ব্যবসার জন্য বই কিনতে বেরিয়ে উইলফ্রিড ভয়নিচের চোখে পড়ে যায় একটি অদ্ভুত হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি। হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে দেখার পরেই কৌতূহলী হয়ে ওঠেন তিনি। কারণ ভয়নিচ নিজে অনেকগুলো ভাষায় পারদর্শী হলেও এই বইয়ের লেখা তিনি প্রায় কিছুই পড়তে পারছেন না। এমনকী, এ রকম বর্ণমালা এর আগে তিনি কখনও চোখেই দেখেননি। তাই দেরি না করেই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে চুক্তি করে বেশ কিছু পাণ্ডুলিপির সঙ্গে এই পান্ডুলিপিটিও বিপুল অর্থ দিয়ে কিনে নেন উইলফ্রিড ভয়নিচ। নগদ অর্থ দিয়ে কিনলেও বিক্রেতার শর্ত ছিল একটাই, এগুলো তিনি বাইরে প্রকাশ করতে পারবেন না।
ভয়নিচও রাজি হয়ে যান এবং চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ইউরোপে যত দিন ছিলেন ভয়নিচ কখনও পাণ্ডুলিপির কথা কাউকে বলেননি। বাড়ি এসে বইটি উলটেপালটে দেখছিলেন তিনি। হঠাৎ বইয়ের ভেতর থেকে একটি খাম মাটিতে পড়ে যায়। সামনের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন ভয়নিচ। এই চিঠিটা আবার কার?
এক দিকে অচেনা বর্ণমালার গোলকধাঁধা, অন্য দিকে খামে ভরা একটি রহস্যময় চিঠি। পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম অমীমাংসিত রহস্য তখনই গড়ে ওঠে এই ভয়নিচ পাণ্ডুলিপিকে কেন্দ্র করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ভয়নিচ সপরিবারে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে যাওয়ার পর তিনি বেশ কয়েক জন বিশেষজ্ঞকে তাঁর পাণ্ডুলিপির কথা জানান। তাঁরা ভীষণ কৌতূহলী হয়ে ওঠেন। শেষ পর্যন্ত বইটি কেনার প্রায় ৯ বছর পরে ১৯২১ সালে ফিলাডেলফিয়ার College of Physicians of Philadelphia-এর একটি সভায় তিনি সেই পাণ্ডুলিপিটি প্রদর্শন করেন। আর তার পর থেকেই একে নিয়ে শুরু হয়ে যায় গবেষণা। বিশ্বের তাবড় তাবড় বিজ্ঞানী, ইতিহাসবিদ, ভাষাবিদেরাও নেমে পড়েন পাঠোদ্ধারের কাজে
কিন্তু এই পাণ্ডুলিপি আবিষ্কারের শতবর্ষ পার হতে চললেও এখন পর্যন্ত এই বইটির পাঠোদ্ধার করতে সক্ষম হননি কেউই। কেউই পড় উঠতে পারেননি অদ্ভুত হরফে লেখা এই ভয়নিচের বইটি।
যেহেতু ভয়নিচের হাত ধরেই এই পাণ্ডুলিপিটি প্রকাশ্যে এসেছিল, তাই তাঁর নামানুসারেই বইটির নাম হয়ে যায়— ভয়নিচ পাণ্ডুলিপি
পাণ্ডুলিপির ইতিহাসে সব চেয়ে বেশি আলোচিত পাণ্ডুলিপিগুলোর মধ্যে এই পাণ্ডুলিপিটি নিঃসন্দেহে প্রথম পাঁচটির মধ্যে একটি।
এটি মধ্যযুগে লেখা হলেও অন্যান্য বই থেকে এটাকে আলাদা করা হয়েছে এর লেখার ধরন এবং বর্ণমালার দুর্বোধ্যতার জন্য।
চামড়া দিয়ে বাঁধাই করা এই বইটির মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৩৪টি পাওয়া গেলেও, গবেষকেরা মনে করেন, লোকচক্ষুর সামনে আসার অনেক আগেই এই বইটির বেশ কিছু পাতা হারিয়ে গেছে।
যে বর্ণমালা দিয়ে এই পাণ্ডুলিপিটি লেখা, পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষাবিদেরা অনেক গবেষণা করেও এর অস্তিত্ব বের করতে পারেননি। এমনকী, আধুনিক কম্পিউটারের সাহায্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েও এই বর্ণমালার সঙ্গে মিল আছে এমন কোনও বর্ণমালারও হদিস পাওয়া যায়নি।
