জুরানের হঠাৎ মনে হল, কতগুলো শীতল ছায়া যেন তার চার পাশে ঘুরঘুর করছে। ফিসফিস করে নিজেদের মধ্যে কী সব বলাবলি করছে। কান খাড়া করে সেগুলো শোনার চেষ্টা করল সে। দেখল, পৃথিবী থেকে এত দূরে, একেবারে অন্য একটা অজানা জায়গায় এসেও সে কিন্তু তাদের ভাষা বেশ বুঝতে পারছে। কিন্তু এরা কারা?
ও শুনেছিল, মানুষ মরে গেলে মৃত-মানুষের ছেলেমেয়ে কিংবা নিকট কোনও আত্মীয় গয়ায় গিয়ে পিণ্ড দিয়ে আসে। পিণ্ড দেওয়ার সময় শুধু সেই মৃত-মানুষই নয়, যাদের পিণ্ড কেউ দেয়নি, দেওয়ারও কেউ নেই, সেই সব অতৃপ্ত আত্মারাও নাকি শীতল ছায়া হয়ে পিণ্ড নেওয়ার জন্য হাত পাতে। এরাও তো শীতল ছায়া। তা হলে কি এরা সব মৃত! অশরীরী আত্মা! হতে পারে। শুধু মানুষ নয়, এদের মধ্যে হয়তো সাপ, ব্যাঙ, পেঁচাও আছে। বেঁচে থাকার সময় যে যার ভাষাতে কথা বললেও মৃত্যুর পরে বুঝি সব ভাষাই এক হয়ে যায়। মানুষের ভাষা, পাখির ভাষা, মাছের ভাষা, সব— সব। তা না হলে এদের ভাষা সে বুঝতে পারছে কী করে!
তার মানে মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে কিংবা তাদের ধারণা অনুযায়ী, মৃত্যুর পরে টানা তিন দিন মায়ায় পড়ে আপনজনদের আশপাশে ঘোরাঘুরি ক’রে, কিছু একটা বলতে চেয়েও, বলতে না-পেরে অবশেষে এখানে চলে আসে!
এটা কি স্বর্গ! স্বর্গ তো সব সময় উপরেই হয়! কিন্তু এটা যে পৃথিবীর উপরের দিকে সেটা কে বলল! পৃথিবীতে কি কোনও মার্কিং করা আছে। ছবিতে যেমন মানুষের মাথা দেখে বোঝা যায়, এটা উপরের দিক। ছোট্ট একটা চারাগাছের ছবি দেখলেও বোঝা যায় কোনটা উপরের দিক আর কোনটা নীচের দিক। কিন্তু শুধুমাত্র ফুটবলের একটা ছবি দেখে কি বোঝার কোনও উপায় আছে কোনটা কোন দিক! পৃথিবীটাও তো ফুটবলের মতোই গোল। তা হলে বুঝব কেমন করে এটা স্বর্গ না নরক! মহাশূন্যের কি কোনও উপর-নীচ হয়!
— কেন হবে না? ভাবলেই হয়…
কথাটা আচমকা শুনে ঘোর কাটল জুরানের। বুঝতে পারল, সময়-কণার সঙ্গে কথা বলতে বলতে একটু অন্য মনস্ক হয়ে গিয়েছিল। এতক্ষণ ধরে আকাশ-পাতাল কত কী ভাবছিল সে। খানিক আগে সময়-কণার সঙ্গে কী নিয়ে কথা হচ্ছিল, ওর আর মনেই পড়ল না। তাই সময়-কণা যখন বলল, ‘কেন হবে না? ভাবলেই হয়…’ তখন তার পরিপ্রেক্ষিতে নিজের মনেই জুরান বলল, ভাবলেই হয়!
