আহমেদ স্বপন মাহমুদ
তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের সাথে সাথে অনেক কিছুই সহজলভ্য হয়ে উঠছে মানুষের কাছে। যেমন পারস্পরিক যোগাযোগ। প্রযুক্তির বিকাশের কারণেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মানুষের সার্বক্ষণিক বিচরণ ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। আর করোনা মহামারীকালে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেড়েছে। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন ফেসবুক, টুইটার, ইউটিব, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদি মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা পারস্পরিক যোগাযোগ রক্ষাসহ মতপ্রকাশ করতে পারছে। ইন্টারনেটসহ বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমে বিচরণের যে পরিবশে তা মূলত ডিজিটাল পরিবেশ। ডিজিটাল পরিবেশ বা ডিজিটাল অধিকার এইসব বিষয় এখন নতুন করে আলোচনায় উঠে আসছে। যেমন ইন্টারনেট স্বাধীনতা বা ইন্টারনেটে মত প্রকাশের স্বাধীনতা। ইন্টারনেটে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে মানবাধিকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অর্থাৎ যখন ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে মতামত প্রকাশ করা হয় তখন তাকে মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে ডিজিটাল অধিকার বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ ডিজিটাল পরিবেশে মানবাধিকার বা ইন্টারনেটে মানবাধিকার।
জাতিসংঘ সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার মাধ্যমে মানবাধিকারের সংজ্ঞাকে আরো পরিষ্কারভাবে বোঝানো হয়েছে। শুধুমাত্র ডিজিটাল, প্রযুক্তি বা ইন্টারনেট ইত্যাদি শব্দ দিয়ে অনেক সময় মূলভাব প্রকাশ করা যায় না। এই শব্দগুলি বিশ্লেষণ করার সময় অনেক ব্যাখ্যা উঠে আসে। উদাহরণস্বরূপ, ডিজিটাল শব্দটি প্রায়ই অনলাইন বা ইন্টারনেটের সাথে মিলে যায়। কিন্তু ডিজিটাল বলতে যে সবসময় ইন্টারনেটের সাথে সংযুক্ত এমন বোঝায় না। এর একটি ভালো উদাহরণ হলো বর্ডার পার হবার সময় বায়োমেট্রিক তথ্য, ফেস শনাক্তকরন, আঙুলের ছাপ শনাক্তকরন ইত্যাদি। এইগুলিও ডিজিটাল কিন্তু ডিজিটাল অধিকারের সাথে সম্পৃক্ত নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে ডিজিটাল স্পেসে সার্বজনীন মানবাধিকারের চর্চাকে ডিজিটাল অধিকার বলা হয়। অর্থাৎ একটি নিরাপদ, ব্যক্তিগত, সুরক্ষিত এবং স্থায়ী ডিজিটাল জায়গায় নিজেকে প্রকাশ করার অধিকারই ডিজিটাল অধিকার।
ডিজিটাল পরিবেশে মানুষের মৌলিক অধিকার হলো ডিজিটাল অধিকার। এটি বাক-স্বাধীনতা, মত প্রকাশের অধিকার, তথ্য প্রাপ্তির অধিকার, ইন্টারনেটের ডিভাইসগুলো ব্যবহার করার অধিকার, সকল প্লাটফর্মে প্রবেশ করার অধিকার (যেমন ফেসবুক, টুইটারসহ অন্যান্য) এসব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। গোপনীয়তা, তথ্য-সুরক্ষা, ইত্যাদির ক্ষেত্রে অনলাইন প্লাটফর্মকে একটি নিরাপদ স্থান হিসেবে বিবেচনা করা দরকার। কারণ ইন্টারনেট সবার জন্য উন্মুক্ত, এবং এটি বৈষম্য বিরোধী এবং সকলের সমতা নিশ্চত করে।
