পর্ব – তিন: কাঁকড়ার চোখে এলইডি স্ক্রিন
অর্ণব আবিষ্কার করল প্রায় একশ আট ফুট লম্বা এক নীল তিমির কংকাল। কংকালের পেটের ভেতর থেকে উপরের দিকে উঠে গেছে আনুমানিক পঁচিশ ফুট লম্বা এক সিঁড়ি। সিঁড়ির ধাপ বেয়ে ও উপরের দিকে উঠতে চাইল। প্রথমে ভেবেছিল সিঁড়ি ভার বহন করতে পারবে না। উঠবে কী উঠবে না দ্বিধায় ভুগে উঠতে লাগল উপরে। না, ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ল না কঙ্কালের হাড়গোড়। প্রতিটি ধাপে পা ফেলে উপরের ধাপে হাত দিয়ে চেপে ধরে ও উঠতে লাগল ওপরে। কংকালের পেটের ভেতর থেকে বাইরে আসার সময় একটুও ভয় পেল না অর্ণব। বাইরে আসার সফলতায় আনন্দও পেল না মনে।
আনন্দ-ভয় টের না পেয়ে ও দেখল নীল পানির জগৎ- স্রোতহীন স্থির পানির জগতে চারপাশে প্রবালের মতো ঝাঁক। আর গভীর জলের তলে ধূসর সবুজের এক প্রাণিজগৎ। প্রবালসৃদশ এই ঝাঁককে জীবন্ত পাথর মনে হলো।
বোঝার সুযোগ ঘটল যখন ও দেখল একটা নাম না-জানা ছোট মাছ লেজ নাড়তে নাড়তে সতর্ক দৃষ্টিতে এগোতে গিয়ে ভিড়ল প্রবালসম স্তূপের পাশে। আচমকা স্তূপের দেহের মধ্য থেকে লতার মতো অসংখ্য প্রবাল-আঙুল ছড়িয়ে গেল মাছটির চারপাশে। ফেনার মতো আঠাল পদার্থ ছড়িয়ে গেল মাছটির চারপাশে। সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেল মাছটির নড়াচড়া। ধীরে ধীরে জীবন্ত মাছটি নিথর হয়ে ঢুকে গেল প্রবাল-দেহের ভেতর।
দৃশ্যটি দেখেও চমকে উঠল না অর্ণব। তবে মাছটির চোখের ভাষা পড়তে পেরেছিল। মনে হচ্ছিল একবার করুণ চোখে সেটি চেয়েছিল তার চোখের দিকে। চোখের উজ্জ্বল আলো ক্রমশ ম্লান হয়ে যখন আঁধার হয়ে গেল- বুঝতে পারছিল উদ্ধারের জন্য আকুল আবেদন জানিয়েছিল নাম না-জানা অচেনা মাছটি। বিপদগ্রস্ত মাছের করুণ মিনতি টের পেয়েও উদ্ধারের কোনো প্রণোদনা টের পায়নি অর্ণব। কেবল তাকিয়েছিল পাথরের মতো। তবে নিজেকে পাথর হিসেবে আবিষ্কার করতে পারল না। পাথরের অস্তিত্ব আছে কিনা দেহের অণুতে, অণুর ভেতর চলমান রাসায়নিক কারখানায় বিক্রিয়া ঘটছে কিনা, কিছুই টের পেল না অর্ণব। ফুসফুসের ভেতর বাতাস ঢোকা এবং বেরুনোর কোনো অনুভবও টের পাচ্ছে না- হৃৎপিণ্ডের অনবরত গেয়ে যাওয়া লাপডাপ শব্দেরও অস্তিত্ব খুঁজে পাচ্ছে না ও।
বাস্তবের মায়াময় গিঁট খুলে কোনো স্বপ্নসাগরে ঢুকে গেছে নিজে―এমনটিই ভাবল ও। ওর আরও মনে হলো আলো ঝলমলে সত্যের ভাঙা স্রোতে ভেসে পালিয়ে এসেছে নীলসমুদ্রের তলদেশে, অন্য জগতে।
