টুং টাং। ডোরবেলের মৃদু শব্দ। দ্রুত ফ্ল্যাটের দরজা খুলল কেয়া। ওপারে পলাশ। ওর ক্লান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে রইল কেয়া, ‘এত দেরি হল যে!’
পলাশ নিরুত্তর। ঘরের কোনায় বেঁটে র্যাকে জুতোজোড়া ঢুকিয়েই ব্যালকনিতে সেঁধিয়ে গেল। লাগোয়া ঘরের আলো খোলা দরজা কাঁচের জানালা গলে প্রশস্ত ব্যালকনিতে ছিটকে আসছে। রেলিঙের ফোঁকর দিয়ে দিনের আলোর মত রাস্তার হ্যালোজেনে বারান্দার অর্ধেকটা ঝকঝকে। চারতলার উপর দশ বাই চারের রেলিং ঘেরা জায়গা। ওটাকেই বারান্দা বলে পলাশ। ব্যলকনির সাথে বারান্দার পার্থক্য বুঝতে চায়না।
ওখানে দাঁড়িয়ে ঘাড় উঁচু করলেই অনন্ত আকাশ। আকাশ থেকে নেমে আসা বৃষ্টি ঝর্ঝর ধারায় পলাশের বারান্দা ধুইয়ে দেয়। গরম কালে বেলা গড়ালে চনমনে রোদ গোটা ব্যলকনি দাপিয়ে বেড়ায়। ভিজে জামাকাপড় নিমেষে শুকিয়ে দেয়। দিনান্তে ওখানকার দেওয়ালে খেলে বেড়ায় গোধূলির মায়াবী হলদেটে আভা। শীতে কৃপণ রোদ সকালে নাক গলায় না কিন্তু দুপুরবেলা দক্ষিণপূর্ব কোনের ইমারতগুলো ডিঙ্গিয়ে ব্যালকনিতে আছড়ে পড়ে। গ্রীষ্ম-বর্ষায় রোদ জলে নিয়মিত স্নান করে ব্যালকনির কোণে রাখা এক বৃক্ষ। বৃদ্ধ এক অশ্বত্থ। রোদ জল আর বাতাসের উপাদান মিশিয়ে নিজের খাবার বানায়। টিকে থাকে।
আগে ব্যালকনির মাঝখানে একটা উঁচু গোল সবুজ টবে অশ্বত্থ গাছটা থাকত। একদিন ছুটির দুপুরে পলাশের চোখে পড়ল, কেয়ার মেলে দেওয়া শাড়ি–সায়া-ব্লাউজ থেকে টপটপ করে জল ঝড়ে পড়ছে অশ্বত্থের চকচকে পাতায়। দুম করে মাথা গরম পলাশের। গলার শিরা ফুলিয়ে স্বভাব বিরুদ্ধ চিৎকার, ‘দেখছো না, সাবান-জল গড়াচ্ছে। গাছ মাটির ক্ষতি হবে না? কাণ্ডজ্ঞান নেই কোন!’
-আমি তাহলে কোথায় মেলবো? শুধু একটা গাছের জন্য এত বড় ব্যালকনি?
ঝগড়াটা ধাপে ধাপে চড়ছিল। জমে উঠবার আগেই ডোর বেলটা ডেকে উঠলো। পাড়া পড়শিদের নিরাশ করে বর্ধমান বিবাদটা কেঁচিয়ে কেয়া ছুটল দরজা খুলতে। দরজার বাইরে কুরিয়ার সার্ভিসের অতি ব্যস্ত এক যুবক। একটা বড় খাম কেয়ার মুখের সামনে বাড়িয়ে ধড়ল। দ্রুত হাতে নাম সই করে খামের দখল নিল কেয়া। পলাশের দিদির চিঠি, সঙ্গে ডাক্তারি পরিক্ষার এক দিস্তা রিপোর্ট।
গভীর মনোযোগে রিপোর্টে চোখ রাখল পলাশ। দিদির দু’চোখেই ছানি। আলিপুরে ডাক্তার কালিদাস সাহার কাছে রিপোর্ট দেখিয়ে অপারেশনের দিনক্ষণ জানতে হবে। সেই মত দিদিরা আসবেন। একমাত্র দিদি এবং প্রিয় ননদের আগমন বার্তায় দুজনেই উৎফুল্ল। চিঠিটা দু’জনেই আবার পড়ল। অস্পষ্ট হাতের লেখায় দরকারি হাবিযাবি বহু কথা। পুনশ্চ দিয়ে নিচে লেখা, ‘হাবুল, তোর অশথ দাদা ভালো আছে তো!’