এই পাণ্ডুলিপিতে এখনও পর্যন্ত প্রায় ১৭ হাজার ধরনের বর্ণের সন্ধান পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও হাতে আঁকা বিভিন্ন ছবি বইটিকে আরও রহস্যময় করে তুলেছে।
আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে পাণ্ডুলিপিটির ৪টি পৃষ্ঠা নিয়ে কার্বন ডেটিং করা হয়। তাতে বোঝা যায়, এটি ১৪০০ খ্রিস্টাব্দে লেখা। পাণ্ডুলিপিটি লেখার জন্য বিভিন্ন রকমের কালি ব্যবহার করা হলেও, সেই কালির মধ্যে বড় রকমের কোনও পার্থক্য নেই।
ওই সময়ে লেখা অন্যান্য বইয়ের মতো এই বইটির শুরুতেও লেখকের নাম বা স্বাক্ষর নেই। তাই এই বইটির প্রকৃত লেখকের নামও আজও উদ্ধার করা যায়নি। আর বইয়ের ভেতর থেকে বেরোনো সেই চিঠি? খামের উপর প্রেরক ও প্রাপকের নাম-ঠিকানা থেকে জানা যায়, ওই পাণ্ডুলিপি-সহ চিঠিটি ১৬৬৫ সালে বিজ্ঞানী জোয়ানাস মার্কাস মার্সি পাঠাতে চেয়েছিলেন তাঁর ইতালির বন্ধু আথানাসিয়াস কার্চারকে। চিঠিতে তিনি এই বইয়ের অর্থ বের করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন
ভয়নিচ পাণ্ডুলিপির মূল রহস্য এই বইয়ের পাতায় লেখা অক্ষরগুলো। যেহেতু এক অজানা ভাষায় লেখা হয়েছে পুরো বইটি, তাই বিজ্ঞানীরা ধরে নেন, এগুলো আসলে সাংকেতিক বর্ণ। প্রতিটি পৃষ্ঠায় ২/৩ টি করে অনুচ্ছেদ রয়েছে।
এর পরের রহস্য— এর বইয়ের মধ্যে আঁকা বিভিন্ন ছবিগুলো। হাতে আঁকা এ সব ছবি দেখে একবার মনে হয়, এটা কোনও বিজ্ঞানীর নোটখাতা। আবার কয়েক পৃষ্ঠা উলটালেই মনে হয় এটা কোনও জ্যোতিষীর ভাগ্যগণনার সহায়িকা।
কিছু কিছু পাতায় আবার বৃত্ত, অর্ধবৃত্ত, ত্রিভুজ ইত্যাদি জ্যামিতিক নকশায় গুটি গুটি অক্ষরে কিছু লেখা রয়েছে। শেষের দিকের পৃষ্ঠাগুলোয় আবার লেখা হয়েছে জাপানীদের মতো লম্ব ভাবে।
সম্প্রতি ভাষাবিদরা জানান, বইটির বেশ কিছু বর্ণে গ্রিক বর্ণমালার ছাপ পাওয়া গেছে। কিন্তু বেশির ভাগ বর্ণমালা দেখতে প্রাচীন রসায়নবিদদের ব্যবহৃত বিভিন্ন চিহ্নের মতো। প্রাচীনকালে পাওয়া পাণ্ডুলিপিগুলোর মধ্যে প্রায়ই দেখা যায় বাক্যে বানান ভুলের কারণে মাঝে মাঝেই কেটে দিয়ে সংশোধন করার চল ছিল। কিন্তু এই রহস্যময় বইটিতে ভুলের সংখ্যা একেবারেই শূন্য! মানে লেখার পরে একটি বাক্যও সংশোধন করতে হয়নি লেখককে।
এর পর রয়েছে ছবি। ফুল, ফল, পাতা, মানুষ, চিহ্ন-সহ আঁকা ছবিগুলোকে গবেষকরা ৭টি বিভাগে ভাগ করেছেন— ভেষজ, জ্যোতির্বিদ্যা, মহাজাগতিক বস্তু, রাশিচক্র, জীবজগৎ, সাংকেতিক চিহ্ন এবং চিকিৎসা বিষয়ের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত ছবিও রয়েছে।
কিছু কিছু ছবির সঙ্গে জুড়ে দেওয়া আছে সংক্ষিপ্ত পরিচিতিও। তবে অবাক করা ব্যাপার হল, এই পাণ্ডুলিপির মধ্যে চিনের পৌরাণিক প্রাণী ড্রাগনের ছবিও পাওয়া গেছে।
দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করার পরেও পাঠোদ্ধারে তেমন কোনও আশানুরূপ অগ্রগতি না হওয়ায়, অনেকেই হাল ছেড়ে দেন। কয়েক জন বিজ্ঞানী বলেন, এটি অর্থলাভের আশায় ভয়নিচের বানানো একটি তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয়।
