বনভূমে ডেকে ওঠা শেয়ালটি বোধকরি মুরগীর ঘ্রাণ পেয়ে কুটিরের কাছে এসেছিল। কিন্তু মুরগী পাবে কোথায়? সেগুলো ততক্ষণে মানুষের পেটের খোঁয়াড়ে চালান হয়ে গেছে। রাতের আহার শেষ হলে বাকি থাকে কবি হাফিজ রশিদ খানের জন্মদিন পালন। এ উপলক্ষকে সামনে রেখেই আমরা কবি ও গায়কদল মহেশখালীর সর্বদক্ষিণে সোনাদিয়া দ্বীপে এসেছি। আমি ভেবেছি বিদ্যুৎহীন একটি বনকুটিরে কী করে এ অনুষ্ঠান হবে? আয়োজকরা তা বহুআগেই ভেবে রেখেছিল। তারা সঙ্গে এনেছে ৬০টি (যেহেতু ৬০তম জন্মদিন) মোমবাতি। তরুণ কবিগণ বনকুটিরের বারান্দাটি মোমবাতি দিয়ে সাজিয়ে ফেললো। বাইরের চাপকলের স্মৃতি ধরে রাখা চারপাশের বর্গাকার অনুচ্চ সিমেন্টের ঘেরাটোপটিও মোমশিখায় উজ্জ্বল হয়ে অনিন্দ্য হয়ে উঠল। বারান্দার পশ্চিমপ্রান্তে, যেখানে সিমেন্টের তৈরি লালবেদীটি রয়েছে, তার উপরে টাঙানো হলো ব্যানার। একপাশে কবির যুবক বয়সের সাদা ছবি, অন্যপাশে ‘আদিবাসী কবিতা সংগ্রহ’ বইটির সবুজ প্রচ্ছদ, মাঝে লেখা আদিবাসী কাব্যের স্রষ্টা, কবি ও প্রাবন্ধিক কবি হাফিজ রশিদ খানের ৬০তম জন্মদিনে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
৬০তম কথাটি একটি বৃত্তের ভেতর লেখা। নিচে লেখা দীপাঞ্চল সাহিত্য অঙ্গন, মহেশখালী। সেই ব্যানারের দুপ্রান্তে ঝুলিয়ে দেওয়া হলো সঙ্গে আনা ১০০টি বেলুনের যতগুলো মুখ দিয়ে ফোলানো সম্ভব হয়েছিল ততটি। সমুখের টেবিলে রাখা হলো কেক। প্যাকেটের ভেতর সেদ্ধ হওয়া কেকটিকে বের করে দেখা গেল সে তখনো অটুট, গরমে নরম হয়েছে সত্যি, কিন্তু ভাবগাম্ভীর্য অটুট রেখেছে। কেকের উপর লেখা শুভেচ্ছাবার্তাটি তার আয়তনের সীমাবদ্ধতার জন্য ব্যানারের মতো বিস্তৃত নয়, আর কেকের পিঠ ব্যানার হতে যাবে কেন? খয়েরি চকলেটের উপর সাদা ভ্যানিলায় লেখা ‘৬০তম শুভ জন্মদিন কবি হাফিজ রশিদ খান ২৩/০৬/২১ ইং’ কথাটি। তরুণ কবিরা কেকের চারপাশে ছোট ছোট মোম জ্বালিয়ে একেবারে শিশুর জন্মদিন পালনের মতো বুড়ো খোকার জন্মদিনের আয়োজন করে ফেল্ল। যাকে ঘিরে আয়োজন তাকে একটু সলজ্জই দেখা গেল। প্রিন্টের সবুজ শার্ট খুলে সে পরেছে একটি সাদা টি-শার্ট, তার বুকে নিজেরি ছবি।