ডিজিটাল অধিকার সার্বজনীন মানবাধিকারের একটি অংশ। এটি প্রত্যেকের লিঙ্গ, বয়স, জাতি, যৌনতা নির্বিশেষে উন্মুক্ত এবং ইন্টারনেটে সকলের সমান প্রবেমাধিকার থাকার অধিকার নিশ্চিত করে, যা জনগণের মৌলিক স্বাধীনতা এবং অধিকার নিশ্চিত করার জন্য একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, জবাবদিহিমূলক এবং স্বচ্ছ পদ্ধতিতে পরিচালিত হওয়া উচিৎ।
ডিজিটাল অধিকার মূলত অনলাইন মানবাধিকার। এটি গোপনীয়তা এবং নিরাপত্তা অনুসরণ করে নিরাপদ স্থানে তথ্য এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার অনুমতি দেয়। ডিজিটাল অধিকার তথ্য, প্রযুক্তি এবং জ্ঞানের সমান অধিকার নিশ্চিত করে; সহিংসতা, নজরদারি এবং বৈষম্য থেকে মুক্তি দেয়; গোপনীয়তা, স্বায়ত্তশাসন এবং আত্মনিয়ন্ত্রণকে সম্মান করে, যদি প্রকৃতপক্ষে সেই অধিকারকে কার্যকর করা যায়।
প্রকৃতপক্ষে, ডিজিটাল অধিকারের বিভিন্ন উপাদানকে ব্যাখ্যা করার জন্য বৈশ্বিক, আঞ্চলিক এবং স্থানীয় বিভিন্ন উদ্যোগ রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ, এসোসিয়েশন অব প্রোগ্রেসিভ কমিউনিকেশনস’র (এপিসি) ইন্টারনেট রাইটস চার্টার, মানবাধিকার সনদ, জাতিসংঘের ইন্টারনেট গভর্নেন্স ফোরাম (আইজিএফ), ইন্টারনেট রাইটস অ্যান্ড প্রিন্সিপলস ডাইনামিক কোয়ালিশন রয়েছে। মানবাধিকারের মানকে কীভাবে অনলাইন পরিবেশে প্রয়োগ করা উচিত এসব সংগঠন সেই রূপরেখা দেয়।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ডিজিটাল অধিকার সম্পর্কে ২০১৯ সালের একটি গবেষণা পত্রে, জুন-ই চারটি ক্ষেত্র চিন্তা করে ডিজিটাল অধিকারের ধারণাকে প্রসারিত করার প্রস্তাব করেছে:
ডিজিটালকে একটি স্পেস হিসাবে দেখার মাধ্যমে এবং ডিজিটাল অধিকারগুলোকে প্রচলিত অধিকারের পরিপূরক হিসেবে দেখা; বাস্তব জগতের তথ্য উপস্থাপনা হিসেবে দেখার মাধ্যম হলো ডিজিটাল মাধ্যম, তাই তথ্য সুরক্ষা এবং গোপনীয়তার উপর ডিজিটাল অধিকারকে গুরুত্ব দেওয়া; ডিজিটাল স্পেসে প্রবেশাধিকার এবং অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণ; এবং ডিজিটাল স্পেস বা ইন্টারনেটের নিয়ন্ত্রণে অংশগ্রহণ।
অসংখ্য উপায় রয়েছে যার মাধ্যমে আমরা ডিজিটাল অধিকারগুলিকে কার্যকর করতে পারি। আমরা ডিজিটাল অধিকারকে কার্যকর ও অর্থপূর্ণ করার জন্য বিভিন্ন কৌশল এবং আন্দোলন গড়ে তুলতে অবদান রাখতে পারি। ডিজিটাল অধিকারের সীমানা সংজ্ঞায়িত করার ক্ষেত্রে আমরা কী অন্তর্ভুক্ত করছি এবং কী বাদ দিচ্ছি তা পুনর্বিবেচনা করতে পারি। সর্বোপরি, ডিজিটাল অধিকারকে বাস্তবে কার্যকর করার ক্ষেত্রে আমরা সম্মিলিতভাবে কাজ করতে পারি।
আহমেদ স্বপন মাহমুদ: কবি, সমালোচক ও গবেষক।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত সম্পূর্ণভাবে লেখকের, সাময়িকীর নয়।