মহেশখালীর বড় দীঘির দক্ষিণ-পূর্ব কোণায় উদ্ভাসিত হয়ে এর উত্তর পার্শ্বের সড়ক ধরে চলেছে আমদের টমটম, ঘোড়ায় টানা নয়, ইঞ্জিনচালিত। আমার পাশে বসেছেন কবি হাফিজ রশিদ খান, যাকে ঘিরে এত আয়োজন। এই সিটটি একটু উঁচু, আমাদের মুখ সম্মুখপানে। আমাদের বিপরীতে অপেক্ষাকৃত নিচু সিটে, পথের পশ্চাৎদিকে মুখ করে বসেছেন গানের শিল্পী জাহান এ বি, যার আগমনের সাথে জোয়ারের সম্পর্ক বাঁধা আর সূর্যাস্তের শত্রুতা। বড় দীঘির পূর্বপাশে জাহানের দেয়ালঘেরা বাড়িটির আয়তন ও লোকেশন চমৎকার লাগল। তার পাশে কবি জাহেদ সরওয়ার। সড়ক গেছে সোজা পশ্চিমে, তার বামপাশে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি অনেকখানি জায়গা নিয়ে ছড়ানো। এখন করোনা মহামারীকাল, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভীড়াক্রান্ত। দূরে একটি দীঘিসদৃশ জলাশয় চোখে পড়ে। জাহেদ সরওয়ার জানাল ওটা কলেজের দীঘি। এই কলেজের ছাত্র সে হতে পারেনি, যদিও সে মহেশখালীরই সন্তান।
স্মৃতিতে ছাত্রজীবন চলে আসায় জাহেদ সরওয়ারের মনে পড়ল, একটি বিস্মরণ অযোগ্য ঘটনা যা ঘটেছিল তার মাধ্যমিক পরীক্ষার সময়। জাহেদ সরওয়ার ছিল ছাত্রলীগের স্থানীয় নেতা। তখন বিএনপি-জামাতের শাসনামল। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন কালাচাঁদ মণ্ডল নামের একজন। ছাত্রলীগ একটি সভা (জনসভা নয়) করার জন্য ইউএনওর অনুমতি নিয়েছিল। কিন্তু সঠিক সময়ে সেখানে উপস্থিত হয়ে দেখলেন ছাত্রশিবির সভা করছে। এটা করছিল শত্রুতা করে, আর তখন মহেশখালী-কুতুবদিয়ার এমপি হলো জামাতের লোক। প্রতিবাদ করায় ইউএনও ক্ষিপ্ত হয়, তখন জাহেদ সরওয়ার ইউএনওকে শাসিয়ে আসে, আমরা দেখব আপনি কী করে এখানে কাজ করেন। এর কদিন পরে ছিল ১৯৯২ সালের এসএসসি পরীক্ষা। ইউএনওর ব্যক্তিগত রাগ আর জামাত-শিবিরের রাজনৈতিক আক্রোশ মিলে জাহেদ সরওয়ারকে নকল করার মিথ্যে অপবাদ দিয়ে পরীক্ষা হল থেকে বহিস্কার করে ইউএনও। জাহেদ বলে, এটা আপনি করতে পারেন না, যে অন্যায় আমি করিনি তার শাস্তি আপনি দিতে পারেন না। ইউএনও দুর্ব্যবহার করে। জাহেদ তখন বলে, আমি যদি আপনার সন্তান হতাম, তাহলে আপনি কি পারতেন আমার ক্যারিয়ার ধ্বংস করতে? একথা শুনে ইউএনও তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। তখন মেজাজ হারিয়ে ফেলে অন্যায্য হস্তক্ষেপে ইতিমধ্যে ক্ষুব্ধ জাহেদ ইউএনওকে বেদম পেটায়। ম্যাজিস্ট্রেটকে বাঁচাতে আসা দুই পুলিশকেও পেটায়। পিটিয়েই সে পালিয়ে যায় ভোলায়।
ম্যাজিস্ট্রেটকে মারধোরের দায়ে বোর্ড জাহেদকে বহিষ্কার করে। সে তখন চট্টগ্রাম বোর্ড থেকে পরীক্ষা দিতে পারবে না জেনে সে বরিশাল বোর্ড থেকে পরীক্ষা দেবার প্রস্তুতি নেয়, নিজের নাম সরওয়ার কামাল থেকে জাহেদ সরওয়ারে পাল্টে নেয়। জাহেদের বাবা জনাব আবুল ফজল তখন ৫টি ট্রলারের মালিক, বেশ বিত্তশালী মানুষ ছিলেন। প্রতি সপ্তাহে ১৪/১৫ লক্ষ টাকার মাছ বিক্রি করতেন। ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলায় যেখানে জাহেদ আশ্রয় নিয়েছিল সে বাড়িটি তার বাবার সাথে ঘনিষ্ঠ এক মাছ ব্যবসায়ীর। পুলিশের গ্রেফতার এড়াতে বেশ কিছুদিন একটি ঘরের ভিতর নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিল। সেই ঘরের আলমারিতে কেবল বই আর বই। সে পড়তে শুরু করে। বিশেষ করে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা প্রথম বইটি পড়েই সে মুগ্ধ হয়ে যায়। বইগুলো যার সে বোধকরি সুনীলের ভক্ত, জাহেদ সরওয়ার সুনীলের লেখা অনেকগুলো উপন্যাস পায়, সবগুলো পড়ে ফেলে। এক নতুন জগতের সন্ধান পায় সে, তার মধ্যে জেগে ওঠে পাঠতৃষা ও সাহিত্যপ্রীতি। ভোলা থেকে সে ফিরে আসে অন্য মানুষ হয়ে। ‘গিয়েছিল বাঘ হয়ে, ফিরে এলো হরিণ হয়ে’ কবি হাফিজ রশিদ খানের কাব্যিক মন্তব্য।