অথচ আজ সকালে হাফিজ রশিদ খানকে চট্টগ্রাম থেকে মহেশখালী আসতে দিতে চায়নি কবির স্ত্রী। সে তখন বলেছে, ‘আমার জন্য ঢাকা থেকে কামরুল ভাই এসে গেছেন, আমি না গেলে কী করে হয়?’ আমার যাওয়াটা তবে কবির কাজে লেগেছে। তাকে নিরুৎসাহিত করেছিল মহেশখালীর আরেক কবি। সেসব অতিক্রম করে সোনাদিয়া দ্বীপে এসে তিনি বিমোহিত। এই আয়োজন তাকে অতিবিস্মিত করে তুলেছে। আমরা কেকের ছবি তুললাম। কেকের ওপাশে কবিকে মধ্যে রেখে একপাশে জাহেদ সরওয়ার, অন্যপাশে আমি ও গোলাম সামদানী- বারোজনের দলে আমরাই সিনিয়র, দাঁড়ালাম। ঘড়ি মধ্যরাত পেরিয়েছে সামান্য আগে। ঠিক ১২ টা ১০ এ কেক কাটলেন কবি হাফিজ রশিদ খান, সমুখে মাইক্রোফোন হাতে দুই গায়ক জাহান এ বি ও শাফায়াত জামিল দিদার। জাহানের উপস্থাপনায় জন্মদিনের গান ধরলেন দিদার, ব্যান্ড শিল্পী শাফিন আহমেদের গান ‘আজ তোমার জন্মদিন’। নির্জন ও শব্দহীন বনকুটির ও তার পরিপার্শ্ব গানের সুরে ভরে উঠলো। মোবাইল থেকে গানের কথাগুলো, শিল্পীরা যেভাবে হারমোনিয়ামের উপর তাদের গানের খাতা খুলে রাখে, চরণ বিস্মৃত হলে একঝলক দেখে নেয়, তেমনি দেখে নেওয়া নয়, লম্বা গানটির পুরোটাই লাইন বাই লাইন দেখে আবেগের সাথে গাইলেন দিদার। তার কণ্ঠস্বর মিষ্টি। জাহান তাকে একটু সঙ্গত করল। গানটির মিউজিক মোবাইল থেকে ব্লুটুথের মাধ্যমে সঙ্গে আনা লাউডস্পিকারে বাজতে লাগল। ভারি শৈল্পিক এই জন্মদিন পালন। তরুণ কবিরা বারান্দার দুপাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে গানের সাথে করতালি দিচ্ছিল। এমনকি শিশুদের বার্থডে পার্টিতে যেমন ফোম স্প্রে করা হয়, তেমনি ফোম ঝরে পড়ল মাথার উপর। কয়েকটি আতশবাজি ছিল, সেগুলি জ্বালালে ষোলকলা পূর্ণ হতো, অজ্ঞাত কারণে তারা জ্বলল না। সবকিছু দেখেশুনে ষাট ছোঁয়া কবি বাকরহিত ও বিমুগ্ধ হয়ে রইলেন। তিনি এতটা আশা করেননি, আমরাও।
এরপরে অনুভূতি প্রকাশ। প্রথমেই কবি হাফিজ রশিদ খানের হাতে মাইক তুলে দিলেন জাহান এ, বি,। তিনি প্রথমেই তাঁর জন্মদিন পালনের এই অভূতপূর্ব আয়োজনটির প্রশংসা করে নিজের আনন্দ ও বিস্ময় প্রকাশ করলেন। তিনি মহেশখালীর তরুণ কবিদের প্রতি তার ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানালেন। এরপরে তাঁর আদিবাসী কাব্য লেখার পটভূমি সবাইকে জানালেন। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রতি সরকার ও সমতলের সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর মানুষদের সহনশীল ও মানবিক হতে আহবান জানালেন। তিনি জানালেন পাহাড়ের মানুষ সরল প্রকৃতির, তাদের চাহিদা বেশ কম, তারা অল্পে তুষ্ট। তারা এ অঞ্চলের আদিবাসী, হাজার বছর ধরে আছে অথচ আমরা যাই তাদের উৎস আর বসতির ইতিহাস জানতে, আমরা তাদের ভূমি দখল করি। তিনি বল্লেন, একজন কবির জীবনই তিনি কাটাতে চেয়েছেন, বিত্ত করেননি, অর্থ কষ্টেই কেটেছে তার জীবন। তাতে তিনি অখুশী নন।
