মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার ভাটেরা ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর গ্রামের মেয়ে ঝর্ণা চৌধুরী উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠানোয় দেশে তার পরিবারকে “সমাজচ্যুত” করে স্থানীয় মসজিদ কমিটি। পরে ঝর্ণার পরিবার লিখিতভাবে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের (ইউএনও) কাছে অভিযোগ দিলে মসজিদ কমিটিকে সতর্ক করা হয়।
অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে উপজেলা ও পুলিশ প্রশাসনের তৎপরতায় নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছে মসজিদ কমিটি।
ঝর্ণার পরিবারকে সমাজচ্যুত করার কারণ হিসেবে মসজিদ কমিটির সেক্রেটারি আমিন মিয়া জানান, ঝর্ণা আমেরিকায় সনাতন ধর্মাবলম্বী একজনকে বিয়ে করেছে, তাই তার পরিবারকে সর্তক করা হয়েছে। তবে বিয়ের বিষয়টি অস্বীকার করে ঝর্ণা বলেন, “এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট”।
এ বিষয়ে ৩১ জানুয়ারি মসজিদ কমিটির বিরুদ্ধে কুলাউড়ার ইউএনও বরাবর ঝর্ণা চৌধুরীর বাবা আব্দুল হাই চৌধুরীর লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।
অভিযোগ থেকে জানা যায়, উচ্চশিক্ষার জন্য গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান ঝর্ণা চৌধুরী। সেখানে গিয়ে শার্ট ও জিন্সের প্যান্ট পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। স্থানীয় কিছু যুবক ঝর্নার ওই ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেসবুকে আপলোড করে তার নামে কুৎসা রটায়।
অভিযোগে বলা হয়েছে, ঝর্ণা ২০০৮ সাল থেকে বিভিন্ন সামাজিক কাজে যুক্ত ছিলেন। একটি সামাজিক সংগঠনের প্রধান সমন্বয়কও ছিলেন তিনি। নারী অধিকার নিয়ে তিনি বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন। এ কারণে এলাকার কিছু মানুষের বিরাগভাজন হন ঝর্ণা।
অভিযোগে আরও বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত ঝর্ণার ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে এলাকায় নানা অপবাদ প্রচার করে আসছে একটি গোষ্ঠী। বলা হয়, ঝর্ণা নাস্তিক হয়ে গেছেন। এরপর স্থানীয় মসজিদ কমিটি সভা ডেকে আব্দুল হাইয়ের পরিবারকে সমাজচ্যুত করার ঘোষণা দেয়। এ ঘটনায় তিনি সামাজিকভাবে চাপে আছেন।
ঝর্নার মা মিনারা জানান, তার মেয়ে বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজে জড়িত। নারী সমাজের উন্নয়নে সে অনেক কাজ করেছে। “পজিটিভ জেনারেশন অব সোসাইটি, বাংলাদেশ” নামে তার একটি উন্নয়ন সংগঠনও রয়েছে।
তিনি অভিযোগ করেন, তার মেয়ের লক্ষ্য পিছিয়ে পড়া নারী সমাজকে এগিয়ে নেওয়া। এই কাজে একটি মহল তার মেয়ের বিরুদ্ধে দেশে থাকাকালেই নানা অপপ্রচার চালায়। এ ঘটনায় গত ৮ জানুয়ারি তার মেয়ে সিলেট শাহপরান থানায় একটি সাধারণ ডায়রি করেন বলেও জানান তিনি।
তিনি আরও জানান, এ ঘটনায় তার স্বামী মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। আগে তিন বার তার “স্ট্রোক” (মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ) হয়েছে। এখন স্বামীর সুস্থতা নিয়েও দুশ্চিন্তায়। আবার বিদেশে গিয়ে মেয়েও দুশ্চিন্তায়।
এ প্রসঙ্গে ঝর্ণা বলেন, “গত ২৬ ডিসেম্বর আমি উচ্চ শিক্ষার জন্য আমেরিকায় আসি। ২৭ ডিসেম্বর থেকে স্থানীয় একটি মৌলবাদী গোষ্ঠী ফেসবুকে আমাকে নিয়ে কুৎসা রটাতে থাকে। বিদেশ গিয়ে ছোট কাপড় পরছি, নাস্তিক হয়ে গেছি- এই সেই নানা কিছু গল্প তারা তাদের মতো বানাতে থাকে।”
তিনি আরও বলেন, “স্থানীয় ভাটেরা বাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ পঞ্চায়েত কমিটি আমার বাবা আব্দুল হাইকে জুমার নামাজের সময় সালিশ বৈঠক ডাকেন। গুরুতর অসুস্থ থাকায় বাবা যেতে পারেননি। তাই ক্ষিপ্ত হয়ে মসজিদ পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি মাখন মিয়া ও সম্পাদক আমিন মিয়ার নির্দেশে আমার পরিবারকে এক ঘরে করে দেওয়া হয়।”
তিনি আরও বলেন, “গ্রামের অতি উৎসাহী কিছু মানুষ স্থানীয় মসজিদে আমাকে নিয়ে সালিশ ডাকেন। আমার বাবাকে সেই বিচারে উপস্থিত হতে বলেন, কিন্তু ৭০ বছর বয়সী আমার বাবা ইতোমধ্যে তিনবার স্ট্রোক করেছেন। চিকিৎসক বিশ্রামে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন।”
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, “সামান্য ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। এটি সমাধান হয়ে যাবে। এ বিষয়ে মেয়ের বাবার সাথে কথা হয়েছে।”
কুলাউড়ার ইউএনও এটিএম ফরহাদ চৌধুরী বলেন, “সামাজিকভাবে যেন কোনো ধরনের হয়রানি না করা হয়, তার জন্য অভিযোগ পাওয়ার পরেই আমি মসজিদ কমিটিকে সতর্ক করে দিয়েছি। তারাও বলেছে এ ব্যাপারে কোনো কথা বলবেন না। সেই সঙ্গে আগামী ৯ ফেব্রুয়ারি তাদেরকে অফিসে আসতে বলেছি। স্থানীয় চেয়ারম্যানকেও বলেছি বিষয়টি দেখে দিতে।”
তিনি আরও বলেন, “ঝর্ণার পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্থানীয় থানাকেও অবগত করেছি। ঝর্ণার বাবার সঙ্গে আমি আলাপ হয়েছে। তিনিও আশ্বস্ত হয়েছেন।”
এ বিষয়ে মসজিদ কমিটির সভাপতি মাখন মিয়া বলেন, “আমরা ইন্টারনেট বুঝি না। এলাকার কিছু লোক ভুল বুঝিয়ে এ কাজ করিয়েছে। এজন্য আমরা অনুতপ্ত। এই মুহূর্তে আমরা তাদের বাড়িতে আছি।
নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে তারা এজন্য অনুতপ্ত বলে জানান মাখন মিয়া। পাশাপাশি সাধারণ সম্পাদক আমিন মিয়াও তার সঙ্গে ঝর্ণার বাড়িতে গিয়েছেন বলে জানান তিনি।