চিঠির হাওয়া তর্ক ঝগড়া উড়িয়ে দিল। গুছিয়ে সন্ধি প্রস্তাব পেশ করল কেয়া। গাছটা থাকবে ব্যালকনির বাঁদিকের কোণ ঘেঁষে। বাকী জায়গায় কাপড় মেলা। সাবান কাচা জলে গাছ-মাটির স্বাস্থ্য হানি হবেনা জেনে পলাশ নিশ্চিন্তে সাপ্তাহিক দিবা নিদ্রায় ঢলে পড়ল।
দু’বছর নিজেদের এই ফ্ল্যাটে ব্যালকনির বাঁদিকের কোণে স্থায়ী ভাবে থাকছে গাছটা। মাঝে মাঝে পলাশ টবটাকে এপাশ ওপাশ ঘুরিয়ে দেয়। কোন একটা ডালকে একটু বেঁকিয়ে রেলিঙের বাইরে রাখে যাতে সবুজ ছোট্ট পাতা গুলো আরেকটু রোদ পায়। একটু বেশী বৃষ্টির জল খায়।
ঘামে ভেজা বাইরের পোষাকে একটা বেতের মোড়ায় বসে গাছটাকে অনেকক্ষণ ধরে দেখছিল পলাশ। বছর দুয়েক আগেও গাছটার পাশে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ত। ইদানীং ভারী শরীর। পেটে জমেছে কয়েক থাক চর্বি। সামনে বেশী ঝুঁকতে পারেনা। ইদানিং আবার হাঁটুর ব্যাথা। মেঝেতে না বসে অর্ধেক হাঁটু মুড়ে মোড়াতেই বসতে হয়।
কেয়ার ডাকে উঠতে হোল পলাশকে। ধীর পায়ে চায়ের টেবিলে এসে বসতেই কেয়ার ব্যাকুলতা, ‘কী দেখলে! গাছটা এখনও নেতিয়ে আছে?’
চায়ে আলতো চুমুক দিল পলাশ, ‘ভালো তো কিছু দেখছি না। রোজ চোখের সামনে একটু একটু করে নেতিয়ে পড়ছে।’
-আজ কী দেখলে?
-কুঁকড়ানো পাতার গায়ে কালো কালো ছোপ। দু’মাস চেষ্টা করছি, উন্নতির কোন লক্ষণ নেই। চোখের সামনে জলজ্যান্ত বিশাল গাছটা শুকিয়ে মরে যাচ্ছে। কিচ্ছু করতে পারছিনা।’
-তোমার কে বোটানিস্ট বন্ধু আছে না?
-হ্যাঁ, প্রশান্ত তলাপাত্র। বোটানিক্যাল সার্ভের সিনিয়ার সায়েন্টিস্ট। ফোনে কথা বলেছি। -উনি কী বললেন?
-সেই দায়সারা উপদেশ। ‘সপ্তাহে দু’দিন গ্রোথ হরমোন স্প্রে কর। মাটি আলগা করে পাতা পচা সার লাগা।’
-কাল সকালে ওসব ক’রো। অনেক সময় পাবে তুমি। কুর্চি তো নেই যে স্যারের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে!
একটু থামল কেয়া। তারপর ধীরে ধীরে বলল, ‘মেয়েটা হোস্টেলে যাবার পর থেকে অনেকটা সময় পাও তুমি। এবার একটু মরনিং ওয়াক শুরু কর। কাল সকালে পার্কে কয়েক পাক হেঁটে এসে চা-টা খেয়ে গাছটায় হরমোন স্প্রে কর।’
-আরে, গত সপ্তাহে দু-বার মাটি আলগা করে সার চাপিয়েছি। মিরাকুল্যান স্প্রে করেছি। অবস্থার কোন হেরফের নেই। খটখটে শুকনো ডাল। কোন নতুন পাতা নেই।’
একটু থেমে আবার, ‘গরমের এ সময়ে সব গাছ তেজী। কী সুন্দর তেল চুকচুকে নতুন পাতা। শুধু আমাদেরটাই ধুঁকছে। ম্যাড়ম্যাড়ে কোঁচকানো হলুদ পাতা। গাছের কাণ্ডে ছিটে ফোঁটা রস নেই অথচ মাটি ভেজা। মাঝে মাঝে মনে হয় অশ্বত্থ বেঁচে আছে তো!’
-তোমার চোখ মুখের অবস্থা কিন্তু ভালো দেখছি না। কিছু লুকাচ্ছো না তো?
-তেমন কিছু না। আবার চাগিয়েছে অসুখটা। কোষ্ঠকাঠিন্য। তার সাথে নোতুন উপসর্গ, বুক ধরফর।
– জানি অশ্বত্থটা তোমার প্রান। দু’হাত দিয়ে পলাশের কাঁধ টিপতে টিপতে কথা বলছে কেয়া, ‘তা বলে অশ্বত্থের জন্য চিন্তা করে নিজের শরীর খারাপ করবে? তুমি কালই হার্টের ডাক্তার দেখাও। মেয়েটা এত দূরে পড়ছে। আমাদের সুস্থ্য থাকতেই হবে।’
-আচ্ছা, কুর্চির হস্টেল যাওয়া তো দু’মাস হল, তাই না? আশ্চর্য, তখন থেকেই তো গাছটা শুকিয়ে যাচ্ছে!
