বিশতম বারের মত ৩১ আগস্ট ২০২১ পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বন্ধ বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছেন সরকার। ৫০০ দিনের পরে লাগাতার বন্ধের কাতারে যুক্ত হল আরো ৩৩ দিন।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ বৃদ্ধির এই বিশতম বারে, ‘বিষ’ সম্পর্কিত জালাল উদ্দিন রুমী’র একটা কথা মনে পড়লো। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, বিষ কি..?
উত্তরে তিনি চমৎকার করে বলেছিলেন- “মানুষের প্রয়োজনের অতিরিক্ত যা কিছু আছে, তাই হচ্ছে বিষ। এটি হতে পারে ক্ষমতা, সম্পদ, ক্ষুধা, অহংকার, লোভ, অলসতা, ভালোবাসা, উচ্চাকাঙ্খা, ঘৃণা বা যে কোন কিছু।”
এখন এই যে কোন কিছুর স্থানে যদি লাগাতার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ৫৩৩দিন যুক্ত করি তবে কি তা বিষাক্ত হবে না..? গত দেড় বছরে ৬৬দিনের সাধারণ ছুটি কি বিষাক্ত হয়নি সাধারণ মানুষের কাছে..? প্রায় ১৮ কোটি জনসংখ্যার এই দেশের মোট ১২ লাখ ১৭ হাজার ৬২ জন সরকারি চাকরিজীবী ছাড়া অন্য সবার জীবন কি দুর্বিষহ ও বিষাক্ত হয়ে ওঠেনি..? ঘটেনি জীবনের সকল ছন্দপতন..? আস্থা, বিশ্বাস, নির্ভরতা, সম্মান, শিক্ষা, বিচার, প্রশাসন, রাজনীতি, মানবিকতা কোনটা বিষাক্ত হয়নি বাদ বাকি সমস্ত জনগোষ্ঠীর কাছে..?
জীবনে বেঁচে আছি, এটাই যে এখন সবচেয়ে বিষাক্ত, বিভীষিকাময় হয়ে দাঁড়িয়েছে তা সোস্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত বিভিন্ন শ্রেণিপেশার অখ্যাত মানুষদের বিখ্যাত সব উক্তি সম্বলিত ক্ষোভের ভাষায় স্পষ্ট বোঝা যায়। তবুও কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙ্গে না।
কিছু বিষ খুব দ্রুত কার্যকর হয়ে মানুষের জীবনাবসান ঘটায়। আবার কিছু বিষ খুব আস্তে আস্তে সবার অলক্ষে দীর্ঘ মেয়াদে তার প্রভাব ছড়িয়ে যখন রুদ্রমূর্তি ধারণ করে, তখন নিয়তি বলে মেনে নেয়া ছাড়া সাধারনের কোন গত্যন্তর থাকে না। মানুষের শরীরের বিষক্রিয়া অনেক সময়ে তাৎক্ষনিক চিকিৎসায় উতরে যাওয়া সম্ভব হয়। তার কারন, ওটার চিকিৎসক ও ওষুধ আমাদের কম-বেশি সবার জানার নাগালের মধ্যে থাকে বলে। কিন্তু একটি সমাজ বা রাষ্ট্র যদি ওভাবে খুব আস্তে আস্তে, সবার অলক্ষে, শাসকের একগুয়েমিতে, পরজীবীদের উচ্ছিষ্ট ভোগের মনোবৃত্তিতে, সুশীলদের নিষ্ক্রিয়তায় , শিক্ষকের নীরবতায়, দীর্ঘ মেয়াদে বিষাক্ত হয়ে যায় তখন করণীয় কি..?
