‘ঝাঁকড়া চুলের বাবড়ি দোলানো সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাঁপা’ নজরুলকে আমরা অনেকেই দেখিনি, দেখেছি ফুলের জলসায় নিরব কবিকে। তাই এ কবি সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে দ্বারস্থ হয়েছি নজরুল গবেষকদের প্রবন্ধের ওপর।
একারণে শুরুতেই কবিগুরুর কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে স্বীকার করছি: ’জ্ঞানের দীনতা এই আপনার মনে / পূরণ করিয়া লই যত পারি ভিক্ষালদ্ধ ধনে।’
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের মহতী উদ্যোগে ১৯৭২ এর ২৪ মে কবি কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশে নিয়ে এলে এদেশের সকল স্তরের মানুষ তাঁকে স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য লাভ করেন এবং নীরব- কবিকে ঘিরেই তাদের আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটাতে সচেষ্ট থাকেন।
১৯৪২ এর ১০ জুলাই থেকেই তিনি নীরব। তাই ‘কবি ভবনে’ কবির সামনে বসে এ দেশের শিল্পীরা যখন তাঁর গানগুলো গাইতেন, নীরব কবি চঞ্চল হয়ে উঠতেন। কিন্তু এ জলসায় তিনি মুখর হতে পারেননি। স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার সেই চির সংগ্রামী চির-প্রেমিক কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যে আমাদের প্রিয় বরিশাল কিভাবে এসেছে সে- প্রসঙ্গ এবং তারপরে আমাদের এ প্রিয় কবিকে আমরা কতটুকু মূল্যায়ন করেছি তা নিয়ে সংক্ষেপে কিছু লিখছি।
’ধান-নদী-খাল এই তিন-এ বরিশাল’। বঙ্গোপসাগরের পানি বিধৌত এই বরিশালে একদিন কংক্রিটের রাস্তার চেয়ে জলপথ ছিল বেশী। প্রকৃতির অবাধ সৌন্দর্যের এই লীলাভুমিতে নিছক সৌন্দর্যের খোঁজে নয় রাজনৈতিক ও সাংবাদিকতা সংক্রান্ত কারণে হক সাহেবের ভাগ্নে ইউসুফ আলীর আমন্ত্রণে বাংলার- বাঘ দ্রোহ- বিদ্রোহের মূর্ত প্রতীক বরিশালের বীর সন্তান এ, কে ফজলুল হকের সাথে ১৯২০-এর অক্টোবরে বাংলা ১৩২৭-এর আশ্বিণে পূজার ছুটিতে কবি বরিশাল আসেন।
পরে ১৯৩০ এ বাংলা ১৩৩৭ এর বৈশাখে বরিশালের স্মৃতি নিয়ে রচিত কবির দ্বিতীয় উপন্যাস ’মৃত্যুক্ষুধা’ গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশিত হয়। এর আগে মাসিক ‘সওগাত’ পত্রিকায় ১৩৩৪ এর অগ্রহায়ণ সংখ্যা থেকে ১৩৩৬ এর ফাল্গুন সংখ্যা পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে এ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিল।
১৯২৬ সালের ২ জানুয়ারি কবি হুগলী ছেড়ে মাটির পুতুলের দেশ কৃষ্ণনগরে যান। সেখানে শ্রমজীবী খ্রীস্টান ও মুসলমান অধ্যুষিত চাঁদ- সড়ক এলাকায় একজন খ্রীস্টান মহিলার বাড়িতে ওঠেন। হতদরিদ্র এই পরিবারগুলোর ভাগ্য- বিড়ম্বিত জীবনের করুণ কাহিনীকে বাস্তব অভিজ্ঞতার রসে সিঞ্চিত করে কবি রচনা করেন ’মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসটি। এ উপন্যাসটিতে বরিশাল একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছে।
