পর্ব – আঠারো: মৃত আত্মার চোখ থেকে কেন নামছে অশ্রুধারা
উর্বশীর মনের গিটারে বাজতে থাকা নজরুলের ত্রিতালের আধ্যাত্মিক অনুভব ছড়িয়ে যেতে লাগল অর্ণবের আলোদেহের বিদ্যুতপ্রবাহের মধ্যেও। মগ্ন হয়ে ও বোঝার চেষ্টা করছিল প্রলয়-সৃষ্টি করে প্রভুর পুতুল খেলার লীলা-বিলাসের ব্যাপকতা আর বিস্তৃতি নিয়ে। ভেবে কূল পেল না। কেন ভাঙছেন, কেন গড়ছেন- নজরুলের এসব জিজ্ঞাসার আড়ালের সত্য প্রভুর মনে নাড়া দিতে পেরেছে কিনা জানা নেই। তবে বোঝার বাকি নেই এ খেলার আড়ালের খেলা আর গোপন থাকে না; বাস্তবের রোদে তপ্ত হয়ে ধোঁয়াশার খোলস পুড়ে স্বচ্ছতা নিয়ে উড়ে আসে খোলা জগতে। সেই জগতে ট্রাফিকজ্যামবিহীন খোলা সড়ক ধরে এখন এগিয়ে যাচ্ছে অ্যাম্বুলেন্স। আচমকা মগ্ন-ভাবনার ধোঁয়াশা হটিয়ে সপ্তাকাশ ভেঙে পড়ার মতো বিশাল এক টুকরো ভাঙা আকাশ আছড়ে পড়ল জলজগতের উত্তাল তরঙ্গমালায়। সাঁই সাঁই গতিতে তলদেশের দিকে ছুটতে থাকা বিরাট টুকরাটি ক্রমশ ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র হতে লাগল। পতনকালীন সময়ে শব্দ আর বিদ্যুৎ বিস্ফোরণের কারণে পতিত টুকরোটিকে বৃহৎ মনে হলেও ক্রমেই বুঝল আসলে আকাশ থেকে ট্রাকচ্যুত হয়েছে একটা এয়ারবাস। কোনো বিপদসংকেত ছাড়াই টুপ করে ঝরে যেতে পারে উড়াল বিমানও? নিজেকে প্রশ্ন করেই নিজ দেহের দিকে ফিরে তাকাল অর্ণব। হ্যাঁ, ঝরে যেতে পারে। প্রভুর পুতুল খেলার এর চেয়ে সহজ উদাহরণ আর কিছুই হতে পারে না। নিজেও তো টুপ করে সবার অলক্ষ্যে ঢুকে গেছে জলজ জীবনে। কোনো বিপদসংকেত কি ছিল?
হ্যাঁ, ছিল। লাল পতাকা উড়ছিল সৈকতে। সেই পতাকার নির্দেশ মানেনি ও। উর্বশীর সাবধানী ডাকও অগ্রাহ্য করে এগিয়ে গিয়েছিল সামনে। চন্দনাকেও সাবধান করেছিল উর্বশী। সে শোনেনি নিষেধবাণী। বিপদসংকেত তাহলে থাকেই, হয় সে-সংকেত আমলে নেয় না মানুষ, অথবা সংকেতের অগ্রিম বার্তার গুরুত্ব বুঝতে পারে না- এমন ভাবনা ঠেলে মনে প্রশ্ন ঢুকল এয়ারবাসটির পাইলটের কী ঘটেছিল? কেন সে হারিয়েছিল নিয়ন্ত্রণ? কেবলই কি যান্ত্রিক গোলযোগ? মানবসৃষ্ট দুর্যোগ নাকি নির্জনে আপনমগ্ন বিলাসে প্রভুর কোনো ইশারায় ঘটেছে এমন দুর্ঘটনা?
দোটানায় পড়ে অর্ণবের ভাবনা থেমে গেল। কোন দিকে মন দেবে ও- আলোর দিকে না চলমান অ্যাম্বুলেন্সের দিকেই তাকিয়ে থাকবে, নাকি ছুটে যাবে দুর্যোগকবলিত এয়ারবাসের দিকে? এ মুহূর্তে কোন বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ?