— হ্যাঁ, ভাবলেই হয়। যেমন পৃথিবীতে পৃথক কোনও দিক না-থাকলেও তোমরা তোমাদের মতো করে উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম — চার-চারটে দিক ভেবে নিয়েছ, খানিকটা সে রকম। এটাকে যদি উপর ভাবো, উপর। নীচ ভাবলে, নীচ।
— না। সে উপর-নীচের কথা বলছি না। বলছি, এটা কি স্বর্গ, না নরক?
জুরানের কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠল সময়-কণা। সেই হাসিটার মধ্যে দিয়ে সে যে কী বোঝাতে চাইল, জুরান বুঝতে পারল না। তবে আন্দাজ করল, এ নিয়ে যদি সে ফের প্রশ্ন করে, তা হলে হয়তো আগের মতোই সময়-কণা বলবে, স্বর্গ বা নরক বলে আসলে কিছু হয় না। মৃত্যুর পরে মানুষ যেখানে আনন্দে থাকে, সুখে থাকে, ভাল থাকে, যেখান থেকে আর কোথাও যেতে চায় না, সেটাই স্বর্গ। আর যেখানে থাকলে কষ্ট হয়, কষ্ট করে থাকতে হয়, দম বন্ধ হয়ে আসে। মনে হয়, কবে যে এখান থেকে রেহাই পাব, সেটাই নরক। আচ্ছা, সত্যিই কি স্বর্গ বা নরক বলে কিছু হয়!
জুরান মনে মনে এটা ভাবতেই সময়-কণা বলল, হয় হয়…
— তা হলে সেটা কোথায়?
— যেখানে আলো আছে, প্রশান্তি আছে, সেটা পৃথিবীতেই হোক কিংবা অন্য কোনও গ্রহে, অথবা মহাশূন্যে— সেটাই স্বর্গ। আর যেখানে কেবলই অন্ধকার, ঘুটঘুটে অন্ধকার, যেখানে আলোর রেশটুকুও পৌঁছয় না, সেটা যেখানেই হোক না কেন, সেটাই নরক।
— আমরা এই মুহূর্তে যেখানে আছি, এটা কি স্বর্গ, না নরক?
— দুটোই। একই জায়গা লোকভেদে কারও কাছে স্বর্গ, কারও কাছে নরক হয়ে যায়। দাঁড়াও, তোমাকে একটা জিনিস দেখাই। ওই দ্যাখো, সামনে তাকাও।
জুরান তাকাল। দেখল, সামনে একটা বিশাল গ্লোব। সত্যিই বিশাল বড়। এতক্ষণ তো সে এটা দেখেনি! কোত্থেকে এল! ভূগোল পড়ার জন্য তার বাবা সব থেকে বড় যে গ্লোবটা তাকে কিনে দিয়েছেন, এটা তার থেকেও বড়। তবে তার আর এটার মধ্যে বিস্তর ফারাক। ওখানে শুধু রং আর রেখাচিত্র দিয়ে দেশগুলি ভাগ করে দেখানো আছে। কিন্তু এটা প্রকৃত অর্থেই পৃথিবীরই একটা জলজ্যান্ত রেপ্লিকা। সারা গা জুড়ে কী যেন কিলবিল-কিলবিল করছে। কোনও অংশ বড় করে দেখতে চাইলে সোনামুখী সূচের চেয়েও ছুঁচোলো মাথাওয়ালা ‘পয়েন্ট-টাচ’ দিয়ে সেই জায়গাটায় ছোঁয়ালেই সঙ্গে সঙ্গে সেটা বড় হয়ে যায়। বালিকণার চেয়েও হাজার হাজার ভাগ ছোট কোনও মানুষকে দেখতে চাইলে, সেটাও মুহূর্তের মধ্যে প্রমাণ সাইজের সত্যিকারের মানুষ হয়ে ওঠে। ছলাৎ ছলাৎ করে পাড়ে আছড়ে পড়ে সমুদ্রের বিশাল বিশাল ঢেউ।
তেমনই একটা সমুদ্রের দিকে আঙুল তুলে জুরান বলল, এটা কি পুরীর সমুদ্র?
