নান্দনিক শব্দের খোঁজে
জীবনের সুতীব্র বেদনার সূতিকাগারে
জন্ম নেয় সুমধুর কবিতা
কবি,কোথা থেকে বেদনার বাগানে
নান্দনিক শব্দের ফুল ফোটাও?
আমার শব্দের বাগানে তো
সে ফুল ফোটেনা
যখন দেখি দশ বছরের শিশু
ভাসমান বণিতা-ধর্ষিতা
স্হান পায়
সামাজিক প্রতিবন্ধী প্রশিক্ষণাগারে
কিন্তু
শেষ রক্ষা তো হয় না।
সেখানেও সে ধর্ষিতা
বিকোয় টাকার বিনিময়ে
আবার কখনোবা গ্রিল ভেঙ্গে
দেয়াল টপকে ফিরে যেতে চায়
সেই পঙ্কিল জীবনে।
কিশোর বয়সের স্বাধীনতার
উদগ্র আকাঙ্ক্ষা ওদেরকে করেছে
এমন বন্ধনহীন,উদ্দাম,উচ্ছল
তাই অবলীলায় বলে চলে মিথ্যে
অকারণে হেসে ওঠে খিলখিল করে
জানেনা আগামী জীবনের কথা
কেউ স্বনির্ভরতার হাত বাড়ালে
বিশ্বাসের ঘাটতি দেখা দেয় ওদের মনে
ওরা বিশ্বাস করে
এ অসুস্থ জীবন থেকে
ফিরে যাওয়া যায়না
সেই সুন্দর স্বভাবিক জীবনে
যেখানে ভালোবাসা নির্মল
বোনের আদর সোহাগে নেই খামতি
প্রতিবেশীর চোখে নেই ঘৃণা
নেই সমাজের রাঙা চোখ
তাই
ভাই আসেনা আর ফিরিয়ে নিতে
বাবা নিশ্চল নিশ্চুপ
মায়ের চোখের জল
আঁচলেই শুকিয়ে যায়।
বল কবি,
এ বাগান থেকে কি
নান্দনিক শব্দের ফুল ফোটে?
তাই আমার কলম আর
কবিতা হয়ে ওঠে না
খুঁজে ফেরে মুক্তির পথ।
সম্পূর্ণা
আমি নারী
সম্পূর্ণা নই।
শৈশবে ছিলেম ‘মানুষ’
কৈশোরে মেয়ে মানুষ
সেদিন থেকেই বন্দী জীবনের প্রথম পাঠ।
যথার্থ ‘মেয়ে মানুষ’হয়ে
গড়ে ওঠার কঠোর তপস্যা
যৌবনে।
তারপর একদিন মা
জন্মদানের সুখময় মৃত্যু যন্ত্রণা নিয়ে
সেদিন পরিপূর্ণ নারীত্বের স্বাদ
খুঁজে ছিলাম নিজের মধ্যে।
মৃত্যুকে জয় করে
সন্তান প্রসবের গর্বে ছিলাম গর্বিতা
কিন্তু পূর্ণতা কোথায়?
আত্মজাকে সঠিক পথ দেখানোর সাধনায়
এখন অতন্ত্র প্রহরী আমি
তারপর
একসময় ওরা নিজেরাই নিজেদের পথ খুঁজে নেয়
পরে রই শুধু তুমি আর আমি।
বার্ধক্যের একাকীত্বের এই নিসঙ্গতাই কি
সম্পূর্ণা?না পূর্ণের সাথে মিলনেই
হবো সম্পূর্ণা?
আজকের আমি
জীবনের প্রথম বেলায়
একটুকু কথায় সারাদিন গুঞ্জন
একটুকু ছোঁয়ায় সারাদিন শিহরণ
তারপর
শুধু অকারণ পুলকে
কথা কথা কথা
ফুল পাখি আকাশ বাতাস
কিন্তু আজ?
চাল ডাল ছেলেমেয়ের বেতন
দখল করে নিল সব
মনে মনে খুঁজে ফিরি কাউকে
যার সাথে
কথায় কথায় গুঞ্জন উঠবে
যার ছোঁয়ায় জাগবে শিহরণ
কিন্তু কোথায় সে?
সব মুখ ছাপিয়ে
ভেসে ওঠে ঐ একটা মুখ
যার সাথে চাল ডাল ছাড়া
দৈবাৎ দু’একটা পুলকলাগা
কথা হয়
যাকে এখন আর বলতে পারি না
For God sake hold your toung
& let me love
শুধু অকারণ বচসা
for God sake open your toung
& let me quarrel.
