ধর্মতলার অম্বর রেস্তোরাঁ কাম বারের ওপরে ছিল বুদ্ধদেব গুহর অফিস। আমি তখন আনন্দবাজারে ঢুকেছি মাত্র কয়েক দিন হয়েছে। সবে পুজো সংখ্যার কাজ শুরু হয়েছে। রমাপদ চৌধুরী আমাকে বললেন, যান তো। বুদ্ধদেব গুহর লেখাটা হয়ে গেছে। চট করে একটু নিয়ে আসুন।
গিয়ে দেখি ওঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য অনেকেই অপেক্ষা করছেন। আমি বুদ্ধদেব বাবুর সঙ্গে দেখা করতে চাই বলাতে রিসেপশনিস্ট মেয়েটি বললেন, কী ব্যাপার বলুন…
আমি বললাম, ওনাকে বলুন আমাকে রমাপদ চৌধুরী পাঠিয়েছেন। আনন্দবাজার পত্রিকার পুজো সংখ্যার লেখাটা নিতে এসেছি।
উনি সঙ্গে সঙ্গে বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনি ভিতরে যান।
আমি ভিতরে ঢুকে বললাম, ও আপনি?
আসলে আমি বেশ কয়েক বার ওঁর বাড়িতে গিয়েছিলাম। না, একা নয়, কাস্তেকবি দিনেশ দাসের বড় ছেলে শান্তনু দাসের সঙ্গে। শান্তনুদা তখন ঘরোয়া পত্রিকা দেখছেন। প্রসাদ পত্রিকা দেখছেন। যে সময়ের কথা বলছি, তখন এই দুটি পত্রিকাই ছিল বাংলা ভাষার প্রথম সারির চটকদার পত্রিকা।
বাবার সুবাদে বাংলা ভাষার প্রায় প্রতিটি কবি লেখকের বাড়িতেই ছিল শান্তনুদার অবাধ যাতায়াত। আমি শান্তনুদার সঙ্গে প্রথম গিয়েছিলাম শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি। শিবনারায়ণ রায়ের বাড়ি এবং এই ভদ্রলোকের বাড়ি।
তখনও আমি তাঁর নাম জানতাম না। তবে মনে আছে, শান্তনুদার সঙ্গে তাঁর একবার বেশ কথা কাটাকাটি হয়েছিল। তাঁর একটি লেখা প্রসঙ্গে শান্তনুদা বলেছিলেন, কোনও বাঘ কি আট ফুট লম্বা হতে পারে?
উনি খুব সুন্দর করে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, পারে। অবশ্যই পারে। কোনও বাঘ যদি গাছের গুড়িতে সামনের পা দুটো আড়মোড়া ভাঙার ভঙ্গিমায় টান টান করে মেলে দেয়, তা হলে আট ফুট কেন? তার থেকে বেশিও হতে পারে।
ও, তার মানে ইনিই বুদ্ধদেব গুহ! এঁর বাড়িতে তো আমি বহু বার গিয়েছি। কিন্তু ততক্ষণে আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে, ‘ও আপনি?’
আমার কথা বলার ধরন দেখে উনি বলেছিলেন, কেন? অন্য কাউকে আশা করেছিলে নাকি? শান্তনু কেমন আছে?
আমি বললাম, শান্তনুদা নয়, আমাকে পাঠিয়েছেন রমাপদবাবু, মানে রমাপদ চৌধুরী।
সে দিন পুজো সংখ্যার লেখা দেওয়ার সময় উনি আমাকে একটি শেফার্ড পেন উপহার দিয়েছিলেন।
আসলে কলমের প্রতি তাঁর ছিল ভীষণ দুর্বলতা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নামীদামি কোম্পানির দামি দামি পেন সংগ্রহ করতেন। সেই পেন রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্যে দু’জন লোক ছিল এবং প্রথম কারও সঙ্গে আলাপ হলেই উনি তাকে কলম উপহার দিতেন।
বুদ্ধদেব গুহ শুধু একজন লেখকই ছিলেন না, ছিলেন একজন সংগীতশিল্পীও। তিনি ১৯৩৬ সালের ২৯ জুন কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করে নিয়মিত লেখালেখি শুরু করেন। লিখেছেন কবিতা, গল্প এবং উপন্যাস। তাঁর সৃষ্ট বিখ্যাত চরিত্র ঋজুদা যেন তাঁর মতোই পরিব্রাজক। সে বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় তার সঙ্গী রুদ্রকে নিয়ে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে আসা এই লেখক অরণ্যকে যেমন তাঁর লেখার এক মূল আধার হিসেবে বেছে নিয়েছেন, তেমনই তাঁর লেখাগুলোর পটভূমিও ছিল পূর্ব বাংলার গহীন অরণ্য।
বুদ্ধদেব গুহ প্রেমের উপন্যাস রচনা করেছেন বেশ কয়েকটি। তার মাঝে ‘হলুদ বসন্ত’ অন্যতম। বাংলা কথাসাহিত্যে এমন রোমান্টিসিজমের সংযোজন খুব কম লেখকই করতে পেরেছেন। পাঠকনন্দিত বুদ্ধদেব গুহর উপন্যাসগুলো হল— ‘মাধুকরী’, ‘একটু উষ্ণতার জন্য’, ‘নগ্ন নির্জন’, ‘অববাহিকা’, ‘পরদেশিয়া’, ‘সবিনয় নিবেদন (পত্রোপন্যাস)’, ‘আলোকঝারি’ ইত্যাদি।
