নদীয়ার রাজারা যে বিস্তীর্ণ ভূমির অধিকারি ছিলেন তার বর্ণনা আমরা পাই রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি ভারতচন্দ্র রায় গুণাকরের কবিতায়–
“অধিকার রাজার চৌরাশী পরগণা, খাড়ি জুড়ী আদি করি দপ্তরে গণনা। রাজ্যের উত্তরসীমা মুর্শিদাবাদ, পশ্চিমের সীমা গঙ্গা-ভাগীরথী খাদ। দক্ষিণের সীমা গঙ্গা-সাগরের ধার, পূর্ব্ব সীমা ধুল্যাপুর বড়গঙ্গা পার।”
বর্তমান কৃষ্ণনগরের পত্তন হয় ‘বেউই’ নামে একটি গ্রামকে কেন্দ্র করে। কৃষ্ণনগর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ভবানন্দ মজুমদারের পৌত্র রুদ্র ওই গ্রামের গোপজাতির কৃষ্ণপূজায় মোহিত হয়ে এই অঞ্চলের নাম রাখেন কৃষ্ণনগর। এই কৃষ্ণনগরে রাজ্যের নাম ছড়িয়ে পড়ে রুদ্র মজুমদারের প্রপৌত্র রাজা কৃষ্ণকান্তের রাজত্বকালে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বন্ধু রামতনু লাহিড়ীর বৃদ্ধ প্রপিতামহ রামহরি লাহিড়ী প্রথম কৃষ্ণনগরে এসে বাস করতে শুরু করেন। এই বংশের তৃতীয় পুরুষ গোবিন্দ লাহিড়ী ও কিঙ্কর লাহিড়ীর কথা নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যগ্রন্থে উল্লেখ আছে —
কিঙ্কর লাহিড়ী দ্বিজ মুন্সী প্রধান। তার ভাই গোবিন্দ লাহিড়ী গুণবান। রামতনু লাহিড়ী গোবিন্দ লাহিড়ীর প্রপৌত্র।
১৮১৩ খৃষ্টাব্দের চৈত্রমাসে (১২৬৯ বঙ্গাব্দে) বারুইহুদা গ্রামের মামার বাড়িতে রামতনু লাহিড়ীর জন্ম হয়। ১৮২৬ খৃষ্টাব্দে তাঁর বড়দাদা কেশবচন্দ্র লাহিড়ীর বাসস্থান ছিল কলকাতার চেতলা অঞ্চলে। রামতনু লাহিড়ীর পড়াশোনার কারণে সেখানে তিনি বসবাস করছিলেন। এই সময় ডেভিড হেয়ারের প্রিয়পাত্র গৌরমোহন বিদ্যালঙ্কারের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হওয়ার পর কেশবচন্দ্র তাঁর ভাইকে হেয়ার স্কুলে ভর্তি করার প্রস্তাব দেন কিন্তু প্রথমেই হেয়ার জানিয়ে দেন, ‘ফ্রি সিট খালি নেই।’ হেয়ার পাল্কি চড়ে যেখানেই যেতেন, বালক রামতনু তাঁকে অনুসরণ করতেন। একদিন হেয়ার তাঁর শুকনো মুখ দেখে খাওয়াতে চাইলে তিনি ‘খিদে নেই’ বলে জানিয়ে দেন। হেয়ার তখন মিঠাইওয়ালাকে ডেকে জোর করেই মিঠাই খাওয়ান। পরে হেয়ারের স্কুল সোসাইটিতে রামতনু ভর্তি হয়ে যান। তারপর ১৮২৮ খৃষ্টাব্দে তিনি হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। এই সময় হেনরি ভিভিয়ান ডিরোজিও -র সংস্পর্শে আসেন তিনি। তাঁর সংস্রবে আসার পর ছাত্রদের মধ্যে বিপ্লব ঘটে যায়। যে বালক রামতনু