মা করতেন কাপড় বোনার কাজ। আর বাবার ছিল সাইকেল সারানোর ছোট্ট গুমটি। তাই ছোটবেলা থেকেই বাবার সাইকেলের কলকব্জা নিয়েই খেলতে ভালবাসতেন তিনি।
তিনি যে স্কুলে পড়তেন, সে সময় সেই স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের রিপোর্ট কার্ড মুখ বন্ধ খামে করে বাবা-মায়েদের কাছে পাঠানো হত। তাঁরা সেটা দেখে, তাঁরা যে সেটা দেখেছেন, তার প্রমাণস্বরূপ পারিবারিক সিলমোহর মেরে আবার মুখ বন্ধ খামে করে স্কুলে পাঠিয়ে দিতে হত।
তাঁর পড়াশোনায় ফাঁকি এবং দুরন্তপনার খবর যাতে বাবা-মা কিছুতেই জানতে না পারেন, সে জন্য তিনি নিজেই সেই খাম খুলতেন। কিন্তু সিলমোহর পাবেন কোথায়? বাবা তো সেটা আলমারিতে তালা-চাবি দিয়ে রাখেন। ফলে বাবার ফেলে দেওয়া লোহার কলকব্জা নিয়ে বানিয়ে ফেললেন নকল একটা সিলমোহর। শুধু নিজের জন্যই নয়, বানিয়ে ফেললেন ক্লাসের অন্য বন্ধুবান্ধবদের জন্যও। যাতে তাঁর কোনও সহপাঠী মার তো দূরের কথা, বাবা-মায়ের কাছে সামান্য বকাঝকাও না খায়।
সূর্যোদয়ের দেশ জাপানের ফুজি পাহাড়ের নীচে ছোট্ট একটি গ্রামে ১৯০৬ সালের ১৭ নভেম্বরে জম্মানো এই ছেলেটি মাত্র ১৫ বছর বয়সেই কাজের সন্ধানে বাড়ি থেকে পালিয়ে টোকিও চলে যান।
সেখানে জুটিয়ে নেন গ্যারেজের একটা কাজ। কলকব্জা পরিষ্কার করা ছাড়াও মালিকের বাচ্চার দেখাশোনা করাই ছিল তার মূল কাজ।
এক বছরও কাটল না। ১৯২৩ সালে ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পে টোকিওতে মারা যান প্রায় এক লাখ মানুষ। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় সেই গ্যারাজটিও। অনেক মেকানিক তখন চাকরি ছেড়ে চলে যান। ফলে তিনি হয়ে ওঠেন সেখানকার প্রধান মেকানিক।
ওখানে হাতে-কলমে কাজ শিখে একুশ বছর বয়সেই মাত্র একজন কর্মী নিয়ে শুরু করে দেন নিজের গাড়ি মেরামতির দোকান।
জাপানে ভীষণ ভূমিকম্প হয়। ফলে মজবুত গাঁথুনি ছাড়া টিকে থাকা সম্ভব নয়, তাই কাঠের ছাঁচের বদলে তিনি প্রথম চালু করলেন লোহার ছাঁচ। আর তা করা মাত্রই রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে উঠল সেটা। জাপানের জাতীয় ইন্ডাস্ট্রিয়াল সম্মেলনের প্রদর্শনীতে সেটা দেখে সবাই তাঁর নামে জয়জয়কার করতে লাগলেন।
তবু সেটাকে আরও বিজ্ঞানসম্মত ভাবে করার জন্য ৩০ বছর বয়সে মোটর মেকানিক প্রশিক্ষণের স্কুলে ভর্তি হলেন তিনি। চারপাশে ছোট ছোট বাচ্চাদের সঙ্গে পড়তে গিয়ে তখন কত লাঞ্ছনা যে তাঁকে সইতে হয়েছে!
১৯৪২ সালে তিনি যোগ দেন টয়োটাতে। খুব দ্রুত হয়ে যান প্রধান নির্বাহী পরিচালক। কিন্তু ১৯৪৫ সালের দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ধ্বংস হয়ে যায় পুরো জাপান।
যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে সবাই যখন দু’বেলা খাবার জোগাড় করতেই হিমশিম খাচ্ছেন, তখন দিন-রাত এক করে ১৭০ স্কোয়ার ফিটের ছোট্ট একটি গ্যারেজে, মাত্র ১২ জন কর্মী নিয়ে তিনি শুরু করে দিলেন বাইসাইকেল (Motorized Bicycle) তৈরি এবং বিক্রির কাজ। গড়ে তুললেন— হোন্ডা টেকনোলজি রিসার্স ইন্সটিটিউট এবং ১৯৪৬ সালে তৈরি করে ফেললেন প্রথম মোটরচালিত সাইকেল।
সেই মোটর সাইকেলে তিনি প্রথম ব্যবহার করলেন সাধারণ বাইসাইকেলের ইঞ্জিন। এবং পাতি জলের বোতল দিয়ে বানালেন তেলের ট্যাঙ্ক। জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করলেন জাপানের সব চেয়ে সহজলভ্য ‘ফির অয়েল’ নামক বিশেষ এক ধরনের তেল।
বারবার ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। প্রতি পদে পদে পড়েছেন সমস্যায়। সামান্য টাকার জন্য বউয়ের যাবতীয় গয়না পর্যন্ত বিক্রি করতে হয়েছে। ভাগ্য বারবার পরিহাস করেছে তাঁর সঙ্গে।
তবু সেই ভাগ্যই শেষ পর্যন্ত তাঁর পাশে এসে দাঁড়াল। সেই মোটর সাইকেলের চাহিদা দেখতে দেখতে এত বেড়ে গেল যে, সেই চাহিদা সামাল দেওয়ার জন্যই ১৯৪৮ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন— হোন্ডা মোটর কোম্পানি। যে কোম্পানি মোটর সাইকেলের পাশাপাশি পরবর্তিকালে জেট বিমান নির্মাণের কাজেও হাত দেয় এবং সেখানেও চূড়ান্ত সফল হয়।
একমাত্র তাঁর পরিশ্রম, নিষ্ঠা আর কারিগরি কৌশলের জন্যই ১৯৬৪ সালের মধ্যেই সেই হোন্ডা কোম্পানি পৃথিবীর সব চেয়ে বড় মোটর সাইকেল নির্মাতায় পরিণত হয়। হয়ে ওঠে বিশ্ববিখ্যাত হোন্ডা কোম্পানি। এখনও অনেকে ‘হোন্ডা’ বলতে মোটর সাইকেলকেই বোঝেন।
১৯৯১ সালের ৫ আগস্ট ৮৪ বছর বয়সে কিডনিজনিত জটিলতার কারণে জাপানের টোকিওতে এই মহানায়কের জীবন-যুদ্ধের অবসান ঘটে। তিনি আর কেউ নন, অটোমোবাইল সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র সম্রাট— সইচিরো হোন্ডা।
তিনি বলতেন, ‘যে কোনও সাফল্যের পিছনে রয়েছে ১ শতাংশ কাজ আর ৯৯ শতাংশ ব্যর্থতা।’ অর্থাৎ, পরাজয়ই জয়ের একমাত্র পথ।