ক্ষুধার সর্বগ্রাসী প্রভাব কী ভাবে মানুষকে ক্রমান্বয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়, এমন কি তার আজন্ম লালিত ধর্ম-বিশ্বাস ও মন-মানসিকতাকে পর্যন্ত বিপর্যস্ত করে ফেলে তারই বাস্তবচিত্র তিনি এঁকেছেন ’মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসটিতে।
নিজের পারিবারিক জীবনের দারিদ্র্যের অভিজ্ঞতাকে সাথে করে চাঁদ-সড়কের এই হতদরিদ্র জনগোষ্ঠির দরিদ্রতার-স্বরূপ তিনি হৃদয়ের সবটুকু দরদ ও সহানুভূতি দিয়ে এঁকেছেন।
নজরুল ’মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসটির কাহিনি সংক্ষেপ হচ্ছে: ’বৃদ্ধা বিধবা গজালের মা, তিনটি বিধবা পুত্র-বধূ, তাদের ডজন খানেক ছেলে মেয়ে আর একমাত্র জীবিত ছেলে ১৮/১৯ বছরের যুবক প্যাঁকালে—এই নিয়ে একটি পরিবার। গোটা পরিবারের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব রাজমিস্ত্রি প্যাকালের ওপর। মেঝো ছেলের বিধবা বউ খ্রীস্টান হতে বাধ্য হলেও ছেলে মেয়ে দু’টোকে এর ছোঁয়া থেকে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছে গজালের মা। এক সময়ের বিপ্লবী পরবর্তীতে স্বদেশী আন্দোলনের কর্মী আনসারের ছোঁয়া ও ব্যক্তিত্ব মেঝ বউ এর মনে মিশনারীদের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে ক্ষণিক আশা ও উত্তেজনা সৃষ্টি করলেও সমসাময়িক যুগ পরিবেশের কারণে ধর্মচ্যুত এ বিধবা আর এগুতে সাহস পাননি। মিশনারীরাও টের পেয়ে তাকে কৃষ্ণনগর থেকে বরিশাল সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। তাই আনসার যখন তাকে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয় জিজ্ঞাসা করে তখন “মেঝ বৌ নখ দিয়ে খানিকক্ষণ মাটি খুঁটে মুখ নীচু করে বলল, করব আর কি? আমার যা করবার তা এখন ঠিক করে দেবে ঐ সাহেব মেমগুলোই। তারা আমায় কালই বোধ হয় বরিশাল বদলি করবে।”
বস্তুতঃ দারিদ্র্রের সুযোগ নিয়ে এ পরিবারে ‘ওমান কাতলি (রোমান ক্যাথলিক)’ খ্রীস্টান মিশনারী ঢুকে পরে। মুমুর্ষূ সেজ বৌকে তারা বিনা মূল্যে চিকিৎসা ও ঔষধপথ্য দিয়ে সুস্থ করে তোলায় মেঝ বৌ তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। স্বাবলম্বী হওয়ার আশায় সে ছেলে-মেয়ে দু’টোকে ছেড়ে মিশনে যায়। সেজ বৌ ও ছেলে দু’জনেই মারা যায় । মেঝ বৌ খ্রীস্টান হয়। তাকে বরিশাল স্থানান্তর করা হয়। এদিকে প্যাকালেও খ্রীস্টান হয়ে বাল্য-প্রেমিক বিধবা কুর্শিকে বিয়ে করে এবং মিশনারীদের সুপারিশে সে বরিশাল ডিস্ট্রিক কালেকটারের অফিসে চাকুরি পায়।
