ইঞ্জিনচালিত কাঠের নৌকাখানির দুইপ্রান্তে দুই গলুই, মাঝের অংশটি ফাঁকা, সেখানেই রাখা ইঞ্জিনটি। আমরা বসেছি দুই গলুইয়ে। আমরা মানে, আমাদের কারো কারো বহুমাত্রিকতা থাকা সত্ত্বেও, কেউ মূলত কবি, কেউ চিত্রশিল্পী, কেউ গানের শিল্পী। সে বিচারে এই ভ্রমণবিলাসী ও নিসর্গপ্রেমী দলটিতে ৮ জন কবি, ১ জন চিত্রশিল্পী এবং ৩ জন কণ্ঠশিল্পী রয়েছেন। কবিরাও কেউ কেউ গান গায়, চিত্রশিল্পী কবিতা লেখে, গানের শিল্পীরাও তাই। ওপাশের গলুইয়ে বসেছে মহেশখালীর তরুণ কবিদের একাংশ, সুব্রত আপন দুই মাঝির মাঝখানে, একপাশে রুদ্র সাহাদাৎ, অন্যপাশে চিত্রশিল্পী আর. করিম ও কবি গোলাম সামদানী। শেষোক্ত জন অবশ্য তরুণ নন। মাঝের ফাঁকা জায়গাটির দুপাশে পাতা বেঞ্চে বসেছেন কবি হাফিজ রশিদ খান, তার মুখোমুখি কবি সাইয়্যিদ মঞ্জু। সবচেয়ে ভারসাম্য পূর্ণ জায়গা সেটিই। শরীরের ভারসাম্য বজায় রেখে পড়ে যাবার সমূহ সম্ভাবনা নিয়ে নৌকার প্রান্তে বসেছেন কবি মিজান মনির ও কবি জাহেদ সরওয়ার। তারা যদিবা না পড়েন জলে, তাদের মোবাইল পড়ে যাওয়া বিচিত্র কিছু নয়। জাহেদ সরওয়ার সেলফি স্টিকে মোবাইলকে আঁটোসাটো করে বেঁধে পানির উপর স্টিক বাড়িয়ে দিয়ে সেলফি তুলছেন। আঁতকে উঠে মোবাইল না জানি মাছরাঙা পাখি হয়ে মাছ ভালোবেসে টুপ করে জলে লাফিয়ে পড়ে। আমি বসেছি সমুখের গলুইয়ে, প্রান্তে বসার সাহস আমার নেই, পাটাতনের উপরেই আসন পেতে বসা, যাতে আমার মোবাইল পাখি ভুল করেও যেন মাছ না দেখে। আমার কাছে একই প্রান্তে বসেছেন দুই গায়ক শাফায়াত জামিল দিদার ও রশিদ খান। আজ রাতে যে প্রচুর গান হবে বুঝতে পারি।
নৌকা ছাড়তেই বড়োধার খালের সিমেন্টের (ভেতরে রড আছে অনুমান করা যায়) সেতুর পুরোটা চোখের বারান্দায় গোচরীভূত হলো। জেলেদের গ্রাম তার সেকেন্ড হ্যান্ড মার্সিডিজ বেঞ্জ (ট্রলারগুলোর দাম ঐরূপ বা কাছাকাছি) জলযানসারি ও নারিকেল বীথি নিয়ে সামগ্রিকরূপে ধরা দিল। নৌকা চলেছে পশ্চিমে, অরুণ বসেছে অস্তগামী পাটে। পড়ন্ত বরুণের রক্তিমাভায় উজ্জ্বল সব কিছু, এটাকেই কনে দেখা আলো বলে, আমাদের নৌকায় কনে নেই একজনও, বরও নেই, বরযাত্রী আছে বারো জন। একটি সমুদ্রগামী মাছ ধরার ট্রলার আমাদের নৌকা অতিক্রম করে গেল, তার পেছনে বাঁধা একটি ডিঙ্গি, মোটা ট্রলারটিকে মনে হলো পুরুষ, সরু ডিঙিটিকে নারী; ধিঙ্গি সে নয়, বড়ো সমর্পিতা, স্বামীর হাত ধরে বেড়াতে বেড়িয়েছে। ভরা জোয়ারে ভরে আছে বড়োদীঘি খাল, তার শাখা-প্রশাখা, জলে অর্ধ নিমজ্জিত দুপাশের সুন্দরী গাছগুলো, একেবার সুন্দরবন, পশ্চিমাকাশে প্রভাময়ী কিরণ গুচ্ছ গুটিয়ে নেওয়ায় স্বল্পমেঘাবৃত আকাশ হয়ে উঠেছে মায়াময় নরোম। নক্ষত্রের বিদায়ে আকাশে উঠে এসেছে গ্রহটির একমাত্র উপগ্রহ, চাঁদ বলেই যাকে আমরা চিনি।
এখন কী করে আমি এই অনুপম প্রকৃতি দৃশ্যটির বর্ণনা দেই?