-অত চিন্তা করতে হবে না, ওঠ। আফিসের জামা প্যান্ট ছেড়ে একটু ফ্রেস হও।
কেয়ার পিড়াপিড়িতে উঠতেই হল। স্নান সেরে পা-জামা গেঞ্জি গায়ে পলাশ ব্যলকনিতে মোড়ায় বসল।
এ সময় পাশের ঘরে বাবা-মার সাথে কেয়ার দীর্ঘ ফোনালাপ চলে। তারপর শুরু হয় ‘কলাবতীর কান্না’। অখণ্ড মনোযোগে রাত আটাটার টেলিভিশন সিরিয়ালটা দু’চোখ দিয়ে গিলতে থাকে ও। তখন দশ-বাই চার ব্যালকনির মাথায় তারা ভরা আকাশ। হাল্কা মেঘের পটভূমিতে সরে সরে যাচ্ছে চাঁদ। পশ্চিম দিক থেকে উঁচু বাড়ি টপকে মৃদু বাতাস ছুঁয়ে যাচ্ছে শরীর। তির তির কাঁপছে বৃদ্ধ গাছের বিবর্ণ পাতা। গাছের দু’একটা শুকনো পাতা সাদা কালো মোজাইকের ঝকঝকে মেঝেতে পড়ে আছে। আকাশ পাতাল ভাবনা নিয়ে মোড়ায় স্থির হয়ে বসে পলাশ। বিষণ্ণ মুখ।
বিষণ্ণতার শুরু কুর্চি হোস্টেলে যাবার পর থেকেই। ফ্ল্যাটটা বড্ড ফাঁকা। সংসারও আলুনি লাগে। শরীরে অসুখের থাবা। রিক্ত কেশ, স্ফিত উদর। বয়সের ভারে নুব্জ শ্লথ দেহ। অথচ প্রথম যেদিন গাছটা ঘরে এল, পলাশের তখন ছিপছিপে শরীর। ছাব্বিশ বছরের তরতাজা শ্যামলা যুবক। শক্তিমান, হাসিখুশি। একহারা শরীরে মাথা ভর্তি কোঁকড়ানো চুল। উজ্জ্বল আয়ত চোখ।
দু’চোখে একরাশ বিস্ময় নিয়ে কুচবিহারের দিনহাটা, তস্য গ্রাম গোসানিমারি থেকে সটান দমদমের ইটালগাছায় পা রেখেছে পলাশ। ক্ষুদিরাম সরণির শেষ মাথায় দোতলা বাড়ির একতলায় চিলতে অংশ ভাড়া নিয়েছে। বাড়ির এপাশওপাশে উঁচু উঁচু বিল্ডিং। ছিটে ফোঁটা সবুজ নেই মহল্লায়। দমবন্ধ হয়ে আসতো ওর। নির্বান্ধব কলকাতায় মনের আনাচে-কানাচে উঁকি মারে কুচবিহার জলপাইগুড়ি। কলেজের ছাত থেকে দৃশ্যমান কাঞ্চনজঙ্ঘার উদ্ধত বরফ চূড়া। চোখ জুড়িয়ে যায় নিজের বাড়ি ভর্তি ফুল গাছে। বাড়ির বাইরে তামাক পাটের বিস্তৃত ক্ষেত আর পাড়ার মোড়ের বাঁদিকে ডালপালা বিছিয়ে দাঁড়ানো বিশাল এক অশ্বত্থ। পলাশ হাড়িয়ে যায় শাল মনজিরি শিরিষ সেগুনের জঙ্গলে কিম্বা তিস্তার দিগন্ত ছোঁয়া চরে। কখনও বা রন্ধামালির বিস্তৃত চা-বাগানে। বাগানের সরু পথের দুধারে সবুজ চা গাছ দিগন্তে মিশেছে। সবুজ সমুদ্রে সহপাঠির সঙ্গে সাইকেলের প্যাডেল দাবিয়ে দিক শূন্য লক্ষ্যে হাড়িয়ে যায় পলাশ।
কলেজ জীবনটায় কষ্ট একটু থাকলেও দিনগুলো আনন্দেই কাটছিল। হঠাৎ দুর্যোগ। দিনহাটা স্টেশনে সান্টিং করবার সময় রেলের ইঞ্জিনের ধাক্কায় প্রান হারালেন প্রধান গ্যাংম্যান। হঠাৎ পিতৃশোক আর প্রবল অর্থকষ্ট। বিপর্যস্ত পলাশ। তখন তৃতীয় বর্ষ, ইতিহাস অনার্সের ছাত্র পলাশ রায়। বিভাগীয় প্রধান প্রশান্ত পারিয়ার সাহায্য সম্বল করে শেষ পরীক্ষা সম্পূর্ণ করল মাধাবী পলাশ। বুকের ভিতর উচ্চাশার যে পাখিটা কুব কুব করে ডাকতো, এবার গবেষণা তারপর অধ্যাপনা, সেই পাখিটার গলা টিপে দিল পলাশ। উচ্চাশা আকাঙ্খা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কণ্ঠ রোধ করে বাড়িতে আবার নোতুন উদ্দমে লড়াই শুরু করল পলাশ।
বছর ঘুরতেই পিএসসির সফল পরীক্ষার প্রার্থী তালিকায় জায়গা করে নিল পলাশ। প্রশান্ত স্যারের সাহায্য ও যোগাযোগে কলকাতার উপকণ্ঠে বাসস্থানও জুটল।
বহু মেহনতের পর চাকরি আর বাসস্থান জুটিয়ে ভেবেছিল, জীবনটা এবার সুখের রাস্তায় তরতরিয়ে ছুটবে। কিন্তু কলকাতায় আবার সংগ্রাম-মুখর নতুন জীবন শুরু হল। সকাল ন-টায় সাইকেল ঠেঙিয়ে রুদ্ধশ্বাসে দমদম ক্যান্টনমেন্ট। লোকাল ট্রেনের দমবন্ধ ভিড়ে অনেকটা পথ পেড়িয়ে বারাসাত। সকাল দশটার মধ্যে ভুমি রাজস্ব অফিস। দশটা-পাঁচটা কাজ। কাজ বলতে মাঝে মাঝে বগলে ম্যাপ নিয়ে সার্ভে করতে যাওয়া আর ইউনিয়ন অফিসে কাদা-ছোঁড়াছুড়ি। প্রতিযোগিতা আর হট্টগোলে নিঃসঙ্গ পলাশ হাঁপিয়ে উঠত। চাকরি ছেড়ে চলে যাবার চিন্তা মাথায় উঁকি দিত। কিন্তু তখনই মায়ের রোগ শোকে কাহিল মুখটা চোখে ভেসে উঠত।
