সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলায় কক্সবাজারের টেকনাফ থানা পুলিশের বরখাস্ত ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ ও বরখাস্ত পরিদর্শক লিয়াকত আলীর মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন আদালত। এ সময় এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাগর দেব, রুবেল শর্মা, পুলিশের সোর্স নুরুল আমিন, নিজাম উদ্দিন ও আয়াজ উদ্দীনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে।
এছাড়া, এপিবিএন এসআই শাহজাহান আলী, কনস্টেবল মো. রাজীব ও মো. আব্দুল্লাহ, পুলিশের কনস্টেবল সাফানুল করিম, কামাল হোসেন, লিটন মিয়া ও পুলিশের কনস্টেবল আব্দুল্লাহ আল মামুনকে মামলা থেকে খালাস দিয়েছেন আদালত।
সোমবার (৩১ জানুয়ারি) বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে এ রায় দেন কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল।
রায় ঘোষণা
কঠোর নিরাপত্তায় সোমবার দুপুর ২টার দিকে ৯ পুলিশ, তিন এপিবিএন সদস্য ও তিন স্থানীয় বাসিন্দাসহ ১৫ অভিযুক্তকে আদালতে আনা হয়। এর পর ২টা ২৫ মিনিটের দিকে জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল মামলার রায় পড়া শুরু করেন। এ সময় বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ১৫ আসামিই সেখানে উপস্থিতি ছিলেন। এজলাসের এক কোণায় চিন্তিত ও বিমর্ষ অবস্থায় ওসি প্রদীপকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
বিচারকের পর্যবেক্ষণ
বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল বলেন, “আমি মেজর সিনহা হত্যা মামলার বিভিন্ন খুঁটিনাটি তথ্য খোঁজার চেষ্টা করেছি। মামলার প্রত্যক্ষ সাক্ষীর জবানবন্দি থেকে জানা গেছে ‘এপিবিএন’র তিন সদস্য ঘটনার সময় দায়িত্বে ছিলেন। এ তিনজন প্রথমে সিনহার গাড়ি ছেড়ে দিলেও, পুলিশ আবারও তাকে আটকায় এবং এর ১০ থেকে ২০ মিনিটের মধ্যেই গুলি করা হয়। এতে প্রমাণিত হয় এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।“
এছাড়াও বিচারক পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেন, “সিনহার সহযোগী সাহেদুল ইসলাম সিফাতের সাক্ষ্য অনুসারে মেজর সিনহাকে ৪ রাউন্ড গুলি করেন লিয়াকত আলী। শেষ পর্যন্ত ওসি প্রদীপ ঘটনাস্থলে পৌঁছে সিনহার শরীরে লাথি মারলে তিনি নিস্তেজ হয়ে যান।“
পরে, মাইকে ঘোষণা দিয়ে সিনহাকে ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনি দিয়ে হত্যার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পুলিশের সোর্স নুরুল আমিন, মোহাম্মদ আয়াজ ও নিজাম উদ্দিনকে ৫ লাখ টাকার দেওয়ার কথা থাকলেও ওসি প্রদীপ তা দেয়নি।
আইনজীবীদের বক্তব্য
মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম বলেন, “ওসি প্রদীপের কৃতকর্ম নিয়ে মেজর সিনহা ভিডিওচিত্র তৈরি করছিলেন। বিষয়টি প্রদীপ জেনে যায়। এরপর ওসি প্রদীপ ও লিয়াকতরা পরিকল্পনা করে সিনহাকে হত্যা করে। এই রায়ে আমরা সন্তুষ্ট নই। সম্পূর্ণ রায় হাতে পাওয়ার পর পরবর্তীতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।“
মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোস্তফা বলেন, “আমরা একদিকে সন্তুষ্ট আবার অন্যদিকে অসন্তুষ্ট। কারণ, যারা অপরাধ করেছেন তাদের উপযুক্ত শাস্তি হয়েছে। আবার অনেকে অপরাধ করেও শাস্তির আওতায় আসেনি। আমরা উচ্চ আদালতে যাওয়ার বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করছি।“
রায়ের পর আসামি প্রদীপের আইনজীবী মো. মহিউদ্দিন খান আদালত থেকে বেরিয়ে বলেন, “আমি ওসি প্রদীপের পক্ষে ছিলাম। আমরা আদালতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে উপস্থিত ছিলাম এবং ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করেছিলাম। কিন্তু আদালত যে আদেশ দিয়েছেন তা নিয়ে আমরা উচ্চ আদালতে যাবো।“
যা বলছেন সিনহার বোন
আলোচিত এই হত্যা মামলার বাদী ও মেজর সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস বলেছেন, “মামলার প্রধান আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি হোক সেটা প্রথম থেকে আমরা বলে আসছি। আমাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। তবে যারা অপরাধ করেও খালাস পেয়েছেন, তাদেরও শাস্তি হওয়া উচিত। আমি যদি এখন সন্তুষ্টির কথা বলি, তাহলে আমি বলবো- যেদিন রায় কার্যকর হবে, সেদিন আমি সন্তুষ্ট হব।“
আসামির স্বজনদের বক্তব্য
মামলার আসামি কনস্টেবল রুবেল শর্মার ভাই বিচারিক কার্যক্রমে গণমাধ্যমকে দোষারোপ করেছেন। তিনি দাবি করেন, সিনহা হত্যা মামলাকে মিডিয়া ট্রায়াল করেছে গণমাধ্যমকর্মীরা। তারা সব আসামিকে ঢালাওভাবে দোষী বানিয়ে সংবাদ পরিবেশন করেছে। কিন্তু সব আসামি দোষী না। মূলত ওসি প্রদীপের সঙ্গে তাদের ফাঁসানো হয়েছে।
আদালত প্রাঙ্গণে ছিল কড়া নিরাপত্তা
সিনহা হত্যা মামলার রায়কে ঘিরে সকাল ৭টা থেকেই কক্সবাজার আদালত প্রাঙ্গণে ছিল কড়া নিরাপত্তা। ইউনিফর্ম পরা পুলিশের পাশাপাশি ছিলেন সাদা পোশাকের বিপুল সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য। ঢাকার বাইরে কোনো মামলার রায়ের জন্য এমন কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা বেশ বিরল। এ ধরনের কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্প্রতি শুধুমাত্র ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের রায়ের সময়েই দেখা গিয়েছে। বিচারক আসার বেশ আগেই এজলাসকক্ষ গমগম করছিল সাংবাদিক এবং আইনজীবীদের উপস্থিতিতে। স্থানীয় সাংবাদিকদের বাইরেও ঢাকা থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যমের কর্মীরা কক্সবাজার আদালতে উপস্থিত হন।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, মামলার রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা যেন না ঘটে সেজন্য অন্যান্য সময়ের তুলনায় এবার কড়া নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
উল্লেখ্য ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ রোডের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান। এ ঘটনা আড়াল করতে পুলিশ বাদী হয়ে তিনটি (টেকনাফে দুটি, রামুতে একটি) মামলা করেছিল। ঘটনার চার দিন পর (৫ আগস্ট) কক্সবাজার আদালতে টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ ৯ পুলিশের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস।