হঠাৎ থেমে গেলেন। এমনিতে বেশ গুছিয়ে কথা বলেন মানুষটা। স্পষ্ট উচ্চারণ। মুখে হাসি। কথা বলার ভঙ্গীটাও সুন্দর। প্রতিটা শব্দে জোর দিয়ে কথা বলেন। কিন্তু আজ অন্যমনস্ক। কথা বলতে গিয়ে থেমে গেলেন তপন ভট্টাচার্য। লম্বা-চওড়া চেহারা। সুদর্শন। স্কুল কলেজে পড়াকালীন ভালো ফুটবল খেলতেন।
এখন বয়স হলেও দারুন ফিট। সকালে জগিং আর ফ্রি-হ্যান্ড। সন্ধ্যায় প্রাণায়াম। বয়সের ছাপমুক্ত টানটান শরীর। বুঝবার উপায় নেই যে, চাকরী থেকে ভদ্রলোকের অবসর নেওয়া দু’বছর পেরিয়ে গেছে। অবসর নিয়েই আবার অন্য ব্যস্ততা। বন্ধু মিলন সমাদ্দারের সাথে একটা কনসালটেন্সি ফার্ম খুলেছেন। ধর্মতলায় এক পুরনো বাড়িতে অফিস। বেশ চালু ব্যবসা। সার্ভিস ট্যাক্স, জিএসটি এসব নিয়েই কারবার।
কসবা থেকে আমি সকাল সকাল আসি। বিল্ডিঙের দারোয়ানের কাছ থেকে চাবি নিয়ে অফিসের তালা খুলি। আমার ডিউটি সকালে দশটা থেকে বারোটা, বিকেল পাঁচটা থেকে সাতটা। এর মাঝখানে কর্পোরেশনের তিন তলায় জনগণনা সেকশনে আমার স্থায়ী চাকরী। তপন বাবুর অফিসের মাইনেটা এক্সট্রা। অবশ্য ওটা ছাড়া আমার কোন উপরি কামাই নেই। কর্পোরেশন অফিসে অনেকেই দু’নম্বরি ইনকামে লাল কিন্তু ফাটা কপাল আমার। দফতরে উপরি কিছু জোটে না। অগত্যা তপন বাবুর কনসালটেন্সি অফিসে যাওয়া আসা।
মাসের এক তারিখেই বি এস মানে ‘ভট্টাচারজি সমাদ্দার কনসালটেন্সি’ নগদে মাইনে দিয়ে দেয়। কোম্পানির সমাদ্দার বাবু একটু রাগী মার্কা। তবে তপনবাবু অতি অমায়িক সজ্জন মানুষ। খেতে খাওয়াতে ভালোবাসেন। নিজের বাড়িতে অনুষ্ঠান হলে নিমন্ত্রণ করেন আমাকে।
আজ ওঁর ফ্ল্যাটে ছোট একটা অনুষ্ঠান। আমেরিকা থেকে দু’সপ্তাহের ছুটিতে ছেলে এসেছে। সেই উপলক্ষে সস্ত্রীক আমিও নিমন্ত্রিত।
নীল জিন্সের উপর সাদা পাঞ্জাবী পড়া মানুষটাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। বড় সোফায় একপাশে স্ত্রী, আরেক পাশে ছেলে। মাঝখানে যুবকের প্রাণ প্রাচুর্যে ভরপুর প্রবীণ এক মানুষ। এই সুন্দর মানুষটা একদিন আমার উপর রেগে খাপ্পা হয়ে গেলেন। দুপুর বারোটায় ওঁকে বললাম, আজ বিকেলে আসতে পারবো না কিন্তু। মেয়রের সাথে মিটিং। দাবী না-মিটলে ঘেরাও হয়ে যেতে পারে মেয়র।
আমার কথায় উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করে উঠলেন সংযত ভদ্র মানুষটা, ‘আজকে সমাদ্দার নেই। তুমিও আসবে না। এত বড় ঘরে আমি একা থাকবো কী করে?’
হাত পা কাঁপছে তপন বাবুর। মনে হয় ভয় পাচ্ছেন কোন কারণে। আমি সাহস করে বললাম, ‘কোন গুন্ডা মস্তান আসবে নাকি?’