ছক বাঁধা ব্যস্ত জীবনে বহু অপছন্দের মধ্যেও বাসস্থানটা ভালো লাগতো পলাশের। একার পক্ষে একতলায় বেশ বড় ফ্ল্যাট। ফ্ল্যাটের পেছনে যে বাড়ি ওয়ালার এক চিলতে ফাঁকা জমি আর আগাছা আবর্জনা ভর্তি ভাঙা চোরা একটা ঘর আছে, পলাশ জানতই না। জানতে পারল রবিবারের এক সকালে।
হঠাৎ ঠকা ঠক শব্দ। বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে খবরের কাগজ পড়ছিল ও। হাতুড়ি পেটার শব্দের উৎস খুঁজতে গিয়ে প্রথমবার আগাছা ভর্তি বাগানটায় ঢুকল পলাশ। দু’জন মিস্ত্রী পরিত্যক্ত ঘরের ছাতে দুমদাম হাতুড়ি পিঠছে। ছাতের একদম ধারে ডান দিকে ডালপালা ছড়ানো একটা বেঁটে অশ্বত্থ গাছে চোখ আটকে গেল পলাশের। চুন সুরকির ছাতে বলিষ্ঠ গাচ্ছটা এক নিপুণ শিল্পকর্ম।
শক্ত পোক্ত কাণ্ড। খাঁজ কাটা চকচকে পাতা। উপর থেকে ক্রমশ সরু হয়ে নিচে নেমেছে। সবুজ পাতায় তুলির সুক্ষ আঁচড়। বলিষ্ঠ কাণ্ডে গ্রীক ভাস্কর্য। ডালপালা বিস্তার করে বেঁচে থাকবার তীব্র তাগিদে আকাশে মুখ তুলেছে খর্বকায় পেশী বহুল অশ্বত্থ। মোটা কাণ্ডের নিচে রসস্থ মাটির বদলে শক্ত চুন সুরকি। তার মধ্যেই প্রবল বিক্রমে শিকড় ছড়িয়েছে গাছটা। বর্ষার জল, খোলা হাওয়া আর সূর্যের কিরণে বছরের পর বছর অজত্নেও বাঁচার মত বেঁচে আছে। সবার অলক্ষে নিজের তৈরি খাবারে সাধ্যমত পুষ্টি জুটিয়েছে। বিরুদ্ধ পরিবেশ আর অপ্রতুল খাবারে হয়ত আকারে খর্বকায় কিন্তু জীবন শক্তি আর প্রান প্রাচুর্যে অফুরন্ত।
খাদ্য আর মাটি বিহীন শিকড়, বছরে দু-তিন মাস মাত্র বৃষ্টির জল জোটে, তার মধ্যে এত সুন্দর গাছটা বাঁচল কি করে? গাছ তো নয়, এক অপ্রতিরুদ্ধ অসম্ভব জীবন। সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে একক প্রচেষ্টায় দৃপ্ত ভঙ্গিমায় জীবনের জয় ঘোষণা করছে। ওর অসম্ভব প্রাণ প্রাচুর্য আর বিরুদ্ধ পরিবেশে বেড়ে উঠবার তীব্র প্রয়াসকে কুর্নিশ জানালো গোসানিমারির পিতৃহারা স্বপ্ন পুরনে ব্যর্থ এক নিঃসঙ্গ যুবক।
গোসানিমারিতে খেলার মাঠের উত্তর দিকে ছিল এই রকম একটা অশ্বত্থ। ডালপালা মেলে দাঁড়িয়ে থাকতো। স্কুলের পর ফুটবল খেলে গাছের হাওয়ায় ঘাম শুকাতো ওরা। সূর্য ডুবু ডুবু সময়ে মেলা বসত গাছের নিচে। চানা ফুচকা বাদাম ভাজার পসরা বসত। শিশু বৃদ্ধ বৃদ্ধার অনর্গল কথাবার্তা আর গাছের ডালে অসংখ্য পাখির কিচির মিচির শুনত পলাশ। কলেজ শেষ করে পিএসসির চাকরি-পরীক্ষার পড়ায় ব্যস্ত পলাশ মাঝে মাঝে গাছের নিচে বাঁধানো বেদীতে এসে বসতো। অনেক দিন চোখের জলও ফেলেছে। তখন বাড়িতে দিদির কান্না। অপমানিত দিদি মায়ের বিছানার পাশে পাত্র পক্ষের অসম্মতির যন্ত্রণা বুকে নিয়ে গুমরে উঠছে।
‘বাবু, কিছু বলবেন’? প্রবীণ মিস্ত্রির ডাকে চমকে উঠল পলাশ। ইশারায় কাছে ডাকতেই কাঠবিড়ালির মত নেমে এল মানুষটা। ছাতের দিকে আঙুল তুলে পলাশ বলল, ‘ওই অশ্বত্থ গাছটা আমার চাই।’
মিস্ত্রির নিচু নিস্প্রিহ স্বর। বলল, ‘ছাত ভাঙা হলে অনেক জিনিষ ভ্যাটে ফেলে আসতে হবে। ওখান থেকে গাছটা তুলে টবে বসিয়ে আপনাকে দিয়ে দেব। টবের দামটা শুধু আমাকে দেবেন।’
একটু থেমে আবার মুখ খুলল মিস্ত্রি। স্বর নিম্ন গ্রামে কিন্তু কথায় আত্মবিশ্বাস। ‘গাছ নষ্ট করতে মন চায়না বাবু। প্রাণ তো! আপনি ওটাকে বাঁচিয়ে রাখবেন। দেখবেন খুব পয়া গাছ।’
-বয়স কত হবে?