গত ১৭ মাসে সবচেয়ে বেশি বিষাক্ত হয়ে যাওয়া খাতটি হচ্ছে শিক্ষাখাত। এবং দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি এ খাতেই সবচেয়ে কম দূরদর্শি, কম চিন্তাশীল ও কম সাহসি মানুষের বিচরণ এখন। এক জন শ্রমিক, দিনমজুর, কৃষকসহ নানা পেশার সাধারণ মানুষ যেমন সুক্ষ্মভাবে, যে ক্ষুরধার ভাষায় তার নিজের অধিকার হরণে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায়। সমস্যা সমাধানের ইঙ্গিত প্রকাশ করে। শিক্ষকরা তার ধারে কাছেও নেই। যেন আপনি বাঁচলে বাপের নাম। অথচ কবি গোলাম মোস্তফার জবানীতে জেনেছি- “শিক্ষক মোরা শিক্ষক, মানুষের মোরা পরমাত্মীয়, মানুষের মোরা দীক্ষক।”
একটা সময় ছিল, যখন আমাদের সিনিয়র সিটিজেনরা বলতেন, ‘শিক্ষা-দীক্ষায় মন দাও।’ তখন শিক্ষা মানুষকে জীবনের মন্ত্রে দীক্ষিত করত। আজ কিন্তু সে জায়গাটি বিষাক্ত হয়ে যাবার জন্যেই পান থেকে চুন খসলেই আমাদের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা আত্মহত্যার মত ভুল পথটি অনায়াসেই বেছে নেন। কারণ শিক্ষা-শিক্ষক তার কাছে ম্যাটার করে না। এগুলো তার জীবনে আদর্শ হিসাবে প্রতিস্থাপিত হতে পারেনি। হয়েছে চাকরী বা বিবাহে নিজের অবস্থানের মাপকাঠি হিসাবে।
প্রাথমিক বা বুনিয়াদি শিক্ষা হচ্ছে গুরুমুখী শিক্ষা। এখানে শিক্ষার্থীদের স্বশরীরে গুরুর কাছে আসতে হয়। প্রযুক্তি নির্ভর ভার্চুয়াল জগতে (অনলাইন) তা সম্ভব নয়। তবুও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ৫৩৩দিনে বহু কিন্ডারগার্টেন বা সমমানের প্রতিষ্ঠান, বহুবার সরকারি প্রচার প্রপাগান্ডা শুনে, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার মানসে অনলাইন ক্লাসের চেষ্টা করেছিল। নানাবিধ নিষ্ঠুর বাস্তবতায় তা কার্যকর হয়নি বরং আমাদের ভাবনা ও প্রচেষ্টাগুলোকে অনেকাংশে বিষাক্ত করে দিয়েছে।
২৯ জুলাইয়ে লাগাতার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ৫০০তম দিনের কর্মসূচিতে অংশগ্রহনের জন্য জনসংযোগ কালে ভোলার একজন বর্ষীয়ান কিন্ডারগার্টেন শিক্ষক দুঃখভারাক্রান্ত কন্ঠে জানিয়েছেন, অন লাইন ক্লাস শুরুর জন্যে তিনি ইন্টারনেট সাপোর্টেড ডিভাইস কিনে কার্যক্রম শুরু করেন। যদিও খুব কম সংখ্যক শিক্ষার্থীর কাছে তা রিসিভ করার মত ডিভাইস ছিল। দিন দশে ক্লাস করার পরে যখন টিউশন ফিস এর কথা বলা হ’ল, তখন আর কেউ ক্লাসে আগ্রহী হলেন না। এবং মাস যেতে না যেতেই পুরো কার্যক্রম বন্ধ হতে বাধ্য হল। যদিও এমন ঘটনা কেবল ভোলাতে নয়, সারা দেশেই ঘটেছে। ভুল করে যাওয়া একটা মিসড কলে যে অভিভাবক কল ব্যাকে অস্থির হয়ে যেতেন, সেই অভিভাবক বহুবার কল করলেও শিক্ষকের ফোন রিসিভ করেন না।
যে বা যে সকল অভিভাবক এমনটা করলেন, তারা কি শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের মধ্যে বিরাজমান মানব সভ্যতার সমান বয়সী মধুর সম্পর্কটাকে বিষাক্ত করেননি..? বীতশ্রদ্ধতার যে দুষ্ট ক্ষত তৈরি করলেন তার পরিণাম কতটা ভয়াবহ হয়ে গেল একটি জাতির জন্যে তা কি বুঝতে পারছেন..! কাল যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে যায়, তখন তাদের ছেলেমেয়েদের মুখ দেখে কি শিক্ষক তার বিষব্যাথা অনুভব করবেন না..? সামান্য হলেও কি শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যের সে শ্রদ্ধা ও সম্মানের জায়গাটি বিষাক্ত আভায় ছেয়ে যাবে না..?
