মূল সমাধিসৌধের সামনে দাঁড়িয়ে সাদা পাথরের গোলাকার গম্বুজের দিকে স্তব্ধ হয়ে পলকহীন চোখে তাকিয়ে রইল ময়ূখ। সমাধির ওপরে লাগানো কারুকাজ করা কাচের ভেতর দিয়ে জ্যৈষ্ঠের কড়া রোদ ঝাঁপিয়ে পড়ছে ভেতরে। কোথাও আলো, কোথাও ছায়ার মায়াবি খেলা ছড়িয়ে পড়েছে সমাধিতে। এর ওপরের দেয়াল জাফরি কাটা। ওই কাটা অংশ দিয়েও আলো ঢুকছে ভেতরে। লাল সিরামিক ইট আর সাদা-কালো মার্বেল পাথর দিয়ে তৈরি এ সৌধের কারুকাজে ফুটে আছে অবাক করা কষ্টের চিহ্ন। চারদিকে কালো ও মাঝখানে শ্বেতশুভ্র টাইলস দিয়ে বাঁধানো রয়েছে একটি কবর। সমাধির ভেতরের তিনটি কবর ঘিরেই উপরে রয়েছে মূল গম্বুজ। এসব দেখে আকস্মিক শান্তির একটা স্রোত ছুটে এল ময়ূখের হৃদ-সাগরে।
এ স্রোতের উৎস কোথায়?
পাশ দিয়ে বয়ে চলা বাইগার নদী!
নাকি পদ্মা মেঘনা যমুনা কর্ণফুলী গৌরীর প্রাকৃতিক স্রোত মূল গম্বুজ পর্যন্ত চলে এসেছে!
ময়ূখের ভাবনায় জট বেঁধে গেছে। আশ্চর্য হয়ে দেখল মাটির স্তূপ থেকে মূল কবর অভাবনীয় গতিতে রাজ-সিংহাসনের মতো উঠে গেছে উপরে। ঘোরের ভেতর ও পেয়ে গেল একটা সিঁড়ি। আর এ সিঁড়ি বেয়ে সেও উঠে এসেছে আকাশ-সিংহাসনের সামনে। এ আসনের চারপাশে কালো টাইলসটা অবিকৃত রয়েছে। মাঝের শ্বেতশুভ্র পাথর ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে বিরাট সিংহাসনটি। সিংহাসনে বসে আছেন এক দীপ্যময় আলোর পুরুষ। তাঁর গায়ে সাদা পাঞ্জাবি, পাঞ্জাবির মিহি সুতোর ভেতরে সাদা গেঞ্জিও দেখতে পাচ্ছে ময়ূখ। পাঞ্জাবির এক পকেটে উঁকি দিচ্ছে কালো চশমা, আরেক পকেটে পাইপ। তাঁর মোচের ভেতর থেকেও বেরিয়ে আসছে জ্যোতির্ময় প্রজ্ঞার হাসি। এমন জীবন্ত দৃশ্য কীভাবে দেখছে ময়ূখ! ভাবতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলছে।
‘কী? এভাবে তাকিয়ে কী ভাবছ, ময়ূখ?’
‘আপনি কি আমাদের বঙ্গবন্ধু, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি? বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা? জাতির পিতা?’
‘বাহ্! তোমার মনজুড়ে দেখছি জড়িয়ে আছি আমি!’
‘কেবল জড়িয়ে আছেন! আমি তো আপনার আলোয় আলোকিত, আপনার সত্তা তো মিশে আছে আমার সত্তায়। আপনাকে নিজের চোখে দেখতে পেয়ে আমি তো আমাকেই হারিয়ে ফেলেছি। আবার আমার সত্তাটাও খুঁজে পাচ্ছি।’
মুচকি হাসলেন সিংহাসনে আসীন আলোর পুরুষ। জ্যোতির্ময় চোখ মেলে তিনি তাকিয়ে আছেন ময়ূখের দিকে।
‘আমি শুনেছি ঘাতকরা আপনাকে কেবল গুলিতে ঝাঁজরা করে দেয়নি, আপনার মৃতদেহের ওপরও সহিংসতা চালিয়েছিল। আর আপনার শেষ বিদায়ের কাফনের কাপড়টাও ছিল অনাড়ম্বর। দুস্থ নারীদের জন্য পাঠানো সাদা জমিন শাড়ির লাল-কালো পাড় ছিঁড়ে কাফনের কাপড় হিসেবে পরিয়ে আপনাকে দাফন করা হয়েছিল!’
