সরকারি নির্দেশে শাস্তিস্বরূপ একটা ‘ট্রাভেল পারমিট’ যে কারও জীবনের আপাদমস্তক বদলে দিতে পারে, তার জলজ্যান্ত প্রমাণ— ইলিয়া এরেনবুর্গ। আঠারোশো একানব্বই সালের সাতাশে জানুয়ারি রাশিয়ার কিয়েভ শহরে এক বুর্জুয়া ইহুদি পরিবারে তাঁর জন্ম। ছোটবেলা থেকেই তিনি এত দুরন্ত এবং ডানপিটে ছিলেন যে, তার জন্য তাঁর বাবা-মাকে প্রায় রোজই কারও না কারও কাছে নালিশ শুনতে হত।
একবার কাউকে কিছু না বলেই হঠাৎ উধাও হয়ে এলেন তিনি। শুরু হল খোঁজাখুঁজি। চারিদিকে খোঁজ খোঁজ খোঁজ। কিন্তু তাঁকে আর পাওয়া গেল না। তখন তাঁর বয়স এমন কিছুই নয়, খুব বেশি হলে বারো কি তেরো। দিন পাঁচেক ছোটাছুটি করে বাবা-মা এবং পাড়াপড়শিরা যখন ক্লান্ত, ছেলেকে ফিরে পাবার আশা ত্যাগ করেছেন, ঠিক তখনই, যে হোটেলে তাঁরা থাকতেন, সেখানে একটা টেলিগ্রাম এসে পৌঁছল। তাঁর ইঞ্জিনিয়ার বাবার নামে। ছেলে লিখেছেন— ‘বাবা, আমি বার্লিনে চলে এসেছি। একদম টাকা পয়সা নেই। এমনকী বাড়ি ফেরার মতো ভাড়াও নেই। কিছু টাকা পাঠাও। আমি বাড়ি ফিরব।’
সে দিনই তড়িঘড়ি করে টাকা পাঠানো হল। কোনও কাণ্ড ঘটিয়ে বাড়ি ফিরলে প্রত্যেক বার যেমন মারধোর করা হয়, এ বার আর তা করা হল না। মা-বাবা শুধু চোখের জল ফেললেন। ছেলেও চুপচাপ। এ ভাবেই নিঃশব্দে কেটে গেল বেশ কয়েকটা দিন। একদিন হঠাৎই মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়লেন এরেনবুর্গ। মাকে ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করলেন, তিনি আর কখনও কোনও দিন এ ভাবে তাঁদের না বলে কোথাও যাবেন না।
এর পর নিজে থেকে আর কখনও ঘর ছেড়ে পালাননি তিনি। অথচ আশ্চর্য ব্যাপার! এর কিছু দিন পর থেকেই তাঁকে ঘর ছেড়ে থাকতে হয়েছে। পালিয়ে থাকতে হয়েছে নিয়মিত। কখনও জারের পুলিশের হাত থেকে বাঁচার জন্য, কখনও রাশিয়ার অন্তর্বর্তিকালীন সরকারের চোখকে ফাঁকি দিতে, আবার কখনও বা সরাসরি সোভিয়েত সরকারের অত্যাচার এড়ানোর জন্য। অথচ তা সত্ত্বেও তিনি ধরা পড়লেন। তাঁর বয়স তখন সবেমাত্র চোদ্দো। এই অল্প বয়সেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পদে দায়িত্বের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছিলেন তিনি।
এর পর অনেক অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে। একসময় সেই অত্যাচার এত মারাত্মক হয়ে উঠেছিল যে, মারের চোটে তাঁর বেশির ভাগ দাঁতই পড়ে যায়। অবশেষে সেই নির্মম অত্যাচারের প্রতিবাদে তিনি আমরণ অনশন শুরু করেছিলেন। সে খবর ধামাচাপা থাকেনি। রাস্ট্র হয়ে গিয়েছিল। ফলে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল তাঁর দলের গুপ্তবাহিনী। তারা স্লোগান তুলেছিল— এরেনবুর্গের নিঃশর্তে মুক্তি চাই। প্রতিদিনই তারা কোথাও না কোথাও বিক্ষোভ দেখাচ্ছিল। আইন অমান্য করেছিল। সংগঠিত করছিল এখানে সেখানে অশান্তি। তাই আর রিক্স না নিয়ে সরকারের তরফ থেকে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। তবে নিঃশর্ত নয়। তার সঙ্গে এমন একটা শর্ত আরোপ করা হয়, যাতে তিনি এক জায়গায় খুব বেশি দিন আর থাকতে না পারেন। এমন বন্দোবস্ত করে তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয় একটি ‘ট্রাভেল পারমিট’ এবং নির্দেশনামা।
এর পর থেকেই তাঁর আর এক জায়গায় খুব বেশি দিন থাকা হয়ে ওঠেনি। যাযাবরের মতো ঘুরে ঘুরে থাকতে হয়েছে কখনও এখানে কখনও সেখানে। ঘুরতে হয়েছে দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। এবং যে কোনও জায়গায় পৌঁছনো মাত্রই স্থানীয় থানায় তাঁকে জানাতে হয়েছে তাঁর আগমনবার্তা।
এই সময় তাঁর ওপর কড়া নজর থাকা সত্ত্বেও তিনি বূদ্ধিবলে সে সব এড়িয়ে আশপাশের মানুষের সঙ্গে অবলীলায় মিশেছেন এবং দেখেছেন মানুষ ভেদে ভিন্ন ভিন্ন জাতি, ধর্ম, রুচি ও ধ্যান-ধারণা। এই সময়, এই সব মানুষদের তিনি খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পান। এবং এদের কথা তিনি অন্য ভাবে ভাবতে শুরু করেন। আর সেই ভাবনাগুলোই নথিভূক্ত করতে থাকেন একটা জাবদা খাতায়। ফলে ওই সব লেখাজোখা করতে করতেই তাঁর মনের গভীরে কোথাও একটা সাহিত্যের দানা বাঁধতে থাকে। তখন তাঁর বয়স সবেমাত্র কুড়ি কি একুশ।
সেই জানা, দেখা এবং অভিজ্ঞতাই পরবর্তিকালে তাঁর জীবনে লেখালিখির বিষয় হয়ে উঠেছিল, যা বিশ্বসাহিত্যে দিয়েছে স্বতন্ত্র সৃষ্টি।
এরেনবুর্গ সম্পর্কে বলা হয়, তিনিই একমাত্র, যিনি তিন মহাযজ্ঞ দেখা লেখক। অর্থাৎ প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছাড়াও স্পানিয়ার গৃহযুদ্ধ তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন। আর এই তিন যুদ্ধেই তিনি প্রত্যক্ষ ভাবে অংশ নিয়েছিলেন সাংবাদিক হিসাবে।