এখানে একটু বলে রাখি, শ্রদ্ধা হচ্ছে সেই উপলব্ধি বা সেই বোঝাপড়া যা স্বীকার করে পরষ্পরের মর্যাদা। আর সম্মান হচ্ছে প্রেম, আশা আর বিশ্বাস ফুরিয়ে যাবার পরে যা থাকে তা। শিক্ষকের সাথে আমাদের শ্রদ্ধার সম্পর্কটা আমরা বিষাক্ত করেছি অনেক আগেই। কখনো বাণিজ্যের নামে আবার কখনো আধুনিকতার নামে। স্যার থেকে টিচার বানিয়েছি, মিস বানিয়েছি আরো কত কি..!
এগুলো কি কেবলই শব্দের পরিবর্তন ছিল..? ভাবনার পরিবর্তন নয়..? মর্যাদার পরিবর্তন নয়..? আজকে এই ৫৩৩ দিনতক বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের যারা খোঁজ নেননি বরং শিক্ষা বাণিজ্যের মুনাফাখোর এজেন্ট হিসাবে সংজ্ঞায়িত করার হীন চেষ্টা করছেন, তারা মহীরুহের শেকড়ে কি পরিমান বিষ ঢালছেন বুঝতে পারছেন কি..? আজ না বুঝলেও বুঝবেন কাল, কপোল চাপড়াবেন দেবেন গাল..!
আরো একটি বিষয় লক্ষণীয়, আজকে যারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার ক্ষেত্রে বিরোধিতা করছেন, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সম্পর্কে অসম্মানজনক মন্তব্য করছেন তারা কারা..? হিসাব করে দেখবেন তারা এরশাদ আমলের কিশোর বা যুবক। আমাদের দেশে শিক্ষা ব্যবস্থা কলুষিত হওয়া শুরু হয়েছিল যে সময় থেকে। স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানের পাবলিক পরীক্ষার দাবী তুলে তা কার্যকর করে নকলের মহোৎসব করেছিলেন। নিজ শিক্ষকের সামনে নকল করে শিক্ষককে অপমান করেছেন। তাদের তো নিজেদেরই পড়াশুনা অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। যাকে বলে ডেপথ অব এডুকেশন। তা কি তাদের অর্জিত সনদের সমমানের আছে..?? কাজেই তারা বলতে পারেন। আর তার পরবর্তী প্রজন্মতো প্রশ্নপত্র ফাঁশের প্রজন্ম। তারা তো আরো এক কাঠি এগিয়ে। যেমনতার মেজবান, তেমনতাতেই তো খায়..!
প্রচলিত আছে, শিক্ষকদের একটি স্বভাবসুলভ দোষ হচ্ছে, তারা দুনিয়ার সবাইকে ছাত্র মনে করে। ছাত্রের কাছ থেকে যে গুরুত্ব, সম্মান, শ্রদ্ধা পেতে অভ্যস্ত তা অন্য সবার কাছ থেকেও আশা করে। সে সবাইকে সব ভুল শুধরে দিতে চেষ্টা করে। সে সব সময়ে সত্য ও ন্যায়ের পথে নিজে চলে ও অন্যকে আহ্বান করে। যাকে বলে আপনি আঁচড়ি ধর্ম পরকে শেখানো। তো এর মধ্যে দোষের কি আছে..? আমি তো দেখি সবটাই গুণ। এ গুণটা কাজে লাগাবার তো এখনই সময়।