কাহিনীর আরেকটি পিঠ হল, বিপ্লবী আনসার ও কৃষ্ণনগরের তরুণী বিধবা কন্যা রুবির প্রেম কাহিনী। ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী আনসার রেঙ্গুনে কারাবন্দী থাকাকালে দুরারোগ্য যক্ষ্মা ব্যাধিতে আকান্ত হলে রুবি তার সেবাযত্ন করে। পরিণতিতে উভয়েরই মৃত্যু হয়।
ওদিকে মেঝ বৌ অভাবের তাড়নায় কোলের সন্তান রেখে খ্রীস্টান হয়ে বরিশাল মিশনে জীবন কাটিয়ে দেয়ার প্রয়াস পায়। ছেলের অকাল মৃত্যুর পর মেঝ বৌ সর্বজনীন মায়ে পরিণত হয়। সন্তানের জন্য পুনরায় মুসলমান হয়ে মেঝ বৌ বস্তির ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া শেখাবার জন্য একটি স্কুল খোলার চেষ্টা করে। পাড়ার শিশুদের স্নেহ ভালবাসা দিয়ে সে তার সন্তানকে খোঁজার চেষ্টা করে। প্যাঁকালেকে খান বাহাদুর সাহেব কুড়ি টাকা মাহিনার চাকরি দেয়ায় প্যাঁকালে ও কুর্শি কলমা পড়ে মুসলমান হয়ে যায়।
এখানেই ’মৃত্যুক্ষুধা‘ উপন্যাসের কাহিনীর সমাপ্তি।
পূর্বেই বলেছি কবি কাজী নজরুল ইসলাম মাত্র দু’দিন বরিশালে অবস্থান করেছিলেন। এ দু’দিনে বরিশালের যে বিশেষ দু’টি বৈশিষ্ট্য তার মনকে নাড়া দিয়েছিল তার একটি হল খালে ঘেরা বরিশাল, যা ইতালীর ভেনিস নগরীর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। অন্যটি হল, বরিশাল খ্রীস্টান মিশনারীদের তৎপরতার ঘাটি।
’মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসের ২৩তম পরিচ্ছদে আমরা খ্রীস্টান মিশনারী অধ্যুষিত ও ঝাউবীথি সমৃদ্ধ যে এলাকা ও সড়কের বর্ণনা পাই, তা বর্তমান উদয়ন স্কুলের ভিতরে অবস্থিত রোমান ক্যাথলিক চার্চ এবং বান্দ বা কোর্ট রোড হিসেবেই অনুমান করা হয়।
’মৃত্যুক্ষুধা’য় বরিশালের রুপের বর্ণনা এরকমের: ‘বরিশাল বাংলার ভেনিস।
আঁকাবাঁকা লাল রাস্তা শহরটিকে জড়িয়ে আছে ভুজবন্ধের মত করে।
রাস্তার দু’ধারে ঝাউগাছের সারি। তারই পাশে নদী। টলমল করছে বোম্বাই-শাড়ি পরা ভরা যৌবন বধূর পথ চলার মত। যত না চলে, অঙ্গ দোলে তার চেয়ে অনেক বেশী। নদীর ওপারে ধান ক্ষেত। তারও ওপারে নারকেল সুপারীর কুঞ্জ ঘেরা সবুজ গ্রাম, শান্ত নিশ্চুপ। সবুজ শাড়ি পরা- বাসর ঘরের ভয় পাওয়া ছোট্ট কনে বৌটির মত। এক আকাশ হতে আরেক আকাশে কার অনুনয় সঞ্চরণ করে ফিরছে, ‘বৌ-কথা কও, বৌ-কথা কও।’
আঁধারের চাঁদর মুড়ি দিয়ে এখনো রাত্রি অভিসারে বেরোয় নি। তখনো বুঝি তার সন্ধ্যা প্রসাধন শেষ হয়নি। শঙ্কায় হাতের আলতার শিশি সাঁঝের আকাশে গড়িয়ে পড়েছে। পথের চেয়ে আকাশটাই রেঙে উঠেছে বেশী। মেঘের কালো খোঁপায় তৃতীয়া চাঁদের গোড়ে মালাটা জড়াতে গিয়ে বেঁকে গেছে। উঠানময় তারার ফুল ছড়ানো। তিন-চারটি বাঙালি মেয়ে কালোপেড়ে শাড়ি পরা, বাঁকা সিথি, হিল-শু পায়ে দেওয়া,—ঐ রাস্তায় একটি ভগ্নপ্রায় পুলের উপর এসে বসল। মাথার ওঁপর ঝাউ শাখাগুলো প্রাণপণে বীজন করতে লাগল।’
