নদীনালা বেষ্টিত জঙ্গল ঘেরা ছোট্ট একটি দ্বীপ সুন্দরবনের ছোট মোল্লাখালি। সাতজেলিয়া, দত্তা, গাঁড়াল ও বিদ্যাধরী নদী দিয়ে ঘেরা ছোট মোল্লাখালি দ্বীপের জঙ্গল পরিষ্কার করে মানুষের বসবাস শুরু হয়েছিল বেশ কয়েক যুগ আগে।
ছোট মোল্লাখালি দ্বীপ এলাকার একমাত্র গ্রাম হেতালবেড়িয়া।সেই গ্রামের জমিদার অহিদারি ঘোষ। তাঁর জমিতে বসবাস শুরু করে পরমান্য পরিবার। পরে জমিদারের কাছ থেকে জমি নিয়ে মকবুল গাজীর সাথে বিনিময় করেন।সেই গ্রামেই সর্বপ্রথম ১৯৪৭ সালে পারিবারিক দুর্গোৎসব শুরু করেন বাংলাদেশের খুলনা জেলার বাদোঘাটা থানার অন্তর্গত বাদোঘাটা গ্রামের পরমান্য পরিবারের সাত পুত্র রাজেন্দ্র,দেবেন্দ্র,কালীপদ, নটোবর,দ্বিজ,অতিকায় ও বিপিন বিহারী পরমান্য’রা। যদিও পারিবারিক দুর্গোৎসব শুরু হয়েছিল ১৯০৯ সালে বাংলাদেশেই। ভারতে আসার পর থেকেই সেই রীতি আজও অব্যাহত পরমান্য পরিবারে।
১৯০৯ সালে পরমান্য পরিবারের সদস্যরা মহাসংঙ্কটে পড়ে যায়। চলে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। অবশেষে সংঙ্কট থেকে মুক্তির জন্য পরিবারিক গুরুদেবের দ্বারস্থ হয় পরমান্য পরিবার।বিপদ মুক্ত হতে গেলে পরিবারের মধ্যে মাতৃ আরাধনার আয়োজন করতে হবে।পরমান্য পরিবার সংঙ্কটময় বিপদ থেকে উদ্ধার হয় এবং গুরুদেব বিজয় কৃষ্ণ গোস্বামীর নির্দেশ পালন করে উমেশ চন্দ্র পরমান্য সর্বপ্রথম পারিবারিক দুর্গোৎসব শুরু করেন কুলপুরোহিত সুরেন ভট্টাচার্য ও বিষ্টুপদ ঘোষাল এর তত্বাবোধানে।তৎকালীন সময়ে মাতৃরুপে চিন্ময়ী মা কে রুপদান করেছিলেন মৃৎশিল্পী সুরেন ঘরামী।কালের প্রবাহে অতীতের সেই নিয়ম নিষ্ঠার সাথে পরমান্য পরিবারে আজও পুজিত হয় দেবী দশভূজা।
এই পরিবারের দুর্গাপ্রতিমা তৈরী হয় ডাকের সাজ বিহীন সম্পূর্ণ মাটি দিয়েই রাজ রাজেশ্বরী মূর্তি। যা এক বিশেষ বৈশিষ্ট।আর্থিক অনটনের জন্য আচমকাই পারিবারিক এই পুজো বন্ধ হয়ে যায় ১৯৮১ সালে।পরে সংঙ্কটমোচন হলে প্রিয়াংশু,পবিত্র,প্রদীপ্ত,পুলকেশ পরমান্যদের উদ্যোগে আবারও পারিবারিক দুর্গোৎসব শুরু হয় ২০১৬ সালে। বিগত দিনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ আম্ফান,ফণী, বুলবুল, ইয়াস ঘূর্ণিঝড় সহ প্রবল জলোচ্ছ্বাসে তছনছ করে দিয়েছে সমগ্র সুন্দরবন। দুঃখ কষ্টের মাঝেও সুন্দরবনের দ্বীপান্তরের সাধারণ মানুষ ভোলেনি দেবী দশভূজার আগমনের কথা।শরতের শিশির বিন্দু গায়ে মাখিয়ে শিউলির পূর্বাভাস পেয়েই দোদুল্যমান কাশ ফুলের আবেগ নিয়ে সমস্ত দুঃখ যন্ত্রণা,বেদনা ভুলে দূর্গা মায়ের আরাধনায় ব্রতী হয়েছেন সুন্দরবনের প্রত্যন্ত ছোট মোল্লাখালি দ্বীপের পরমান্য পরিবার।শহর থেকে এই গ্রামের দূরত্ব প্রায় ২০০ কিলোমিটারেরও বেশি।কিছুটা এগিয়ে গেলেই সুন্দরবনের রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের আস্তানা। সুন্দরবনের অসহায় দরিদ্র পরিবারের মানুষরা এই পরামান্য পরিবারের পূজোকে নিজেদের পুজো মনে করেই পুজোর দিনগুলো আনন্দে কাটিয়ে দেয়। পরামান্য পরিবারের অন্যতম সদস্য পুলকেশ পরামান্য জানান ‘তাঁর ঠাকুরদা এই পুজোর সূচনা করেছিলেন বিগত প্রায় ১১২ বছর আগে বাংলাদেশে। তবে এই পুজোকে ঘিরে গ্রামের মানুষের মনে খুশি হাওয়া লেগেছে। শহরের লাখ টাকা বাজেটের পুজোর কাছে এই পুজো অতি সাধারণ। না আছে প্যান্ডেলের বাহার,না রয়েছে কোন থিমের ছোঁয়া। দুচালা তাবুর প্যান্ডেলে এবার মাকে দেখতে ভীড় জমাবে প্রত্যন্ত সুন্দরবনের বিভিন্ন দ্বীপের অসহায় সম্বলহীন পরিবারের কচিকাঁচা থেকে বুড়ো বুড়ীদের দল।’
আবার দশমীর নির্দিষ্টক্ষণেই দেবী দুর্গাকে সুন্দরবনের নদীতে বিসর্জন দেওয়া হয়। বিসর্জনের পর একটি বছরের জন্য প্রতীক্ষায় চাতকের মতো তাকিয়ে থাকেন পরমান্য পরিবার সহ ছোট মোল্লাখালির হেতালবেড়িয়া গ্রামের প্রায় পাঁচশো পরিবার দুহাজারেরও বেশী মানুষজন।