ঘর থেকে এক ছুটে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করলেন তিতার। কিন্তু তাঁর পা যেন ঘরের মেঝের সঙ্গে ফেবিকুইক দিয়ে সাঁটা। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে পা তোলার চেষ্টা করেও তিনি পা তুলতে পারলেন না।
ভীষণ ঘাবড়ে গেলেন উনি। তবে কি সারা জীবন তাঁকে এ ভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে! যতই উনি এটা ভাবতে লাগলেন, ততই তাঁর সারা শরীর দিয়ে দরদর করে ঘাম বেরোতে লাগল। তাঁর এখন একটাই চিন্তা, সে রকম কোনও বিপদ আবার মাথাচাড়া দিয়ে সামনে এসে দাঁড়াবে না তো!
তিতারের ভ্রু কুঁচকে গেল। এ তো বড় অদ্ভুত ব্যাপার। তাঁর সেই ছেলেবেলায়, তাঁদের গ্রামে এর-তার বাড়ির আশপাশ দিয়ে সরু সরু জল নিকাশি মেঠো নালাগুলি গ্রামের একটা বড় নালায় গিয়ে মিশেছিল। বর্ষার জল শুকিয়ে যাওয়ার পরে সেই নালার কোল জুড়ে সোনালি রঙের এক ধরনের লতানো গাছ হত। সেই গাছে বনকুলের চেয়েও ছোট ছোট এক রকমের জংলা ফুল ফুটত। কিন্তু সন্ধ্যা নামলেই সেই সাদা-সাপটা ফুলগুলি ময়ূরের পেখমের মতো রঙিন হয়ে উঠত। অদ্ভুত এক আলো ঠিকরে বেরোত সেগুলি থেকে। একবার তাকালে আর চোখ ফেরানো যেত না। তার ছোট্ট ছোট্ট তিতকুটে ফলগুলিও দিনের আলো কমার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সুস্বাদু আর সুগন্ধী হয়ে উঠত। ঝিকমিক করতে থাকা ওই লাল নীল সবুজ ফুলগুলি দু’চোখ ভরে দেখার জন্য আরও অনেকের মতো তিনিও যখন একদিন সন্ধ্যাবেলায় ওখানে গিয়েছিলেন, দাঁড়িয়ে দেখতে দেখতে পা যখন ব্যথায় টনটন করছিল, তখন ওই নালার পাশেই বসে পরেছিলেন তিনি। ওগুলোকে আরও ভাল করে দেখার জন্য যখন একটু ঝুঁকেছিলেন, ঠিক তখনই সোনালি রঙের ছোট ছোট লতানো গাছের ডালপালা তরতর করে বেড়ে তাঁকে আষ্টেপৃষ্ঠে পেঁচিয়ে ধরেছিল। নালার মধ্যে দিয়ে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গিয়েছিল এক অন্ধকার পাতাল কুঠুরিতে। মাঝারি মাপের শক্তপোক্ত একটা সুঠাম গাছের সামনে।
তিনি যখন প্রচণ্ড ভয় পেয়ে বাবা-মায়ের জন্য কাঁদছিলেন, তখন সেই গাছটা, যার শিকড়-বাকড় নিয়ে মাটি আঁকড়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকার কথা, সে গুটিগুটি পায়ে তাঁর দিকে এগিয়ে এসেছিল। আর তিনি? যিনি কিনা সারা দিন ছোটাছুটি করে খেলে বেড়ান, যখন যেখানে খুশি যান, তিনি কিনা ওই বিপদের সময় হাজার চেষ্টা করেও এক পা-ও নড়তে পারলেন না। কেন জানি বারবারই তাঁর মনে হচ্ছিল, পায়ের তলা দিয়ে মোট মোটা শিকড় বেরিয়ে মাটি কামড়ে আছে!