পলাশের প্রশ্নে অনেকক্ষণ বিড়বিড় করে হিসাব কষল মিস্ত্রী। ধীরে ধীরে বলল, ‘আমার হিসাবে গাছটার বয়স কুরি-পঁচিশ তো হবেই। বেশিও হতে পারে। দেখছেন না শিকড় বাকর চালিয়ে প্রাচীরটা কেমন জাপ্টে ধরে আছে।’
কদিন পর ইট-রাঙা একটা টবে মিস্ত্রীর হাতে লাগানো ছোট ছোট পাতায় ভর্তি গাছটা পলাশ যত্ন করে বারান্দায় রাখল। পাঁচ-ছ দিন পর পলাশ লক্ষ করল ওর দীর্ঘ দিনের বিচ্ছিরি কোষ্ঠ কাঠিন্য আর ভোগাচ্ছেনা। মাস খানেক পর মায়ের কাঁপা কাঁপা হাতের লেখায় এক পাতা চিঠি পেল পলাশ। ‘স্নেহের নিমু, তোমার দিদির বিবাহ স্থির হইয়াছে। সৎ পাত্র। জলপাইগুড়ির দীনবাজারে জামাই বাবাজীর নিজস্ব কাপড়ের দোকান। তুমি শীঘ্রই ছুটির দরখাস্ত কর।’
পাঁচ বছরের বড় দিদির বিয়ের পর অফিসে ফিরে কানাঘুষা শুনল পলাশ। তার দিন দশেক পর অবাক করা খুশির খবর। হেড অফিস থেকে বদলির চিঠি এল। বাড়ির কাছে নারায়ন পুর অফিসে বদলি। চিঠিটা পরতে পড়তে মিস্ত্রীর কথাটা মনে পড়ছিল পলাশের, ‘এটা খুব পয়া গাছ বাবু।’
নিজের সুস্থ্য শরীর, দিদির বিয়ে, কাছের অফিসে বদলি। ঘটে গেল মাত্র দু-তিন মাসে। এর পর প্রখর গ্রীষ্ম কাটিয়ে তুমুল বর্ষা নামল কলকাতায়। ঝম ঝম বৃষ্টি মুখর ফাঁকা অফিসে পিওনের হাতে মায়ের চিঠি এল। লিখছেন, ‘নিমু, এবার তুমি পছন্দ মত বিবাহ করিয়া সংসার ধর্ম পালন কর।’
পর দিন বারান্দায় গুন গুন গান থামিয়ে অশ্বত্থের পাশে বসে মায়ের চিঠির উত্তর লিখল পলাশ। ‘অফিসে আমার এক সহকর্মী ওর দাদার মেয়েকে বিয়ের কথা খুব করে বলছেন। আমি ওদের বলবো, তোমার ঠিকানায় চিঠি লিখতে। তুমি দিদি মতামত জানিও। আমি একটা বড় ফ্ল্যাটের সন্ধানে আছি।’
দমদম ক্যান্টনমেন্টের কাছে তিন তলার এক বড় ফ্ল্যাটে উঠে এল পলাশ। কম ভাড়ায় প্রশস্ত দুটো ঘর, বড় ব্যলকনি। ব্যালকনির মাঝখানে অশ্বত্থ গাছটা রাখল পলাশ। রবিবারের এক সকালে বিয়ের দিনক্ষন পাকা করতে দিদি জামাইবাবু জলপাইগুড়ি থেকে এলেন পলাশের নতুন ফ্ল্যাটে। ব্যালকনিতে রাখা অশ্বত্থ গাছটার দিকে চোখ পড়তেই উচ্ছল কিশোরীর মত চোখ বড় করে লাফিয়ে উঠল দিদি, ‘এটাতো আমাদের গোসানিমারির সেই অশথ গাছটা!’