আমার পালা এলে আমি বলি যে এই আয়োজনে তরুণ কবিদের যে আন্তরিকতা ও শ্রদ্ধা আমি প্রত্যক্ষ করলাম তাতে মনে করি এটি হাফিজ রশিদ খানের কবিজীবনে এক বড়ো প্রাপ্তি, বড়ো পুরস্কার। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবন ও সংস্কৃতিকে কাব্যে ধারণ করে তিনি বাংলা কবিতায় একটি নতুন ধারা সৃষ্টি করেছেন আর নিজের জন্য তৈরি করেছেন একটি স্বতন্ত্র অবস্থান। এ বিচারে তিনি একক ও মৌলিক। বিপণনের ভাষায় একে বলে niche marketing এবং unique value proposition (UVP)। হাফিজ রশিদ খান একটি জীবন উৎসর্গ করেছেন কবিতার বেদীতে। আদিবাসী মানুষদের প্রতি তাঁর সহমর্মিতা আন্তরিক ও ভালোবাসাসম্পৃক্ত। সবশেষে বলি, এই উৎসবে না এলে আমি হারাতাম অনেককিছু, কেননা এমন রাত্রি, এমন উপলক্ষ জীবনে বহুবার আসে না।
গোলাম সামদানি তার অভিব্যক্তি প্রকাশে করতে গিয়ে সরল স্বীকারোক্তি করলেন তিনি হাফিজ রশিদ খানের নাম শুনেছেন, কিন্তু তার সম্পর্কে তেমন কিছু জানতেন না। ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর জনগণ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী, তাদের নিয়ে দীর্ঘকাল কাজ করছেন হাফিজ রশিদ খান। এটা খুবই প্রশংসনীয়। বাঙালিদের ‘ভীতিকর প্রাণী’ হিসেবেই দেখে পাহাড়ি জনগণ। সেই ভয় কাটাতে, নৈকট্য বাড়াতে তিনি কাজ করছেন। হাফিজ রশিদ খানের প্রসঙ্গ ধরে তিনি বললেন একথা সুস্পষ্ট যে পাহাড়ি জনগণ ভালো, কেননা তারা অল্পেই তুষ্ট। লোভহীন জনগণকে ভালো না বলে, ভালো না বেসে উপায় নেই। তারা বাংলাদেশের মানচিত্রের অংশ।
সর্বশেষ অনুভূতি প্রকাশ করলেন জাহেদ সরওয়ার। সেটা নব্বই দশকের শেষভাগ, নতুন সহস্রাব্দ উঁকি দিচ্ছে মহাকালের দিগন্তে, তিনি কবিতা লিখতে শুরু করেছেন। হঠাৎ তার হাতে এলো ‘আদিবাসী কাব্য’। পড়ে মুগ্ধ হলেন। হাফিজ রশিদ খানের কবিতায় চাকমা, মারমা, মুরং, ম্রো প্রভৃতি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর শব্দ, উপমা, চিত্রকল্প দেখে মোহিত হলেন। তিনি স্বতোঃপ্রণোদিত হয়ে একটি রিভিয়্যু লিখলেন। সেটাই ছিল কাব্যটির প্রথম রিভিয়্যু। হাফিজ রশিদের কবিতায় তিনি সুফী মতাদর্শ খুঁজে পান। ইংরেজিতে যাকে বলে sublime poetry, হাফিজ রশিদ খানের কবিতা তাই।
