বর্ষার জল সরিয়া গিয়াছে জাগিয়া উঠেছে চর
গাঙ শালিখেরা গর্ত খুঁড়িয়া বাঁধিতেছে সবে ঘর৷
গহীন নদীর ঐ পাড় দিয়া আঁখি যায় যত দূরে
আকাশের মেঘ অতিথি যেনোগো তাহার আঙিনা জুড়ে …
নবীন কবির কবিতা৷ দুরুদুরু বুকে পাঠিয়েছেন আর এক কবির কাছে৷
আষাঢ়ের জলভরা মেঘের দুপুর৷ সামনে শান্তি নিকেতনের ভূবনডাঙার খোলা মাঠে বৃষ্টির খেলা দেখতে দেখতে “ময়নামতির চর” পড়ছেন কবিদের যিনি কূলগুরু৷ বারবার কবিতাটি পড়েও যেনো পড়া হয়না … এমনই মনোমুগ্ধকর! এক সময় কলম টেনে নেন তিনি…৷ নবীন কবির প্রতি তাঁর আবেগ তিনি গোপন রাখতে না পেরে চিঠি লিখতে শুরু করেন —
‘… পদ্মাতীরের পাড়াগাঁয়ের এমন নিকটস্পর্শ বাংলা ভাষায় আর কোনো কবিতায় পেয়েছি বলে আমার মনে পড়ছে না৷বাংলা সাহিত্যে তুমি আপন বিশেষ স্থানটি অধিকার করতে পেরেছ…’
নবীন কবির নাম ‘বন্দে আলী মিয়া’৷ পাবনার রাধানগর গ্রামে ১৯০৬ সালে জন্ম৷ ‘দুখু’ কবির মতই অল্প বয়সে বাবার মৃত্যু৷ মা গ্রামের ‘মজুমদার একাডেমি’তে ছেলেকে ভর্তি করিয়ে দেন৷
এরপর সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় তিনি লেখাপড়া চালিয়ে যান৷ ১৯৩০ সালে ২৫বছর বয়সে কোলকাতার একটি বিদ্যালয়ে চাকরিও যোগাড় করে নেন৷
এই সব গুরুগম্ভীর কথা, পড়ে জেনেছি – অনেক পরে৷
রবীন্দ্রনাথের প্রিয় কবিতাটি ছোটোদাদারও অনেক ভালো লাগতো৷ দরজা ছিলনা চিলেকোঠার ঘরে৷খোলা ছাদের পাঁচিলের ওধারে সারি সারি গাছ-গাছালি৷ সেখান থেকে ছুটে আসত দামাল হাওয়া৷ সু এবং উচ্চ স্বরে এই কবিতাসহ আরো অনেক কবিতা দাদা পড়ত-পাঠ্যছিল যে৷
পাঠ্য নয়, তবু শুনতে শুনতে আমারও মুখস্থ হয়ে যেতো এক সময়৷ বড় ভাইবোনদের জামা-কাপড়-জুতোর মতন একদিন বইগুলোও আমরা পেতাম দু’এক বছরের ব্যবধানে৷ তার অনেক আগেই অবশ্য পড়া হয়ে যেতো তাদের ক্লাসের বাংলা বইয়ের গল্প কবিতা৷
আমাদের বাড়িময় ছিল আম-জাম, কাঁঠাল, ডুমুর, কদম – লেবু আরও নানান গাছের ছড়াছড়ি৷যে যার মতন দাঁড়িয়ে থাকত৷ সকাল সকাল ঘুমানোর জন্যে ভোর ভোর ঘুম ভেঙে যেতো৷কাঠ কয়লা দিয়ে দাঁত মাজতাম আর মুখ ধুতাম পুকুরের জলে৷
অত ভোর – তখনও পুকুরের জলের সর ভাঙেনি৷ উত্তর কোণের ডুমুর গাছের পাতারা ছায়া নামতো সেই জলে৷ ভয় আর ভাবহীনতায় দেখতাম দোয়েল আর কুবো পাখির আলসেমি…৷ একটু পরেই বারান্দায় পড়তে বসেই প্রথমেই মুখস্থ যত কবিতার মহড়া দিতাম৷