তার উপরে জানালা দিয়ে আসা দমকা বাতাসের সঙ্গে যে গন্ধটা তাঁর নাকে আজ বারবার আছড়ে পড়ছে, সেটাও তো সেই দিনেরই সেই গন্ধ। তার মানে, এখন একটা কিছু ঘটবে। কিন্তু কী! কার মুখোমুখি দাঁড় করানোর জন্য তাঁর ঘরের মেঝে এই ভাবে তাঁকে আটকে রেখেছে! কার!
ঠিক তখনই তিতার দেখলেন, এই সাত-সকালে যেখানে গোটা চরাচর জুড়ে আলো লুটোপুটি খাচ্ছে, সেখানে তাঁর ঘরের ভিতরটা হঠাৎ করেই কেমন যেন ছায়ায় ঢেকে যেতে লাগল। কী রকম একটা অন্ধকার-অন্ধকার মতো।
তবে কি মেঘ করেছে আকাশে! জানালার দিকে তাকাতেই তিতার দেখলেন, ধূসর রঙের ধোঁয়ার একটা কুণ্ডলি পাক খেতে খেতে ওই জানালা দিয়ে তাঁর ঘরের মধ্যে ঢুকছে। কুণ্ডলিটা ঢুকেই চোখের পলকে এক মানুষ সমান লম্বা, খানিকটা মৎস্যকন্যার মতো আদল নিয়ে মেঝে থেকে মাত্র ক’আঙুল উঁচুতে উঠে ভাসতে লাগল। ভাসতে ভাসতেই বলল, চ্যাঁ চুঁ ইঁয়াকো?
তিতার প্রথমে ঘাবড়ে গেলেন। তাঁর মনে হল, এ নির্ঘাৎ কোনও ভূত। শুধু ভূত বললে একটু কমই বলা হয়। এ একটু সাহসী ভূত। যে ভূত শুধু ভরদুপুর কিংবা ভরা-সন্ধ্যাতেই নয়, একেবারে সক্কালবেলায় মানুষের সামনে আসতেও এতটুকু ভয় পায় না।
ও যদি ভূত হয়ে মানুষকে ভয় না-পায়, তা হলে মানুষ হয়ে তিনি কেন ভূতকে ভয় পেতে যাবেন! আগে তিনি কোনও দিন ভূত দেখেননি। ভূতের সঙ্গে কখনও কোনও দিন কথাও বলেননি। ফলে ভূতের ভাষাও তিনি জানেন না। সুতরাং ‘চ্যাঁ চুঁ ইঁয়াকো’র মানে কী, তিনি তার বিন্দুবিসর্গও বুঝতে পারলেন না। তবু ও যখন কষ্ট করে এখানে এসেছে, তাঁকে কিছু বলছে, তখন সে কথার উত্তরও তো তাঁর দেওয়া উচিত, নাকি? কিন্তু তার কথা বুঝতে না পারলে তিনি বলবেনটাই বা কী! তাই তাঁর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, অ্যাঁ?
সঙ্গে সঙ্গে মৎস্যকন্যা বলল, চ্যাঁ চুঁ ইঁয়াকো?
এ বারও বুঝতে না-পেরে আমতা আমতা করে তিতার বললেন, আমি আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।
তাঁর কথা শেষ হওয়ার আগেই মৎস্যকন্যাটা তাঁর দিকে হাত দেখিয়ে, তাঁকে যেন অপেক্ষা করতে বলল। তার পর ডান হাতটা নিজের মাথার চার দিকে গোল করে তিন বার ঘোরাল। বলল, এ বার বলো…
তিতার অবাক। তিনি ভুল শুনছেন না তো! এ তো একেবারে একশো পারসেন্ট বিশুদ্ধ বাংলা ভাষা। তার মানে ও বাংলা জানে। তাই তিনি বিড়বিড় করে বললেন, কী বলব? ‘চ্যাঁ চুঁ ইঁয়াকো’র মানে কি আমি তো তা-ই জানি না।
মৎস্যকন্যা বলল, আসলে আমারই ভুল। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম ‘ভাষান্তর’টার লক খুলে দিতে। সুতরাং আমরা আমাদের মধ্যে যে ভাষায় কথা বলি, সেই ভাষাই বেরিয়ে পড়েছিল। এখন এই যে মাথাটার চার দিকে তিন বার হাত ঘুরিয়ে ‘ভাষান্তর’টা খুলে দিলাম, এখন আর কোনও চিন্তা নেই। আমি যা বলব, তা হুবহু তোমার মাতৃভাষায় অনুবাদ হয়ে তোমার কাছে পৌঁছবে। আর তুমি যা বলবে, সেটা আমার কাছে আমার ভাষায় রূপান্তর হয়ে ধরা দেবে। সে যাই হোক, আমি বলছিলাম, তুমি কেমন আছ?