লাউরা এস্কিবেল বলেছেন, “আমরা প্রত্যেকে শরীরের ভেতর একটা দেশলাইয়ের বাক্স নিয়ে জন্মাই কিন্তু আমরা নিজেরা সেগুলো জ্বালাতে পারি না।…প্রিয় খাবার, সুন্দর গান, গভীর আলিঙ্গন, শব্দ কিংবা কোনো ধ্বনি। এতে প্রথম দেশলাইটি জ্বলে ওঠে। মুহূর্তে আমরা ভীষণভাবে আবেগে উদ্বেলিত হই। চমৎকার এক উষ্ণতা আমাদের ঘিরে রাখে, সেটি সময়ের সাথে সাথে ম্লান হতে থাকে–আবার নতুন বিস্ফোরণের অপেক্ষায়।
বেঁচে থাকার জন্য প্রতিটি মানুষের বিস্ফোরণের উপকরণগুলো খুঁজে নিতে হয়। কারণ এ বিস্ফোরণের উপকরণগুলো আত্মার খোরাক জোগায়। এই জ্বলে ওঠা আগুনই আত্মার রসদ। কিন্তু কেউ যদি সময়মতো এই বিস্ফোরণ ঘটানোর উপকরণগুলো খুঁজে না পায়, তাহলে তার ভেতরের দেশলাইতে নোনা ধরে যায়, আর কখনো জ্বলে না।”
বিষ্ফোরণের এখনই সময়। বুকের গভীরে ৫৩৩ দিনের ছাইচাপা দেয়া আগুনের উত্তাপে আমাদের দেয়াশলাইতে নোনা ধরার সুযোগ নেই। এ সময়েও যদি ভেতরের দেয়াশলাই না জ্বালাতে পারি, তবে যে চির অন্ধকারে পতিত হবে জাতি।
আমরা বলছি না, আগামীকালই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিতে হবে। বলছি, এবারে যখন পর্যায়ক্রমে সব কিছু খুলে দেয়া হবে তখন যেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও খুলে দেয়া হয়। ইউনিসেফ প্রধান হেনরিয়েটা ফোর ও ইউনেস্কো প্রধান অড্রে অ্যাজুল বলেছেন, বন্ধের ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সবার শেষে ও খোলার ক্ষেত্রে সবার আগে হওয়া উচিত। অথচ আমাদের শাসকগোষ্ঠী তাতে কর্ণপাত করায় আগ্রহী নয়। তাকে আগ্রহী করে তুলতে আপনাকে সরব হতে হবে।
আপনার সন্তানের জন্যে জাতিসংঘ কথা বলেছে, আপনি চুপ থাকছেন কেন? ইতোমধ্যে গার্মেন্টস খুলে দেয়া হয়েছে। বিকল্প যানে গাদাগাদি করে, পায়ে হেঁটে দলবেধে মানুষ কর্মস্থলমুখী হচ্ছেন। সেখানে কোথায় স্বাস্থ্যবিধি, কোথায় লকডাউন..? আগে ও পরে কারা নিয়েছে এই হটকারি সিদ্ধান্ত..? কোন আইন বলে দেশের অগুনিত মানুষকে দু চারদিন পর পর এই লকডাউনের নামে দুর্ভোগ ও অর্থদন্ডের অধিকার দিয়েছে তাদেরকে..? এই দোদুল্যমান হটকারিদের সিদ্ধান্তে কিভাবে একটি দেশের শিক্ষা সকল প্রতিষ্ঠানগুলোকে লাগাতারবন্ধ রাখা মেনে নেয়া যায়..? কোন যুক্তিতে..? সেখানে নিরবধি কাজ করে যদি পোশাক শ্রমিকরা করোনাক্রান্ত না হয়, তবে স্কুলে এসে তাদের ছেলেমেয়েদের আক্রান্ত হবার বিষয়টি কি জুজুর ভয় দেখানো নয়..? এটুকু বোঝার জন্যে কি মহা পন্ডিত হতে হয়..!