এই একটি ঘটনা, হট্টগোল মুখরিত তো বটেই, পরে প্রশান্ত, বিদ্রোহী জাহেদ সরওয়ারকে কবি ও কথা সাহিত্যিক জাহেদ সরওয়ারে পরিণত করে। পিতার পরামর্শে একসময় পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করলে ম্যাজিস্ট্রেট তাকে জেলে পাঠিয়ে দেয়। ধনাঢ্য পিতা পুত্রকে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনেন অর্থের বিনিময়ে। মামলা খারিজ করতে তার ১২লক্ষ টাকা খরচ হয়। মজার ব্যাপার আমরা যখন কালাচাঁদ মণ্ডলের কথা বলছিলাম তখন আমাদের টমটম যে ছোট বাজারটি পার হচ্ছিল তার নাম কালামিয়া বাজার। জাহেদের পৈতৃক বাড়ি এখানেই। সরু সড়কের পাশ ঘেষে বাড়ির দেয়ালের পিঠ। বেশ বড়ো হাজী আবুল ফজল মঞ্জিল। আরও মজার ব্যাপার সেই ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে পরে জাহেদ সরওয়ারের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়েছিল। তাগড়া জাহেদকে ফের দেখেই কালাচাঁদ ভয়ে আরও কালা হয়ে গিয়েছিল। জাহেদের সঙ্গী আশ্বস্ত করেছিল, ‘না, আর মারবে না।’ সম্পর্ক স্বাভাবিক হলে কালাচাঁদ স্বীকার করেছিলেন তিনি প্রভাবিত হয়ে অন্যায় কাজটি করেছিলেন, দুঃখপ্রকাশ করেছিলেন, জাহেদও অনুতাপ প্রকাশ করেছিল। সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকে হাওয়া যেদিকে সেদিকে পাল খাটায়।
সেটা ছিল এক আলোড়িত ঘটনা। ওই প্রথম মহেশখালী দ্বীপাঞ্চলে একজন ম্যাজিস্ট্রেট মার খেয়েছিল। আর কি কেউ মার খেয়েছিল এখানে? জাহান এ বি জানাল সাম্প্রতিককালে আরও এক ছাত্র পরীক্ষার হলে ম্যাজিস্ট্রেটকে মারধোর করেছে। বুঝলাম ম্যাজিস্ট্রেটরা (কেউ কেউ) মাঝে মাঝে ছাত্রদের হাতে মার খায়। তবে এর জন্য ‘হিরো’কে চড়া মূল্য দিতে হয়, নিদেনপক্ষে ১২ লাখ টাকা। মামলার ঝামেলা মিটে গেলে জাহেদ সরওয়ার নারায়ণগঞ্জের চাষাড়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৯৩ সালে মাধ্যমিক ও পরবর্তীতে ভাওয়াল বদরে আলম ডিগ্রি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক সম্পন্ন করে। সেই থেকে বহুকাল তার ঢাকায় বসবাস। দুপাশে বাড়িঘর, মাঝে দুটি টমটম পাশাপাশি যাওয়ার মতো সড়ক, অর্থাৎ দৃষ্টি কেবলি গাছে বা দেয়ালে প্রতিহত হয়, এমন আবদ্ধ পরিবেশ ছেড়ে টমটম হঠাৎই এসে পড়ে এক খোলামেলা প্রান্তরে। দুপাশে মাছের ঘের, পড়ন্ত সূর্যের আলো পড়ে ঝলমলে স্বচ্ছজলের প্রসারতা ও প্রশান্তি, আর চোখে পড়ে অবারিত নীলাকাশ। বাতাসের প্রবাহ গতিশীল, তাই শরীর জুড়িয়ে যায়। জায়গাটির নাম তাজিয়াকাটা। এইসব মৎস্য খামারের জায়গা আগে ঝাউবনে আচ্ছাদিত ছিল, বন কেটে মাছের ঘের করেছে মানুষ, কারণ ঘূর্ণিঝড় হয়তো বছরে একবার আসবে, কিন্তু পুষ্টির অভাব ও ক্ষুধা যে প্রতিদিন হানা দেয়। ১৯৯১ সালে এক প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়, যা শক্ত বাহুতে টেনে তুলেছিল সমুদ্র জলপিঠকে অনেক উপরে, সেই রাক্ষুসী সমুূ্দ্র ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল মহেশখালি দ্বীপের প্রচুর মানুষ। সাইয়্যিদ মঞ্জু জানাল তাজিয়াকাটা ও কুতুবজুমের প্রতিটি পরিবার থেকে কেউ না কেউ জলস্রোত ভেসে গিয়েছিল।
অনেকগুলো মাছধরার ট্রলার ও সাম্পান সড়কের নিচে জলের কিনারে বাঁধা। ঘোড়ার পিঠ থেকে (টমটম যেহেতু) তাদের দেখি আর ভাবি কত সংক্ষুব্ধ রাত্রি, প্রমত্ত সাগর আর পূর্ণিমার দাগ লেগে আছে একেকটি ট্রলারের গায়ে। তাজিয়াকাটা পার হয়ে আমরা এসে পড়ি, বা বলা ভালো, আমাদের নিয়ে টমটম এসে পড়ে কুতুবজুম ইউনিয়নে। সোনাদিয়া দ্বীপ এই কুতুবজুম ইউনিয়নের একটি ওয়ার্ড। টমটম এসে থামে ঘটিভাঙ্গা নামক জায়গায়। এখান থেকেই সোনাদিয়া যাওয়ার নৌকায় চড়তে হবে।
(চলবে)