বক্তৃতামালা শেষ হলে কখনো গান কখনো কবিতা পাঠ চলল। শাফায়াত জামিল দিদার গাইল মান্না দে গীত ‘সবাই তো সুখী হতে চায়, তবু কেউ সুখী হয় কেউ হয় না’। পরে সে গেয়েছিল কুমার বিশ্বজিৎয়ের গান ‘আমি নির্বাসনে যাব না। রশিদ খান গাইলেন আইয়ুব বাচ্চুর গান ‘সেই তুমি: ও ‘উড়াল দিব আকাশে’ ও দেশপ্রমের গান ‘সূর্যোদয়ে তুমি, সূর্যাস্তেও তুমি’। জাহান এ বি শুরু করলেন নকীব খানের গাওয়া ‘ও নদীরে, তুই যাস কোথায় রে’। এরপরে গাইলেন মান্না দের সুবিখ্যাত গান ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’; অঞ্জন দত্তের সবচেয়ে বিখ্যাত গান, ‘চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি বেলা’ ও নকীব খানের গান ‘ভালো লাগে জ্যোৎস্নারাতে’। এরা তিনজনেই চমৎকার গায়ক, লাউডস্পিকার থেকে নির্গত সুর ছিল সুস্পষ্ট ও সুউচ্চ; একসঙ্গে নয়, পালা করে গাইলেন। বনভূমি ভরে উঠল সাঙ্গীতিক ঝঙ্কার ও কবিতা আবৃত্তির পেলবতায়। কবি হাফিজ রশিদ তাড়াহুড়োয় কোনো কবিতার বই আনেননি, তাকে মোবাইল থেকে তিনটি কবিতা বের করে দেওয়া হলো। আমি আমার ‘বাছাই ১০০ কবিতা’ থেকে তিনটি কবিতা পড়লাম। জাহেদ সরওয়ারকে কবিতা পাঠের জন্য মাউথপিস এগিয়ে দিলে তিনি কবিতা না পড়ে গান গেয়ে উঠলেন। বুঝলাম তার বহুমাত্রিক মেধা। এই অনুষ্ঠান রেকর্ড করে ফেসবুক লাইফে পাঠিয়ে দিচ্ছিলেন চারজন – সুব্রত আপন, সাইয়্যিদ মঞ্জু, শাফায়াত জামিল দিদার ও আর. করিম। প্রযুক্তির অনেক ক্ষমতা। অনুষ্ঠান হচ্ছে সোনাদিয়া নামের দ্বীপে এক ঝাউবনের ভেতর আধো আলো আধো অন্ধকার কুটিরে, তা সঙ্গে সঙ্গে চলে যাচ্ছে দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তরে, বিভিন্ন মোবাইল ফোনের স্মার্ট পর্দায়।
রাত যত বাড়ল, গান তত নিনাদিত হতে থাকল আরও নির্জন হয়ে পড়া ঝাউবনে। ঘড়ির কাঁটা দুয়ের ঘর স্পর্শ করলে আমার চোখের পাতাও জড়িয়ে আসে। দেখলাম নিভে যাওয়া মোমবাতিগুলো ফের জ্বালিয়ে দিচ্ছে মিজান মনির। অর্ধেক কেক তখনো পড়ে আছে টেবিলে, কেকটি ঘিরে মোমবাতির ঘুমপ্রহরের কুহক। গরমে ঘুমাতে পারব না জেনেও বিদায় নিয়ে চলে আসি খাটে। চারটি কাঠের খাট দখল করে আছে পুবের ঘরটি। আমি তারই একটির একপাশে শুয়ে পড়ি। সৌভাগ্য সে সময়ে ঝিরঝির বৃষ্টি নেমে আসে ঝাউবন ও সোনাদিয়া দ্বীপে, গরম কিছুটা কমে আসে, ভোরের দিকে অগ্রসরমান সময়ও একটি কারণ। পাশেই জানলা ছিল, কিন্তু খুলিনি মশার ভয়ে। কে এসে মশার কয়েল জ্বালিয়ে দিল। দেখি আমার দেখাদেখি হাফিজ রশিদ খানও গানের জলসা ছেড়ে চলে এসেছেন ঘুমাতে। যতই তরুণ ভাব ধরি না কেন, যতই করি যুবকের মতো আস্ফালন, আমাদের যে বয়স হয়েছে তা কী করে অস্বীকার করি? যারা তরুণ, যারা যুবক তারা সারারাত জেগে থাকুক গানে ও আনন্দে।
(চলবে)