আবারও হো হো করে হেসে উঠলেন জ্যোর্তিময় পুরুষ। স্থির চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘ওই কাপড়ে তো মিশে ছিল দুস্থ মানুষের জন্য আমার মমতা। খুনিরা আমাকে নির্মমভাবে গুলি চালিয়ে হত্যা করলেও আমায় মানুষের মমতা থেকে তো ছিন্ন করতে পারেনি। শেষ যাত্রায় তো আজন্মের সাধ মানুষের ভালোবাসা গায়ে জড়িয়েই সাড়ে তিন হাত ভূমিতে আসন পেতেছি। ঘাতকরা কি তা জানে? জানে না।’ কথা শেষ করেই আবারও হো হো করে হেসে উঠলেন তিনি। তাঁর হাসির দাপটে টুঙ্গিপাড়ার বাইগার নদীর জলে নতুন এক ঢেউ উঠে তা ছড়িয়ে যেতে লাগল। মধুমতি, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, কর্ণফুলী, গৌরীর বুকেও আঘাত হানল নতুন ধরনের ঢেউ। শেখ পরিবারের ঐতিহ্যবাহী বড় ও ছোট পুকুরের মাছেরা দাপাদাপি শুরু করে দিল। যেখানে বঙ্গবন্ধু ছেলেবেলায় গোসল করতেন সেই হিজলতলা ঘাটে শুভ্র পানির ঢেউ এসে আঘাতের পর আঘাত হানতে লাগল। বঙ্গবন্ধুর অতি প্রিয় বালিশা আমগাছে বসা একঝাঁক পাখি উড়াল দিল আকাশে। সমাধির আকাশজুড়ে ওড়াউড়ি শুরু করে দিল ওরা। থরথর করে কেঁপে কেঁপে উঠছে মাজার কমপ্লেক্সের মাটি, এখানকার পাঠাগারের দেড় হাজারেরও বেশি বইয়ের ভেতর আসন পাতা অক্ষর-সমুদ্রের কোটি কোটি শব্দ জেগে উঠেছে। চারপাশে শোরগোল তুলে কাঁপিয়ে দিচ্ছে পাঠাগার, গবেষণা কেন্দ্র, প্রদর্শনী কেন্দ্র, পাবলিক প্লাজা, প্রশাসনিক ভবন। উন্মুক্ত মঞ্চের গ্যালারিতেও আচমকা ছুটে এসেছে ৭ই মার্চের জনতার ঢলের একাংশ। ওদের অধিকাংশই দাঁড়িয়ে আছে সমাধি কমপ্লেক্সের এক নম্বর গেটের বাইরে; মুহুর্মুহু স্লোগান তুলছে। সেই স্লোগানের দাপটে বকুলতলা চত্বর ভরে গেছে ঝরে পড়তে থাকা ফুলে ফুলে। মনোরম এ বাগানে ফুটতে শুরু করেছে নাম না-জানা অসংখ্য ফুল। কমপ্লেক্সের ভেতরের কৃত্রিম পাহাড়টার চূড়া যেন উঠে গেছে আরও উপরে। আকাশ ছুঁয়ে দিচ্ছে।
হু হু বাতাসের দাপটে খুলে গেছে ময়ূখের অনুভবের দরজা। কিছুতেই সে-দরজা সাঁটাতে পারছে না ও।
‘কী ময়ূখ, এমন বোকার মতো চেয়ে আছ কেন?’
‘ঘাতকের দল আপনাকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল। তাচ্ছিল্যভরে টুঙ্গিপাড়ায় কবর দিয়ে আপনাকে দেশবাসী থেকে দূরে ছুড়ে দিতে চেয়েছিল। আমি অনুভব করছি তাদের উদ্দেশ্য বিন্দুমাত্র সফল হয় নি। আমি বুঝতে পারছি তারা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। আমি বুঝতে পারছি আপনি মিশে আছেন বাংলার মাটি, ফুলে-ফলে শোভিত সবুজ প্রকৃতিতে, নদী আর সাগরের জলে, এমনকি পাখপাখালির কলকাকলিতে। মানুষের মনে তো অবশ্যই।
‘গুপ্তঘাতক কি নেই সেই মানুষের দলে?’
‘আছে, বন্ধু আছে। তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। মূল খুনিদের অনেকের ফাঁসি হয়েছে, অনেকে পলাতক আছে; ফাঁসির দড়ি ঝুলছে তাদের মাথার ওপর।’
‘ভদ্র মুখোশ পরা কোনো গুপ্তঘাতক কি এখনও নেই, ময়ূখ? ইতিহাস বিকৃতকারীর দল কি চুপ হয়ে আছে? নাকি গোপনে শতছিন্ন করে দিতে চায় ওরা ইতিহাসের মূল দলিল?’
‘পারবে না। কোনো দিন তা তারা পারবে না আর। ওপার থেকে শুনতে পান নি তাদের পতনের কথা?’
ময়ূখের প্রশ্নের উত্তর দিলেন না বঙ্গবন্ধু। তিনি দেখলেন আকাশে উড়ছে শকুনের দল। তিনি দেখছেন হায়েনারা ঘুর ঘুর করছে এখনও দেশজুড়ে। সুযোগের অপেক্ষায় ওত পেতে আছে তারা। ময়ূখকে এসব বলে ভীত করে তুলতে চাইলেন না। তার ভেতরের অনুভবকে সম্মান জানিয়ে তাকে বোঝার চেষ্টা করে বললেন, ‘এসবের খোঁজ-খবর রাখে তোমাদের প্রজন্ম?’
‘বলেন কি, বন্ধু? একাত্তরের মহাকাব্যিক ভাষণ তো আমাদের বিরাট ঐশ্বর্য। বিশ্বদরবারেও “ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ”-এর অংশ হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি নিয়ে বিশ্বের মর্যাদাপূর্ণ ভাষণের তালিকায় তা উঠে গেছে। ইতিহাসের সংরক্ষিত মহান দলিল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। কারও বিকৃতির আঁচড়ে কি আর তার কোনো শব্দের পতন হতে পারে, বদলে যেতে পারে?’ কথা বলার সময় ময়ূখের ভেতরের রোষ আর জোশ তার চোখমুখ দিয়ে আলো ছড়াতে লাগল। তা দেখে বঙ্গবন্ধু মোচের ফাঁকে ঈষৎ হাসির টান ধরে রেখে চেয়ে রইলেন ময়ূখের দিকে।
অপর পক্ষের সাড়া না পেয়ে ময়ূখ আবার বলতে লাগল, ‘আপনার কারাগারের রোজনামচা বই আমি পড়েছি, অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়েছি। মনে হয়েছে রাজনীতিবিদ না হয়ে আপনি যদি লেখক হতেন, তাহলেও বিশ^দরবারে আসীন হতে পারতেন। আপনার লেখকসত্তাও বেশ উঁচুস্তরের।’
‘তোমার মুখে নিজের সাহিত্যসত্তার খবর পেয়ে ভালো লাগছে, ময়ূখ। তো তোমরা কি বুঝতে পারছো, এখন আমার হাসু দেশ শাসন করছে, তাই আমার প্রশংসা ছড়াচ্ছ তোমরা। যখন সে ক্ষমতায় থাকবে না তখনও কি এভাবেই আমার রেখে আসা রাজনৈতিক জীবন আর লেখকসত্তাকে সমান মূল্য দিয়ে মাপতে পারবে, কী বলো তুমি, ময়ূখ?’
ময়ূখকে বাজিয়ে দেখার জন্য কঠিন প্রশ্ন সহজ ভঙিতে তুলে ধরলেন বঙ্গবন্ধু। আর তা শুনে থরথর করে কেঁপে উঠল ময়ূখ। নিজেকে অবিষ্কার করার চেষ্টা করল ও। বুঝতে পারল দূরদর্শী প্রশ্ন কেন করেছেন এ মহান নেতা। নিজেকে ভেঙেচুরে গুঁড়ো করে দিয়ে সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে জেগে উঠে সব বুঝে দৃপ্তস্বরে ময়ূখ বলল, ‘না। কোনো দিন না। কোথাও আগুন লেগে গেলেও মস্তিষ্কের অরণ্যে লুকিয়ে থাকা অক্ষরমালা একসঙ্গে জেগে উঠবে। নিভিয়ে দিবে সেই আগুন। অনূদিত হয়ে আপনি এখন ছড়িয়ে গেছেন বিশ্বের অসংখ্য দেশের বহু ভাষার অক্ষরস্রোতে। এ স্রোত সাগরের সহস্র ঊর্মিমালার মতো সতত বহমান থাকবে। ইতিহাসের এ বাতিঘর আর নেভানোর শক্তি নেই কোনো অপশক্তির। যতই নেভানোর চেষ্টা হোক না কেন, ততই শব্দভেলায় চড়ে আপনার কীর্তি আরও গতি পাবে, যুগ থেকে যুগে। কালের সর্বোচ্চ আলোঘরে আপনাকে ঘিরে সহস্র কোটি শব্দরাজি স্থান পেয়ে গেছে। আর তা নিভানোর শক্তি থাকবে না মানবকুলের।’
কোটি কোটি শব্দ-তরঙ্গ আঘাত হানতে লাগল আলোময় বঙ্গবন্ধুর গহনে। তিনি মগ্ন হয়ে শুনতে লাগলেন সেই শব্দজোয়ারের উচ্ছ্বাস। তিনি বুঝতে পারলেন ময়ূখ ঠিকই বলেছে। কেবল ময়ূখের মধ্যে নয়, কোটি কোটি অক্ষরধ্বনির মধ্যেও মিশে গেছে তাঁর কণ্ঠধ্বনি। এসব সম্পদ কেউ আর বিলোপ করতে পারবে না। ঘোর থেকে বেরিয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি বুঝি শব্দ নিয়ে খেলা করো, সাহিত্য ভালোবাসো?’
প্রশ্ন শুনে সংকোচে চোখ বুঁজে এল ময়ূখের। আচমকা বলে বসল, ‘এ বুকটা ফেড়ে আপনাকে দেখিয়ে দিতে ইচ্ছা করছে। ছেলেবেলা থেকে বুকের জমিনে শব্দের বুনিয়াদ গড়ে দিয়েছেন রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পালক তিনি গুঁজে দিয়েছেন মস্তিষ্কের কেন্দ্রে আর সেই সঙ্গে পুঁতে দিয়েছেন দেশ সৃষ্টির সঠিক ইতিহাস। আপনার জয়গাথা। দেশের জন্য আপনার ভালোবাসার কথা।’
বঙ্গবন্ধুও মনে মনে শ্রদ্ধা জানালেন দাদাভাইকে। ময়ূখ যে এক ফোঁটাও ভুল বলে নি, তা বুঝতে অসুবিধা হলো না তাঁর। দাদাভাইয়ের হাতে গড়া ফুলকলিরা যে আজও সাহিত্যে নেতৃত্ব দিচ্ছে জেনে আন্দোলিত হলেন। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলেন ময়ূখের দিকে। তাঁর মনে ভেসে উঠল নিজের ভাষণের একটি কথা, ‘আর দাবায়ে রাখতে পারবা না’―ময়ূখের মধ্যে জেগে ওঠা বেপরোয়া ইচ্ছা দেখে স্বস্তি পেলেন। কেবল জাতি জেগে ওঠে নি, কেবল জাগরণের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন করেই থেমে থাকে নি সেই মর্মকথা। প্রতিটি তারুণ্যের মধ্যেও তাদের নেতাকে জানার দুর্নিবার আকাক্সক্ষা দেখে বুঝলেন ওকে ঠেকিয়ে রাখা যাবে না, সব তথ্য-উপাত্ত উদঘাটন করেই ছাড়বে ও। তাই কোমল কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, ‘আমার কবর জিয়ারত করতে চলে এসেছো, সেই রাজধানী থেকে!’
‘আমি কি একা এসেছি? দেশ-বিদেশ থেকে প্রতিদিন গড়ে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ আসে টুঙ্গিপাড়ায়। আপনার কবরের সামনে এসে শ্রদ্ধা জানায়। তারা বুক ভরে নিয়ে যায় আপনার ঢেলে দেওয়া অন্য আলো―বোঝেন না? দেখা দেন না তাদের?’
প্রশ্নের জবাব দিলেন না বঙ্গবন্ধু। প্রশ্নের তাড়া খেয়ে কেবল হাসলেন। উত্তর না দিয়ে বললেন, ‘আসা-যাওয়ায় কষ্ট হয় না সবার?’