আক্ষরিক অর্থেই খুব সকাল অর্থাৎ জীবনেরও সেই প্রথম লগনে যে সব কবিতা পড়েছি, সেখানে রবি বা দুখু কবির কবিতা থেকে অন্যদের কবিতার স্মৃতি অধিক স্পষ্ট৷ মাটির কাছাকাছি সে সব কবিতা, সবুজের গন্ধমাখা৷ হৃদয়ের বড় আপন…
‘আমাদের ছোটগায়ে, ছোটছোট ঘর,
থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর৷
আমগাছ জামগাছ, বাঁশঝাড় যেনো
মিলেমিশে আছে তারা, আত্মীয় হেনো৷’
পাঠ্যের সাথে প্রকৃতির, আরও ভাল করে বললে জীবনের প্রতিটি বিষয়ের সাথে এমন মিল থাকায় কবিতাগুলো আজও প্রায় কন্ঠস্থ৷আর সেই কবিদের মধ্যে অন্যতম ‘বন্দে আলী মিয়া’৷
পদ্মাচরের দৃশ্যকাব্য ‘ময়নামতীর চর’৷
রং তুলি দিয়ে যেমন ছবি আঁকা হয়, কবি তাঁর এই প্রথম কাব্যগ্রন্থটিকে শুধু কলম দিয়েই ছবির আঁকার সেই অসাধ্যকে সাধ্য করে তুলেছেন৷ বাস্তব জীবনের কাব্য ধর্মের সে এক মনোগ্রাহী মেল-বন্ধন৷ কবিতা, অথচ বুঝবার জন্যে ব্যাখ্যা-টীকা-টিপ্পুনি-শব্দার্থ সব কিছুই অপ্রয়োজন৷চারপাশে তাকাও আর কবিতার বাহার দেখো…
কবিতার উপকরণ যৎসামান্য,গাঁয়ের আলাভোলা সহজ-সরল নির্দোষ এক জীবনের জলছবি! মাঠের পাশে একা দাঁড়িয়ে থাকা প্রাচীন বটগাছ, শালিখের গর্ত করা,পায়ে চলার মেঠো পথ৷ নিরিবিলি- নিঝুমতায় কবির কেটেছে সকাল-সন্ধ্যা-দুপুর ৷ আলো দিয়ে বায়ু দিয়ে বাঁচানো প্রাণ, আর জল ভরা দিঘির সাহচর্যে… তারই প্রতিফলন কবিতাগুচ্ছে৷ যা মনকে স্নিগ্ধ করতে বাধ্য-সকল হিংসার বিরুদ্ধে প্রদীপ জ্বেলে৷গুরুর আর্শীবাদ মিথ্যে হয়নি৷ বাংলা সাহিত্যে তাঁর স্থান বিশেষ জায়গাটি কেউ নিতে পারেননি৷
শিশু মনে সেই যে স্নিগ্ধতার আনন্দ জেগেছিল তাঁর কবিতায়, তার অভিঘাত ছিল গোপন৷ যার জন্যে সারা জীবনে আধুনিক কবিতা আর পড়তেই ইচ্ছে করল না -বুঝতেও পারলাম না!
বর্ষাকে কবি ভালবাসতেন৷ এমনই এক আষাঢ়ে চলে গিয়েছিলেন তিনি৷ নতুন দিনের কবিদের প্রতি তাঁর বিশ্বাস ছিল—
‘তোমরা লিখিও নতুন কাব্য
ওগো আগামী দিনের কবি,
তোমাদের লেখায় ফুটে ওঠে যেনো
এই গ্রাম বাংলার ছবি৷’
নতুন কবিদের কবিতায় গ্রাম বাংলার দর্পন কতটা স্পষ্ট জানা নেই৷ কিন্তু এক অখ্যাত গ্রামের বালিকা আপনার কবিতা পড়েছিল একদিন৷ যে কবিতার প্রতিটা শব্দে গ্রাম-বাংলার ছবি তুলে ধরা৷ আপনার অনেক কবিতা আজও তার মুখস্থ৷ একজন গুণমুগ্ধ পাঠিকা আপনাকে স্মরণ করছে৷
নিশ্চয় আগামীর কোনো বালিকাও একই রকম ভালোবেসে পড়বে আপনার কবিতা।