বার্ধক্যের আমি
বয়সের হাত ধরে
ধূসর হল মাথার চুল
তন্দ্রালু চোখে বারান্দার
ঝুলনে ঝিমুচ্ছি
আর
মোলেমচোখে সুমধুর স্বপ্ন দেখছি
কী গভীর স্বপ্নময় ছিল আমার ও চোখদুটো।
কত শতেকজন আমার
সুখী-সমৃদ্ধ সময়গুলোর সাথী ছিল
সত্য বা মিথ্যে করে হলেও
ভালোবেসেছিল আমার রূপলাবণ্য
কিন্তু
একজন আমার যাযাবর আত্মার প্রেমে পড়েছিল
ভালোবেসেছিল রূপ বদলের দুঃখ বিলাস।
দোলনায় দুলতে দুলতে তন্দ্রালু চোখে
ম্লান মুখে গুনগুন করছি
কীভাবে ভালোবাসা দ্রুত পালায়
সে লাফিয়ে বনজঙ্গল পেরিয়ে গেল
নিজের মুখটি লুকালো অসংখ্য তারার ভীড়ে।
আমি মা হতে চাই
আমি সেই নারী
যার সমস্ত বুক জুড়ে
মাতৃত্বের হাহাকার
কিন্তু এই আমিই আমার কন্যাশিশুকে
ভ্রূণেই নষ্ট করি প্রতিনিয়ত
না, আমি কন্যার মা হতে চাইনা
নয় কোন প্রজন্ম রক্ষার কারণে
না কোন লজ্জা বোধ থেকে।
পারস্যের এক মহিলা কবি
বলেছিলেন,তার জন্মবারতার
“ধাইমা কেঁপে উঠেছিল
স্বর্ণমূদ্রার এনাম হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায়
আর সম্ভাব্য খৎনাউৎসবেব মিষ্টান্ন প্রাপ্তির অপমৃত্যুতে।”
ব্রীড়াবনত হয়েছিল তার মায়ের কুণ্ঠিত দৃষ্টি।
আমার মেয়ের জন্মবারতায়
লজ্জায় হতাশায় কুণ্ঠিত হবনা আমি
ভরে দিতে চাই ধাইমার হাত
স্বর্ণমূদ্রা আর মিষ্টান্নে
কিন্তু
পারিনা আমি পারিনা
ভয়ে শিউরে উঠি
একটি মানুষকে ‘মেয়েমানুষ’ তৈরীর আতঙ্কে
শঙ্কিত হই
প্রতিক্ষণে ধর্ষিতা লাঞ্ছিতা হবার ভয়ে
আৎকে উঠি
মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার আশঙ্কায়
ব্রীড়াবনত হই
‘মেয়েমানুষ’ বলে অবহেলার পুতুল করার লজ্জায়
আমি সেই মা
শিক্ষার আলো দিয়ে
কন্যা সন্তানের ডানা তৈরি করি
আহা, বাছা আমার
নিশ্চিন্তে নির্ভয়ে মনের সুখে
সংসার অভয়ারণ্যে উড়ে বেড়াবে
কিন্তু সমাজের কাঁচি দিয়ে
আমারই হাতে কাটি
সযত্নে গড়ে তোলা সেই সুন্দর ডানাদুটো
অবশেষে
উড়ে বেড়াবার ব্যাকুলতা নিয়ে
মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে সে গৃহকোণে
নিজের দুঃখ-বেদনা হাসি-কান্না
বন্দী রাখে অব্যক্তের খাঁচায়।
ব্যাক্তিত্ব নিয়ে পথ চললে
হবে ভ্রষ্টা
স্বাধীন হতে চাইলে – উশৃঙ্খল
পরের জমিতে ফসল ফলাবে
অথচ নিজেকে নিজেই পয়সায় বিকোয়
হতে হয় যৌতুকের বলি
কী লজ্জা!
কী অপমান!
মাতৃত্বের অসীম হাহাকার বুকে নিয়েও
ভ্রূণেই নষ্ট করি আমি আমারই আত্মজাকে
আমাকেই আমি হত্যা করি
বারবার পুনবার।
হে পৃথিবী
আমার কন্যাসন্তানটির নিরাপত্তা দাও
দাও আমাকে সেই দুনিয়া
যেখানে আমার কন্যাটি ঝলসে যাবেনা
ধর্ষিতা হবে না–ঝরে যাবেনা অকালে
করতে হবে না মানব বন্ধন
ধরতে হবে না আইনের রশি
আমি মা হতে চাই
মা হতে চাই
মা হতে চাই
একটি কন্যাশিশুর মা।
শব্দের পার্লার
শব্দগুলো ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে
আমার চারপাশে
ওরা ক্ষুব্ধ বিক্ষুব্ধ
মিছিল করছে দাবি করছে
ওদের দাবি
একটা শব্দের পার্লার।
তোমরা মানুষরা পার্লারে যাও
নিজেদের সাজিয়ে গুছিয়ে
সুন্দর করে সবার সামনে বস
আমাদের কেন
যেখানে সেখানে বসিয়ে
নিজেদের ব্যথা-বেদনা-আনন্দগুলোকে
তুলে ধরো সবার কাছে!
আধুনিকতার নামে
একী হচ্ছে আমাদের সাথে?
নাওনা আমাদের একটা
শব্দের পার্লারে
সাজিয়ে গুছিয়ে সহজভাবে
তুলে ধরো নিজেকে
হোক না সে ‘ঝলসানো রুটি,’
‘মানচিত্র খাব’,
অথবা ‘ফুলস্টপ ভালোবাসা’।
জীবন যন্ত্রণা থেকে বেড়িয়ে আসা
অমিত্র কষ্টগুলোকে দিয়েই
শব্দগুলো সাজাও
মিত্র অক্ষরের নেই প্রয়োজন
চাই শুধু
একটা সহজবোধ্য শব্দের পার্লার
একটা সুন্দর কবিতার অবয়ব।