রাগে কাঁপতে কাঁপতে উত্তর দিলেন, ‘ওদের আমি সামলে নিতে পারি। কিন্তু…।’
কথা শেষ করলেন না তপন বাবু। চেয়ারে ধপ করে বসে বললেন, ‘চারটায় ক্লায়েন্টের আসবার কথা। আমি অ্যাপয়েন্টমেন্ট ক্যান্সেল করে দিয়ে ড্রাইভারকে ডেকে নিচ্ছি’।
‘আপনার কি একা থাকবার ভয়?’ মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল কথাটা। তপন বাবু নিরুত্তর। বুঝলাম ভয়ের কোন একটা ব্যাপার আছে।
ভয়ের কারণটা জানতে আমি অনেক দিন ধরেই তক্কে তক্কে আছি। মনে হোল আজ এক ফাঁকে সুযোগ মত জিজ্ঞেস করব ব্যাপারটা। স্ত্রী সন্তান আর দু’একজন প্রতিবেশীর সামনে কি-ই বা রাগ দেখাবেন?
জিজ্ঞেস করবার সুযোগ খুঁজছি। চায়ে চুমুক দিলেন তপন বাবু। কোন এক অতিথির কথার উত্তর দিতে গিয়ে একটু থামলেন। তারপর দিরে ধীরে ধীরে বললেন, ‘সত্যিই টেনশন ফ্রি আরামের জীবন এখন। অফিস থেকে নিজের গাড়িতে বাড়ি ফিরি। কোথাও হাজিরা খাতায় সই করতে হয় না। দু’দশ মিনিট কি আধঘণ্টা জ্যামে ফেঁসে গেলে মেজাজ খারাপ হয় না। টাকা-পয়সা নিয়েও চিন্তার কিছু নেই…।’
আড্ডা জমে উঠেছে। তপনবাবুর কথার মাঝখানে নিচের তলার স্যান্যাল বাবু বলে উঠলেন, ‘নিউটাউন ছাড়াও ভি আই পি রোডে আপনার তো একটা ফ্ল্যাট আছে।’ তপনবাবুর স্ত্রী বললেন, ‘ওটা তো কাছেই। সমস্যা নেই। দিল্লীর ফ্ল্যাটটা নিয়েই যত ঝামেলা!’
আমি ওই ঝামেলার লাইনে কথা চালালাম না। তপনবাবুর দিকে তাকিয়ে নরম বলায় বললাম, ‘চাকরী করে এতগুলো ফ্ল্যাট বানানো! দারুন ব্যাপার তো! হিম্মত লাগে।’
তপন বাবুর মুখে মৃদু হাসি। ওঁর দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে হাসি ছুঁইয়ে আবার আমি বললাম, ‘খুব সাহসী ছিলেন আপনি, না? প্রপার্টি বানানো তো সহজ নয়।’
হেঁসে ফেললেন মীরা দেবী, তপনবাবুর স্ত্রী। চায়ের কাপে আলতো ঠোঁট ছুঁইয়ে বললেন, ‘সাহসী? সন্ধ্যে হলেই ভুতের ভয়ে জুবুথুবু। আমি কোত্থাও যেতে পারিনা।’
আচমকা নিস্তব্ধ হয়ে গেল আলোকিত উচ্ছল বিশাল হলঘর। বিস্ময়ের ঘোর লাগা ডজন খানেক চোখের দৃষ্টি ঘিরে আছে ওঁকে।
আমার স্ত্রী সুরঙ্গমা আবার কবিতা লেখে। ছোটখাট পত্রিকায় ছাপা হয়। কারওর মুখে ভ্রমণ বৃত্তান্ত শুনে চটপট লিখে ফেলে। তারপর স্বনামে কোথাও ছাপিয়ে দেয়।
সুরঙ্গমা স্বরে মধু ঢেলে ঘরের মৌনতা ভাঙল। ‘তপন দা, দারুন সুইট তো! আমার না ভূতের গল্প দারুন ফেবারিট! প্লিস, একটা শোনান।’