সরকার যা চাইবেন, সেটাই জায়েজ..! একটার পর একটা স্ববিরোধী, হটকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করছেন তারা। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা নিয়ে তাদের এত ছলনা কেন..? এত ভয় কেন..? কথায় আছে, ‘আপনি যখন কোন কাজ করতে চাইবেন, তখন একটি উপায় খুঁজে নেবেন। আর যখন তা এড়িয়ে যেতে চাইবেন, তখন একটি বাহানা খুঁজবেন।’ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার ক্ষেত্রে গত ১৭ মাসে সরকার কেবল বাহানাই খুঁজে গেছেন। এবং এটি সম্ভব হয়েছে কেবল ও কেবলমাত্র অভিভাবক হিসাবে, শিক্ষক হিসাবে, শিক্ষার্থী হিসাবে আমাদের নির্লিপ্ততায়।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিতে জাতিসংঘ ৪টি নীতিমালাও প্রকাশ করেছেন। যেগুলো হচ্ছে-
(১) বন্ধের ক্ষেত্রে স্কুলগুলো সবার শেষে ও খোলার ক্ষেত্রে সবার আগে থাকা উচিত। বর্তমানের অস্পষ্ট কিছু সুবিধার জন্য আমাদের ভবিষ্যৎকে স্কুল বন্ধ রাখার মাধ্যমে জিম্মি করে রাখা হচ্ছে, ধ্বংস করা হচ্ছে। এটা চলতে পারে না।
(২) স্কুলগুলো পুনরায় চালুর ক্ষেত্রে সব শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর টিকা দেয়ার জন্য অপেক্ষা করা যায় না। স্কুলে যেতে না পারার কারনে শিশু ও তরুন জনগোষ্ঠি যে ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছে, তা কখনোই পুষিয়ে নেয়া যাবে না।
(৩) স্কুল খোলার জন্য করোনা শূন্যের কোঠায় যাওয়ার অপেক্ষায় থাকা যায় না। কারণ সংক্রমনের প্রধান চালিকা শক্তিগুলোর মধ্যে স্কুলগুলো নেই। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর মাত্র ১৯টি দেশ এভাবে একটানা স্কুল বন্ধ রেখেছে।
(৪) স্কুলে প্রবেশের আগে টিকা দেওয়া বাধ্যতামূলক না করে সব স্কুলের উচিত যত দ্রুত সম্ভব শারীরিকভাবে স্কুলে উপস্থিত হয়ে শিক্ষার্থীরা যাতে কোন রকমের বাধা ছাড়াই স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে সে ব্যবস্থা করা।
এখানে আমাদের শাসক গোষ্ঠির হাতে দরকারের চেয়ে বেশি ক্ষমতা রয়েছে, জালাল উদ্দিন রুমীর ভাষায় যেটা বিষ। আর সে কারনেই তারা কারো সুপারিশে কর্নপাত করেনা, উপেক্ষা করে। তাদের হাতে থাকা অতিরিক্ত ক্ষমতার যত্রতত্র অপব্যবহার করে। মানুষকে অসম্মান করে। নিগৃহীত করে, নির্যাতন করে। এবং দুর্ভাগ্য আমাদের গান্ধারীর মত কেউ নেই যে আবেদন করবে, “অধর্মের মধুমাখা বিষফল হাতে তুলি, আনন্দে নাচিছে পুত্র স্নেহ মায়া ভুলি। ও ফল দিওনা ভোগ করিবারে, কেড়ে লও, ফেলে দাও, কাঁদাও তাহারে।” আবার আমাদের আমজনতা যে নিজেদের অধিকারের প্রশ্নে বেশি মাত্রায় উদাসিন, রুমীর ভাষায় সেটাও বিষ।
জাতিসংঘের মানবিক আবেদন উপেক্ষা করার দৃষ্টান্ত দুনিয়ায় এটাই প্রথম নয়। বর্বরের হাতে ক্ষমতা থাকলে অনেক সভ্যতা বিনা বিবেচনায় ধ্বংস হয়। আফগানিস্তানে বৌদ্ধমূর্তি ধ্বংস না করার জাতিসংঘের আবেদনেও কিন্তু তৎকালিন তালেবানরা কর্ণপাত করেনি। উপেক্ষা করেছে। ধ্বংস করেছে সে বৌদ্ধ মূর্তি।
একটি সুদূরপ্রসারী অদূরদর্শিতার যাঁতাকলে পিষে আমরা একদিন, প্রতিদিন, প্রতিবাদহীন, প্রতিকারহীন অবস্থায় একটু একটু করে মৃত্যুমুখে পতিত হতে যাচ্ছি। কুল্লু নাফসি যাইকাতুল মউত। এ মৃত্যু সে মৃত্যু নয়। এ মৃত্যু বোধের মৃত্যু। শিক্ষার মৃত্যু। স্বাধীনতার মৃত্যু। স্বপ্নের মৃত্যু। অথচ সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অনায়াসেই এটি রোধ করা সম্ভব। নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব একটি জাতিকে। একটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে।