‘কষ্ট কেন হবে? উল্লাস নিয়েই এসেছি আমি। সবাই একই মনোভাব নিয়েই আসে। ঘাতকরা ভেবেছিল দূরবর্তী গ্রামে আপনার লাশ পাঠিয়ে দিয়ে ওরা আপনাকে দেশের মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। ভেবেছিল এখনকার প্রায় আঠারো কোটি মানুষের নয়নের মণিকে বিচ্ছিন্ন করে দূরে ঠেলে রাখবে। পেরেছে ঘাতকরা? পারেনি।’
‘সেকি! টুঙ্গিপাড়াকে বিচ্ছিন্ন লোকালয় বলছ কেন? খুনিরা আমাকে দূরে রেখে যাওয়ার সময় ভাবতেই পারেনি যে পৃথিবীর মায়াময় মাটিতে আমাকে শুইয়ে দিয়ে গেছে। তারা হিংস্রতার আড়ালে ভুল করে গেছে। তাদের উদ্দেশ্য―আমাকে বিচ্ছিন্ন করা হলেও দেখো, ওই যে, ডান হাত পাঞ্জাবির ডান পকেট থেকে বের করে, মুঠোবদ্ধ হাত না-খুলে, বুড়ো আঙুল খাড়া করে নির্দেশনা দিতে দিতে বললেন, ‘এটি আমার বাবা শেখ লুৎফর রহমানের কবর। বাবার পাশে রয়েছেন আমার মা শেখ সায়েরা খাতুনের কবর। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম মাটিতে শ্রেষ্ঠতম জায়গায় কি আমি চিরনিদ্রার জায়গা পাই নি? শত্রুরা কি আমাকে নিশ্চিহ্ন করতে পেরেছে? পারেনি।’
এমন করে এর আগে কখনও ভেবে দেখেনি ময়ূখ। এ মুহূর্তে স্বস্তি পেয়ে ও প্রশ্ন করে বসল, ‘ডান হাতের তর্জনিটা মুঠোয় বন্দি করে রেখেছেন কেন? আপনার তর্জনিটা কি দেখার সুযোগ পাব? দেখতে ইচ্ছা করছে।’
সঙ্গে সঙ্গে কেঁপে কেঁপে উঠল বঙ্গবন্ধুর সমাধির ভেতর থেকে উঠে আসা আলোর সিংহাসন। তা দেখে ময়ূখ আবার প্রশ্ন করল, ‘দেখাবেন সেই তর্জনি, তর্জনিটার গর্জন শুনতে ইচ্ছা করছে?’
‘আমার তর্জনি দেখতে চেয়ো না। আর দেখার সুযোগও পাবে না। ঘাতকের বুলেটে বুলেটে যেমন ঝাঁঝরা হয়ে গেছে আমার বুকের খাঁচা তেমনি তর্জনিটাও। তবে আসল তর্জনি দেখতে যদি চাও, ঢাকায় যাও। বাড়ি যাও। আমার হাসুর ডান হাতের তর্জনিটা দেখে নিয়ো।’
হঠাৎ আজানের ডাক ভেসে এলো―‘আল্লাহ আকবর! আল্লাহ আকবর!’ আলোর সিংহাসন ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। ময়ূখের পায়ের তলার মাটি কেঁপে কেঁপে উঠল। ও কিছুতেই এ প্রাঙ্গণ থেকে যাবে না, যেতে চায় না। আবার তাকাল কবরের দিকে। তিনটি কবর ঘিরে নির্মিত গম্বুজের ওপর থেকে চোখ গেল মূল কবর এলাকায়। মায়ের কবর, বাবার কবর, তার পাশে সন্তানের কবর। শ্রেষ্ঠ সন্তান পেয়ে গেছেন শ্রেষ্ঠ কবর। মা-বাবার পাশে শ্রেষ্ঠ ভূমি। সাড়ে তিন হাত ভূমি।
কবর-ঘিরে থাকা রেলিংয়ে হাত রেখে স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে ময়ূখ শুনল গমগমে স্বর―‘যাও ময়ূখ, ঢাকা যাও। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। যাও। আমার হাসুর ছায়াতলে থেকো। সংঘবদ্ধ থেকো।’
স্পষ্ট কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ময়ূখের মনে হলো বঙ্গবন্ধু এখানে ঘুমিয়ে নেই। জেগে আছেন। নিজের জোরালো গর্জন হাসুর কণ্ঠে আর তাঁর তর্জনির দিকনির্দেশনা হাসুর তর্জনিতে ঢেলে দিয়ে তিনি নিশ্চিন্তে শুয়ে আছেন মায়াময় ভূমিতে, তাঁর বাবা-মায়ের পাশে, শ্রেষ্ঠ কবরে। এ ভাবনা থেকে মনে মনে মহান আল্লাহ’র উদ্দেশে বলল, আলহামদুলিল্লাহ!
