আগামী ২৩ জানুয়ারি পর্যন্ত জাপানি দুই শিশু জেসমিন মালিকা (১১) ও লাইলা লিনা (১০) তাদের মা নাকানো এরিকোর সঙ্গেই থাকবে বলে আদেশ দিয়েছেন আদালত। তবে শিশু দুটির বাবা বাংলাদেশি ইমরান শরীফ চাইলে এই সময়ের মধ্যে প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টার মধ্যে যেকোনো সময় দুই সন্তানের সঙ্গে দেখা করতে পারবেন।
এ সময়ের মধ্যে শিশুদের মাকে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে নিয়মিত আপিল করতে বলা হয়েছে। আগামী ২৪ জানুয়ারি পরবর্তী আদেশ দেবেন আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ সোমবার এই আদেশ দেন।
আদালতে জাপানি মায়ের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী আহসানুল করিম। তাকে সহযোগিতা করেন শিশির মনির। শিশু দুটির বাবার পক্ষে ছিলেন আইনজীবী ফাওজিয়া করিম। তাকে সহযোগিতা করেন ব্যারিস্টার মারুফুল ইসলাম।
গত বছরের ১২ ডিসেম্বর মেয়েদের দুইদিন গুলশানে তার মায়ের বাসায় থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন আপিল বিভাগ। আদেশ অনুযায়ী, সেই দিন রাত ১০টা থেকে মায়ের সঙ্গে থাকার কথা ছিল তাদের। কিন্তু বাবার পক্ষ থেকে সেই আদেশ পালন করা হয়নি। অর্থাৎ মায়ের কাছে দুই শিশুকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি ওইদিন রাতে।
দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আদেশ পালন না করায় পরদিন ১৩ ডিসেম্বর সকালে জাপানি মায়ের পক্ষ থেকে আইনজীবীর মাধ্যমে আপিল বিভাগে বিষয়টি অবগত করা হয়। সেদিন তাৎক্ষণিক দুই মেয়েসহ বাবাকে আদালতে তলব করেন আপিল বিভাগ। এরপর ওইদিন বেলা ১১টার পর দুই মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে আপিল বিভাগে হাজির হন বাবা। পরে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের বিচারপতিরা খাসকামরায় ডেকে নেন দুই শিশু কন্যাকে। তাদের সঙ্গে প্রায় আধা ঘণ্টা কথা বলার পর তাদের বাবা-মাকেও খাস কামরায় ডেকে নেওয়া হয়। বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলার পর তাদের উভয়পক্ষের আইনজীবীদের সঙ্গে বিচারকরা বসে কথা বলেন।
এরপর এজলাসে ওঠেন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ সেই রাতেই মায়ের কাছে শিশুদের বুঝিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। এছাড়া বাবা দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আদেশ অমান্য করে আদালত অবমাননা করেছেন বলে মন্তব্য করেন আপিল বিভাগ।
আদালতে আপিলের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি ও অ্যাডভোকেট আহসানুল করিম। তাদের সহযোগিতা করেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির। অন্যদিকে বাবার পক্ষে শুনানিতে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ফিদা এম কামাল ও অ্যাডভোকেট ফাউজিয়া করিম ফিরোজ।
২০০৮ সালে বিয়ে করে জাপানে স্বামী প্রকৌশলী ইমরানকে নিয়ে থাকা চিকিৎসক নাকানো এরিকো দাম্পত্য কলহের জেরে গত বছরের ১৮ জানুয়ারি বিচ্ছেদের আবেদন করেন। এরপর ইমরান স্কুলপড়ুয়া বড় দুই মেয়েকে নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। ছোট মেয়ে জাপানে এরিকোর সঙ্গে থেকে যান।
দুই সন্তানের জিম্মা পেতে জাপান থেকে বাংলাদেশে এসে বাংলাদেশি স্বামীর সঙ্গে আইনি লড়াই করতে থাকেন নাকানো। কয়েক মাস ধরে চলছে তার এই লড়াই। তা রিট আবেদনে গত ২১ নভেম্বর হাইকোর্ট সিদ্ধান্ত দিয়েছিল, জাপান থেকে ঢাকায় নিয়ে আসা দুই মেয়ে তাদের বাংলাদেশি বাবা ইমরান শরীফের কাছেই থাকবে। তবে জাপানি মা সন্তানদের সঙ্গে একান্তে সময় কাটানোর সুযোগ পাবেন।
রায়ে বলা হয়, জাপান থেকে এসে মা বছরে তিনবার ১০ দিন করে দুই সন্তানের সঙ্গে একান্তে সময় কাটাতে পারবেন। জাপানি মায়ের আসা-যাওয়া ও থাকা-খাওয়ার সব খরচ বাবা ইমরান শরীফকে বহন করতে হবে।
রায়ে আদালত বলেন, রিটটি চলমান থাকবে। দুই মেয়ে বাবা ইমরান শরীফের হেফাজতে থাকবে। মা দেখা-সাক্ষাৎ এবং একান্তে সময় কাটানোর সুযোগ পাবেন। যেহেতু মা জাপানি নাগরিক, সেখানে থাকেন এবং কাজ করেন, তাই তিনি নিজের সুবিধা মতো সময়ে বাংলাদেশে এসে সন্তানদের সঙ্গে প্রতিবার কমপক্ষে ১০ দিন করে সময় কাটাতে পারবেন।
এ ক্ষেত্রে বছরে তিনবার বাংলাদেশে যাওয়া-আসাসহ ১০ দিন অবস্থানের যাবতীয় খরচ বাবা ইমরান শরীফকে বহন করতে হবে। এর বাইরে আসা-যাওয়ার খরচ মা বহন করবেন। ছুটির দিনে অন্তত দুইবার বাবা সন্তানদের মায়ের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেবেন।
এছাড়া আদালত নির্দেশনা দেন, গত কয়েকমাস বাংলাদেশে অবস্থান ও যাতায়াত খরচ বাবদ শিশুদের মা নাকানো এরিকোকে ১০ লাখ টাকা দেবেন বাবা ইমরান শরীফ। রায় ঘোষণার সাত দিনের মধ্যে তাকে এ অর্থ দিতে হবে। রিটটির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আদেশ প্রতিপালিত না হলে বা অন্য কোনো আদেশের জন্য আদালতে উভয়পক্ষ আসতে পারবে। সংশ্লিষ্ট সমাজসেবা কর্মকর্তা শিশুদের দেখভাল অব্যাহত রাখবেন। প্রতি তিন মাস অন্তর শিশুদের বিষয়ে হাইকোর্টের রেজিস্ট্রারের কাছে প্রতিবেদন দিতে হবে।