সময়-কণা বলল, না না, এটা পুরীর সমুদ্র না। এটা হল ভূমধ্যসাগর। কেন? তুমি কি কখনও পুরীতে গিয়েছিলে?
জুরান বলল, হ্যাঁ। অনেক দিন আগে। বাবা-মায়ের সঙ্গে। সমুদ্রের উল্টো দিকের একটা হোটেলে আমরা ছিলাম। সেই ঘরের ব্যালকনি থেকেই সমুদ্র দেখা যেত। আমরা প্রত্যেক দিন সকালে সূর্যোদয় দেখতে যেতাম।
— সূর্যোদয়!
— হ্যাঁ, সমুদ্রের ও পার থেকেই তো সূর্য উঠত।
সময়-কণা বলল, ধ্যাত। সূর্য আবার ওঠে নাকি?
— হ্যাঁ গো, ওঠে। পূর্ব দিক থেকে ওঠে আর পশ্চিমে ডোবে।
— ওটা তোমাদের মনে হয়। আসলে সূর্য ওঠেও না, ডোবেও না। সূর্য তার নিজের জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। পৃথিবীটাই বরং লাট্টুর মতো পাক খেতে খেতে ঘোরে। ঘুরতে ঘুরতে পৃথিবীর যে দিকটা সূর্যের দিকে বাঁক নেয়, তখন সে দিক থেকে সূর্যকে দেখে তোমাদের মনে হয়, ওই তো সূর্য উঠছে। আর চক্কর মারতে মারতে পৃথিবীর যে দিকটা সূর্যের আড়ালে চলে যেতে থাকে, তখন সে দিক থেকে তোমাদের মনে হয় সূর্য বুঝি ডুবছে।
— হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। এটা তো আমরা স্কুলের বইতে পড়েছি। কিন্তু বইমেলায় যে কে সি পাল নামে একটা লোক বলেছিলেন, আমরা এত দিন ধরে যা জেনে এসেছি, সেগুলো নাকি বেশির ভাগই ভুল। আসলে সূর্যই বছরে একবার করে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। তিনি তো আবার বড় মুখ করে চ্যালেঞ্জও করছিলেন, তাঁর তথ্য কেউ ভুল প্রমাণ করতে পারলে তিনি তাঁকে এক কোটি টাকা দেবেন। তাঁর কথা শুনে তো আমার মাথা ঘুরে গিয়েছিল। তাই বলছিলাম কি, এর মধ্যে কোনটা ঠিক?
— সেটা অবশ্যই জানতে পারবে। তবে এক্ষুনি নয়। সেটার জন্য তোমাদের একটু অপেক্ষা করতে হবে। আমি নই। ওটা তোমাদের জানাবে অন্য একটা সময়-কণা।
জুরান জানতে চাইল, কিন্তু কবে?
— একটু ধৈর্য ধরো। সব জানতে পারবে। শুধু ওটাই নয়, এখনও তোমরা এমন অনেক কিছুকেই ধ্রুব সত্য বলে জানো, যেটা ভুল। সেগুলিও তোমাদের কাছে ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে যাবে। এক-একটা সময়-কণাই তোমাদের জানিয়ে দেবে কোনটা আসল সত্যি। পাশাপাশি এটাও জেনে রাখো, যখন যেটা জানবে, সেটা শুধু সেই সময়ের জন্যই সত্যি। চিরসত্যি বলে কিচ্ছু হয় না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব কিছুই পাল্টে যায়।
— এই এত আধুনিক যুগে এসেও এই কথা বলছ?
