প্রখ্যাত ডাক্তার ও রাজনীতিবিদ বিধানচন্দ্র রায় এক সময় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তাঁর মাহাত্ম্য বর্ণনা ররতে গিয়ে, একটি গরিব ছেলে কী ভাবে তাঁর আনুকূল্য পেয়েছিল, সেই গল্পই ধরা পড়েছে— একটি পেরেকের কাহিনী’তে। এ রকম অসামান্য একটি কাহিনি লিখেও যিনি শুধুমাত্র সম্পাদনায় মনোনিবেশ করবেন বলে লেখালিখি থেকে প্রায় হাত গুটিয়ে নিয়েছিলেন, সেই প্রবাদপ্রতিম সম্পাদক সাগরময় ঘোষ, বলেছেন, লেখক হতে গেলে বিশেষ করে তিনটি ক্ষমতার অধিকারী হওয়া প্রয়োজন। প্রথমত, প্রচুর পড়াশোনা, মানে বিদ্যা-বুদ্ধি থাকা চাই। দ্বিতীয়ত, জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে। আর তৃতীয়ত হল, কতখানি সিমেন্টের সঙ্গে কতখানি বালি মেশালে ইমারত গাঁথা যায়, সেই কলাকৌশলটুকুও জানতে হবে। অর্থাৎ কতখানি বাস্তব ঘটনার সঙ্গে কতটুকু কল্পনার মিশেল দিলে সেটা সাহিত্য হয়ে উঠবে, সে সম্পর্কে অবশ্যই টনটনে জ্ঞান থাকতে হবে।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে এই তিনটি গুণই একেবারে পরিপূর্ণ ছিল। তাঁর ছেলেবেলা কেটেছিল অভাব আর দারিদ্র্যের মধ্যে। তবে তাঁর মনের মধ্যে লেখক হওয়ার বীজ রোপন হয়েছিল সেই সময়, যখন তিনি সবেমাত্র পাঠশালায় যাতায়াত শুরু করেছেন। পাঠশালায় কিছুতেই তাঁর মন বসত না। সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়লেই তাঁর বাবা তাঁকে নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন গাছ-গাছালি, পাখ-পাখালির জগতে। চলে যেতেন ইছামতির পাড়ে। এতে সুবিধাই হয়েছিল বিভূতিভূষণের।
একদিন তাঁর হাত ধরে বনমরিচের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে প্রকাণ্ড এক গাছের কাছে এসে দাঁড়ালেন তাঁর বাবা। তাঁকে বললেন, এই হল সপ্তপর্ণ জুনিপার গাছ। বুঝেছিস? তোর দাদু এই গাছের বাকল দিয়ে ওষুধ তৈরি করতেন। আর আমি সেগুলো ছেঁচে-বেটে দিতাম। মাঝে মধ্যে এই গাছ সেই গাছ দেখিয়ে বিভূতিভূষণ তাঁর বাবাকে জিজ্ঞাসা করতেন, বাবা, এই গাছটির নাম কী?
একবার এ রকমই একটি প্রশ্ন শুনে তাঁর বাবা সঙ্গে সঙ্গে গাছটির কাছে গিয়ে বললেন, সে কী রে! তোকে না দু’দিন আগেই এই গাছটি চিনিয়ে দিয়েছিলাম! এই তো সে দিন তোর মায়ের গলা ভেঙে গেল, এই গাছের লতাপাতা থেঁতলে রস করে তোর মাকে খাইয়ে দিলাম আর অমনি তার গলা ভাঙা সেরে গেল।
বিভূতিভূষণ বললেন, ও, তার মানে এটাইসেই অপরাজিতা গাছ!
