা, মহিলা মুক্তিযোদ্ধাদের কথা। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণিপেশার মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল মুক্তিযুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আমাদের বীরত্বগাঁথা ইতিহাস। শুনেছি অসংখ্য নারীর সম্ভ্রম লুটে নিয়েছিল পাকিসৈন্যরা, যাদের আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে বীরাঙ্গনা খেতাব দিয়েছে রাষ্ট্র। যাদেরকে আমি বীরঙ্গনা মা বলেই সম্বোধন করি।
মুক্তিযুদ্ধের কথাগুলো শুনতে শুনতে আবেগী হয়ে পড়তাম, শরীরের মধ্যে এক ধরণের অনুভূতি হতো। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠান টেলিভিশনে দেখতাম। যখন স্কুলে পড়তাম তখন এই দিবসগুলোতে আয়োজিত স্কুলের অনুষ্ঠানে যোগ দিতাম। ঐ সময়ে আনন্দের সাথে সমস্ত থানার স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকেরা সেই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করতো। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জানানো হতো । কুচকাওয়াজ, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সারাটা দিন কেটে যেত। আমাদের বাড়িতে ভাইবোনেরা মিলে দেশাত্ববোধক গান শুনতাম, গুনগুনিয়ে গাইতাম আমরাও, সঙ্গে বাবা-মাও শুনতেন। এখনও আমি দেশাত্মবোধক গান শুনি, আমার শরীরের পশম দাড়িয়ে যায়। দেশের জন্য কোথাও যেন মমত্ববোধ কাজ করে। আমার বেড়ে ওঠা রাজপুর থানায় স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সকল অনুষ্ঠানে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ক্লান্তিহীন ভাবে যুক্ত থাকতাম। আর ভাবতাম, আজীবন যেন এই আয়োজনের সাথে যুক্ত থাকতে পারি।
ছোট বেলায় স্বপ্ন দেখতাম, আমাদের দেশ অনেক উন্নত হবে, মনে মনে ছবির মত সাজাতাম দেশ। আমাদের দেশ অসাম্প্রদায়িক প্রীতির দেশ। মানুষের সঙ্গে মানুষের ভ্রাতৃত্ব আর সৌহার্দ্যেপূর্ণ একটি দেশ। আর আমরা খুশি মনে আনন্দ করে বেড়াবো,সবাই মিলে ভালো থাকবো। এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি- যতবার দ্বিজেন্দ্র লাল রায়ের একটি গানটি শুনি ততবার শিহরিত হতাম, এখনও হই। অসাপ্রদায়িক আমাদের এই দেশে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ সবাই এক সাথে থাকবো, আনন্দ করবো। ছোট বেলায় আমি আমার ভাইদের সাথে পূজা দেখতে যেতাম। কোনদিন পরিবার থেকে বাঁধা দেয়নি। পূজায় যাবার সময় আমাদেরকে জনপতি দশ টাকাও দিতেন, কখনও বা বেশী। পুজার সময় তাদের বাড়িতে গেলে নাড়ু, মোয়া খেতাম। হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিবেশী বড় ভাই সমতূল্য দাদারা আমাদের বাড়ি সহ অন্য মুসলিমদের বাড়িতে আসা যাওয়া করতো। রোজার সময় আমার মায়ের হাতে বানানো ইফতার আমাদের সঙ্গে খেত। ঈদের দিনে আমাদের বাড়িতে ভাত খেত। সে সময় হিন্দু মুসলমাদের চলাফেরায় অথবা উঠাবসায় কোন রকম বিধিনিষেধ ছিল না। যে কারণে আমার ছোটবেলা ছিল ভীষণ রকমের উপভোগ্য। আমার বাবা খুব ধার্মিক মানুষ ছিলেন, কিন্তু তিনি ছিলেন হিন্দু বা অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। অন্যান্য ধর্মের মানুষের সঙ্গে তার তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। আসলে সে সময়কার বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষেরা ধার্মিক হলেও, তারা ছিলেন অসম্প্রদায়িক ও উদার মানসিকতা সম্পন্ন।
ছোট বেলা থেকে নিজেকে একজন বাঙালীই মেনে এসেছি। আমি একজন বাঙালি বাংলাদেশী মানুষ। এই পৃথিবীর সন্তান আমি। মনে প্রানে চাই, বাংলা সংস্কৃতি, ঐতিহ্য আমাদের সকলের ভেতরে লালিত হোক। বাংলা সাহিত্য চর্চা বৃদ্ধি পাক। পৃথিবী বিশাল জনগোষ্ঠীর ভাষা বাংলা, পঞ্চমতম কথিত ভাষা।