প্রশ্ন জাগছে মনে। প্রশ্নের আড়ালে কোনো অনুভব-অনুভূতি জাগছে না। প্রশ্নের মালা গেঁথে কংকালের সিঁড়ির শেষ ধাপ পেরিয়ে উঠে এলো ভাঙা দালানের বিশাল পিলারের মতো তিমির পিঠের শিরদাঁড়ার ওপর। ধীর পায়ে হেঁটে হেঁটে এগোতে লাগল মাটির সঙ্গে মেশানো লেজ বেয়ে। মাটিতে পা দিয়ে চমকে উঠল ও। ঝুরঝুর করে সরে যাচ্ছে পানির তলে সাজানো সাদামাটির ঢেউ, সমুদ্র ঢেউয়ের আদলে মাটির ঢেউয়ের মধ্যেও রয়েছে সুশৃঙ্খল সারি। নিচু থেকে উঁচু ঢেউ এগিয়ে গেছে সামনের ঢেউ খেলানো পাহাড়ের দিকে। পাহাড়গুলো পাউডারের জমাট অস্তিত্বের মতো শক্ত মনে হলেও পা বসে যাচ্ছে মাটির ঢেউয়ের তটে। কোনো কোনো ঢেউয়ের মাটি লাল, কোনো কোনোটি গোলাপি, বেগুনি আর সাদা ঢেউয়ের পাহাড়ও রয়েছে সামনে। বেগুনি পাহাড়ের সবুজ প্রাণিজ উদ্ভিদের আড়ালে তেলাপিয়া মাছের আকৃতির দুটো মাছ পেটের সঙ্গে পেট লাগিয়ে আটকে আছে একের মধ্যে অন্যে। নারী মাছটির কানের পাশে দুলছে লেজের মতো লাল পাখনা। আর পুরুষ মাছটির কানের পাখনা ধূসর। একবারও নড়ছে না। স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে। গোল চোখের ভেতর কালো মণির বদলে রয়েছে লাল মণি। লালের মধ্যে গোলাকারে বসে আছে সাদা টিপ। লাল আর সাদার বিকিরণে থমকে গেল অর্ণব। স্থির চোখে তাকিয়ে রইল ও। মনের তারে বেজে উঠল- জৈবিক ক্রিয়া সব ক্ষেত্রে একই রকম। সৃষ্টির অপূর্ব সুন্দর এ শৈল্পিক কাজটিকে অশ্লীল বলে কেন মানুষ- বুঝতে পারল না অর্ণব। তবে মনে কোনো বিস্ময় জাগল না, আনন্দও না। ও কেবলই দেখেই যাচ্ছে রোবটের মতো- এ-ই যা।
বর্ণিল অথচ ঢেউ খেলানো পাহাড় বেয়ে হাঁটতে গিয়ে পায়ের দিকে চোখ গেল তার। একটা লাল কাঁকড়া তার অসংখ্য পায়ের অগ্রভাগের কাঁচির মতো দু ফালি ধারাল দাঁত দিয়ে খামচে ধরেছে অর্ণবের পায়ের পাতার উপরের ত্বক। ব্যথা পাওয়ার কথা, রক্ত ঝরার কথা, এমন আক্রমণে পা ঝাটকা দিয়ে কাঁকড়াটিকে ছুড়ে মারার কথা। তেমন স্বাভাবিক কোনো আচরণই করল না ও। কেবল তাকাল মার্বেলের মতো ঘূর্ণায়মান কাঁকড়ার লালচোখা-মণির দিকে। মনে হলো কিছু বলতে চায় অদ্ভুত কাঁকড়াটি। কী কথা বলবে ওটা? মনে প্রশ্ন জাগলেও জিজ্ঞাসু শব্দ বেরুল না অর্ণবের কণ্ঠ থেকে। মনে হলো ও হারিয়ে ফেলেছে মুখের ভাষা। অনুভব-অনুভূতির কেন্দ্রে ছোট-বড় কোনো ঢেউ টের পাচ্ছে না ও। পায়ে কামড় দিয়ে কী কথা জানান দিতে চায় কাঁকড়াটি? প্রশ্নভরা চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল ও। খুব কাছ থেকে এবার তাকাল কাঁকড়ার চোখের লাল মণির দিকে। বিস্ময়ে নড়ল না, অনুভূতির ঢেউ উঠল না মনে- কেবল নিথর চোখে তাকিয়ে রইল অর্ণব। কাঁকড়ার চোখকে আর চোখ মনে হলো না। এক বড় এলইডি স্ক্রিনে ও এখন দেখতে পেল অনন্য এক জগৎ। কখনও এমন জগতে পরিভ্রমণ করেছে, বিচরণ করেছে, কাটিয়েছে আনন্দময় কিংবা নিরাপত্তাহীন সময়- মনে পড়ল না ওর।
উদিত ভাবনা কোনো বিক্রিয়া ঘটাল না মস্তিষ্কে- নাড়া খেল না মন, কেবল তাকিয়ে রইল থ্রিজি এলইডি স্ক্রিনের দিকে…
চলবে…