খ্রীস্টান হয়ে কৃষ্ণনগর ছেড়ে বরিশাল এসে মুসলমান বিধবা মেঝ বৌ’র মন-মানসিকতার খুব একটা পরিবর্তন না হলেও, এর প্রকৃতির প্রভাব তাকে করে তুলেছে বিদ্রোহী অগ্নিকন্যা মা-মনসা। তাই সংসার ছেড়ে এসেও মেঝ-বউ এর নামটি না ঘোচার উত্তরে হেসে বলে ‘তালগাছ না থাকেলে তালপুকুর নামটা কি বদলে যায়?’ আর তার সে হাসি ‘বুকের সল্তে জ্বালিয়ে প্রদীপের আলো দেওয়ার মত।’ শুধু তাই নয় ‘মেজ বৌও কথা শিখেছে দেখছি’ বলে সঙ্গীরা তাকে ঠেস দিয়ে কথা বলার উত্তরে সে জবাব দেয় ‘তার চেয়ে বল মানুষ হয়ে উঠলাম।’
তার এ পোশাকের পরিবর্তন তার মনকে বদলে দিতে পারে নি। ‘এখানে এলে কেন?’ এ ক্ষূূরধার প্রশ্নের জবাবে একই হাসি হেসে সে বলে: ‘আমি ত মেমসাহেব হতে আসি নি ভাই, মানুষ হতে এসেছিলুম। আলো-বাতাস প্রাণের বড় অভাব আমাদের সমাজে, তাই খাঁচার পাখির মত শিকলি কেটে বেরিয়ে পড়েছিলুম। কিন্তু যে ভাল হয় নি আমার তা বলব না। এখন যা শিখেছি- তাতে করে যেখানেই থাকি দু’টো পেটের ভাত জোগার করবার অসুবিধা হবে না। কিন্তু কি করি চিরজন্মের অভ্যেস। ঐ জুতোটুকু পড়লে মনে হয় পায়ে এক নতুন রকমের শিকলি পড়ল।‘
এরপর প্যাঁকালের সাথে দেখা, কৃষ্ণনগরের চিঠি পাওয়া, ছেলে অসুস্থতার খবর শুনে পাগলের মত বরিশাল ছেড়ে মেঝ বৌ-এর দেশে ফিরে যাওয়া, সন্তান-হারা মেঝ বৌএর আবারও মুসলমান হয়ে শিশু সেবায় আত্মনিয়োগ করার মধ্য দিয়ে ’মৃত্যুক্ষুধা’র বরিশাল প্রসঙ্গ শেষ।
উপন্যাসের পরে আসা যাক কবির কবিতা প্রসঙ্গে। কবি বরিশালে দু’দিন অবস্থানকালে ৪টি গান লিখেছিলেন। ছায়ানট ও সিন্ধুহিল্লোল কাব্যের এ গানগুলো হল (১) বন্ধু আমার থেকে থেকে কোন সুদূরের নিজন পুরে ডাক দিয়ে যাও ব্যথার সুরে, (২) হয়তো তোমার পাব দেখা/যেখানে ঐ নত আকাশ চুমছে বনের সবুজ রেখা, (৩) কোন মরমীর মরম ব্যথা আমার বুকে বেদন হানে/জানি গো সেও জানেই জানে, এবং (৪) পথিক ওগো চলতে পথে/ তোমায় আমায় পথের দেখা।
এ গানগুলো স্বরলিপিসহ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া নজরুলের গীতিশতদল-এর ’পল্লী নৃত্যে’র অংশে বরিশাল প্রসঙ্গ এসেছে এভাবে- ”ও গিজে যাসনে ভিজে/ ও গিজে ঠান দিদি যে/ সাবাস বেটি বকন ছা/কলা মোচায় ফড়িং খা / ও গিজে তাল ভটাভট!/ও গিজে যাচ্চলে যা বরিশাল্যা, পবনা, ঢাকা, খুলনা জেলা।
কাজী নজরুল ইসলামের সাথে বরিশালের কৃতিসন্তান শের-ই-বাংলা এ, কে ফজলুল হকের ছিল অত্যন্ত গভীর সম্পর্ক। ফজলুল হকের ’নবযুগ’ পত্রিকা দিয়েই নজরুলের সাংবাদিকতা জীবন শুরু। নজরুল সাহিত্য, জীবন ও প্রতিভা লালনে শের-ই-বাংলার অবদান অনস্বীকার্য। গণমুখীনতা, অসাম্প্রদায়িকতা, স্বাধীন অবিভক্ত বাংলার প্রবক্তা হিসাবে এ দু’জনের মধ্যে ছিল মনমানসিকতাগত সাদৃশ্য ও পারস্পরিক নির্ভরশীলতা। যদিও মাঝে মধ্যে মতের অমিল হয়েছে, কিন্তু বিচ্ছেদ ঘটে নি। নবযুগ পত্রিকা ছাড়াও সিলেট সফর, কলকাতায় জাতীয় সংবর্ধনা, অসুস্থ নজরুলের চিকিৎসায় শের-ই-বাংলা ছিলেন নজরুলের পাশে। কবির দৃষ্টিতে ফজলুল হক ছিলেন ‘জগলুল পাশা।’