১৯৭১ থেকে ২০২১সাল। বাংলাদেশের বয়স ৫০ বছর। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর বছর। গত বছর ছিল আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের জন্মশতবর্ষ। এ বাংলায় বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে আমরা বাংলাদেশ পেতাম না। কোভিভ-১৯ মহামারীর কারণে গত বছর আমরা মুজিব শতবর্ষ সেভাবে পালন করতে পারিনি। হাজার অসংগতি ও নানা সমস্যার মধ্যেও গত বছর থেকে ভাবনায় ছিল মহাসমারোহে মুজিব শতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উৎসব উদযাপন করবো। করোনা পরিস্থিতি আমাদের সে সীমা বেঁধে দিল। তবুও স্বল্প পরিসরে হলেও যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী ও মুজিব জন্ম শতবর্ষ।
১৯৭১ সালের যেই তারিখে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নৃশংস ভাবে বাঙালি জাতির উপরে ঝাঁপিয়ে পরে অমানবিক নির্যাতন করেছিল আমাদের পূর্বসূরীদের, সেই একই রকমের আচরণ পরিলক্ষিত হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট ধর্ম ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর ভেতরে। খুব কষ্টের সাথে বলতে হচ্ছে; স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশী উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠীর সন্ত্রাসীরা বাংলাদেশে সন্ত্রাস করে মানুষের ভেতরে ভয় ঢুকিয়ে দিচ্ছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি আয়োজন বানচাল করার জন্য তারা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরকে ইস্যু করে সারাদেশে উগ্র সাম্প্রদায়িক বক্তব্য প্রদান করে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষকে ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িকতার বিষ খাইয়ে দিচ্ছে। যার ফলশ্রুতিতে আমরা দেখেছি, শাল্লায় শতাধিক হিন্দু বাড়িতে হামলা, লুটপাট করেছে একদল উগ্র মৌলবাদী সন্ত্রাসী। মোদীর সফরের বিরোধিতা করে তারা অশান্ত বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে ২৫শে মার্চ। অথচ এই ২৫শে মার্চ আমাদের কালরাত্রি। ১৯৭১ সালে এইদিনে কোন রকম ঘোষণা ছাড়াই পাকিস্তানীরা আমাদের উপরে হামলা করেছিল, নির্বিচারে গুলি করেছিল এ বাংলার সন্তানদের। স্বাধীনতা দিবস উদযাপন আমাদের জন্য যেমন আনন্দের, তেমনই আছে আমাদের স্বজন হারানোর বেদনাও। যে বা যারা দেশকে ভালবাসে, নিজেকে বাংলা মায়ের সন্তান বলে দাবী করে; তারা কেমন করে অশান্ত বিক্ষোভ করতে পারে? মোদীর বাংলাদেশের সফরের সঙ্গে শিশু শিক্ষার্থীদের স্বার্থ সংশ্লিষ্টতা আছে কি? কেন তারা শিশুদের ব্যবহার করছে? একদল আবার ঢাকার শাহবাগে গরু কেটে ‘ফেলানী’র নামে জেয়াফতের আয়োজন করেছে। সত্যিই সেলুকাস! কি বিচিত্র এদের মেধা!
হঠাৎ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে চোখে পড়লো একটি পোলের স্ক্রিনশট। ডয়েস ভেলে পত্রিকার সম্পাদক খালেদ মুহিউদ্দিন জানতে চেয়েছেন,
প্রিয় দর্শক, স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে একজন বাংলাদেশী হিসেবে আপনি গর্বিত?
একজন সম্পাদক এই প্রশ্ন কিভাবে করতে পারেন? নয়মাসের গণহত্যা, মুক্তিযুদ্ধের ফলে বাংলাদেশের নামক একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম। গৌরবান্বিত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আমাদের গর্ব। মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের শ্রদ্ধেয়জন। এই দেশের মানুষের জাতীয়তা বাংলাদেশী এবং জাতীয়তা সকল নাগরিক মানতে বাধ্য। একটি রাষ্ট্রের জন্ম ইতিহাস নিয়ে একজন বাংলাদেশী স্বাধীনতা দিবসে এই প্রশ্ন কোন উদ্দেশ্য নিয়ে করতে পারেন?