‘বল না’! মীরা বৌদি ঘাড় নেড়ে বললেন। তপনবাবুর মুখে গাল ছড়ানো হাসি। একটু থেমে গলা ঝাড়লেন তপন বাবু। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, ‘সাতটা তিরিশের ট্রেন ধরতাম। অফিসের পর ব্যাঙ্কের উঁচু তলা থেকে লিফ্টে করে নেমে আসা। তারপর সন্ধ্যার কর্মব্যস্ত ডালহৌসি পাড়ার ফুটপাথ ধরে দল বেঁধে হাঁটতে হাঁটতে বড় বাজার। ঘুপচি গলিতে ঢুকে এক কাপ চা খেয়ে নিতাম। সঙ্গের ক’জন বন্ধু বিদায় নিয়ে উত্তর কলকাতার গলিপথে মিলিয়ে যেত। কয়েকজন হাওড়া ষ্টেশন থেকেই চলে যেত খড়গপুর লাইনে। দু’একজন আমার সঙ্গে উঠতো কাটোয়া লোকালে। কাছের যাত্রী ওরা। অল্প পথ পেরিয়েই নেমে যেত রিষরা, শ্যাওরাফুলি কিম্বা ত্রিবেণীতে। শুধু আমি পাড়ি দিতাম লম্বা পথ। হাওড়া থেকে দাঁইহাট। কাটোয়ার আগের ষ্টেশন’।
‘বাবা, কাট সর্ট।’ আমেরিকা ফেরত ছেলে বলল।
ওর দিকে একবার তাকিয়ে তপন বাবু আগের কথার খেই ধরলেন। ‘তখন তো ব্যাচেলার। কম বয়েস। সারাদিন কাজের পরও ক্লান্তি আসে না। কিন্তু ঘুম পায়। ঘুম চোখে স্টেশন থেকে অনেকটা হেঁটে বাড়ি ফিরি। অন্ধকার পথ। দু’পাশে বটগাছ। রাস্তায় ঝুরি নেমে এসেছে। কোন গাছের ডাল থেকে শকুন চিৎকার করে। দূরে বাঁশ বন থেকে শিয়ালের ডাক ভেসে আসে। অনেক রাত তখন। এগারোটা–বারোটা। পথে লোক না-পেলে গা ছম ছম করে।’
‘এই পথেই কী ভূত দেখেছিলেন’? তপন বাবুর কথার মোড় অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিল সুরঙ্গমা। তপনবাবু বললেন, ‘না ট্রেনে।’ তারপর সোফার উপর বাবু হয়ে বসলেন। ঠোঁটের দু’পাশে হাসি।
বললেন, ‘সর্টে বলছি। নবদ্বীপ এলেই ফাঁকা হয়ে যেত ট্রেন। কোন কোন দিন গোটা ট্রেনটাই প্রায় খালি। লোক খুঁজতাম। কাটোয়া বা দাঁইহাট যাবার লোক।’
‘ফাঁকা কামরায় একা বসে থাকতে ভয় লাগতো নাকি?’ সান্যাল বাবুর গলায় কেমন একটু ব্যাঙ্গের সুর।
মুখে হাসি ছড়িয়ে সান্যালের দিকে পলক তাকালেন তপনবাবু। তারপর শুরু করলেন, ‘ওই পরিবেশে না পড়লে কেউ বুঝবে না। আলোর বন্যায় ভেসে যাওয়া কলকাতার বালিগঞ্জ বা পার্ক স্ট্রীট নয়। অন্ধকার গ্রাম বাংলা। দু’পাশে আদিগন্ত ধান ক্ষেত। জনমানবহীন মধ্য রাত। তার মধ্যে ট্রেন ছুটছে। ফাঁকা কামরা, টিমটিমে আলো। কখনও ঘুটঘুটে অন্ধকার। বর্ষার আঁধার রাতে দূরে হাতছানি দিয়ে ডাকে ভুতুরে আলো। নীলাভ আলেয়া। দেখলেই হাড় হিম হয়ে যায়। তারমধ্যেই হু হু করে ছুটে চলে ট্রেন। নিজের অস্তিত্বই টের পাওয়া যায় না’।
‘ট্রেন নবদ্বীপে এসেছে। তারপর বল।’ মীরা দেবী তাড়া দিলেন।
কাপের বাকী চা-টা গলায় ঢাললেন তপন বাবু। দু’এক সেকেন্ড চোখ বন্ধ। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, ‘নবদ্বীপে যাত্রীরা নেমে যাবার পর নিজেও নেমে এসে লোক খুঁজি। যে কামরায় প্যাসেঞ্জার চোখে পড়ে, সেখানে উঠে যাই।
সেদিন ফাঁকা কামরা থেকে নামতে গিয়ে দেখি দরজার কাছে বেঞ্চিতে বসে আছে একজন। চাদর মুড়ি দেওয়া। আলোর উল্টো দিকে বসা। মুখটা অস্পষ্ট। তবে চেনা চেনা লাগছে। দেখতে অনেকটা নাদুর মতন। জ্যেঠামশায়ের জমিতে জন খাটে। লম্বা, লিকলিকে লোক। জিজ্ঞেস করলাম, কতদূর যাবেন, দাঁইহাট?