উত্তর পেয়ে গেল অর্ণব।
বিদ্যুৎবাহী ধনাত্মক বা অ্যানায়নের ওপর বিদ্যুৎঝলক বয়ে গেল। ঋণাত্মক বা ক্যাটায়নের দাপটও কমে গেল। তবু তাকে চমকে দিয়ে দোদুল্যমান অবস্থা আচমকা স্থির হয়ে গেল একবিন্দুতে। আর তখনই ঘটল উল্কা উড়ালের মতো সাগরের তলদেশে নিজের উল্কাযাত্রা। সেকেন্ডের মাইক্রোতম বিন্দুর ওপর চড়ে হাজির হলো জাভা সাগরের তলদেশে। দেখল এয়ারএশিয়া ইন্দোনেশিয়ার এয়ারবাস- ফ্লাইট কিউজেড ৮৫০১ পারমাণবিক বোমার গতি নিয়ে ডুবে যাচ্ছে সাগরে। উপরে তাকিয়ে দেখল ইন্দোনেশিয়া থেকে সিঙ্গাপুর যাত্রাপথের আকাশে ঝড়ো মেঘের ওড়াউড়ি আর তার তলে জাভা সাগরের উন্মাতাল তরঙ্গমালার পৈশাচিক উল্লাস। আকাশে ঘনঘটা আর পাতালে দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী বিশৃঙ্খল জলস্রোত দেখে এটাকে মোটেই প্রভুর ‘পুতুলখেলা’ মনে হলো না। মনে হতে লাগল লীলা-বিলাসের ভাঙাগড়ার এ খেলার উদ্দেশ্য ব্যাপক- মানব অ্যান্টেনায় তা ধরা পড়ার বিষয় নয়। তবে এ মুহূর্তে কী করবে?
মস্তিষ্কে নড়ে ওঠা প্রশ্নের উত্তরের জন্য অপেক্ষার সুযোগ ঘটল না। উত্তর পেতে লাগল অসংখ্য ভাসমান মানবদেহ দেখে। এই দেহখণ্ডের মধ্যে আলোর প্রবাহ নেই। আত্মাবিহীন তাজা আঁধারখণ্ডরূপী মানবদেহের দিকে টর্চলাইটের মতো শিকারি চোখের আলো ফোকাস করে ছুটে যাচ্ছে হাঙরের দল। মানব দেহগুলো কি তবে চলে যাবে হাঙরের পেটে? সেই পেটের ভেতর থেকে কি আলোর দেহ নিয়ে বেরিয়ে আসবে আত্মার ভিন্নরূপ, ঠিক ওর নিজের মতো?
ভাবনা চাপা দিয়ে দ্রুত গুণতে লাগল মানবদেহ- এক… দুই… তিন… একশ… একশ পঞ্চাশ… একশ বাষট্টি। গোনা থামিয়ে একবার স্থিত হয়ে ধ্যানমগ্নতায় দেখে নিল গাজীপুর থেকে ঢাকার দিকে এগোতে থাকা অ্যাম্বুলেন্সটিকে। চন্দনার হাত ধরে বসে আছে উর্বশী। আর চন্দনার চোখের পাতা ঠেলে বেরিয়ে আসছে অশ্রুকণা।
অশ্রুকণাকে আর চোখের জল মনে হলো না অর্ণবের। সাগরের জলস্রোত যেন নেমে যাচ্ছে তার চোখের ভেতর থেকে। হাঙররূপী মানব হা থেকে রেহাই পেলেও নিজের অজ্ঞতা, অতিসাহস আর ভুলপথ যাত্রার আগ্রাসী ঢেউয়ের আঘাত থেকে মুক্তি ঘটেনি চন্দনার। কেবল পচা শামুকে পা কাটেনি তার, কেবলই পচন ধরেনি পায়ে, ভুলযাত্রার ভয়াবহ ক্ষত ধারণ করে বেঁচে গিয়েও মরে গেছে তার আসল আত্মা। মৃত আত্মার চোখ থেকেই নামছে অশ্রুধারা। উর্বশীর মমতার ছোঁয়ায় কি তবে জেগে উঠছে আবার চন্দনার আত্মার স্বর, আবেগ-অনুভূতি?
