টেমি টি গার্ডেন। পাহাড় রাজ্য সিকিম, তার একমাত্র চা-বাগান। বিশাল পাহাড়ের ঢালে বাগানের চোখ ধাঁধানো বিস্তার। সুন্দর বাগানে থাককার জায়গাও মনোরম। দ্বিতল বাড়ি। ছাদে দাঁড়ালেই চারদিক খোলা। তিনশো ষাঠ ডিগ্রী, আক্ষরিক অর্থেই উন্মুক্ত। সবুজ কার্পেটে মোরা উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম। উত্তর দিকে খানিক দূরে অদ্ভুত দৃশ্য।
আকাশ যদি হয় মেঘমুক্ত, চোখের সামনে তখন কাঞ্চনজঙ্ঘার উন্নত শিখরদেশ। শুভ্র পাহাড় চুড়া। আকাশ ছুঁয়েছে উন্নত শৃঙ্গ। একক শৃঙ্গ নয়। শৃঙ্গরাজী। কুম্ভকর্ণ, রাথং, কাব্রু। খানিক দূরে পান্ডিম আর সিমারো। কাঞ্চনজঙ্ঘা-শৃঙ্গ সবার মাথা ছাড়িয়ে। ক্ষণে ক্ষণে রং বদল। ভোরের আধো অন্ধকারে মাথায় সোনালী ছটা। খানিক পরেই রুপালি আভা। তারপরেই অন্য রূপ। নীল আকাশের নিচে রোদে ঝলমল করছে ভয়ংকর সৌন্দর্য। চোখ ফেরানো যায় না।
শৃঙ্গরাজি দর্শনের আকুতি নিয়ে দেশ বিদেশের মনুষ্য সমাগম। সুবিশাল, ভারত নেপালের মধ্যবর্তী বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম শৃঙ্গ। কাঞ্চনজঙ্ঘা, নামের অর্থই ‘পাহাড় চূড়ায় পঞ্চ ঐশ্বর্য’। স্থানীয় মানুষের দেবতা। সৌভাগ্য প্রদান করেন, তেমনি বিশ্বাস।
পাহাড় চূড়ার সৌন্দর্য চাক্ষুষ করেই স্থান ত্যাগ করেন অধিকাংশ ভ্রমণকারী। তবে অন্যরকম মানুষও আসেন। পূর্ণিমার রাতে কিংবা ভোরের আলোয় তাকে একবার শুধু দেখবেন। সাক্ষাত দেবতা। সৌভাগ্য প্রদানকারী। কয়েক মুহূর্ত মাত্র দর্শনের অভিলাষ।
টেমি গেস্ট হাউসের ছাদ থেকে, ঘর থেকেও দৃশ্যমান সেনযেলুংমা (Senjelungma)। লিম্বু ভাষায় ঈশ্বরের আবাস, কাঞ্চনজঙ্ঘা। সিকিম, দার্জিলিঙের বহু স্থান এমনকি দূরের উত্তরবঙ্গ থেকেও দর্শন মেল। টেমি চা বাগান থেকে হাতের নাগালে রুপের খনি।
টেমিতে দেখা হয়েছিল রতনবাবুদের সঙ্গে। আমার ঘরের পাশে তাঁরা ছিলেন। মাথায় টিপটিপ বৃষ্টি নিয়ে আমি পৌঁছালাম। সকাল তখনও দুপুরে গড়ায়নি। কিন্তু অন্ধকার। কালো মেঘ ঢেকে দিয়েছে চরাচর। সেদিন ছিল পূর্ণিমা। কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার দিন। ওরা উপস্থিত তার দুদিন আগে থেকেই। লক্ষ্মী পূজার দিন একবার যদি দর্শন পাওয়া যায় সৌভাগ্য-দেবতার!
আমার আগমন পর্বতশৃঙ্গ দর্শন আর ছবি তোলা। ক্যামেরার রকমারি লেন্স সঙ্গে। ওয়াইড অ্যাঙ্গেল ফিলটার স্ট্যান্ড। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘রিপোর্টার নাকি?’