মাথা নাড়ল লোকটা। আমিও আশ্বস্ত হলাম। ফাঁকা কামরায় একা একা যেতে হবে না। অন্তত একজন সঙ্গী আছে ।
ট্রেন ছাড়তেই আমি ওই লোকটির উল্টো দিকের বেঞ্চিতে এসে বসলাম। হু হু করে বাতাস ঢুকছে কামরায়। মার্চ মাস। দিনের বেলা প্রচণ্ড গরম। রাতের এ সময়টা বেশ ঠাণ্ডা। অনেকেই চাদরে জড়িয়ে নেয় শরীরে।
আমার সামনে চাদর জড়ানো একটা লোক। আমার সহযাত্রী। মুখে কথা নেই। ঘুমোচ্ছে বোধ হয়। আমি ওর মুখোমুখি গোটা একটা বেঞ্চ দখল করে হাত-পা ছড়িয়ে বসেছি। বেশ খুশী খুশী একটা নিশ্চিন্ত ভাব আমার। ভালো একজন সঙ্গী পেয়েছি। দাঁইহাট অবধি আমার সঙ্গে যাবেন। বেশ আয়েশ করে বসে আরামে চোখ বুজলাম।
কতক্ষণ চোখ বন্ধ রেখেছিলাম জানি না। ঠাণ্ডা বাতাসে হয়তো ঝিমুনি এসে গেছিল। ঘুম চোখ খুলতেই মাথাটা বনবন করে উঠল। বুক ধড়ফড় করছে আমার। দেখি, দু’হাতে…’
একটা ঢোঁক গিললেন তপন বাবু।
‘কী দেখলেন’? সান্যাল বাবু চিৎকার করে উঠলেন।
একটু থেমে তপন বাবু আস্তে আস্তে বললেন, ‘দেখি লোকটা… লোকটা নিজের কাটা মুণ্ডু বাঁ’হাতে ধরে বসে আছে।’
-মানে?
-মানে আর কি! ধর আর মুণ্ডু আলাদা।
-তারপর’? আমার স্বরে উত্তেজনা। হৃৎপিণ্ড এক লাফে গলায় উঠে এসেছে।
তপন বাবু ঢোঁক গিললেন। কাঁপা গলায় বললেন, ‘ভয় পেয়ে আমি চোখ বন্ধ করলাম। বুক ধক ধক করছে। দরদর করে ঘামছি। শিরদাঁড়ার নিচ থেকে ভয়ের ঠাণ্ডা স্রোত উপরে উঠে আসছে। আমার গলা মুখ শুকিয়ে কাঠ। কাঠের বেঞ্চে বসে ঠক ঠক করে কাঁপছি।’
-তারপর?’ সান্যাল বাবুর অস্থির জিজ্ঞাসা।
ওদিকে তাকালেন তপনবাবু। খানিক চুপ থেকে বললেন, ‘একটু পরে আবার চোখ খুললাম। দেখি…,
দেখি লোকটা ডান হাতে কাটা মুণ্ডুটা উপরে তুলে ধরে আছে। আবার চোখ বন্ধ করলাম। বসে বসে ঘামছি। জিভ শুকিয়ে কাঠ। নড়বার শক্তি নেই। কিছুক্ষণ পর চোখ পিটপিট করলাম। চোখের ফাঁক দিয়ে উল্টো দিকের বেঞ্চিতে তাকাতেই এবার অন্য দৃশ্য। দেখি কোমর থেকে অদ্ভুত ভাবে বেঁকে মাটি ছুঁয়ে আছে শরীর। যেন কোন বড় গাছ ঝড়ে ভেঙে মাটিতে লুটিয়ে আছে’।
-তারপর’? রুদ্ধশ্বাস জিজ্ঞাসা সুরঙ্গমার।