— আধুনিক? কীসের আধুনিক? তোমাদের বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটনকে ‘জ্ঞানের সমুদ্র’ বলা হয়েছিল দেখে তিনি কি বলেছিলেন জানো? উনি বলেছিলেন, জ্ঞানের সমুদ্র তো দূরের কথা, আমি সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়িয়ে সবেমাত্র নুড়ি কুড়োচ্ছি।
— সে তো বহু বছর আগে বলেছিলেন।
— বহু বছর মানে? কত বছর? ইতিহাসের ক্ষেত্রে একশো-দুশো বছর কি? দু’-পাঁচ হাজার বছরও কিচ্ছু না। আর তুমি বলছ, বহু বছর আগে? বলছ, এটা আধুনিক যুগ? আধুনিক যুগের কী দেখেছ তোমরা? সবে তো হামাগুড়ি দিচ্ছ, এর পর প্রতিনিয়ত যে কত কী আবিষ্কার হবে, তা তুমি তোমার জীবদ্দশাতেই দেখে যেতে পারবে। তোমার পরবর্তী প্রজন্মের কথা না-হয় বাদই দিলাম।
সময়-কণার কথা খুব মন দিয়ে শুনছিল জুরান। কিন্তু মাঝে মাঝেই তার চোখ চলে যাচ্ছিল সামনে বনবন করে ঘুরতে থাকা পৃথিবীর ওই রেপ্লিকাটার দিকে। সেখানে যতটা স্থল তার চেয়ে বেশি জলাশয়। সাপের মতো এঁকেবেঁকে এক দিক থেকে আর এক দিকে চলে গেছে বিশাল-বিশাল নদী। অবশেষে সাগরে গিয়ে মিশেছে। সাগরের মাঝখানটা শান্ত হলেও পাড়ে এসে বারংবার আছড়ে পড়ছে তার বড় বড় ঢেউ। সেই ঢেউ ভেঙে পড়তেই সাবান গোলা ফেনার মতো সে কী সাদা ধবধবে বুজকুড়ি।
সে যখন তার বাবা মা-সহ পাড়ার আরও অনেকের সঙ্গে লাক্সারি বাসে করে পুরী বেড়াতে গিয়েছিল, তখন তারই পাশের বাড়ির তরুণকাকু সমুদ্রের পাড় ধরে ঝিনুক কুড়োতে কুড়োতে বলেছিলেন, তোরা কি জানিস, আগে কিন্তু সমুদ্রে কোনও ঢেউ ছিল না।
তরুণকাকুর কথা শুনে ওরই বয়সি যে চার-পাঁচ জন ওর সঙ্গে ছিল, তার মধ্যে থেকে একটা ছেলে বলে উঠেছিল, তাই নাকি? তা হলে এখন হয় কেন?
তিনি বলেছিলেন, সমুদ্র কখনও চায়নি তাকে কেউ নোংরা করুক। কিন্তু মানুষ যখন মানুষ হয়ে ওঠেনি। যখন বনমানুষ ছিল কিংবা তারও আগে— তারা তখন থেকেই সমুদ্রে নামা শুরু করেছিল। সমুদ্রে গিয়েই স্নান করত। স্নান তো নয়, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে রীতিমত লাফালাফি-ঝাঁপাঝাঁপি করা। আর স্নান করতে করতে হঠাৎ হিসি পেয়ে গেলে কেউ আর সমুদ্র থেকে উঠে, পাড়ে গিয়ে করত না। জলের মধ্যে করলে কে আর টের পাবে ভেবে, ওই সমুদ্রের মধ্যেই হিসি করে দিত।
— ও… সেই জন্যই বুঝি সাগরের জল এত নোনতা!