-আমারও তাই মনে হয়।’ পলাশ হাসল।
-শোন নিমু, গোসানিমারিতে আমি এখন যেতে পারবোনা। ডাক্তারবাবু বেশী ঘুরতে বারণ করেছেন। আমি ওই গাছের ডালে সূতো বাঁধবো। আমার একটা মানত আছে।
পলাশের মনে পড়ল, গোসানিমারিতে অশ্বত্থ গাছের নিচে অনেকে পূজা করত। কেউ কেউ হনুমান চলিশা পড়ত সুর করে। গাছের ডালে লাল সুতোয় ঢিল বেঁধে মানত করত। প্রতিবেশী লছমি চাচির হাত ধরে মা-ও পূজা দিয়েছেন গাছের নিচে। পলাশ ঢিল বাঁধা বা পূজা না-করলেও গাছের বেদিতে বসে মনে মনে প্রার্থনা করেছিল। নিজের জন্য চাকরি আর দিদির সৎ পাত্রে বিয়ে। প্রার্থনা পূরণ হয়েছিল পলাশের। দিদি সুখী হয়েছিল বিয়ের পরে। হারমোনিয়ামের ধুলো ঝেড়ে জামাইবাবুর সাথে ডুয়েট গাইত, ‘পরাণ মাঝি রে, কোন ঘাটে ভাসাইলা তোমার নাউ….।’
কেয়াকে বিয়ে করে দমদম ক্যান্টনমেন্টের বড় ফ্ল্যাটটাতে এনে তুলল পলাশ। দিদি আসতে পারেনি পলাশের বিয়েতে কিন্তু জামাইবাবু আর মা এসেছিলেন। বিয়ের দু’দিন পর বারান্দার গাছটায় চোখ পড়তেই ঝিকমিক করে উঠল মা’র মুখ। গাল ছড়ানো হাসি। গাছের গায়ে হাত বুলিয়ে মন্ত্র পড়লেন, ‘আয়ো প্রজম ধনম ধান্যম/সৌভাগ্য সম্পদম/ দেহি দেব মহাবৃক্ষ/ ত্বয়াম অহম স্মরনাগত।’
কেয়া অর্থ জানতে চাইলে মা ব্যাখ্যা করলেন, ‘অশ্বত্থ হচ্ছেন বৃক্ষ শ্রেষ্ঠ। সাক্ষাৎ ভগবান। এর শিকড়ে ব্রহ্মের রূপ। কাণ্ড বিষ্ণু রুপিন। বৃক্ষের ঊর্ধ্বাংশ সাক্ষাৎ শিব। ওই বৃক্ষকে আমি পূজা করি। তিনি আমদের সাফল্য, সৌভাগ্য প্রদান করেন।’
কেয়া-পলাশের সৌভাগ্য বলতে হবে, কেয়ার পেটে কোন কাটা ছেঁড়া করতে হয়নি কুর্চির জন্মের সময়। কেয়ার রক্ত চাপ বেড়ে গেছিল খুব। তবুও ডেলিভারি স্বাভাবিক হয়েছিল। এই বাড়িতেই কেয়ার আদরে কুর্চি বড় হয়ে উঠল। এখানেই স্কুল। কিন্ডার গারটেন তারপর অক্সিলিয়াম কনভেন্ট।
কুর্চির তখন ক্লাস সিক্স। বাগুইহাটিতে ব্যাঙ্ক ঋণে ফ্ল্যাট কিনে চলে এল পলাশ। সকালে কুর্চি হারমোনিয়ামের রিডে কচি আঙুল টিপে গান করে। ব্যলকনিতে গাছের পরিচর্যা করতে করতে গান শোনে পলাশ। গাছের পাতায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘মহাবৃক্ষ, আমার মেয়ের গান শোন। ভৈরব গাইছে। কোমল ‘রে’ ঠিক লাগছে তো’? তখন সদ্য ঘুম ভাঙা সকালের শরীরে আলসেমি। অলস ভঙ্গিমায় তিরতির বাতাসে সিক্ত পাতা দাদরা তালে মাথা দোলাচ্ছে। দু’দশকের সঙ্গী পয়া অশ্বত্থ নোতুন পাতায় সেজে মেয়ের কচি গলার গান শুনছে।
সেই মেয়ে স্কুল ডিঙ্গিয়ে এখন ভর্তি মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিঙে। প্রথম বছর। কলকাতায় একুশটা বছর কেমন হুস করে কেটে গেল। নিজের ফ্ল্যাটে শুধু কেয়া আর পলাশ। কেয়ার চওড়া সিঁথি, কপালের দুপাশে রুপোলী চুল। এক মনে টিভির সিরিয়ালে মশগুল হয়ে আছে কেয়া। ব্যালকনির মোড়ায় বসে গাছের শুকনো পাতায় হাত বুলাচ্ছে পলাশ। দু-দশকের সঙ্গী প্রবীণ অশ্বত্থকে মনে মনে বলছে, কোন দুঃখে মৃত্যুর পথ বেছে নিয়েছে তুমি? দুঃসহ স্পর্ধায়, ক্ষুদা যন্ত্রণা উপাক্ষা করে ঝড়-তুফানের সামলা করেছ একা! বিরুদ্ধ পরিবেশে যন্ত্রণায় দীর্ণ হয়েও সৌন্দর্য বিলিয়েছো। জেগে ওঠ বৃক্ষ। অবরুদ্ধ চৈতন্য থেকে জেগে ওঠ। অফুরন্ত জীবনী শক্তি তোমার। সদা ব্যাস্ত কাজের শহরে একমাত্র তুমিই আমার বন্ধু। তোমার কাছেই শিখেছি সতত বিরুদ্ধ পরিবেশে মাটি কামড়ে টিকে থাকা।’