সমাধিসৌধের সামনে দাঁড়িয়ে
এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
কথাসাহিত্যিক মোহিত কামালের জন্ম ১৯৬০ সালের ০২ জানুয়ারি চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলায়।
তাঁর বাবার নাম আসাদুল হক এবং মায়ের নাম মাসুদা খাতুন। তাঁর শৈশব-কৈশোর কেটেছে আগ্রাবাদ, চট্টগ্রাম ও খালিশপুর, খুলনায়। বর্তমান নিবাস ধানমন্ডি, ঢাকা। স্ত্রী মাহফুজা আখতার মিলি, সন্তান মাহবুব ময়ূখ রিশাদ, পুত্রবধূ ইফফাত ইসলাম খান রুম্পা ও জিদনি ময়ূখ স্বচ্ছকে নিয়ে তাঁর সংসার। চার ভাই এক বোনের মধ্যে চতুর্থ সন্তান তিনি। তাঁর অ্যাফিডেভিট করা লেখক-নাম মোহিত কামাল। তিনি সম্পাদনা করছেন শুদ্ধ শব্দের নান্দনিক গৃহ, সাহিত্য-সংস্কৃতির মাসিক পত্রিকা শব্দঘর। তাঁর লেখালেখির মুখ্য বিষয় : উপন্যাস ও গল্প; শিশুসাহিত্য রচনার পাশাপাশি বিজ্ঞান বিষয়ে গবেষণাধর্মী রচনা। লেখকের উড়াল বালক কিশোর উপন্যাসটি স্কলাস্টিকা স্কুলের গ্রেড সেভেনের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে; ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্যও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পাঠাভ্যাস উন্নয়ন কর্মসূচি (ঝঊছঅঊচ) কর্তৃকও নির্বাচিত হয়েছে। এ পর্যন্ত প্রকাশিত কথাসাহিত্য ৩৭ (উপন্যাস ২৪, গল্পগ্রন্থ ১৩)। এ ছাড়া কিশোর উপন্যাস (১১টি) ও অন্যান্য গ্রন্থ মিলে বইয়ের সংখ্যা ৫৫।
জাতীয় পুরস্কার: কথাসাহিত্যে অবদান রাখার জন্য তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (২০১৮), অগ্রণী ব্যাংক-শিশু একাডেমি শিশুসাহিত্য পুরস্কার ১৪১৮ বঙ্গাব্দ (২০১২) অর্জন করেছেন।
তাঁর ঝুলিতে রয়েছে অন্যান্য পুরস্কারও; হ্যাঁ (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০২০) উপন্যাসটি পেয়েছে সমরেশ বসু সাহিত্য পুরস্কার (২০২০)। পথভ্রষ্ট ঘূর্ণির কৃষ্ণগহ্বর (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০১৪) উপন্যাসটি পেয়েছে সিটি আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার (২০১৪)। সুখপাখি আগুনডানা (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০০৮) উপন্যাসটি পেয়েছে এ-ওয়ান টেলিমিডিয়া স্বাধীনতা অ্যাওয়ার্ড ২০০৮ এবং বেগম রোকেয়া সম্মাননা পদক ২০০৮―সাপ্তাহিক দি নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেস-প্রদত্ত। না (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০০৯) উপন্যাসটি পেয়েছে স্বাধীনতা সংসদ নববর্ষ পুরস্কার ১৪১৫। চেনা বন্ধু অচেনা পথ (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০১০) উপন্যাসটি পেয়েছে ময়মনসিংহ সংস্কৃতি পুরস্কার ১৪১৬।
কিশোর উপন্যাস উড়াল বালক (রোদেলা প্রকাশনী, ২০১২; অনিন্দ্য প্রকাশ, ২০১৬) গ্রন্থটি ২০১২ সালে পেয়েছে
এম নুরুল কাদের ফাউন্ডেশন শিশুসাহিত্য পুরস্কার (২০১২)।
তিনি মনোচিকিৎসা বিদ্যার একজন অধ্যাপক, সাবেক পরিচালক জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ,ঢাকা
একটি মন্তব্য করুন
একটি মন্তব্য করুন