জুরান কথাটা বলতেই সঙ্গে সঙ্গে আর একটা ছেলে বলেছিল, না রে, সে জন্য না। আমার বাবা বলে, যে-সব মাছকে আমরা জাল ফেলে তুলে আনি, তাদের মা-বাবা, ছেলেমেয়ে, দাদু-দিদা, এমনকী নিকট আত্মীয়রাও ঠিক বুঝতে পারে, আমরা তাদের কেন ধরেছি। তাই তার শোকে তারা হাপুস নয়নে কাঁদে। আর তারা কাঁদে দেখেই তাদের চোখের নোনতা জলে গোটা সমুদ্রটাই ধীরে ধীরে এ রকম লবণাক্ত হয়ে গেছে।
সেটা শুনে তরুণকাকু বলেছিলেন, তোরা তো নিরামিষাশী, মাছ-মাংস কিছুই খাস না। তাই ওই সব বলে নিজেদের সান্ত্বনা দিস। আর বাকি লোকদেরও প্রভাবিত করতে চাস। যাতে কেউ আর মাছ না খায়…
— তা হলে কি আমি যেটা বললাম, সেই পেচ্ছাপের জন্যই? জুরান কথাটা বলতে না-বলতেই ওদের পাড়ারই অন্য আর একটা ছেলে বলে উঠেছিল, ধুস, বোকার মতো কথা বলিস না তো। ওইটুকু পেচ্ছাপে কি সমুদ্রের অত জল নোনতা হতে পারে?
তরুণকাকু বলেছিলেন, কেন হবে না? প্রত্যেক দিন কত লোক সমুদ্রে স্নান করে বল তো… তার ওয়ান পার্সেন্ট লোকও যদি হিসি করে, এই হাজার হাজার বছরে কত হিসি সমুদ্রে মিশেছে একবার ভেবে দ্যাখ তো…
জুরানের পাশে পাশে হাঁটতে থাকা আর একটি ছেলে সঙ্গে সঙ্গে বলেছিল, ও… তার মানে, আগে এত জল ছিল না। অত পেচ্ছাপের জন্যই সমুদ্রের জল এত বেড়েছে…
তরুণকাকু বলেছিলেন, না না, তা নয়। হিসেব মতো তো বাড়ারই কথা। বাড়তও নিশ্চয়ই। কিন্তু যতটা বাড়ার কথা সেটা তো সূর্যের তাপে বাষ্প হয়ে উড়ে যায়।
সে কথা শুনে অন্য আর একটি ছেলে বলেছিল, বাষ্প হয়ে উড়ে গেলেও, সেটা তো বৃষ্টি হয়ে নীচেই নেমে আসে, নাকি?
তখন উনি বলেছিলেন, সমুদ্র থেকে উবে গেলেও বৃষ্টি হয়ে সব সময় তো আর সমুদ্রেই পড়ে না। অন্য জায়গাতেও পড়ে। ফলে সেই সব প্লাস-মাইনাস করে দেখা যায়, সমুদ্রে প্রথমে যতটা জল ছিল, একটু-আধটু হেরফের হলেও মোটামুটি সমুদ্রের জল ওই একই আছে।
জুরান জিজ্ঞেস করল, সে নয় ঠিক আছে। কিন্তু এখন কেন ঢেউ হয় সেটা তো বললে না?
তরুণকাকু তখন বলেছিলেন, এখন মানে এখন নয়, ওই সময় থেকেই ঢেউ হওয়া শুরু হয়।
— কিন্তু কেন?