-এতক্ষণ ধরে ডাকছি শুনতে পাওনা’? হঠাৎ কেয়ার ডাকে ভাবনার ঘোর কেটে গেল। ধীর পায়ে খাবার টেবিলে এসে বসল পলাশ।
কয়েক দিন পর দিদি এল চোখের ছানি কাটাতে। সঙ্গে জামাইবাবু, কাঞ্চনদা। আর পলাশের চঞ্চলা ভাগ্নি, গুঞ্জা। গুঞ্জার গলাও দিদির মত সুরেলা। একটু খাবার মুখে দিয়েই দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তি হটিয়ে কুর্চির হারমোনিয়াম নিয়ে মেতে উঠল সবাই। ব্যবসায়ী কাঞ্চনদা ব্যালকনিতে বসে খোলা হাওয়ায় ভাওয়াইয়া গানের সুর ধরলেন।
বাজার থেকে ফিরে ব্যালকনিতে মোড়ায় বসে অশ্বত্থের দিকে তাকিয়ে অবাক হ’ল পলাশ। বলল, ‘গাছের ডালে লাল সুতো সুতো কে বাঁধল?’ গুণ গুণ গান থামাল গুঞ্জা, ‘আমি বেঁধেছি। মানত করলাম। পরশু দিন রেসাল্ট, খুব টেনশনে আছি।’ স্নান ঘরে ঢুকতে ঢুকতে এক মুখ হেসে পলাশ বলল, ‘বিএসসি, অনার্স। ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হতে চাইলে টেনশন তো একটু হবেই।’
পরদিন ছানি কাটিয়ে রাতেই ফিরে এল দিদি। সকাল দুপুর সন্ধ্যা ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে দু-ফোঁটা ওষুধ পড়ছে চোখে। আপাতত কয়েক দিন বিশ্রাম। সারা দিনই বাড়িতে গান গল্প চলছে। অনেক দিন পর কেয়াও গাইতে বসেছে।
বন্ধুর মোবাইলে খবর পেল গুঞ্জা, পাশ করেছে। কেমিস্ট্রি অনার্সে প্রথম শ্রেণী। বাড়িতে খুশির হাওয়া। তার মধ্যে অনেকক্ষণ চুপ থেকে অন্যমনস্ক পলাশ বড় একটা শ্বাস ফেলে বলল, ‘দিদি, এত দিনের সুখ দুঃখের সঙ্গি অশ্বত্থকে বোধ হয় বাঁচাতে পারলাম না!’
-সে কি রে! আমি তো ঝাপসা চোখে ভালো করে কিছু দেখতেও পাবো না।
-বুঝলি দিদি, আমার বটানিস্ট বন্ধুর সাথে অনেক আলোচনা করেছি। ও বলছে, একটা পুরানো বনসাই টিকিয়ে রাখার অনেক হ্যাপা। বানালেই হ’ল না। ফাইকাস রেলিজিয়াসা বাঁচানো কোন আনাড়ি লোকের কম্ম নয়। অনেক বুঝিয়েছি ওকে। বনসাই আমি বানাই নি। যেমন পেয়েছি, তেমনি মেন্টেন করেছি। একটা ডালও কখনও কাটি নি। মাঝে মাঝে শুধু টব পাল্টেছি। প্রশান্তর শুধু এক কথা, দু’মাস ধরে ডালপালা বাড়ছে না। নোতুন পাতা নেই। তার মানে, মরে গেছে গাছটা। ডেড।
হঠাৎ এক ঝলক বিষাদে থম মেরে গেল পরিবেশ। এতক্ষন ঠোঁট কামড়ে মামার কথা মন দিয়ে শুনছিল গুঞ্জা। এবার মাথা নাড়িয়ে বিজ্ঞের মত বলল, ‘ক্লাসিক্যাল বটানিস্টদের কথা তুমি শুনবে না মামু। গাছ মতামত জানাতে পারে। ওদের নিজস্ব সিগন্যাল আছে। কোন আঘাতে গাছ দীর্ঘ দিন গুটিয়ে থাকতে পারে।’
চায়ের কাপ হাতে জামাইবাবু বললেন, ‘আমার কথা শোন নিমু, অশথ গাছ সহজে মরে না। তুমি অন্য সার বা হরমোন লাগাও।’
আবার বক্তৃতা শুরু করল গুঞ্জা, ‘মামু তুমি তো জান, বৃদ্ধ গাছ অনেক সময় সুপ্ত হয়ে থাকে। উঁচু পাহাড়ে বরফে সম্পূর্ণ ঢেকে যায়। সাত-আট মাস পর বরফ গললে আবার সবুজ পাতা নিয়ে জেগে ওঠে। সুপ্ত হয়ে থাকাটা অনেকটা সাপের শীত ঘুমের মত।’
বালিশে হেলান দিয়ে দিদি বলল, ‘জানিস তো গাছেরও কষ্ট হয়। বাবা মারা যাবার পর, নিমুর হয়ত মনে আছে, আমাদের ফলন্ত জলপাই গাছটা বেমক্কা মরে গেল। আমার মনে হয়, অশথ গাছটা দুঃখ পাচ্ছে কোন কারণে।’