এ ভাবে কিছু দিন চলার পর তাঁর হঠাৎ কী খেয়াল হল কে জানে। নোটবুকের মতো একটি খাতা তৈরি করলেন তিনি এবং নতুন কোনও গাছ, লতা, পাখির নাম পেলেই সঙ্গে সঙ্গে পেন্সিল দিয়ে তাতে লিখে রাখতে লাগলেন।
বিভূতিভুষণের র মা তাঁর ছোট ছোট ভাইবোনদের নিয়ে বাপের বাড়ি সুরাতিপুরে চলে গেলেন। বড় ছেলে বিভূতি কী করবে? পড়ার পাঠ সাঙ্গ করে ফিরে যাবেন গ্রামে? না কিছুতেই না। বোডিংয়ে খরচ তখন চালাচ্ছেন সহৃদয় প্রধান শিক্ষক চারুবাবু। চারুবাবু জানেন, অতি মেধাবী ছাত্র বিভূতি। কিন্তু চারুবাবু বিভূতিকে পছন্দ করেন অন্য কারণে। নানাবিধ বই পড়তে পছন্দ করে বিভূতি। চারুবাবু বিলক্ষণ বুঝতে পারেন, এই ছেলে জীবনে সফল হবেই।
চারুবাবুর সুপারিশে ডাক্তার বিধুভূষণ বন্দ্যোপাধ্যয়ের বাড়িতে তাঁর খাওয়া ও থাকার ব্যবস্থা হল। তবে শর্ত হল, ডাক্তার সাহেবের ছেলে জামিনীভূষণ এবং মেয়ে শিবরানীকে তাঁর পড়াতে হবে। বিভূতিভূষণ রাজি হয়ে গেলেন। বিধু ডাক্তারের বাড়ির পাশেই মন্মথ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি। আর এই বাড়ির আকর্ষণ হল এখানকার একটি ক্লাব, নাম— লিচুতলা ক্লাব। এই ক্লাবের প্রধান পৃষ্ঠপোষক মন্মথ চ্যাটার্জি। তিনি একজন মোক্তার হলেও আসলে মনেপ্রাণে তিনি ছিলেন একজন সাহিত্য সাধক। বিভূতিভূষণ বুঝতে পারলেন, মন্মথদা শুধু নিজেই সাহিত্য রচনা করেন না, ‘বালক’ ও ‘যমুনা’ নামের দুটো সাহিত্য পত্রিকারও গ্রাহক। ও-ও সেগুলো অনুগ্রাহক হয়ে গেল। একেকটি সংখ্যা লিচু ক্লাবে আসতে না আসতেই ছোঁ মেরে নিয়ে তিনি পড়া শুরু করে দিতেন।
এই লিচুতলায় বসেই ‘যমুনা’ পত্রিকায় বার্মা প্রবাসী এক বাঙালি লেখকের একটি ধারাবাহিক উপন্যাস পড়ে বিস্মিত হয়ে গেলেন তিনি। কে এই লেখক, যার নাম শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়? কী জাদুময় তাঁর লেখনীশক্তি! সেও কি কোনও দিন পারবে এ রকম লেখা লিখতে?
এ ভাবেই লেখক হওয়ার দুর্বার আকর্ষণ তাঁকে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকল। তবে বিভূতির প্রথম লেখার সূত্রপাত অবশ্য হয় যখন সে রিপন কলেজের ছাত্র। বিশিষ্ট সাহিত্যিক রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী তখন রিপন কলেজের অধ্যক্ষ। তার প্রেরণায় কলেজে তখন পুরোদমে চলছে বিতর্ক সভা, সাহিত্যচক্র, সাহিত্যপত্র প্রকাশ প্রভৃতি। আর এই সাহিত্যচক্রের একটি অনুষ্ঠানে বন্ধুদের উৎসাহে ‘নতুন আহ্বান’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখে সেটি পাঠ করেন বিভূতিভূষণ। সবার কাছ থেকে অকুণ্ঠ বাহবা ও সুখ্যাতি পেয়ে একদিন কবিতাও লিখে ফেললেন তিনি। কলেজের ম্যাগাজিনে। তারই মধ্যে বিভূতিভূষণ তাঁর লেখাপড়া শেষ করলেন।
অবশেষে কলকাতার একটি স্কুলে চাকরি জুটিয়ে নিলেন। কিন্তু সেটাও পোষাল না বেশি দিন। অগত্যা শেষমেশ পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিটোলায় খেলাত ঘোষদের জমিদারির সেরেস্তায় নায়েবের কাজ নিয়ে চলে গেলেন ভাহলপুরে। তিনি কিন্তু তখনও লেখালেখি শুরু করেননি।