তিতার মনের ভিতরে একটু সাহস এনে বললেন, আমি… আমি… আমি ভাল আছি।
— ভাল আছ মানে? আমি তো বুঝতে পারছি তুমি মনে মনে খুব ছটফট করছ। আর মুখে বলছ ভাল আছি?
— আপনি কী করে জানলেন?
— আমি জানব না!
তিতার অবাক হয়ে বললেন, আপনি কি আমাকে চেনেন?
— না চিনলে কি তোমার ভিতরের ছটফটানি দেখে আমি এখানে ছুটে আসতাম?
— কিন্তু আমি তো আপনাকে চিনতে পারছি না।
— না দেখলে চিনবে কী করে? তোমার তো আমাকে না চেনারই কথা। তবে হ্যাঁ, একটু মনে করলেই চিনতে পারবে।
— মনে করলেই! কই, আপনাকে কখনও দেখেছি বলে তো মনে পড়ছে না।
— মনে করো, মনে করো, মনে করো…
— করছি তো… কিন্তু…
মৎস্যকন্যা বলল, একটু ছোটবেলায় ফিরে যাও। ছোটবেলার কথা মনে করো। তোমার গ্রামের সেই পাঁচ মহলা বাড়ির কথা। বাড়ির পিছন দিকের সেই পুকুরটার কথা। কী? কিছু মনে পড়ছে? মনে পড়ছে, তোমরা সবাই মিলে দল বেঁধে হইহই করে সেখানে স্নান করতে যেতে। পুকুরের পার ঘেঁষে হেলে ওঠা খেজুর গাছে উঠে ঝপাং ঝপাং করে জলে ঝাঁপ দিতে। মনে পড়ছে? একবার তুমি ঝাঁপ দিতেই তোমার পা ধরে টানতে টানতে জলের অতলে নিয়ে যাচ্ছিল একজন। মনে পড়ছে?
মৎস্যকন্যা মনে করিয়ে দিতেই তিতার বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে। মনে পড়েছে। আমি যখন তার কবল থেকে নিজেকে ছাড়াবার জন্য প্রাণপণে হাত-পা ছুড়তে ছুড়তে একদম কাহিল হয়ে পড়েছি, মনে হচ্ছে আর কোনও দিনই ডাঙায় উঠতে পারব না। ঠিক তখনই, যে আমার পা ধরে জলের আরও তলায় টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, সে ছেড়ে দিয়েছিল।
— না। সে ছাড়েনি।
তিতার অবাক, মানে?
— মানে, তখন আর একজন পিছন দিক থেকে গিয়ে খুব জোরে তার মুখ চেপে ধরেছিল। ফলে নিজে বাঁচার জন্যই সে তখন তোমাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল।
— ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল! কিন্তু আপনি এটা জানলেন কী করে?
— কারণ, আমি তখন ওখানে ছিলাম। ও ছাড়লেও তুমি তখন প্রায় অচৈতন্যের মতো হয়ে গিয়েছিলে। বলতে গেলে, তোমার তখন কোনও জ্ঞানই ছিল না। সাঁতার কাটা তো দূরের কথা। তখন আমিই তোমাকে কোলপাঁজা করে জলের উপরে তুলে দিয়েছিলাম। তুমি যখন বুক ভরে বড় বড় শ্বাস নিচ্ছিলে, আমি তখন সেখান থেকে সরে গিয়েছিলাম।
— কিন্তু কেন?