কল্পদৃশ্য নয়, অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরকার বাস্তব দৃশ্যটির প্রভাবে নিজের আলো-দেহের মধ্যে সাগরের বিশুদ্ধ ঊর্মিমালার মতো ছড়িয়ে যেতে লাগল নতুন ঊর্মি- বিপণ্ন একশ বাষট্টি জনের পাশে দাঁড়ানোর প্রণোদনায় সে প্রথমে ছুটে গেল ককপিটের উইন্ডশিল্ডের মধ্যে আটকে পড়া পাইলটের দিকে। জলের প্রবল চাপ সরিয়ে মুহূর্তের মধ্যে বের করে আনল পাইলটকে। মাস্ক পরা পাইলটের চোখে এখনও রয়েছে মিটিমিটি জ্বলতে থাকা মানব চোখের আলো। দূরবর্তী নক্ষত্রের আলোর মতো জ্বলতে থাকা আলোর কণার দিকে তাকিয়ে অর্ণব প্রশ্ন করল, ‘বেঁচে আছেন, আপনি?’
‘জানি না বেঁচে আছি না মরে গেছি। তবে যা বলছি তা আমার কথা। কী ঘটেছিল সে কথা বলা দরকার আগে। ফ্লাইট কিউজেড ৮৫০১-এর পতন নিয়ে ভবিষ্যতে বহু প্রশ্ন জাগবে, গবেষণা হবে। উত্তর না পেলে আকাশযাত্রায় মানুষের ভয় বাড়বে, আতঙ্ক বাড়বে। সেই আতঙ্ক দূর করার জন্য বলছি- হঠাৎ দেখলাম ভোরের নরম আলোয় ঢাকা জাভা সাগরের আকাশে ঘনীভূত উড়ালমেঘের বেপরোয়া চক্রনৃত্য। মেঘ ঘুরছে আর নাচছে! আচমকা সৃষ্ট মেঘের ঘূর্ণিনাচ এড়াতে উচ্চতা বাড়িয়ে ৩৮ হাজার ফুট ওপর দিয়ে চলার অনুমতি চাইলাম। অনুমতি পেলামও কন্ট্রোল রুম থেকে। পরিকল্পনা মতে এগোতে লাগলাম। হঠাৎ কী ঘটল বোঝার সুযোগ হলো না- এয়ারবাসটিতে ঘটে গেল বিদ্যুতবিভ্রাট। এই বিভ্রাটের সঠিক কারণ ধরা সম্ভব হয়নি- বিদ্যুতের অ্যাকশন পটেনশিয়ালের মধ্যে শুরু হয়ে গেল বিশৃঙ্খলা। মনিটরে দেখলাম অ্যানায়ন আর ক্যাটায়ন তথা ধনাত্মক আর ঋণাত্মক বিদ্যুৎকণার উল্টোমুখী বিক্ষুব্ধ ঝড়। তারপরই পতন ঘটল ফ্লাইটটির।’
পাইলটের টানা কথা শোনার পরই নজরুল-ভৈরবীর মরমি বার্তা আবার উর্বশীর কণ্ঠ ছুঁয়ে এসে ঢুকে গেল অর্ণবের আলোর আত্মার কেন্দ্রে। ঝিকমিক ঘটতে লাগল আলোর নাচন :
তারকা-রবি-শশী খেলনা তব হে উদাসী,
পড়িয়া আছে রাঙা পায়ের কাছে রাশি রাশি
নিত্য তুমি হে উদার।
সুখে দুখে অবিকার,
হাসিছ খেলিছ তুমি আপন মনে॥
পাইলটের চোখের আলো নিভে যাচ্ছে। নিভু আলোর কণা থেকে বেরিয়ে আসছে আরেক মানবিক আবেদন-
‘প্লিজ আমাকে দেখার প্রয়োজন নেই। আমার যাত্রীদের দিকে তাকান। তাঁদের বাঁচান।’
অর্ণবের আলো অস্তিত্বের ভেতর গুমড়ে উঠল নতুন প্রশ্ন, ‘ভিন্ন ধরনের আমার আমি কি এ মুহূর্তে কারও উপকারে আসব; বাঁচাতে পারব যাত্রীদের? সে ক্ষমতা কি আছে আমার?’