নজরুল-ফজলুল হক সম্পর্কের বিষয় প্রখ্যাত সংগীত শিল্পী আব্বাসউদ্দিন আহমদ লিখেছেন : ‘ফজলুল হক সাহেব কাজিদাকে খুব ভালবাসতেন। ওয়াছেল মোল্লার দোকানের দোতালায় একবার ঈদ-রিইউনিয়নে কাজীদা আর আমাকে দাওয়াত করা হয়েছিল। সেখানে ফজলুল হক সাহেব উপস্থিত। তিনি বললেন, কাজি, একটা ঈদের গান গাও দেখি। কাজিদা আর আমি দু’জনে মিলে গাইলাম ‘ঈদ মোবারক।’
বরিশালের ভোলার কবি এবং জাতীয় মঙ্গলকাব্যের প্রণেতা কবি মোজাম্মেল হক ছিলেন ’বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতি’র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। এ সমিতি থেকে ত্রি-মাসিক ’বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য পত্রিকা’ বের হত। এ পত্রিকায় ‘কোরক’ শিরোনামে নতুন কবিদের কবিতা ছাপা হত। এ পত্রিকায় ১৩২৬ এর শ্রাবণ-সংখ্যায় (১৯১৯-জুলাই-আগস্ট) কবির প্রথম কবিতা ‘মুক্তি’ প্রকাশিত হয়। প্রথমে এর নাম ছিল ‘ক্ষমা’। মোজাম্মেল হকের পরামর্শে কবিতার নামকরণ হয় ‘মুক্তি’।
এছাড়া জনাব মোজাম্মেল হকের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান ‘ওরিয়েন্টাল প্রিন্টার্স এন্ড পাবলিশার্স লিমিটেড’ হতে কবির ‘পুবের হাওয়া’ গ্রন্থটি প্রকাশ পায়। বরিশালের অন্যতম কৃতি-সন্তান-অশ্বিনীকুমার দত্তের প্রতি ছিল কবির অগাধ শ্রদ্ধা। বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশী আন্দোলনের যুগে বরিশালের অবিসংবাদিত নেতা, ১৯০৮ সালে আলিপুর বোমা হামলার অন্যতম আসামী অশ্বিনীকুমার দত্তের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে কবি ‘অশ্বিনীকুমার’ কবিতাটি লিখলেন। বাঙালি যেন আবার আত্মচেতনা, আত্মবিশ্বাস ও আত্মশ্রদ্ধার জোরে জীবন উচ্ছ্বাসে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতে পারে।
মরা জাতি যেন বাঁচে সে জন্যে এ মহাপুরুষের কাছে আশির্বাদ প্রার্থনা করে কবিতাটির শেষে লেখা হয় ‘হে প্রেমিক তব প্রেম বরিষায় দেশে
এল ঢল বীরভূমি বরিশাল ভেসে
সেই ঢল সেই জল বিষম তৃষ্ণায়-
যাচিছে উষর বঙ্গ তব কাছে হায়।’
বরিশাল প্রসঙ্গের পর এবারে নজরুলকে বাংলাদেশে কতটুকু মূল্যায়ন করা হয়েছে তা হালকা হালকা করে ছুঁয়ে যাওয়া যাক। এ কবির রচনায় রয়েছে মানুষের মুক্তির জন্য ব্যাকুলতা, দ্রোহ, ঊদ্বেগ, উৎকন্ঠা, তারুণ্যের ঔদ্ধত্য আর উজ্জ্বলতা। তার সাহিত্যে মানব ও মানবতা এত ব্যাপক, বিস্তৃত, জীবনঘনিষ্ঠ ও আন্তরিক যে আমাদের হৃদয় আবেগে অপ্লুত হয়ে ওঠে।
নজরুল সাহিত্যে রয়েছে দর্শন ও আধ্যাত্মবাদের শত খোলোসের বাইরে সমাজ, জীবন ও যুগযন্ত্রণায় পিষ্ট মানুষের আহাজারীর এক বিস্তৃত ময়দান।
বাংলাদেশ, এ দেশের মানুষ, তাদের স্বাধীনতা, সংস্কৃতি এবং কাজী নজরুল ইসলাম এক অবিভাজ্য সত্তা। তিনি আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির রূপকার।