— যাতে আমার কথা তুমি ঘুণাক্ষরেও জানতে না পারো।
— সে কী! তা হলে এখন এলেন কেন?
— কারণ সেই একই। তুমি এখন বিচলিত। তোমাকে কখনও এত বিচলিত হতে আমি দেখিনি। তুমি মনে মনে ভীষণ ছটফট করছ, মানে, তুমি কোনও একটা বিপদে পড়েছ। তাই…
তিতার বললেন, তার মানে আপনি আমাকে ফলো করেন?
— বলতে পারো।
— কিন্তু কেন? আমি কি আপনার খুব কাছের কেউ?
— না। সেই হিসেবে কেউ না।
— তা হলে?
মৎস্যকন্যা বলল, আসলে, তোমাকে সে দিন নির্ঘাৎ মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পেরে আমি যে আনন্দ পেয়েছিলাম, তৃপ্তি পেয়েছিলাম, সে জন্য আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ।
— আমাকে বাঁচিয়ে আপনি আমার কাছে কৃতজ্ঞ? কোথায় আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব, তা নয়, এ তো আপনি পুরো উল্টো কথা বলছেন!
— উল্টো কথা নয়। মনে রাখবে, তুমি যদি কখনও কারও উপকার করো, তা হলে সেই উপকার পেয়ে সে যতটা না খুশি হবে, উপকার করতে পেরে তার চেয়ে অনেক অনেক অনেক গুণ বেশি তৃপ্তি পাবে তুমি। সে সময় তোমাকে জলের উপরে পৌঁছে দিয়ে আমি শুধু তোমাকেই বাঁচাইনি, নিজেও মনে মনে বেঁচেছি। একটা ভাল কাজ করতে পারার আনন্দই আলাদা। সেটা যে না-পেয়েছে সে বুঝতেই পারবে না। তাই ও রকম একটা ভাল কাজ করার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। আর সেই কৃতজ্ঞতা থেকেই কী করে যেন তোমার প্রতি আমার তৈরি হয়ে গেছে একটা দুর্বলতা। যা আমি কিছুতেই অস্বীকার করতে পারি না।
তিতিরের মুখ দিয়ে অস্ফুটে বেরিয়ে এল, সে কি?
— হ্যাঁ। শুধু আমি নই, এটা সবার ক্ষেত্রেই হয়। যেমন দেখবে, গাড়ির তলায় চাপা পড়তে থাকা কোনও বিড়াল বা কুকুরছানাকে কেউ যদি বাঁচায়, সেই ছানার প্রতি তার একটা টান জন্মে যায়। সে যখন ফের ওই রাস্তা দিয়ে যায়, সে এ দিকে ও দিকে তাকিয়ে দেখে, বাচ্চাটা ঠিক আছে তো! এটাই নিয়ম।
— তাই?
— একদম তা-ই। জানবে, কেউ ভালবেসে কাউকে পৃথিবীতে নিয়ে এলে, সে যেমন তার বাবা কিংবা মা হয়, ঠিক তেমনি নির্ঘাৎ মৃত্যুর মুখ থেকে বাঁচিয়ে যে তাকে আর একবার নতুন জীবন দেয়, রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও, সেও তার আর এক বাবা অথবা মা হয়ে ওঠে। সুতরাং যে বাঁচে এবং বাঁচায়, কী করে যেন তাদের মধ্যে একটা আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। যে সম্পর্ক, তুমি জানো না-দেখে তোমার তরফ থেকে হয়নি। কিন্তু আমি ওই ঘটনার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছি দেখে, আমার দিক থেকে হয়েছে। বলতে পারো, এটা এক তরফাই হয়েছে। এ বার বুঝতে পেরেছ তো, আমি কে?