চোখ যা দেখে, ক্যামেরা তার কিয়দংশ তুলে আনে, মস্তিষ্ক ধরে রাখে অযুত-নিযুত ছবি। পথের সকল ক্লান্তি ভুলে গেলাম, জোয়ার বা জাহানের দেরি করে আসা, ফলে সোনাদিয়ার সৈকতে সূর্যাস্ত দেখার সুযোগ হারানোর আক্ষেপ বিলীন হলো। মনে হলো এই যাত্রাটির জন্যই বোধকরি অপেক্ষা ছিল আমাদের, এই নৈসর্গিক প্রতিবেশ, আলো আর জল, বৃক্ষ আর চাঁদ, কবি আর শিল্পী স্বর্গের আভাস জাগিয়ে তুলেছে মর্ত্যে। এও মনে হলো সূর্যাস্তের দৃশ্য হারানোর শোক এই সূর্যাস্ত পরবর্তী মায়াবী আলোর সুখে ভুলিয়ে দিল।
গাছের কাণ্ড যেমন শাখা বিস্তার করে তেমনি এই খাল, জোয়ারে পূর্ণ যৌবনা আর ভাটায় শীর্ণা, শাখা বিস্তার করেছে। এখানে জোয়ারের জলে জন্ম, জলে-বেড়ে-ওঠা গাছগুলো প্রতিদিন দুবার জলের তোয়ালে দিয়ে দেহের অর্ধাংশ ঢেকে নেয়, আর দুবার তা খুলে ফেলে গা শুকোয়। বেশি লজ্জাবতীরা কাঁধ অবধি টেনে নেয় জলের চাদর, তাদের সবুজ-পাতা-ভরা মাথাগুলো থাকে জলসংলগ্ন। আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখি আর পাগলের মতো ছবি তুলি। জলযাত্রাটিকে বাসিমুখ করতে চায়নি আয়োজকরা। মিজান মনিরকে দেখা গেল একটি ব্যাগ থেকে সবাইকে কাঁঠালের কোষ বিতরণ করতে। ভারি মিষ্টি সে কাঁঠালের স্বাদ। সবাই দুবার করে কয়েকটি কোষ তুলে নিল। ঝুঁকে পানিতে হাত ধুঁয়ে নেই। সে জল ঠোঁটে ছোঁয়াতেই টের পাই লবনের স্বাদ। বুঝি স্বাদু পানির খাল নয় এটি, লোনা পানির খাল, সমুদ্র নিকটেই, তার জলে ভরা এ খাল। এতক্ষণ নৌকা পশ্চিমে যাচ্ছিল, এখন সে দক্ষিণাভিমুখী।
সেই অগ্রগামী গান বোটটিকে দেখা গেল, সৈন্য বোঝাই নয়, লোক বোঝাই। যেন এক নৌকা বাইচ, কাঠের নৌকা পেরিয়ে গেল লোহার বোটকে। ওরা আমাদের কৌতুহল নিয়ে দেখলো, আমরা ওদের। একপাশে মাছ আটকানোর জাল, খালের কাদায় পোতা সরু কাণ্ডের গাছের সাথে টাঙানো। খালের প্রস্থ বেড়ের ৬০ শতাংশ নিয়ে সেই ‘মৎস্য মারিব খাইব সুখে’র মনুষ্য চতুরতা। দুটি জেলে নৌকা দেখা গেল, একটিতে ঘুমিয়ে আছে চতুর দুই জেলে, ওদিকে জলের তলে পথ খুঁজতে গিয়ে জালে আঁটকা পড়ছে বোকা মাছেরা।
কিছুদূর এগুতেই দেখা দিল পূর্ব থেকে পশ্চিমে বিস্তৃত সোনাদিয়া দ্বীপ!
(চলবে)