-না না। টুরিস্ট। আপনার মতই।
-আমরা কিন্তু টুরিস্ট নই। প্রতি বছর আসি। নিয়ম করে।
কপালে ভাঁজ পড়ল। বৃষ্টি ভেজা দিন। ঘরেই বসে থাকা। আলাপ হয়ে গেল। তিনি এসেছেন দুদিন আগে। রতন সিংহ। আমার মত একা নন। সপরিবারে, সবান্ধবে আগমন। স্ত্রী পুত্র সঙ্গে। বন্ধু পুলক চৌধুরী, তিনিও সস্ত্রীক। সঙ্গে কন্যা। আমার ঘরের পাশে পর পর দুটো ঘরে দুই পরিবারের অধিষ্ঠান।
দুদিন ধরে ওরা আছেন। আগামী কাল থেকে পরের দিন রতনবাবু সদলবলে প্রস্থান করবেন। গত পাঁচ-ছ দিন ধরেই আবহাওয়া প্রতিকূল। বিরামহীন বৃষ্টি। একবারের জন্যও উঁকি দেননি সূর্যদেব। আকাশ জুড়ে জমাট মেঘ। কালো মেঘের পর্দা ঢেকে রেখেছে কাঞ্চনজঙ্ঘার আলো ঝলমল উদাত্ত মুখ।
খাবার ঘরে চায়ের টেবিলে কথোপকথন। কথা চলছে, গল্প জমছে না। যদিও রতনবাবু সুন্দর কথা বলেন। বয়স পঞ্চাশের নিচে। বন্ধু পুলকবাবুর বয়সও তেমনি। ধীরে কথা বলছেন রতনবাবু। ‘আমারা ব্যবসায়ী, বুঝলেন। গাড়ির কারবার। আসানসোল থেকে প্রতি বছর লক্ষ্মী পূজার দিন আসি। কাঞ্চনজঙ্ঘার আশীর্বাদ নিতে।’
চমকে গিয়ে তাকালাম। আমার দিকে দৃষ্টি রতনবাবু। অন্যমনস্ক। স্বরে বিষণ্ণতা। বলছেন, ‘পঁচিশ বছর ধরে চলছে নিয়মিত আসা। লক্ষিপুজার দিন কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শন। একবারও বন্ধ করিনি। গত দু’বছর কোভিডের কারণে বন্ধ ছিল সব। ভাইরাসের ভয়ে সারা দেশে লকডাউন। বাস ট্রেন বন্ধ। তবুও এসেছি। সিকিমে আসতে দেয়নি। দার্জিলিং গেছি কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে। নিজে গাড়ি চালিয়ে আসানসোল থেকে দার্জিলিং, বুঝলেন!’
থামলেন রতনবাবু। এমন হয় নাকি, ভাবছি। চায়ে বড় একটা চুমুক দিলাম। আমার ভাবিত মুখের দিকে তাকিয়ে রতনবাবু। বললেন, ‘এবার ট্রেন চালু হয়েছে। করোনার মধ্যে বহু সাবধানতা। বাস ট্যাক্সি চলছে। বেরিয়ে পড়লাম। কিন্তু আমরা অভাগা, বুঝলেন!’
চায়ের বাকী অংশটা গলায় ঢেলে খানিক চুপ থেকে আবার শুরু করলেন, ‘আবহাওয়া খারাপ। সাতদিন ধরে লাগাতর বৃষ্টি। জীবনে এরম দেকিনি। পুরো রাস্তাতেই ধস। তিস্তা নদী তিনশো ফুট নিচে থেকে রাস্তায় উঠে এসে তাণ্ডব করেছে। বহু জায়গায় রাস্তা ধুয়ে সাফ। কষ্ট হয়েছে অনেক। তবুও এসেছি। …যদি এক বারের জন্যও দর্শন পেতাম!’
এমন তো হয়ই, ভাবছি। পাহাড়ে আবহাওয়া খারাপ। বৃষ্টি দুর্যোগ ধস রাস্তা বন্ধ। সাধারণ ব্যাপার। অনেকের মুখে শুনেছি,’ দশবার পেলিং -এ গিয়েও কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাইনি।’ রতনবাবুর এত দুঃখ কেন?
অন্য প্রসঙ্গে মুখ খুললেন পুলকবাবু। রতনবাবুর বন্ধুটি এতক্ষণ চুপচাপ কথা শুনছিলেন। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘লাগাতর বৃষ্টি এবার কেন দাদা? সাত দিন ধরে চলছে তো চলছেই। নদী কতটা নিচু থেকে সড়কে উঠে রাস্তা উড়িয়ে নিল! আর ধস, মাইলের পর মাইল পাথরের চাই!’