— কারণ, সমুদ্র যখন দেখল, ডাঙার লোকেরা তার গায়ে হিসি করছে, তখন— তার তো হাত নেই, তাই হাত দিয়ে কাউকে ঠেলে সরাতে পারবে না দেখে সে নিজেই ফুঁসে উঠে, ঢেউ তুলে ধাক্কা দিয়ে লোককে ঠেলে সরাতে চাইল। কিন্তু সবাই তো আর তার বারণ করার কৌশল বুঝত না। ফলে আগের মতোই সাগরে যেত। স্নান করত। তাই হাজার ঠেলেও সাগর যখন কাউকে আটকাতে পারল না, তখন এক-আধ জনকে সেই ঢেউ দিয়েই সে টেনে নিয়ে যেতে লাগল অনেক গভীরে। জলে চুবিয়ে-চুবিয়ে মেরে ফেলতে লাগল। যাঁরা বেশি জলে নামতে ভয় পান, তাঁদের জন্য সমুদ্র সৈকতেই চোরাবালির ফাঁদ পেতে জীবন্ত সমাধি দিতে লাগল। লক্ষ্য একটাই— অন্যের মৃত্যু দেখে মানুষ যাতে সতর্ক হয়। জলে আর না-নামে। নামলেও যাতে আগের মতো আর দাপাদাপি না-করে। করলেও, ভুল করেও যেন হিসি না-করে। কিন্তু মানুষ থামেনি। ‘ও মরেছে তো আমার কী’ ভেবে, মানুষ ফের সমুদ্রে নেমেছে। হুটোপাটি করে স্নান করেছে এবং হিসি পেলে আগের মতোই যথারীতি সমুদ্রেই হিসি করেছে।
— আচ্ছা, লোকে তো দিনের বেলায় সমুদ্রে স্নান করে। তাদের ঠেলে সরানোর জন্য সমুদ্র তখন না-হয় ঢেউ তোলে। কিন্তু রাত্রিবেলায়? সমুদ্র কি তখন পড়ে-পড়ে খালি ঘুমোয়, নাকি তখনও ঢেউ তোলে?
— এ মা! কেন তুলবে না? আসলে এত দিন ধরে ঢেউ তুলতে তুলতে ওটা তো ওর একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে।
অন্য ছেলেটি জিজ্ঞেস করেছিল, ঢেউ তুলতে তুলতে ও হাঁপিয়ে যায় না? ক্লান্ত হয় না?
তরুণকাকু বলেছিলেন, কেন হবে? তুই কি নিশ্বাস নিতে নিতে ক্লান্ত হোস? হাঁপিয়ে উঠিস?
— না।
— তা হলে? সমুদ্রও সে রকম। ঢেউ তোলাটা ওর কাছে এখন নিশ্বাস নেওয়ার মতোই খুব স্বাভাবিক সহজাত একটা ব্যাপার হয়ে গেছে। ওটার জন্য ওকে আর ভাবনা-চিন্তা করতে হয় না। অটোমেটিক্যালি হয়ে যায়।
জুরান অবাক হয়ে গিয়েছিল। পর দিন যখন বাবাকে ও তরুণকাকুর কথাগুলো বলেছিল, তখন ওর বাবা ওকে বলেছিলেন, তরুণ ওই রকমই। ও যে কখন কী বলে, ও নিজেও জানে না। তুই কি ওর ওই কথাগুলি আবার বিশ্বাস করেছিস নাকি?
জুরান তো তরুণকাকুর কথাই বিশ্বাস করে বসেছিল। তাই কী উত্তর দেবে ভেবে পাচ্ছিল না। তখন ওর বাবাই ওকে বলেছিলেন, শোন, সমুদ্রের জল কেন নোনতা হয় জানিস? অনেকগুলো কারণ থাকলেও মূল কারণ হল— সমুদ্রের তলার আগ্নেয়গিরি আছে। সেই আগ্নেয়গিরিতে যখন উদ্গিরণ হয়, তখন তার উত্তাপে সমুদ্রতলের পাথরগুলি গরম হয়ে ওঠে। তখন সমুদ্রের জলের সঙ্গে সেই উত্তপ্ত পাথরের একটা বিক্রিয়া ঘটে। আর তার ফলেই সমুদ্রের জল লবণাক্ত হয়…
জুরান যখন তার সামনে থাকা পৃথিবীর ওই রেপ্লিকাটায় সমুদ্রের ঢেউ দেখতে দেখতে এই সব সাত-পাঁচ ভাবছে, আর মনে মনে হাসছে, ঠিক তখনই সমস্ত নিস্তবদ্ধতা ভেঙে সময়-কণা বলল, কী হল, ওটার দিকে ওই ভাবে তাকিয়ে আছ কেন? কী ভাবছ?
থতমত খেয়ে জুরান বলল, কই? কিছু না তো…
চলবে…