— হ্যাঁ। পেরেছি। সে দিন আমাকে ওই ভাবে জীবন ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আপনাকে কী বলে যে কৃতজ্ঞতা জানাব… কিন্তু আজ হঠাৎ আপনি আমার কাছে এলেন কেন?
মৎস্যকন্যা বলল, জানতে। তোমার মন এত ছটফট করছে কেন, তা জানতে। কী হয়েছে তোমার?
— না। সে রকম কিছু না। মানে…
— আমার কাছে কিছু লুকিয়ো না। কী হয়েছে বলো। তুমি বলতে দেরি করলে, সমস্যাটা হয়তো ততক্ষণে নাগালের বাইরে চলে যাবে। তখন হাজার চেষ্টা করেও আর কোনও সুরাহা করা যাবে না। বলো…
আমতা আমতা করে তিতার বললেন, আসলে হয়েছে কি, আমার ছেলে… মানে জুরান… ওকে সকাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না।
— সে কী! আশপাশে খুঁজেছ? যেখানে যেখানে ও যায় বা যেতে পারে…
— সব খোঁজা হয়ে গেছে। এখন কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না।
মৎস্যকন্যা বলল, না বোঝার কিছু নেই। ওকে যখন পাওয়া যাচ্ছে না। তখন খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু…
— কিন্তু কী?
— ওর ব্যবহার করা আধোয়া কোনও জামা-প্যান্ট-গেঞ্জি বা অন্য কোনও কিছু আছে কি?
অবাক হয়ে তিতার বললেন, আধোয়া! দাঁড়ান দেখছি। বলেই, জুরানের ঘরে গিয়ে এ দিকে এ দিকে তাকাতে লাগলেন। তার পর বিড়বিড় করে বললেন, কিছুই তো দেখছি না…
সেটা শুনে পিছন থেকে মৎস্যকন্যা বলে উঠল, কিচ্ছু নেই?
থমথমে মুখে তিতার বললেন, না। দেখছি না তো…
— ওটা কী!
— ওটা তো বালিশ।
বিছানার দিকে আঙুল তুলে মৎস্যকন্যা বলল, না না, ওটা?
তিতার বললেন, ওটা তো বালিশের ঢাকনা।
— ও কি এখানে শোয়?
— হ্যাঁ। ও এখানেই শোয়।
মৎস্যকন্যা জিজ্ঞেস করল, ও কি ওই ঢাকনাটায় মাথা দিয়ে শুয়েছিল?
— তাই-ই তো মনে হয়। ও যখন এখানে শুয়েছিল, তখন নিশ্চয়ই বালিশের উপরে থাকা ওই ঢাকনাটায় মাথা দিয়ে শুয়েছিল।
— দাও। তা হলে ওটাতেই হবে। দাও।
খাটের উপর থেকে বালিশের ঢাকনাটা মৎস্যকন্যার হাতে দিতেই তিতার দেখলেন, সে সেটা নাকের কাছে ধরে চোখ বন্ধ করে খুব গভীর ভাবে পর পর তিন বার তিনটে বড় বড় শ্বাস নিল। তার পর ঘরের ভিতরে, ঘরের বাইরে, এ দিকে ও দিকে, ডায়নিং স্পেসে এবং জানালার কাছে, যেখানে যেখানে ওর মনে হল, সর্বত্র গিয়ে জোরে জোরে বড় বড় শ্বাস নিয়ে তিতারের দিকে তাকিয়ে বলল, ও এখানে নেই।
উদ্বিগ্ন হয়ে তিতার জানতে চাইলেন, তা হলে কোথায়?
— অনেক দূর থেকে খুব ক্ষীণ ভাবে এই গন্ধটা হঠাৎ হঠাৎ ভেসে আসছে। তার মানে দূরে, অনেক দূরে কোথাও আছে।
— যত দূরেই হোক আমি সেখানে যাব। আপনি আমাকে নিয়ে চলুন।
— যাবে? তা হলে একটা কাজ করো।
আশার আলো দেখতে পেয়ে তিতারের চোখ চকচক করে উঠল। বললেন, কী?