নজরুল বাঙলি জাতিকে অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে শিখিয়েছেন। তাই নজরুল চর্চা নিছক সাহিত্যের বা সঙ্গীতের নয়, নিজেদের অস্তিত্বের প্রয়োজনে যত বেশী করা হবে; এ জাতি তত বেশী শক্তিশালী হবে।
অবিভক্ত বাংলায় নজরুল সাহিত্য কর্মের উপর ’মোসলেম ভারত’, ’নারায়ণ’, ’সওগাত’, ’ভারতী’, ’প্রবাসী’, ’ছোলতান’, ’ধূমকেতু’, ’কল্লোল’, ’জাগরণ’, ’মোহাম্মদী’, ’অমৃতবাজার’, দৈনিক ’আজাদ’সহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায আলোচনা-সমালোচনা প্রকাশিত হয়।
তবে ত্রিশ দশকের দিকে নজরুলের সামগ্রিক মূল্যায়নের প্রয়াস ঘটে।
কবি আতাউর রহমান তার ‘বাংলাদেশে নজরুল চর্চা প্রবন্ধে বলেন: ‘১৯৩৮ এ আব্দুল কাদির নজরুলের কবিতার ছন্দ পরিচয়, বাংলা সাহিত্যে নজরুল, নজরুলের গানের কথা ও সুর প্রভৃতি প্রবন্ধে নজরুল সাহিত্যের যথার্থ আলোচনার সূত্রপাত করেন। নজরুল জীবনী রচনার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা অগ্রগন্য।’
১৯৪৪ এ বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ’কবিতা’ পত্রিকার ’নজরুল-সংখ্যা’ প্রকাশিত হয়। এ বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হওয়ায় নজরুল সাহিত্য সমালোচনার ধারায় এক নতুন অধ্যায়ের গোড়াপত্তন হয়।
বাংলাদেশে নজরুল সম্পর্কীত গ্রন্থ কে প্রথম লিখেছেন এ নিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। অধ্যাপক আবুল ফজলের লেখা ‘বিদ্রোহী কবি নজরুল’ গ্রন্থটি নজরুল বিষয়ক প্রথম গ্রন্থ হয়ে থাকতে পারে। এ গ্রন্থের মুখপত্র লিখেছেন প্রিন্সিপল ইব্রাহিম খাঁ।
১৯৫৩-এ করাচী প্রবাসী বাঙালিদের প্রচেষ্টায় করাচীতে ‘নজরুল একাডেমী’ প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে এ দশকে প্রতিষ্ঠানটি আলোচনা ছাড়া কোন উল্লেখযোগ্য কাজ করতে পারে নি।
১৯৫৯-এ মিজানুর রহমানের উদ্যোগে ঢাকায় ‘ইকবাল-নজরুল ইসলাম সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠিত হয়। নজরুল ইসলামের রচনা ইংরেজি অনুবাদ করে বহির্বিশ্বে নজরুলের পরিচিতি ও ভাবমূর্তি তুলে ধরা এ প্রতিষ্ঠানের অন্যতম লক্ষ্য হলেও, গুটি কয়েক কবিতার অনুবাদ ও পুস্তক প্রকাশ ছাড়া এরা তেমন কোন উল্লেখযোগ্য কাজ করতে পারে নি।
১৯৬৪ সালে কবি তালিম হোসেন এবং এ্যাডঃ জনাব এ, কে এম নূরুল ইসলাম (পরবর্তীতে বিচারপতি ও উপরাষ্ট্রপতি) এর যৌথ উদ্যোগে ’নজরুল একাডেমী’ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। একই বছরে জনাব নূরুল ইসলামের ১১নং র্যাংকিন স্টিটের বাসভবনে সাংগঠনিক পর্যায় বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে ’বাংলা একাডেমী’র প্রথম নজরুল জন্ম বার্ষিকীর উদ্ঘাপনের মধ্য দিয়ে নজরুল চর্চার একটি দিক উন্মেচিত হয়।