এই ভাগলপুরেই ‘পথের পাঁচালী’ লেখার মধ্য দিয়ে তাঁর লেখক জীবনের সূত্রপাত। পথের পাঁচালী লেখার আগে অবশ্য ‘স্মৃতির রেখা’ নামে তিনি দৈনন্দিন খুঁটিনাটি নিয়ে ব্যক্তিগত জার্নালের মতো কিছু একটা লিখতেন।
এই ভাগলপুরে তিনি যেমন পথের পাঁচালী লিখেছিলেন, তেমনি নজরে পড়েন উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের। এই উপেন্দ্রনাথ সাহিত্যের ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন দু’জন কিংবদন্তি সাহিত্যিককে আবিষ্কার করার জন্য। তাঁদের একজন হলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় আর দ্বিতীয় জন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।
কলকাতা থেকে আইন পাস করে উপেন্দ্রনাথ চলে এসেছিলেন ভাগলপুরে আইন ব্যবসার উদ্দেশ্যে। কলকাতায় লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার সময়ই তিনি সাহিত্যের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন। ওই সময়ের বিখ্যাত সব পত্রিকা ‘ভারতবর্ষ’, ‘সাহিত্য’ ইত্যাদি পত্রিকায় তার লেখা বেরিয়েছে। ওকালতি করতে এসে উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর নিজ বাসভূম ভাগলপুরে একটি সাহিত্যিক পরিবেশ সৃষ্টি করে ফেললেন তাঁর চার পাশে। উপেন্দ্রনাথ একদিকে সাহিত্যপাগল অন্য দিকে মজলিশি। তাঁর বাড়ির কাছারি ঘরে নিত্যদিন জমজমাট সাহিত্য আড্ডা বসে।
সেই আড্ডায় একটি অপরিচিত যুবকের ছিল নিত্য যাওয়া-আসা। পরনে হাঁটু ছুঁই ছুঁই খাটো ধুতি। গায়ে নিজের হাতে কাচা ইস্ত্রিবিহীন পাঞ্জাবি। এক হাতে লণ্ঠন, অন্য হাতে একটি লাঠি। এই লোকটি তাঁর জমাটি সাহিত্য জলসায় যেন শুধুই একজন শ্রোতা। যেমন নিঃশব্দে আসেন তেমনি নিঃশব্দে চলে যান। সেই আড্ডায় কত জন কত রকম আলোচনা ররে। মন্তব্য করে। কিন্তু এই লোকটি কোনও আলোচনায়ই অংশ নেয় না।
বৈশাখ মাসের এক বিকালে হঠাৎ শুরু হল প্রচণ্ড কালবৈশাখী ঝড়। আর সেই ঝড়-জল ভেঙে সে দিনকার আড্ডায় উপস্থিত হল না কেউই। উপেন্দ্রনাথ কাছারি ঘর থেকে নেমে মাঝে মাঝেই উঁকি মেরে মেরে দেখতে লাগলেন, কেউ আসছে কি না। হঠাৎ রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখেন, দূরে একটি লণ্ঠনের আলো। সঙ্গে একটা ছায়ামূর্তি। ছায়ামূর্তিটি এসে হাজির হলেন তাঁর বৈঠকখানায়। আর তাঁকে দেখেই চমকে উঠলেন উরেন্দ্রনাথ। আরে এ যে বিভূতিভূষণ!
তার পর একেবারে পেছনের বেঞ্চে গিয়ে বসলেন তিনি। উপেন্দ্রনাথ বললেন, এ কী, আপনি পেছনে বসলেন কেন? তিনি বললেন, আরও অনেকে আসবেন তো, আমি কী করে সামনের বেঞ্চে গিয়ে বসি! উপেন্দ্রনাথ বললেন, ঝড় জল ভেঙে আজকে মনে হচ্ছে আর কেউ আসবে না। আসুন, আপনি সামনের চেয়ারটায় এসে বসুন। নানা রকম গল্পগুজব করতে করতে উপেন্দ্রনাথ হঠাৎ তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, তা আপনার কবিতা কিংবা গল্প-উপন্যাস লেখার বাতিক-টাতিক আছে না কি কিছু?
