“আমার হাত ধরে তুমি, নিয়ে চলো সখা, আমি যে পথ চিনিনে” অতি চেনা গানটি আমার হাত ধরে গাইছিলেন, নাটোরের কিংবদন্তি অভিনেত্রী পুতুল রায়। আমার জন্মস্থান লালবাজারে না হলেও শিশুকাল থেকে এখানেই বসবাস। পুতুল রায়‘র জন্মস্থান, মাদ্রাসার মোড়ে হলেও স্বাধীনতার পর থেকে তিনি, লালবাজারে বসবাস করেন।
১৯৯৫ সালের নভেম্বর মাসে বেড়াতে গিয়েছিলাম নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলার, বান্দাইখাড়া গ্রামে, আত্রাই নদীর ধারে, বাজারে বসেছিলাম একটি চা স্টলে, অপরদিকে জন্য এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেন বাবা তোমার বাড়ি কোথায়? উত্তর দিলাম, নাটোর জেলায়।
জিজ্ঞেস করলেন কোথায়,বললাম স্বর্ণকার পট্টির কাছে লালবাজার মহল্লায়, ফের প্রশ্ন করলেন “পুতুল রায়” কে চেনো, উত্তর দিলাম না, বিস্ময়ের চোখে তাকিয়ে বললেন সত্যিই তোমার বাড়ি লালবাজার? কতদিন হলো বসবাস সেখানে? বললাম প্রায় ১৫ বছর।
এবার তিনি জানালেন পুতুল রায়, নাটোর জেলার বললে ভুল হবে, উত্তরবঙ্গের সেরা একজন অভিনেত্রী, তিনি মঞ্চে উঠলে, সংলাপ বলতে কোন মাইকের প্রয়োজন হতো না, যেমন তিনি দেখনেওয়ালা ঠিক তেমনি অভিনয় , অসাধারণ কণ্ঠস্বর, মিষ্টিভাষী, প্রতিটা শব্দ উচ্চারণ সুস্পষ্ট, নির্ভুল, এমন একজন অভিনেত্রীর পাশে বাড়ি হয়েও তুমি তাকে চেনো না বাবা! সত্যিই সেদিন লজ্জিত হয়েছিলাম।
বাড়ি ফিরে কিংবদন্তি সেই অভিনেত্রীর সাথে প্রথমে দেখা করেছিলাম। তারপর কেটে গেছে বহুকাল ২০১৬ সাল তাকে নিয়ে কিছু তথ্য সংগ্রহ করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিলাম, স্থানীয় পত্রিকা ‘সাপ্তাহিক বারনই’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
প্রকাশিত প্রতিবেদন: ‘নাটোরের কিংবদন্তি অভিনেত্রী পুতুল রায় মাত্র ১২ বছর বয়সে শুরু করেন অভিনয় জীবন। অভিনয় করেছেন আনোয়ার হোসেন, রুপা, নায়ক রাজ রাজ্জাক, আনোয়ারা, সুমিতা দেবী, মোস্তফা সহ দেশের বিশিষ্ট অভিনয়শিল্পীর সাথে।
অভিনেত্রী জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৫ সালের ১লা জানুয়ারি মাসে , তার বাবার নাম বৈদ্যনাথ রায় মা মনিকা রায়, চার ভাই বোনের মধ্যে তিনি মেজ, ছোটবেলায় গান শিখেছেন মায়ের কাছে, পুতুলের অভিনয়ে হাতেখড়ি হয় মাত্র ১২ বছর বয়সে।
অভিনয় করেছেন বেতার-টেলিভিশনে, ১৯৬৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান বর্তমান বাংলাদেশ সমগ্র বাংলার নাটক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয় ঢাকায়, সেখানে তিনি অভিনয়ের জন্য“ গোল্ড মেডেল” পেয়েছিলেন।
পূর্ব পাকিস্তান আমলে বাংলার বিখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রী, আনোয়ার হোসেন, রুপা, নায়ক রাজ রাজ্জাক, আনোয়ারা, সুস্মিতা দেবী, মোস্তফা প্রমুখ শিল্পীর সাথে অভিনয় করেছেন। আনোয়ার হোসেনের সাথে অভিনয় করেছেন, নবাব সিরাজউদ্দৌলা নাটকে ঘষেটি বেগমের চরিত্র, টেলিভিশনে অভিনয় করেছেন লালনের মা তারামন বিবির চরিত্রে।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচারে দেশ ছাড়েন, এ সময় তিনি পরিবার নিয়ে অবস্থান করেন ভারতের রানাঘাটে, সেখানে গিয়েও তিনি থেমে থাকেননি, মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলার শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য, সৌমেন ঠাকুরের উদ্যোগে বর্তমান পশ্চিম দিনাজপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে মঞ্চনাটক করেন এবং উপার্জিত অর্থ দান করেন শরণার্থী ক্যাম্পে।