ব্রাহ্মণ সন্তান হিসাবে ডেভিড হেয়ারের দেওয়া খাবার খাওয়ার ভয়ে অভুক্ত থাকা সত্ত্বেও ‘খিদে নেই’ বলেছিলেন, তিনিই ডিরোজিও-র ইয়ংবেঙ্গলে যোগ দিয়ে সুরাপান না-করলেও সুরার পাত্রে ঠোঁট স্পর্শ করিয়েছিলেন। ১৮৫১ সালের পুজোর ছুটিতে গাজীপুরে বেড়াতে যাওয়ার সময় মাল্লাদের করা খাবার খাওয়ার আগে নিজের পৈতাটিকে নৌকার ছত্রিতে ঝুলিয়ে রেখে খেতে বসেছিলেন। বন্ধুদের মধ্যে একজন মজা করে তখন বলেছিলেন, “এদিকে তো মাল্লাদের হাতে খাইতেছি অথচ পৈতাটিকে রাখিয়া ব্রাহ্মণ্য দেখাইতেছি। কি ভণ্ডামিই করিতেছি ?” যদিও নিছক মজা তবু সেই থেকে রামতনু লাহিড়ী পৈতাটি ত্যাগ করিলেন। পৈতা পরিত্যাগ করার পর কী ঘটেছিল তা শিবনাথ শাস্ত্রীর বর্ণনায় পাই–
“যাহা হউক তিনি যখন উপবীত পরিত্যাগ করিয়া বর্দ্ধমানে প্রতিনিবৃত্ত হইলেন তখন এই ব্যাপার লইয়া তুমুল আন্দোলন উপস্থিত হইল। হিন্দু সমাজেরলোক দলবদ্ধ হইয়া তাঁহার ধোপা-নাপিত বন্ধ করিল, দাসদাসীগণ তাঁহাকে পরিত্যাগ করিল। তাঁহার দ্বিতীয় পুত্র নবকুমার তখন শিশু। সেই শিশুপুত্রের রক্ষণাবেক্ষণ ও সংসারের সমুদয় কার্য্যনির্বাহের ভার তাঁহার বালিকা-পত্নীর উপরে পড়িয়া গেল। যিনি অপরের ক্লেশ একটু সহিতে পারিতেন না, সেই লাহিড়ী মহাশয় যে স্বীয় পত্নীর ক্লেশ দেখিয়া অস্থির হইয়া উঠিবেন, তাহাতে আশ্চর্য্য কি?”
এমন অবস্থায় একবছরের মধ্যে ১৮৫২ সালে তিনি বালি-উত্তরপাড়া ইংরেজী স্কুলের হেডমাস্টার হয়ে চলে এলেন। তাঁর বাবা রামকৃষ্ণ লাহিড়ী সহ অন্যান্যরাও তাঁকে পুনরায় উপবীত অর্থাৎ পৈতা ধারণ করতে বললেও রামতনু তা করেন নি। উত্তরপাড়ায় এসে তিনি নিজে স্বস্তি পেলেন, কলকাতাবাসী বন্ধুদের সাহায্যও পেলেন।
একদিন রামতনু লাহিড়ী বিদ্যাসাগরকে বললেন, “ওহে আমাকে একটি রাঁধুনি বামুন যোগাড় করে দিতে পারো?” বিদ্যাসাগর বললেন,” কেন হে, আবার বামুন দরকার কি? বাবুর্চি-খানসামা হলেই তো চলে!” “হ্যাঁ, আমার কোনো আপত্তি নেই।”, রামতনু বললেন, “কিন্তু বাড়ির ভেতর যে বামুন ছাড়া চলে না।” বিদ্যাসাগর হাসলেন। বললেন, “বাপের কথায় পৈতাগাছটি রাখতে পারলে না, এখন পরিবারের কথায় বামুন খুঁজতে বেরিয়েছ!”
এমনই ছিল মহামানব বিদ্যাসাগরের চরিত্রের দৃঢ়তা! সে উচ্চশিক্ষিত বন্ধুই হোন বা উপরওয়ালা সাহেবই হোন, পরিহাসাচ্ছলে হলেও কঠিন সত্যটি তাঁকে শুনিয়েই ছাড়তেন।
তথ্যসূত্র : রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ — আচার্য শিবনাথ শাস্ত্রী।