একটা সময় সবাই এটা মেনেও নিয়েছিলেন। কিন্তু লন্ডনের কিলি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতবিদ গর্ডন রাগ নতুন এক তত্ত্ব প্রকাশ করেন। তিনি ভয়নিচের আদলে আরেকটি সাংকেতিক ভাষা তৈরি করে সেই অনুযায়ী বাক্য রচনা করে দেখান। তিনি গাণিতিক উপায়ে প্রমাণ করেন, ভয়নিচ পাণ্ডুলিপি অর্থবোধক হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।
সংখ্যা কখনও মিথ্যা বলে না। তাই বিজ্ঞানীরা আর আগের মতো এক কথায় একে ‘ভুয়া’ বলে উড়িয়ে দিতে পারছেন না।
ভয়নিচ ১৯৩০ সালে যখন মারা যান তখন পর্যন্ত তিনি কিন্তু মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, এই বইয়ের লেখক বিখ্যাত দার্শনিক রজার বেকন।
যদিও ভয়নিচের মৃত্যুর পরে কলা বিশেষজ্ঞ এরউইন পেনফস্কি বইয়ের পৃষ্ঠা পরীক্ষা করে তাঁর ধারণা যে ভুল, সেটা প্রমাণ করেন। কারণ, এ ধরনের পৃষ্ঠা ব্যবহার শুরু হওয়ার অনেক আগেই রজার বেকন এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যান।
সত্যিই যদি বেকন বইটির লেখক না হন, তা হলে কে? এ ক্ষেত্রে রাফায়েল নিশোভস্কিকে এগিয়ে রাখেন গবেষকরা। তিনি ছিলেন জোয়ানাস মার্সির ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাঁর জীবদ্দশায় তিনি একবার দাবি করেছিলেন যে, তিনি এমন একটি সাংকেতিক ভাষা আবিষ্কার করেছেন, যা কখনই কেউ বুঝতে পারবে না।
কথিত আছে, বইয়ের লেখক হিসেবে রজার বেকনের সম্ভাবনার কথা তিনিই প্রথম তুলে ধরেন মার্সির কাছে। গবেষকরা মনে করেন, রাফায়েল তাঁর সাংকেতিক ভাষার সাহায্যে পাণ্ডুলিপিটি রচনা করেন এবং তাঁর সাংকেতিক ভাষার অভেদ্যতা পরীক্ষার জন্য বিষয়টি গোপন রাখেন। এ ছাড়াও অনেকের মতে, এই বইয়ের লেখক কোনও ইহুদি চিকিৎসক।
এই বইয়ের লেখক যিনিই হোন না কেন, এর পাঠোদ্ধার কিন্তু এখনও পর্যন্ত কেউই করতে পারেননি। এমনকী গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই এবং সিআইএ-র কর্মকর্তারাও পুরোদস্তুর নেমে পড়েছেন এই গবেষণায়।
ইতিমধ্যেই ভয়নিচ পাণ্ডুলিপি নিয়ে কয়েকশো গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে।
বিভিন্ন প্রথিতযশা সাহিত্যিক পাণ্ডুলিপির রহস্য নিয়ে রচনা করেছেন অসংখ্য কল্পকাহিনি। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হল— রবিন ওয়াসারম্যান এর ‘Book of Blood and Shadow’, জোনাথান মেবেরির ‘Assasin’s Code’ এবং মাইকেল কর্ডির ‘The Source’। যেগুলো পাঠকদের দ্বারা বহুল প্রশংসিত এবং বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত।
এই পাণ্ডুলিপি এতটাই সাড়া ফেলে দিয়েছিল যে, যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যায়ের উদ্যোগে ২০০৪ সালে এই রহস্যময় বইটির সম্পূর্ণ চিত্র অনুলিপি প্রকাশিত হয়। এর ফলে পৃথিবীর যে কেউ ইন্টারনেটের মাধ্যমে খুব সহজেই পুরো পাণ্ডুলিপিটি ব্যক্তিগত ভাবে অনায়াসে সংগ্রহ করতে পারেন।
প্রচুর হাতবদল হয়ে এবং অজস্র মালিকানা বদল হওয়ার পরে এখন মূল ভয়নিচের পাণ্ডুলিপিটির স্থান হয়েছে কলেজিও রোমানোর জাদুঘরে।