১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত পর্যন্ত রাজশাহী বেতারের অসংখ্য নাটকে অভিনয় করেন, তারমধ্যে ঈশাখা, সাতরং, নবাব সিরাজউদ্দৌলা নাটক বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া নাটোরের সাংস্কৃতিক মঞ্চ “সাকাম” প্রতিষ্ঠার পর থেকে তিনি সেখানে নিয়মিত অভিনয় করতেন।
হাস্যোজ্জ্বল মমতাময়ী নারী পরিবারের মা, ভাই-বোন ও বোনের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করানোর জন্য বিয়ে করেননি। বর্তমানে তার বয়স ৭১ বছর। তিনি নানা ধরনের জটিল রোগে প্রায়ই অসুস্থ থাকেন, বাড়ি থেকে খুব একটা বাইরে বের হতে পারেন না, জীবনে এত বড় শিল্পী হয়েও ভাগ্যে জোটেনি কোন সরকারি সহযোগিতা বা সম্মাননা।
এক সময়ের মঞ্চ কাঁপানো এই শিল্পীর কথা, তেমর ভাবে মানুষ আর মনে করে না, বিভিন্ন অসুস্থতা এবং বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি আর অভিনয় করতে পারেন না, তার বোনের ছেলে বিজন কুমার বসাক এখন তার দেখাশোনা করেন।
বর্তমানে তিনি লালবাজারের বাড়িতে বসবাস করেন, নানা সাংস্কৃতিক সংগঠন শিল্পী কে সম্মান দিলও এই কৃতী অভিনয়শিল্পীর মেলেনি কোনো সরকারি সম্মাননা, মানুষকে অভিনয়ে মুগ্ধ করলেও এখন জীবন সাহায্যে তার পাশে কেউ নেই একমাত্র ভাগ্নে ছাড়া।
এ ব্যাপারে নাটোর জেলার বিশিষ্ট নাট্যকার অ্যাডভোকেট সুখময় রায় বলেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি নাটোর জেলা শাখা থেকে প্রতিবছর একজন গুণী শিল্পীকে বিশেষ সম্মাননা দেওয়া হয় এ বছরের সম্মাননার জন্য আমি শিল্পকলা একাডেমী কর্তৃপক্ষের কাছে পুতুল রায়ের নাম উত্থাপন করছি।’
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন, শ্রদ্ধেয় প্রফেসর প্রদীপ সরকার, ছবি তুলেছিলেন কাজল পোদ্দার এবং বিশেষ সহযোগিতা করেছিলেন রিঙ্কু রাহি। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি সাপ্তাহিক বারনই পত্রিকার সম্পাদক জনাব বিপ্লব কুমার পাল এর প্রতি।
প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছিল ১১ ই এপ্রিল ২০১৬ সালের রোজ সোমবার, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়সহ সারা নাটোরে পত্রিকাটি বিপণন হওয়ার মাত্র তিন ঘন্টার মধ্যেই অভিনয়শিল্পীর বাড়িতে সরকারি একজন পিয়ন আসে, তথ্যাদি সংগ্রহ করতে, সে বছরের অভিনয়শিল্পী হিসেবে তাঁকে জেলা শিল্পকলা একাডেমী সম্মাননা প্রদান করেন।
অসচ্ছল সাংস্কৃতিক শিল্পী হিসেবে তাকে বাৎসরিক একটি সম্মাননা প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়, এ বিষয়ে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি, তৎকালীন সময়ের জেলা কালচারাল অফিসার জনাব শাহাদৎ হোসেন‘এর প্রতি এবং সাবেক জেলা প্রশাসক জনাব শাহিনা খাতুন`এর প্রতি।
প্রিয় পাঠক সরকার এই গুণী শিল্পীকে প্রতিবছর ষোল হাজার টাকা সম্মাননা প্রদান করেন, যা তার চিকিৎসা খাতে ব্যয় হয়, তবে বর্তমানে তার মাজার হাড় ক্ষয় হয়ে গেছে, সুচিকিৎসা করতে প্রয়োজন আর্থিক ও মানসিক সহযোগিতা, তবেই তিনি আমাদের মাঝে আরো কিছুকাল সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকবেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধে সহযোগী, গুণী এই শিল্পী, অতি কষ্টে দিন অতিবাহিত করছেন, সরকারিভাবে একটি বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া প্রয়োজন। আমাদের সমাজে অনেক বিত্তবান আছেন যারা গুণী শিল্পীকে আর্থিকভাবে সহায়তা প্রদান করতে পারেন, তাদের কাছে সবিনয়ে অনুরোধ করছি-
আপনার একটু কৃপায় একজন উচ্চমানের, শিল্পী আরো কিছুকাল আমাদের মাঝে সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকবেন। দেশ ও জাতির কাছে এটাই প্রত্যাশা করি, নইলে হয়তো চিরসবুজ এই শিল্পীর কাছে আমরা আজীবন ঋণী থেকে যাব।