বিভূতি বললেন, না তেমন কিছু নয়, তবে একটা উপন্যাস লিখেছি। কিন্তু লেখাটি আদৌ পড়ার মতো কিছু হয়েছে কি না, বুঝতে পারছি না। উপেন্দ্রনাথ বললেন, তা হলে উপন্যাসের খাতাটি একবার নিয়ে আসুন। দেখি, কেমন লিখেছেন।
এ ঘটনার কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি তাঁর পথের পাঁচালী উপন্যাসের পাণ্ডুলিপিটা দিয়ে এলেন উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে। একদিন-দু’দিন করে কেটে গেল পুরো দুটো মাস। কিন্তু উপেন্দ্রনাথ তাঁকে কিছুই বলেন না। বিভূতিভূষণও মনে মনে ভাবেন, তা হলে তাঁর উপন্যাস কি আদৌ কিছু হয়নি!
হঠাৎএকদিন মজলিস শেষ করে একে একে সবাই যখন উঠে চলে যাচ্ছেন, ঠিক সেই মুহূর্তে উপেন্দ্রনাথ বিভূতিভূষণকে বললেন, আপনি যাবেন না। আপনার সঙ্গে একটু কথা আছে। সাহিত্য আসর থেকে সবাই চলে যাওয়ার পরে উপেন্দ্রনাথ বিভূতিকে বললেন, ভাই আপনার হবে। হবে বলছি কেন? আপনার হয়েছে। কী এক অসাধারণ উপন্যাস লিখেছেন আপনি। পড়েই মনপ্রাণ দুটোই জুড়িয়ে গেছে আমার। যা হোক এ বার আসল কথা বলি, আমি ভাগলপুরে আর থাকছি না। কলকাতায় চলে যাচ্ছি। তবে আমার কলকাতায় যাওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে সেখান থেকে একটি পত্রিকা বের করব ‘বিচিত্রা’ নামে। সেখানেই আমি ছাপাব আপনার এই উপন্যাসটি। আপনার এই উপন্যাস দিয়েই যাত্রা শুরু করবে ‘বিচিত্রা’ পত্রিকাটি।
এর কিছু দিনের মধ্যেই কলকাতা থেকে প্রকাশিত হতে শুরু করল বিচিত্রা পত্রিকাটি এবং বিভূতিভূষণের উপন্যাসও কিস্তিতে কিস্তিতে বের হতে লাগল। উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাঠক মহলে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল, কে এই লেখক? যে এত দরদ দিয়ে সমাজ ও দেশ গ্রামের তুচ্ছ তুচ্ছ জিনিসগুলো এত মনোমুগ্ধ করে তাঁর লেখনীতে ফুটিয়ে তুলেছেন?
হঠাৎ একদিন সে-সময়কার বিখ্যাত পত্রিকা ‘শনিবারের চিঠি’র সম্পাদক সজনী কান্ত দাস অনেক খোঁজাখুঁজি করে অবশেষে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে গিয়ে হাজির হলেন। নব্বই টাকা তাঁর হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন, বিভূতিবাবু আপনি যদি অনুমতি দেন, তবে পথের পাঁচালী উপন্যাসটি বই আকারে আমি ছাপব।
এর পর বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথ চলা কেউ আর থামাতে পারেনি। দু’হাতে লিখেছেন এবং যা লিখেছেন মোটামুটি সবই বিখ্যাত হয়েছে। বিভূতিভূষণ জন্ম ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর। পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনার কল্যানীর কাছে ঘোষপাড়া অঞ্চলের মুরারীপুর গ্রামে। তাঁর মামার বাড়িতে।|তাঁর পৈত্রিক বাড়ি ছিল ঝারখন্ডের ব্যারাকপুরে। বাবার নাম মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মায়ের নাম মৃনালিনী দেবী | তাঁদের ছিল পাঁচটি সন্তান। তার মধ্যে বিভূতিভূষণই ছিলেন সব থেকে বড়।