২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবস উদযাপনে মোদী বিরোধী আন্দোলনকারীদের নেই কোন আয়োজন, কেন নেই? তারা তো এদেশেরই সন্তান? বিভিন্ন জায়গায় তারা দাবী করে এদেশ নাকি তাদের, তাদের বাপ দাদারা যুদ্ধ করে নাকি স্বাধীন করছে! তারা স্বাধীনতা দিবস পালন করেনি, পরিবর্তে করেছে মোদী বিরধি আন্দোলন! তারা শান্ত বিক্ষোভ সমাবেশের নামে জুম্মার নামাজ শেষে বায়তুল মোকাররম মসজিদ থেকে বেরিয়ে লাঠি নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করেছে। ইট পাটকেল নিক্ষেপ করেছে পুলিশ ও সাধারণ পথচারী জনতার উপর। তারা রাস্তার উপরে দাহ্য পদার্থ ঢেলে আগুন ধরিয়ে উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। দেশের বিভিন্ন জেলায় ভূমি অফিস সহ বিভিন্ন সরকারী ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে কেন? থানায় হামলা করে পুলিশ সদস্যদের আহত করে পুলিশের অস্ত্র লুট করেছে কেন এসব স্থানে হামলার সাথে মোদীর বাংলাদেশ সফরের সম্পর্ক কি? সিডিউল অনুযায়ী প্রতিটি প্রোগ্রামে মোদী গিয়েছেন, তার কোন প্রোগ্রাম বাতিল করা হয় নি। মোদীর কেশ স্পর্শ করতে পারলো না, কিন্তু পথ রক্ত রঞ্জিত হলো কয়েকটি মানুষের প্রাণ গেল কি কারণে? কাদের কারণে? কারা এদের দিয়ে ভুমি অফিস, ডাকবাংলো, থানায় হামলা চালালো? কতটা অতিষ্ঠ হয়ে পুলিশ লাঠিচার্জ ও টিয়ার গ্যাস ছুঁড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করেছে! পরিস্থতি নিয়ন্ত্রণে আনতে অবশেষে পুলিশ গুলি চালাতে বাধ্য হয়েছে। ঝরেছে এদেশের মানুষের প্রাণ। হিন্দ-মুসলমান-বৌদ্ধ- খ্রিস্টান ধর্ম বেঁচে থাকে, কেবল জন্মগ্রহণ ও মৃত্যুবরণ করে মানুষ। মায়ের কোন জাত হয় না তবুও সন্তান হারিয়ে বুক খালি হয় কোন কুচক্রীর ষড়যন্ত্রে । এ বেদনা উগ্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বোঝে না। সন্তানেরাও বোঝে না। কেননা সন্তানদের একমুখী শিক্ষা দিয়ে মগজ সীল করে দেওয়া হয়েছে। সে যেটা ভাল বলে শিখেছে, তার বাইরে বাকী সব খারাপ। কিন্তু কেন খারাপ তার যৌক্তিক বিচার করার মেধাগত ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছে মোল্লাতন্ত্র। দেশ কি জানে না মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা। তারা জানে না জাতীয়তা কি? জাতীয় সঙ্গীত কি? জাতীয় পতাকা কি? পহেলা বৈশাখ কি? আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা কি? বঙ্গবন্ধু কে? মুক্তিযুদ্ধ কি? স্বাধীনতা দিবস কি? বিজয় দিবস কী? এদেশের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ইতিহাস ও অসাম্প্রদায়িক প্রীতির বিষয়ে তাদের শিক্ষা দেওয়া হয় না। ধর্মের নামে তাদেরকে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে উগ্র সাম্প্রদায়িকতা, হিংসা ও হিংস্রতা। আমাদের উত্তরসুরীরা ক্রমশ অন্ধকার গহ্বরের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
প্রচণ্ড ভারাক্রান্ত মন
তবুও আজ মনে পরে কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র কথা —
স্বাধীনতা – একি হবে নষ্ট জন্ম ?
একি তবে পিতাহীন জননীর লজ্জার ফসল ?
জাতির পতাকা খামচে ধরেছে আজ পুরোনো শকুন।