প্যারিস থেকে একটু দূরে ভেনদোমের একটি স্কুলে ভীষণ কড়াকড়ি নিয়ম ছিল। স্কুলটির প্রত্যেক ক্লাসের দরজার পাশে একটি করে বেঞ্চ রাখা হত। সেটার নাম দেওয়া হয়েছিল— গাধার বেঞ্চ। যারা হোমটাস্ক করে আনত না বা ক্লাসে পড়া পারত না, তাদের গিয়ে বসতে হত ওটায়। ওটা ছিল বার্ষিক পরীক্ষায় ফেল করার চেয়েও অপমানজনক। একবার ওই বেঞ্চে কেউ বসলে ক্লাসের আর কেউ পারতপক্ষে তার সঙ্গে মিশত না।
সেই বেঞ্চে একটি অলস, নির্বোধ, একগুঁয়ে এবং একদম অপদার্থ ছেলেকে প্রায়ই বসতে দেখা যেত। সে এতবার ওই বেঞ্চে বসেছিল যে, ধরেই নেওয়া যায় স্কুলের মধ্যে সে-ই ছিল সব চেয়ে কাঁচা বা পাতি বাংলায় একেবারে মাথামোটা। যার ফলে কঠোর শাস্তি হিসেবে দু’বছরের মধ্যে স্কুল কর্তৃপক্ষ তাঁকে মাত্র দু’দিন ছুটি দিয়েছিল।
সে ভবিষ্যতে কী করবে তা নিয়ে বিরূপ মন্তব্যের ছড়াছড়ি ছিল আত্মীয়স্বজন-চেনাজানাদের মধ্যে। এমনকী, হাজার চেষ্টা করেও, স্পেশাল ক্লাস নিয়েও যখন তাকে কিছুতেই মানুষ করা যাচ্ছে না, তখন তিতিবিরক্ত হয়ে স্কুলের স্বয়ং হেডমাস্টার তাকে বাড়িতে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তার বাবা-মাকে অত্যন্ত কড়া ভাষায় চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছিলেন, এর আর কিচ্ছু হবে না। এ একটা নষ্ট বালক। আমরা হাল ছেড়ে দিয়েছি।
শুধু মাস্টার বা হেডমাস্টারই নয়, তার বাবা-মাও তার সম্বন্ধে খুবই হতাশা বোধ করতেন। এবং এই রকম একটা অপদার্থ ছেলের জন্ম দেওয়ার জন্য আফসোস করতেন। মরমে মরে থাকতেন। এমনকী, ওরা যে তার বাবা-মা সেই পরিচয়টুকু পর্যন্ত কাউকে দিতে চাইতেন না। সে জন্য সর্বদা ছেলের কাছ থেকে দূরে দূরে থাকতেন। কে কী বলবেন, সেই ভয়ে ক্রিসমাসের ছুটি পড়লেও ছেলেকে স্কুল থেকে তাঁরা বাড়িতে আসতেন না।
অথচ এই ছেলেটির নাকি লেখাজোঁকা করতে চায়। এটা শুনে অভিভাবকরা যেন আকাশ থেকে পড়লেন। এ ছেলে বলে কী! এটা নিশ্চয়ই তার ফাঁকি দেওয়ার আর একটা নতুন অজুহাত মাত্র। তাই ছেলেকে কঠিন নির্দেশ দেওয়া হল— লেখালেখি করতে পারো। তবে দু’বছরের মধ্যে বই লিখে টাকা রোজগার করতে হবে। আর তা যদি না পারো, তা হলে সব ছেড়েছুড়ে তোমাকে আবার পড়াশোনার জন্য ফিরে যেতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ে।
এ কী সম্ভব? তবু কী আর করা! পিতার নির্দেশ বলে কথা। তাই মাস চারেক অক্লান্ত পরিশ্রম করে অবশেষে লিখে ফেললেন একটি কাব্যনাটক। কিন্তু কেমন হয়েছে সেটা! মতামত জানার জন্য একদিন বেশ কিছু কবি, লেখক, সমালোচক, শিক্ষক এবং বন্ধু-বান্ধবদের নেমন্তন্ন করে বাড়িতে ডেকে আনলেন। সেই ঘরোয়া আড্ডায় সবার সামনে সে পাঠ করে শোনাল সেই কাব্য নাটকটি। শুনে সবাই খুব হতাশ বোধ করলেন। কেউ কেউ তার মুখের ওপরেই বলে দিলেন, এটা কিচ্ছু হয়নি। একজন স্কুল মাস্টার তো বলেই ফেললেন, এটা রেখে আর কী করবে! হয় কাগজওয়ালার কাছে কিলো দরে বেঁচে দাও, নয়তো পুড়িয়ে ফেলো।
কিন্তু নিজের লেখা তো নিজের সন্তানের মতোই। তাই হাল ছাড়লেন না তিনি। এ দিকে সময় ক্রমশ ফুরিয়ে আসতে লাগল। যখন বাবার বেঁধে দেওয়া সময় শেষ হতে আর মাত্র মাস দেড়েক বাকি, তখন রাতদিন এক করে তিনি লিখে ফেললেন, না কোনও কাব্যনাটক নয়, একটি উপন্যাস। জীবনের প্রথম উপন্যাস।
অবাক কাণ্ড! নতুন লেখককের ভাগ্যে একটি প্রকাশক জুটে গেল। এইবার আর কোনও বাধা রইল না। তাকে ফিরে যেতে হল না বাঁধা-ধরা শিক্ষার গণ্ডির ভেতরে। তিনি একের পর এক শেষ করতে লাগলেন নতুন নতুন লেখা এবং অল্প কিছু দিনের মধ্যেই সবার অনুমান আর আশঙ্কা ভুল প্রমাণিত করে, রিয়ালিজমের প্রবর্তক, ফরাসি সাহিত্যের অন্যতম এই দিকপাল, কেবলমাত্র লেখাজোঁকা করেই কেড়ে নিয়েছেন বিশ্বসাহিত্যের একটি স্থায়ী আসন। অলস, নির্বোধ এবং একগুঁয়ে এই পড়ুয়ার নাম থেকে এইচ ডিই বাদ দিলেও, শুধু ‘বালজাক’ বললেই অনায়াসে চিনে নেওয়া যায় এবং শুধুমাত্র বালজাক হিসেবেই তিনি আজও সবার মনের মনিকোঠায় অনেকখানি জায়গা জুড়ে রয়েছেন।