ষাটের দশকে আমীর হোসেন চৌধুরীর উদ্যোগে ‘নজরুল ফোরাম’ (পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক নজরুল ফোরাম) নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬৪ এর দাঙ্গায় আমীর হোসেন শহীদ হওয়ার সাথে সাথে এ ফোরামটির কার্যক্রম স্থবির হয়ে পরে।
১৯৭০ দশকের প্রধান আকর্ষণ কবিকে বাংলাদেশে আনা এবং বাংলাদেশী নাগরিকত্ব প্রদান। ঢাকায় যে ভবনটিতে কবি থাকতেন তার নাম রাখা হয় ’কবি ভবন’।
১৯৭৬ এর ২৯ আগস্ট কবি ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। কবির ইচ্ছা অনুযায়ী অর্থাৎ (মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই), তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে কবর দেয়া হয়।
এরপর একই বছর ১২ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ’ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রে’র মিলনায়তনে এক সর্বদলীয় শোক সভায় নজরুল স্মৃতি রক্ষার্থে ‘নজরুল ভবন’ প্রকল্প গৃহীত হয়।
পরবর্তীতে ১৯৮৪ এর ১২ জুন ‘নজরুল ইনস্টিটিউট’ অধ্যাদেশ জারি করা হয় এবং ৮৫-এর ফেব্রুয়রিতে কবি ভবনে ‘নজরুল ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠিত হয়।
নজরুল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার ফলে এ দেশে নজরুল চর্চার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত এবং গতি সঞ্চারিত হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠান থেকে ১৭ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে ’নজরুল রচনাবলী’ সহ ’নজরুল চর্চা’র উপর বিভিন্ন গবেষণামূলক গ্রন্থ।
নজরুলের জীবন ও সাহিত্য চর্চার ক’য়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল- গোলাম মুরশিদের ’বিদ্রোহী রণক্লান্ত নজরুল-জীবনী’, অরুণ-কুমার বসুর ’নজরুল জীবনী’, আবদুল মান্নান সৈয়দের ”‘নজরুল জীবনী’, রফিকুল ইসলামের ‘কাজী নজরুল ইসলাম : জীবন ও সৃষ্টি’, মুজাফ্ফর আহমদের ‘কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতি কথা’।
এ ছাড়া ব্যক্তিগত উদ্যোগে রেডিও তেহরানে চাকুরিকালীন জনাব ঈসা শাহেদী নজরুলের কিছু কবিতা ফার্সীতে অনুবাদ করেন। পরবর্তীতে ঢাকাস্থ ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নজরুল-কবিতার এ ফার্সী অনুবাদ সংকলনটি প্রকাশ করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের ব্যবস্থাপনায় দেশের ৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে নজরুল চেয়ার প্রবর্তন, নজরুল অধ্যাপক পদ সৃষ্টি এবং নজরুল গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নজরুল-অধ্যাপক পদ সৃষ্টি ও নজরুল গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হলেও, এ যাবৎ এ প্রতিষ্ঠানগুলো নজরুল চর্চার ক্ষেত্রে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে নি।