উত্তর দিলেন তার স্ত্রী। বললেন, ‘দুর্গাপূজার সময় বরাবর আকাশ পরিষ্কার থাকে। এবার সব লণ্ডভণ্ড। গ্লোবাল ওয়ারমিং। জলবায়ু বদলে যাচ্ছে। পাহাড়ে আর বোধহয় আসতে পারবো না!’
আবহাওয়া পরিবর্তন নিয়ে রতনবাবু কিছু বললেন না। মনমরা ভাব। এত দুঃখ কেন মানুষটার? একবার জানলার পর্দা সরিয়ে আকাশ দেখে এসে বললেন, ‘সম্পূর্ণ ব্যর্থ, বুঝলেন! দেবতার মুখ দেখতে পেলাম না’। কথার ফাঁকে ফাঁকে দুঃখ ঝরল। একটু থেমে আবার, ‘তাঁর আশীর্বাদ নিতে পঁচিশ বছর ধরে আসছি। এবার পেলাম না। জানি না জীবনে কী ঘটবে?’
পর দিন সকালেও মেঘ। চোখের আড়ালে পাহাড় রাস্তা বাড়ি ঘর। বৃষ্টি চলছেই। ঘরের বাইরে ছাতা মাথায় খানিক হাঁটা যায়। দূরের কিছু নজরে আসে না। কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শন হল না। পরের দিন তাদের চলে যেতে হবে। টিকিট কাটা। ওরা চলে যাবে। তার পরেও গোটা একটা দিন থাকবো। আবহাওয়া যদি হঠাৎ ভালো হয়ে যায়! ‘পাহাড় কা মৌসম’ কখন কী হয়! কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শনের সুযোগ পাবো কি!
চলে যাচ্ছে রতনবাবুর দলবল। আমাকে ফোন নম্বর দিয়ে বললেন, ‘কাল সকালে আবহাওয়া কেমন থাকে জানাবেন।
পরের দিন অঘটন। ম্যাজিক। মেঘ রাজ্যে হঠাৎ কী যেন ঘটে গেল! মন্ত্র বলে মেঘ উধাও। নীল আকাশ। শ্বাস রুদ্ধ। ভোরবেলা উঁকি দিয়েছেন কাঞ্চনজঙ্ঘা। পাশে অন্যরা মুখ খুলছেন একে একে। প্যান্ডিম, কাব্রু, সিমোরা …। রং লাগেছে বরফ-শৃঙ্গে। কমলা, সোনালী, রুপালি। খানিক পরে ঝকঝকে সাদা বরফ চুড়া। ছবি তুলে যাচ্ছি। মোবাইল ক্যামেরায় আবার বড় টেলিলেন্স লাগানো যন্ত্রটা স্ট্যান্ডে রেখে। এত বড় রেঞ্জ দেখিনি কখনও।
বেলা বেড়ে গেল। সারাদিন থাকবো আজ। টেমির রান্নাঘরে লুচি তরকারি খেয়ে ফোন করলাম রতনকে।
ওর কলকাতা মুখি ট্রেন অনেক পথ এগিয়েছে। ট্রেনে যেতে যেতে বলল, ‘দাদা আপনি ভাগ্যবান। আমরা আশীর্বাদ পাইনি। আপনি তো পেলেন!
মোবাইল ফোনে তোলা কয়েকটা ছবি তখনই পাঠিয়ে দিলাম। একটু পরে উত্তর লিখল, ‘ছবিটাকে প্রণাম করলাম দাদা। দেবতার আজকের আশীর্বাদ।’
‘পরে ভালো ছবি পাঠাবো’ বলে ফোন রেখে দিলাম। বেলা বেড়েছে। এখানে এখনও কাঞ্চনজঙ্ঘা দৃশ্যমান। পাহাড়-পর্বত দর্শন করেছি। বহু শৃঙ্গের ছবি তুলেছি। এবার প্রথম দেবতার আশীর্বাদ পেলাম। নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলাম ঐশ্বর্যবান, সৌন্দর্যে মহিমান্বিত দেবতার দিকে।