মোবাইল ফোনটা বাজতেই কেয়া উঠে গেল পাশের ঘরে। দিদির খাটের পাশে পলাশের কণ্ঠে বন্ধু-মৃত্যুর শোক উথলে উঠছে, ‘দেখ দিদি, আমাকে সান্তনা দিস না। অনেক শোক তো সামলেছি। বার অকালে চলে যাওয়া। রোগ জর্জর মায়ের মৃত্যু। তেমনি অশ্বত্থের বিচ্ছেদও মানিয়ে নেব। কষ্ট হবে ঠিকই। দু’দশকের বন্ধুত্ব! পরশু দিন অশ্বত্থের মরা দেহটা গলির মোড়ে মিউনিসিপ্যালিটির ভ্যাটে ফেলে দিয়ে আসবো।’
কেয়া ঘরে ঢুকে বিছানায় বসে বলল, ‘কুর্চির ফোন ছিল। অনেক কথা বলল ও। কাল রাতে স্বপ্ন অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছে। অশ্বত্থ গাচ্ছটা ওকে আদর করছে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলছে, ‘মামনি, অনেক দিন তোর গান শুনিনি। এখনই একটা ভৈরব শোনা’।
‘তাই তো!’ দিদির গলায় বিস্ময়। কুর্চি হস্টেলে যাবার পর থেকেই তো এ-বাড়িতে কেউ গান গায় না। তোরাও মন খারাপ করে থাকিস! নিরানন্দ পরিবেশ। হারমোনিয়ামটা দে তো …।’ গান শুরু হল। একটার পর একটা গান। গুঞ্জা প্রথমে ব্যান্ডের একটা গান গাইল। তারপর ওর তৈরি একটা ফিউসন, ভাওইয়ার সাথে বিদেশি গান। সব শেষে জামাইবাবুর ভরাট গলায়, ‘ডাঙ্গাত যাইয়া দেখুম পানি/উজান ভাটি করে…।’
গানের জলসা ভাঙতে রাত গভীর হল। সকালে ধাক্কা দিয়ে পলাশের ঘুম ভাঙালো কেয়া। বলল, ‘অদ্ভুত ব্যাপার। আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। দেখবে এসো। তিন দিন তো কিছুই দেখা হয় নি। বাজার-অফিস নিয়ে তোমারও দম ফেলার সময় ছিল না।’
পলাশকে ব্যালকনিতে টেনে নিয়ে এল কেয়া। গাছের পাশে চোখ কচলে মোড়ায় বসলো পলাশ। অশ্বত্থের শুকনো পাতা গুলো ঝরে পড়েছে মেঝেয়। হালকা রোদ লেগেছে গাছের ডালে। সোনালি রোদে চক চক করছে অসংখ্য কচি পাতা। চোখমুখ ধুয়ে এসে আবার দেখল পলাশ। জামাইবাবু কেয়া গুঞ্জার বড় বড় চোখ। কালো চশমা খুলে নোতুন দৃষ্টিতে সবুজ পাতায় চোখ রেখে দিদি গেয়ে উঠল, ‘এ কি হে সুন্দর শোভা…।’
গানের উৎসবের মধ্যেই অফিস যাবার প্রস্তুতি সেরে ফেলল পলাশ। খাবার টেবিলে বসা পলাশের দিকে তাকিয়ে দিদি বলল, ‘নিমু, তোর বন্ধুর শীত ঘুমটা ভাঙাল কে রে?’
অফিসের জামা-প্যান্ট গায়ে বাইরের ঘরে কোণার র্যাক থেকে জুতো বেড় করল পলাশ। ওর উজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে কেয়া বলল, ‘আজ তাড়াতাড়ি ফিরবে তো?’
গল্প: দেহি দেব মহাবৃক্ষ
এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
ড.সৌমিত্র কুমার চৌধুরী, ভূতপূর্ব বিভাগীয় প্রধান ও এমেরিটাস মেডিক্যাল স্যায়েন্টিস্ট, চিত্তরঞ্জন জাতীয় কর্কট রোগ গবেষণা সংস্থাণ, কলকাতা-700 026.
প্রকাশিত গ্রন্থ- বিজ্ঞানের জানা অজানা (কিশোর উপযোগী বিজ্ঞান), আমার বাগান (গল্পগ্রন্থ), এবং বিদেশী সংস্থায় গবেষণা গ্রন্থ: Anticancer Drugs-Nature synthesis and cell (Intech)।
পুরষ্কার সমূহ: ‘যোগমায়া স্মৃতি পুরস্কার’ (২০১৫), জ্ঞান ও বিজ্ঞান পত্রিকায় বছরের শ্রেষ্ঠ রচনার জন্য। ‘চৌরঙ্গী নাথ’ পুরস্কার (২০১৮), শৈব ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত উপন্যাসের জন্য। গোপাল চন্দ্র ভট্টাচার্য স্মৃতি পুরষ্কার (2019), পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও জৈবপ্রযুক্তি দফতর থেকে), পঁচিশ বছরের অধিক কাল বাংলা ভাষায় জনপ্রিয় বিজ্ঞান রচনার জন্য)।
একটি মন্তব্য করুন
একটি মন্তব্য করুন