ছোটদের জন্য লিখেছেন— ‘ঋজুদা’ সিরিজ। বুদ্ধদেব গুহর কাহিনি নিয়ে নির্মিত হয়েছে একাধিক টিভি অনুষ্ঠান এবং চলচ্চিত্র।
১৯৭৭ সালে তিনি আনন্দ পুরস্কার পান।
প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, যে কোনও বেসরকারি বড় অঙ্কের আর্থিক পুরস্কারের ক্ষেত্রে একটা ইনকাম ট্যাক্স কাটা হয়।
আনন্দ পুরস্কার প্রাপকদের যাতে সেই ট্যাক্সটা দিতে না হয়, সে জন্য ট্যাক্স ছাড়ের বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন এই বুদ্ধদেব গুহই। আর সে জন্য আনন্দ পুরস্কার পেলে আজও আর কোনও কবি, লেখক বা প্রাবন্ধিককে কোনও ট্যাক্স দিতে হয় না।
উনি আনন্দবাজার পত্রিকায় ঠিক সময়ে লেখাটা দিলেও ফাইনাল প্রুফ দেখার ক্ষেত্রে তাঁর এতটাই খুঁতখুঁতানি ছিল যে, প্রুফটা নেওয়ার সময় কবে দেবেন দিনক্ষণ বলে দিলেও, কতবার যে ঘোরাতেন তার কোনও ঠিক ছিল না।
পর পর বেশ কয়েক দিন ঘোরার পরে আমি এতটাই বিরক্ত হয়েছিলাম যে, আমি তাঁর সামনেই অসন্তোষ প্রকাশ করে ফেলেছিলাম। উনিও নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি। বলেছিলেন, আমি রাম-শ্যাম-যদু-মধুর মতো লিখি না। আমি টিকে থাকার লেখা লিখি। তাই লেখা ছাপা হওয়ার আগে আমি অত্যন্ত যত্ন নিয়ে পুরোটা দেখি। তাই আমার সময় লাগে, বুঝেছ?
জানতাম, উনি আমার থেকে বয়সে অনেক বড়। কলকাতার একজন নামকরা চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট। যে অফিসে বসে আছি, সেটা তাঁরই ফার্ম।
তবুও সে দিন আমার মাথায় যে কী ভূত চেপেছিল কে জানে! দুম করে বলে ফেলেছিলাম, লেখার জন্য আপনি কার কাছে কত দিন টিকে থাকবেন তা আমি জানি না। তবে আপনি আমার কাছে টিকে থাকবেন ওই কলম আর কলম ঠিক করা লোক দুটির জন্য। বলেই, গটমট করে ওখান থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম।
অফিসে ঢুকেই বুঝতে পেরেছিলাম, উনি আমার নামে কমপ্লেন করেছেন রমাপদ চৌধুরীর কাছে।
না, তার পর আমি আর কোনও দিন তাঁর ওই অফিসে যাইনি।
ওই ঘটনার প্রায় আঠাশ-ঊনত্রিশ বছর পরে যখন সুচিত্রা ভট্টাচার্য মারা গেলেন, তখন তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে একটি সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে তাবড় তাবড় সব কবি, লেখকেরা তাঁকে নিয়ে একান্তই ব্যক্তিগত গদ্য লিখেছিলেন। আমিও লিখেছিলাম। লিখতে বলা হয়েছিল বুদ্ধদেব গুহকেও। তিনি লিখেছিলেন। যেহেতু ওই সংকলনটির কাজের সঙ্গে আমি ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে ছিলাম, তাই সেই লেখাটি আনার জন্য সুচিত্রাদির ভাই কুনালদা আমাকে বলেছিলেন। বলেছিলেন, ওঁর বাড়ি থেকে লেখাটি সংগ্রহ করে আনার জন্য।
প্রখ্যাত ক্রিকেটার সুনীল গাভাস্কারের নামে বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে, গড়িয়াহাট ট্রাম ডিপোর উল্টো দিকে যে আবাসন, আমি সেই সানি টাওয়ারে গিয়েছিলাম। কিন্তু উপরে উঠিনি। নীচের সিকিউরিটি গার্ডকে বলেছিলাম, লেখাটা এনে দেওয়ার জন্য। উনি এনে দিয়েছিলেন।
কিন্তু তা বলে কি আর কোনও দিনই তাঁর সঙ্গে আমার মুখোমুখি দেখা হয়নি? হয়েছে। এই তো কিছু দিন আগে কলামন্দির প্রেক্ষাগৃহে কি একটা অনুষ্ঠানে আমি গিয়েছিলাম। বেরোবার সময় তাঁর সঙ্গে একেবারে মুখোমুখি দেখা। আমি তখন পালাতে পারলে বাঁচি। পাশ কাটিয়ে যখন যাচ্ছি, উনি মুখ ঘুরিয়ে বললেন, কোন দিকে যাবে? আমি তো রাসবিহারী হয়ে যাব।
উনি জানতেন, আমি রাসবিহারীর কাছে থাকি। আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম, এত দিন পরেও সে কথা উনি মনে রেখেছেন দেখে। তবুও আমি সে দিন তাঁর গাড়িতে উঠিনি।
জানি, এখন আমি চাইলেও তাঁর গাড়িতে আমার আর ওঠা হবে না। তাঁর পাশে বসে যাওয়া হবে না কোনও গন্তব্যে। গ্র্যান্ড হোটেলের আনন্দ পুরস্কারের অনুষ্ঠানে গেলেও আমাকে আর লুকোচুরি খেলতে হবে না