ওর দিকে পলক তাকিয়ে এক ঢোক জল গলায় ঢাললেন তপনবাবু। রুমালে মুখ মুছে বললেন, ‘তারপর আর কি! প্রবল ভয়। ঠক ঠক করে কাঁপছি। মনে হচ্ছে বুকের ধড়ফড় থেমে যাবে। চোখ বন্ধ করে রাম রাম জপছি। কতক্ষণ কাটল জানি না। হঠাৎ ট্রেনের হুইসেল শুনলাম। ট্রেন ঢুকছে ষ্টেশনে। একটু ধাতস্ত হয়ে ধীরে ধীরে বন্ধ চোখ খুললাম। হঠাৎ আমার চোখের সামনে আলোর ঝলকানি। কেমন করে যেন হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে মিলিয়ে গেল ওই লোকটার আলোকিত শরীর।
উদভ্রান্ত অবস্থা আমার! কেমন এক ঘোর লাগা চোখে প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে বাড়ির দিকে পা চালালাম। কালীতলার মোড়ে বাঁক নিতেই দূর থেকে দেখলাম বাড়ির দরজায় বাতি হাতে মা দাঁড়িয়ে আছেন। ঘরে ঢুকে জুতো খুলতে খুলতে ট্রেনের ঘটনাটা বললাম মা-কে’।
বড় একটা শ্বাস ফেললেন মা। কিছুক্ষণ চুপ থেকে মৃদু স্বরে বললেন, ‘নাদু মারা গেছে।’
বুকটা ধক করে উঠল আমার। মুখে কথা সরল না। মা বললেন, ‘তাড়াতাড়ি খেয়ে আমার পাশে শুয়ে পড়।’
খেতে বসে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মারা গেল কেমন করে?’
মা বললেন, ‘ভোর রাতে নিশি ডেকেছিল। শামুকতলার মাঠে জলের উপর মুখ থুবড়ে পড়েছিল নাদুর লম্বা শরীরটা। কখন যে মাঝরাতে দরজার খিল খুলে বেড়িয়ে পড়ল! ওর বৌ-টা টেরই পায় নি। ওর দেহটা খুঁজে পেতে বেলা গড়িয়ে গেল।’
আমার মুখে কথা সরলো না। একদম বধির আমি। মা বললেন, ‘খুব খাটতে পারত মানুষটা। ছোট বেলা তোকে কাঁধে বসিয়ে খালের বাঁধে ঘুরে বেড়াত।’
তপনবাবু থামবার পর অনেকক্ষণ কেউ কথা বলে নি। ওনার ছেলে প্রথম মুখ খুলল। বলল, ‘যতবার শুনি গল্পটা নতুন লাগে। ঘোস্ট স্টোরি। ওদেশেও দেখি, হরর কিম্বা ঘোস্ট স্টোরি লোকে হামলে পড়ে শোনে। আসলে কি জানেন, মানুষ ভয় পেতে ভালোবাসে।’
আমি বা সুরঙ্গমা কোন কথা বলি নি। আমাদের ফিরতে রাত হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম আমরা।
রাস্তায় বেড়িয়ে সুরঙ্গমা বলল, ‘কোলকাতাতেও ভূত দেখা যায়, জানো! পুরানো বাড়িগুলোতে ওরা ঘাপটি মেরে থাকে’! আমি কথার উত্তর না দিয়ে তাড়াতাড়ি পা চালালাম।
টোটো চেপে বাস স্ট্যান্ডে যাচ্ছি। আমাদের মুখোমুখি চাদরে মুখ ঢেকে বসে আছে লম্বা লিকলিকে একটা লোক। আলো আঁধারি রাস্তায় ধীর গতিতে এগোচ্ছি। সুরঙ্গমা কাঠ হয়ে বসে আছে। শক্ত করে আমার হাত ধরে কানের কাছে কাঁপা গলায় ফিস ফিস করল, ‘ও ও ওই লোকটার মত, না!'