তাঁর বাবা ছিলেন সংস্কৃতের একজন প্রখ্যাত পণ্ডিত। সংস্কৃতে তাঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্বের জন্য তাঁকে শাস্ত্রী উপাধিতে ভূষিত করা হয়। বিভূতিভূষণ তাঁর বাবার কাছেই প্রথম পড়াশোনা শেখেন এবং নিজের গ্রাম আর আশপাশের গ্রামের বেশ কয়েকটা পাঠশালা থেকেও তিনি প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। এর পর তিনি ভর্তি হন বনগ্রাম উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে। সেখানে তিনি একজন অবৈতনিক শিক্ষার্থী হিসাবেই পড়াশোনা করেন।
ছোটবেলা থেকেই নিজের পড়াশোনার ব্যাপারে তিনি ছিলেন ভীষণ মনোযোগী। সে জন্যই পরে তিনি হয়ে ওঠেন ক্লাসের সব চেয়ে মেধাবী ছাত্র।
কিন্তু তিনি যখন ক্লাস এইটে পড়েন, তখন হঠাৎই কয়েক দিনের রোগে ভুগে তাঁর বাবার মৃত্যু হয়। তবু ছোট্ট বিভূতিভূষণ নিজের পড়াশোনা কিন্তু চালিয়েই যেতে লাগলেন। ১৯১৪ সালে এনট্রান্স পরীক্ষায় তিনি ফার্স্ট ডিভিশন পাস করেন এবং ভর্তি হন রিপন কলেজে। যেটা এখন সুরেন্দ্রনাথ কলেজ।
সেখানেও তিনি আই. এ পরীক্ষায় ফার্স্ট ডিভিশন পান এবং ১৯১৮ সালে একই কলেজ থেকে বি.এ পরীক্ষায়ও ডিস্টিইংশন-সহ পাশ করেন। এর পর তিনি আবার আইন নিয়ে পড়ার জন্য ভর্তি হন কিন্তু কোর্সের মাঝপথে আর্থিক কারণে তাঁকে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হয়।
এর পরে তিনি প্রথমে হুগলির জাঙ্গীপাড়ার দ্বারকানাথ উচ্চবিদ্যালয়ে এবং পরে সোনারপুরের হরিনাভির একটি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। দ্বারকানাথ উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ানোর সময় ১৯১৯ সালে বসিরহাটের মোক্তার, শ্রীকালীভূষণ মুখোপাধ্যায়ের মেয়ে গৌরী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। কিন্তু বিয়ের ঠিক এক বছর পরেই গৌরী দেবী মারা যান। তার প্রায় কুড়ি বছর পরে তাঁর পরিবারের লোকেরা, ১৯৪০ সালের ৩রা ডিসেম্বর, বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার ছয়গাঁওয়ের ষোড়শীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে রমা দেবীর সঙ্গে তাঁর আবার বিয়ে দেন। সেই বিয়ের সাত বছর পরে অবশেষে তাঁর একটা ছেলে হয়— তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।
তার বহু আগেই অবশ্য তিনি লেখালিখি শুরু করেন। ১৯২১ সালে ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় তাঁর প্রথম গল্প ‘উপেক্ষিতা’ প্রকাশিত হয়। তিনি যখন ভাগলপুরে থাকতেন, তখন তিনি ‘পথের পাঁচালী’ লেখা শুরু করেন, ১২৯৫ সালে। এটা আসলে নিশ্চিন্দীপুর গ্রামকে কেন্দ্র করে অপু আর দুর্গাকে নিয়ে লেখা একটি উপন্যাস। লেখাটা শেষ হয় ঠিক তিন বছর পরে। অর্থাৎ ১৯২৮ সালে। এটাই তাঁর লেখা সব চেয়ে সেরা উপন্যাস।