উত্তরের হৃদয় নেই। পাষাণ হৃদয়ের চারপাশে দেখা দিল অপ্রতিরোধ্য ব্যারিকেড। এ ব্যারিকেড ভাঙার কৌশলী পথ খুলল না অর্ণবের মাথায়। কেবল দেখল বিশ্বমিডিয়ার প্রচণ্ড উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর হারিয়ে যাওয়া বিমানের খোঁজে ইন্দোনেশিয়ার কালিমাস্তান এলাকা থেকে জাভা দ্বীপ পর্যন্ত তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকা ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের অভিযান।
খুঁজতে থাকা অভিযান নৌ-আকাশ পথে বাধা পাচ্ছে দুর্যোগের কারণে। রাত ঘনিয়ে এলে উদ্ধার কাজ বন্ধ রাখতে হবে ভেবে উদ্বেগের ঝড় আবারও সজোরে ঝাপটা দিল অর্ণবকে। নিজের কিছু করা উচিত। আশ্চযর্, সেই দায়িত্ববোধের ভেতর থেকে কর্ম-পরিকল্পনার বিন্দুকণা উদ্যোগ নিতে পারছে না, অথচ উর্বশীর পাশে দাঁড়াতে পারে সহজে। নিজের আলোকশক্তির বিকিরণ ছড়িয়ে জোর সঞ্চার করতে পারে উর্বশীর দেহ-মনে। তবে কি তার আলোকঅস্তিত্ব কেবলই ঝুলে আছে উর্বশীর জন্য?
উদ্ধার অভিযানের হতাশা প্রতিস্থাপিত হলো আপন কেন্দ্রে। হতাশ কেন্দ্রের উৎকীর্ণ আলো থেকে নিজে হঠাৎ ছিটকে উড়ে গেল অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর। দেখল উর্বশীর মুখে হতাশার ছায়া নেই। ভয় নেই! কঠিন সংকল্প নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উইমেন ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের দিকে- ‘ওয়ান স্টেপ সার্ভিস’ পাওয়ার আশায়। চাকরির প্রলোভনের রশিতে গেঁথে চন্দনাকে নির্জনে নিয়ে আক্রমণ করার অপরাধে আবসারিকে সাজা দেওয়ার দৃপ্ত প্রত্যয় ক্ষণে ক্ষণে ঝলসে উঠছে উর্বশীর তেজোদীপ্ত মনে। এত তেজ আসছে কোত্থেকে? ভাবল অর্ণব।
সঙ্গে সঙ্গে বিয়েবাড়িতে সাজানো মরিচবাতির মুক্তোদানার মতো আলো ছড়িয়ে যেতে লাগল অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর। এই ছড়ানো শক্তির সঙ্গে আচমকা গেঁথে গেল নিজ দেহের আলো আর আলোর ঝলকও। তবে কি এখন সে উর্বশীর প্রত্যয়দৃপ্ত মননের উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবেই কেবল ঢোকার ক্ষমতা রাখে? আর কোনো উপকারে আসবে না নিজের দেহতরঙ্গ, আলোর শরীর?
এই প্রশ্ন নিয়ে হতাশ হয়ে দেখল সাগরে নিমজ্জিত যাত্রীদের জন্য ও কিছুই করতে পারছে না, কেবল রোবটের মতো দাঁড়াতে পারছে তাদের পাশে।
কিছুক্ষণ পরই দেখল মৃত মানব শরীর খাওয়ার লোভে তার সামনে ধেয়ে আসা হাঙরের দল আর রাক্ষুসে জলজ প্রকাণ্ড মাছগুলো পালিয়ে গেছে আশপাশ থেকে।
পাইলটের সঙ্গেও কথা বলতে পেরেছি! কেবল অলৌকিক কোনো শক্তি নয়, বাস্তব শক্তিও ধারণ করছি। ভেবে তৃপ্তি পেল অর্ণব।
নিজের উপস্থিতিই কি যথেষ্ট? শুধু উপস্থিতির কারণেই পালিয়ে গেল আক্রমণকারী জলজ প্রাণি। নতুন ভাবনা রাঙিয়ে দিল অর্ণবের জলজীবন। তার দেহ থেকে ছড়িয়ে দেওয়া আলো ছুরির ফলার মতো ছুটে যাচ্ছে। আর আক্রমণকারী সামুদ্রিক জলজ প্রাণিরা প্রাণভয়ে ছুটে পালাচ্ছে দিগ্বিদিক।
চলবে…