বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে মৃত্যুর ঘটনা অহরহ ঘটছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, মানবাধিকার ও সামাজিক সংগঠন সীমান্ত হত্যার বিরুদ্ধে বরাবরই প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। তবে এবার খোদ ভারতে সীমান্ত হত্যা বন্ধের দাবি জোরালো হচ্ছে।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ১৮টি মানবাধিকার সংগঠন আনুষ্ঠানিকভাবে সীমান্তে গুলি করে মানুষ হত্যার প্রতিবাদ জানিয়েছে। সোমবার মানবাধিকার সংগঠন বাংলার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চের (মাসুম) উদ্যোগে কলকাতা প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এই দাবি জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ভারতের সাবেক প্রধান বিচারপতি মলয় সেনগুপ্ত, প্রখ্যাত অভিনেত্রী ও চলচ্চিত্র নির্মাতা অপর্ণা সেন, নাট্য পরিচালক সোহাগ সেন, আরএসপি নেতা মনোজ ভট্টাচার্য, সিপিআইএমএল নেতা কার্তিক পাল প্রমুখ।
সীমান্ত এলাকার বিএসএফের নজরদারি এলাকা ৫০ কিলোমিটার করার প্রতিবাদে আজ মঙ্গলবার পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় একটি প্রস্তাব উত্থাপন করার কথা রয়েছে। এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানানো হয় সংবাদ সম্মেলেন।
কলকাতার মানবাধিকার কর্মীরা বলেন, বিএসএফের কাজ সীমান্ত পাহারা দেওয়া। সীমান্তের ভেতরে ঢুকে নিরীহ সীমান্তবাসীকে হত্যা করা নয়। বিএসএফ সীমান্তে হত্যালীলা বন্ধ না করলে পশ্চিমবঙ্গে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলা হবে বলে হুঁশিয়ারি দেন।
এর আগে গত শুক্রবার পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার তৃণমূল বিধায়ক উদয়ন গুহ সীমান্তে রমরমা পাচারের দায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের ঘাড়ে চাপান। তিনি বলেন, ‘বিএসএফের মদদ ছাড়া সীমান্তে কোনো কিছুই পাচার করা সম্ভব নয়। আমি সীমান্তবর্তী এলাকার বিধায়ক। অধিকাংশ কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা। সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষের সমস্যার কথা আমি জানি। স্টিলের ব্লেড দিয়ে মোড়া কাটাতাঁরের বেড়া পেরিয়ে কী করে পাচার হয়? তা নিয়ে সকলের মনেই প্রশ্ন আছে।’
গতকাল সোমবার দিনাজপুরে এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী বলেন, নিশ্চিতভাবে সীমান্ত হত্যা উভয় দেশের জন্য দুঃখজনক এবং অপ্রত্যাশিত। ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে, যদি তাদের ওপর হামলার কোনো শঙ্কা না থাকে, তবে যেন সীমান্তে কোনো অবস্থাতেই গুলি না চালায়। আমরা কোনো দেশেই সীমান্ত হত্যা চাই না। সীমান্ত হত্যা একটি ন্যক্কারজনক ঘটনা।
এর আগে রবিবার ঢাকায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন বলেন, ‘সীমান্ত হত্যা ভারতের জন্য লজ্জার। দুই দেশের মধ্যে সিদ্ধান্ত হয়েছে সীমান্তে কোনো ধরনের প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা হবে না। গুলি করা হবে না। কিন্তু এটা হচ্ছে। তাই এটা ওদের জন্য লজ্জার। আর আমাদের জন্য দুঃখের, আমরা জীবন হারাচ্ছি।’
ভারত বারবার প্রতিশ্রুতি দিলেও থামছে না সীমান্ত হত্যা। চলতি নভেম্বর মাসেই বিএসএফের গুলিতে চারজন বাংলাদেশি নিহত হন। ২ নভেম্বর সিলেট সীমান্তে দুজন এবং ১১ নভেম্বর লালমনিরহাট সীমান্তে দুজন বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হন।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাবে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর এই নয় মাসে সীমান্তে বিএসএফের হাতে মোট ১১ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। এরমধ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে ১০ জনকে। একজনকে নির্যাতনে হত্যা করা হয়েছে। এই সময় গুলিতে আহত হয়েছেন ছয়জন। আর অপহরণ করা হয়েছে তিনজনকে।
২০২০ সালে মোট ৪৮ জন নিহত হয়েছেন। গুলিতে ৪২ জন এবং নির্যাতন চালিয়ে ছয়জনকে হত্যা করেছে বিএসএফ। অপহরণ করা হয়েছে ২২ জনকে। আহত হয়েছেন ২৬ জন।
২০১৯ সালে বিএসএফের হাতে নিহত হয়েছেন ৪৩ জন। এরমধ্যে গুলিতে ৩৭ জন এবং নির্যাতনে ছয়জন। অপহরণ করা হয়েছে ৩৪ জনকে। আহত হয়েছেন ৪৮ জন।
২০১৮ সালে পরিস্থিতি কিছুটা ভালো ছিল। তারপরও ওই বছর বিএসএফ সীমান্তে মোট ১৪ বাংলাদেশিকে হত্যা করে। এরমধ্যে গুলি করে আটজনকে হত্যা করা হয়। অপহরণ করা হয় ১৩ জনকে এবং আহত হন ১৫ জন।