মৎস্যকন্যা বলল, তিন বার বলো তুঁ মুঁ ছুঁ… তুঁ মুঁ ছুঁ… তুঁ মুঁ ছুঁ…
— এর মানে?
— মানে জেনে তোমার লাভ নেই। ও সব পরে জানবে। এখন এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করা যাবে না। প্রতিটা মুহূর্তে ওরা এখন দূরে, দূরে, আরও দূরে চলে যাচ্ছে। এর পর হয়তো ওদের কাছে পৌঁছনোর একমাত্র সূত্র, এই গন্ধটাও ফিকে হতে হতে একেবারে হারিয়ে যাবে। তখন আর কোনও উপায় থাকবে না। তাই বলছি, এখন মন দিয়ে আমার কথা শোনো, তুমি যদি সত্যি সত্যিই আমার সঙ্গে তোমার ছেলের কাছে যেতে চাও, তা হলে আর সময় নষ্ট কোরো না। তাড়াতাড়ি বলো, তুঁ মুঁ ছুঁ… তুঁ মুঁ ছুঁ… তুঁ মুঁ ছুঁ… কারণ, এই ভাষায় না বললে তুমি আমার সঙ্গে কিছুতেই যেতে পারবে না।
তিন বার ওটা বলতেই তিতারের গোটা শরীর আস্তে আস্তে কেমন যেন ধোঁয়া-ধোঁয়া হয়ে গেল। আর সেটা হতেই তিতারের জামা-কাপড়গুলো শরীর থেকে আলগা হয়ে খসে পড়ল মেঝের ওপরে। সঙ্গে সঙ্গে মৎস্যকন্যাটাও ধূসর ধোঁয়ার একটা কুণ্ডলি হয়ে তিতারের ধোঁয়াটার সঙ্গে মিশে গেল। তার পর বাঁই বাঁই করে কয়েক বার চক্কর মেরেই জানালা দিয়ে সাঁ… করে সোজা উঠে গেল উপরে। মুহূর্তের মধ্যে মেঘ ভেদ করে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। কেউ আর দেখতে পেল না।
চলবে…
‘মহাশূন্যে জুরান’ পর্ব – পনেরো
এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
২০২০ সালে 'সাহিত্য সম্রাট' উপাধিতে সম্মানিত এবং ২০১২ সালে 'বঙ্গ শিরোমণি' সম্মানে ভূষিত সিদ্ধার্থ সিংহের জন্ম কলকাতায়।
আনন্দবাজার পত্রিকার পশ্চিমবঙ্গ শিশু সাহিত্য সংসদ পুরস্কার, স্বর্ণকলম পুরস্কার, সময়ের শব্দ আন্তরিক কলম, শান্তিরত্ন পুরস্কার, কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত পুরস্কার, কাঞ্চন সাহিত্য পুরস্কার, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা লোক সাহিত্য পুরস্কার, প্রসাদ পুরস্কার, সামসুল হক পুরস্কার, সুচিত্রা ভট্টাচার্য স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, অণু সাহিত্য পুরস্কার, কাস্তেকবি দিনেশ দাস স্মৃতি পুরস্কার, শিলালিপি সাহিত্য পুরস্কার, চেখ সাহিত্য পুরস্কার, মায়া সেন স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ছাড়াও ছোট-বড় অজস্র পুরস্কার ও সম্মাননা। পেয়েছেন ১৪০৬ সালের 'শ্রেষ্ঠ কবি' এবং ১৪১৮ সালের 'শ্রেষ্ঠ গল্পকার'-এর শিরোপা সহ অসংখ্য পুরস্কার। এছাড়াও আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত তাঁর 'পঞ্চাশটি গল্প' গ্রন্থটির জন্য তাঁর নাম সম্প্রতি 'সৃজনী ভারত সাহিত্য পুরস্কার' প্রাপক হিসেবে ঘোষিত হয়েছে।
একটি মন্তব্য করুন
একটি মন্তব্য করুন