এতো গেল নজরুল চর্চার একপিঠ। এর অপর পিঠটি অর্থাৎ এ দেশে নজরুলকে কতটুকু মূল্যায়ন করা হয়েছে, সে সম্পর্কে বলতে গেলে দেশের অধিকাংশ গবেষক প্রাবন্ধিকদের উক্তিতে ফুটে উঠেছে হতাশা।
আমি এ বিষয় বিস্তারিত আলোচনা না করে প্রাবন্ধিক আবদুল হাই সিকদারের ‘বাংলাদেশে নজরুল চর্চা: মুখোশ ও বাস্তবতা’ প্রবন্ধ থেকে এ বিষয়ক দু’একটি আক্ষেপ তুলে ধরে এ লেখার ইতি টানছি। তিনি লিখেছেন :
এক. নজরুলের উপর আজ অবধি কোন জাতীয় নীতি কারো কাছ থেকে পাই নি আমরা।
দুই. নজরুলের স্মৃতি স্থায়ী-ভাবে সংরক্ষণের কোন উদ্যোগ কোথাও নেই। উল্টো কাজীর শিমলায় নজরুলের থাকা ঘরটি পরিণত হয়েছে গোয়ালে।
তিন. শৈশবে নজরুল প্রীতির বীজ অংকুরিত হয় বাংলাদেশের ছেলে-মেয়েদের বুকে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে বাংলা সাহিত্যের যে কোন ছাত্র ব্যথিত বিস্ময় নিয়ে লক্ষ্য করেন, নজরুলের স্থান পাঠ্য তালিকায় এত কম যে, তাকে না-পড়েও বাংলা সাহিত্যে এম, এ পাস করা সম্ভব।
নজরুলের নামে আলাদা কোন ’পত্র (পেপার)’তো নেই-ই বরং অন্য দশজন কবির সঙ্গে কোন রকম বাংলা সাহিত্যের সিলেবাসের এক কোনায় সামান্য একটু ঠাঁই পেয়েছেন তিনি।
চার. আমরা বার বার ভুলে যাই আমাদের কর্তব্যের কথা, আমাদের অর্পিত দায়িত্ব। এ জন্যই আমাদের ভুলের ফাঁক ফোকর দিয়ে বার বার ঢুকে পড়ে দূষণ। আমরা হয়ে পড়ি শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন, হয়ে পড়ি বিভ্রান্ত, নিজ বাসভূমি তখন আমাদের জন্য পরবাস হয়ে পড়ে।
অথচ ইংরেজরা পৃথিবীর যে প্রান্তে গিয়েছে, সেখানে নিয়ে গেছে শেক্সপিয়ারকে, জার্মানরা গ্যাটেকে ছড়িয়ে দিয়েছে বিশ্বময়, রুশরা গোটা দুনিয়া ফেরি করে ফিরেছে পুশকিন, টলস্টয় আর গোর্কীদের, চীনারা মাওবাদের পাশে পাশে ধারণ করেছে লুসানকে, যেভাবে ইরানীরা বয়ে বেড়ায় ফেরদৌসী, হাফিজ ও রুমীর উত্তরাধিকার… শুধু আমাদের দূতাবাস আমাদের জাতীয় কবির ব্যাপারে নীরব নিঃশব্দ। হাতে গোনা কয়েকটি অতি বিখ্যাত কবিতার বাইরে নজরুল থেকে যাচ্ছেন অপাঠ্য।
যে স্মৃতিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে পারতো নয়নাভিরাম সৌধ, হতে পারত অনন্য সাধারণ তীর্থ, যে সমুদ্রে অবগাহণ করে আমরা হতে পারতাম সত্যিকার অর্থেই আত্মস্থ এবং পরিপূর্ণ মানুষ, সেখানে এখন ঝোপ আর জঙ্গল!
আজকে কবি নজরুল ইসলামের ৪৫তম প্রয়াণ বার্ষিকীতে নজরুল-প্রেমী ও অনুরাগীদের এটাই হোক জিজ্ঞাসা।
শেষে বরিশালের একজন মানুষ হিসেবে ছোট্ট একটি দাবী রাখছি, দেশের বিভিন্ন স্থানে কত ম্যুরাল তৈরি হচ্ছে। কবির নামকরণ করা ’বাংলার ভেনিসে’ও কবির বর্ণিত স্থানে তাঁর একটি ম্যুরাল তৈরি করা হোক। যার নিচে লেখা থাকবে “বাংলার ভেনিস বরিশালে স্বাগত।”