‘পথের পাঁচালী’র পরের অংশের নাম— অপরাজিতা। এই উপন্যাসে আছে অপুর কলকাতা-সহ বিভিন্ন অঞ্চলের জীবন যাপন, অপর্ণার সঙ্গে বিয়ে এবং স্ত্রীর মৃত্যুর পর ছেলে কাজলকে নিয়ে ফিরে আসার ঘটনা।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই দুটো উপন্যাসেই তাঁর নিজের ব্যক্তিগত জীবনের বেশ খানিকটা আভাস পাওয়া যায়।
সত্যজিৎ রায় এই পথের পাঁচালী’ দিয়েই তাঁর চলচ্চিত্র পরিচালকের জীবন শুরু করেন। আর এই ছায়াছবির জন্যই ১৯৯২ সালে তিনি অস্কার পান। আর এই উপন্যাসটি ভারতের বিভিন্ন ভাষায় তো বটেই, ইংরেজি এবং ফরাসি ভাষাতেও অনূদিত হয়েছে।
এর পরেই তাঁর সব চেয়ে জনপ্রিয় উপন্যাস— চাঁদের পাহাড়। মূলত অ্যাডভেঞ্চার বিষয়ক কাহিনি। আফ্রিকার আমাজন জঙ্গলের উপর ভিত্তি করে লেখা। শঙ্কর নামের একটি বাঙালি ছেলের আফ্রিকায় কাজের উদ্দেশ্যে যাওয়া। সেখানে আলভারেজের সঙ্গে আলাপ। সেই সঙ্গে বুনিপের আক্রমণ এবং শেষে হিরের খনির খোঁজ। সব মিলিয়ে এক অসাধারণ কাহিনি
এ ছাডাও তিনি লিখেছেন—
উপন্যাস
পথের পাঁচালি (১৯২৯) / অপরাজিত (১ম ও ২য় খণ্ড, ১৯৩২) / দৃষ্টিপ্রদীপ (১৯৩৫) / আরণ্যক (১৯৩৯) / আদর্শ হিন্দু হোটেল (১৯৪০) / বিপিনের সংসার (১৯৪১) / দুই বাড়ি (১৯৪১) / অনুবর্তন (১৯৪২) / দেবযান (১৯৪৪) / কেদার রাজা (১৯৪৫) / অথৈজল (১৯৪৭) /ইছামতি (১৯৫০) / অশনি সংকেত (অসমাপ্ত, বঙ্গাব্দ ১৩৬৬) / দম্পতি (১৯৫২)।
গল্প-সংকলন
মেঘমল্লার (১৯৩১) / মৌরীফুল (১৯৩২) /যাত্রাবাদল (১৯৩৪) / জন্ম ও মৃত্যু (১৯৩৭) / কিন্নর দল (১৯৩৮) / বেণীগির ফুলবাড়ি (১৯৪১) / নবাগত (১৯৪৪) / তালনবমী (১৯৪৪) / উপলখন্ড (১৯৪৫) / বিধুমাস্টার (১৯৪৫) / ক্ষণভঙ্গুর (১৯৪৫) / অসাধারণ (১৯৪৬) / মুখোশ ও মুখশ্রী (১৯৪৭) / আচার্য কৃপালিনী কলোনি (১৯৪৮; ১৯৫৯ সালে ‘নীলগঞ্জের ফালমন সাহেব’ নামে প্রকাশিত) / জ্যোতিরিঙ্গণ (১৯৪৯) / কুশল-পাহাড়ী (১৯৫০) / রূপ হলুদ (১৯৫৭,মৃত্যুর পর প্রকাশিত) / অনুসন্ধান (১৯৬০,মৃত্যুর পর প্রকাশিত) / ছায়াছবি (১৯৬০,মৃত্যুর পর প্রকাশিত) /সুলোচনা (১৯৬৩)।
কিশোরপাঠ্য
চাঁদের পাহাড় (১৯৩৮) / আইভ্যানহো (সংক্ষেপানুবাদ, ১৯৩৮) / মরণের ডঙ্কা বাজে (১৯৪০) / মিসমিদের কবচ (১৯৪২) / হীরা মাণিক জ্বলে (১৯৪৬) / সুন্দরবনের সাত বৎসর (১৯৫২)।
ভ্রমণকাহিনি ও দিনলিপি
অভিযাত্রিক (১৯৪০) / স্মৃতির রেখা (১৯৪১) / তৃণাঙ্কুর (১৯৪৩) / ঊর্মিমুখর (১৯৪৪) / বনে পাহাড়ে (১৯৪৫) / উৎকর্ণ (১৯৪৬) / হে অরণ্য কথা কও (১৯৪৮)।
অন্যান্য
বিচিত্র জগত (১৯৩৭), টমাস বাটার আত্মজীবনী (১৯৪৩), আমার লেখা (বঙ্গাব্দ ১৩৬৮), প্রবন্ধাবলী পত্রাবলী দিনের পরে দিন। এই লেখালিখির জন্যই ১৯৫১ সালে ‘ইছামতী’ উপন্যাসের জন্য তিনি রবীন্দ্র পুরস্কার পান। অবশ্য সেই পুরস্কারপ্রাপ্তি তিলি তাঁর জীদ্দশায় পাননি। পুরস্কার পাওয়ার অনেক আগেই ১৯৫০ সালের ১ সেপ্টেম্বর, (১৭ই কার্তিক ১৩৫৭, বঙ্গাব্দ, বুধবার) হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঝাড়খন্ডের ঘাটশিলায় তিনি পরলোক গমন করেন।