একটি জাতিকে ধ্বংস করার পেছনে যে মোক্ষম অস্ত্রটি ব্যবহার করা হয় তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তার শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেয়া। আর শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করার সবচেয়ে নিকৃষ্টতম পন্থা হ’ল শিক্ষককে প্রাধান্য না দেয়া। তাকে অপদস্ত করা । সমাজে তার অবস্থান নিচু করে দেখানো যাতে তার ছাত্র-ছাত্রীরাই তাকে উপহাস করে। লজ্জাজনক হলেও সত্যি, আমাদের দেশের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা যে ইতোমধ্যেই সে স্তরে চলে এসেছেন। নিজ পেশা হারিয়ে বিকল্প পেশায় সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছেন নিয়ত। একদা শিক্ষক এখন চায়ের দোকানি, রিকশা চালক, ফল-সবজি বিক্রেতা, দিন মজুর আরো কত কি অনভ্যাসজনিত কাজের মধ্যে বেঁচে থাকার রসদ খুঁজছেন। দীর্ঘ ১৭ মাসে সরকারিভাবে একটি পয়সা দিয়েও দেশের অর্ধ লক্ষাধিক কিন্ডারগার্টেনের দশ লক্ষাধিক শিক্ষক কর্মচারির পাশে দাঁড়ায়নি। অথচ যেটা করার ছিল সর্বাগ্রে। কাজেই আমাদের থেমে খাকলে চলবে না। আওয়াজ তুলতে হবে, যেতে হবে বহুদূর।
পক্ষ-প্রতিপক্ষ, পছন্দ-অপছন্দ সব কালেই ছিল। সৃষ্টির শুরুতেও ছিল। থাকবে অনাদিকাল পর্যন্ত। ওগুলোকে পাত্তা দেবার সময় এখন নয়। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এই ৫৩৩দিনে মধ্যে ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটি বাদ দিলে অন্য ৪৬৭ দিনে বহুবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া যেত। প্রয়োজনে আবার বন্ধ করা যেত। তাতে বহাল থাকত শিক্ষার স্বাভাবিক প্রবাহ। ছন্দময় হত অগনিত বেসরকারি শিক্ষকদের যাপিত জীবন। এমন অনিশ্চিত ও লাগাতার বন্ধের কোন দরকার ছিল না, এখনো নেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার দাবী সবার পছন্দ হবে এমন কোন কথা নেই। আল্লাহ তা’য়ালার আদমকে সৃষ্টিও কিন্তু ইবলিশের পছন্দ হয়নি। তাকে সেজদা করার হুকুমও মানেনি ইবলিশ। নিজের অবস্থানকে বিষাক্ত করে বিতারিত হয়েছে জান্নাত থেকে।
আমাদেরও মনন-মগজ থেকে নিরাশাবাদিদের গুরুত্ব প্রদানের ধারাকে বিতাড়িত করতে হবে। প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে, সোস্যাল মিডিয়া বা অন্য কোন মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা নিয়ে বা শিক্ষকদের দাবি নিয়ে যারা বিরুপ মন্তব্য করে যাচ্ছেন, সে কথায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে তাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলবেন না। মনে রাখবেন, আগাছার ফলন বেশি হয় এবং ফলভারে বৃক্ষ নত হয়।
আমি হতাশাবাদী মানুষ নই। আমি শিক্ষক। একাধারে শিক্ষার্থীদের আবার শিক্ষকদেরও। আমি আর্টিস্ট। আমার চোখে অসুন্দর নেই। আমার ভাবনায় অসম্ভব নেই। আমার কাজ আমার ইবাদত, আমার সাধনা। আমি মনে প্রাণেই বিশ্বাস করি, শিক্ষা মানে বাঁচার সাধনা, আশার সাধনা, আনন্দের সাধনা, স্বপ্নের সাধনা। শিক্ষকের মধ্যে বা শিক্ষিত মানুষের মধ্যে যদি কোন কারণে হতাশা আসে তবে অবশ্যই সে শিক্ষায়, সে সাধনায় ত্রুটি আছে। আমি মুখ বুজে আমার সাধনাকে বিষাক্ত হতে দিতে পারিনা। আমার ও আমার সন্তানের পক্ষে এ আমার সোচ্চার প্রতিবাদ। আপনি তা অনুভব করে আসুন সমস্বরে প্রতিবাদী হই। বিষবৃক্ষের চারা সমূলে উৎপাটনে সচেষ্ট হই। আমাদের সন্তানদের জীবনকে অর্থবহ করার, রঙ্গীন করার লড়াইয়ে সামিল হই। বন্ধুরা লড়াইয়ে কোন চূড়ান্ত পরাজয় নেই, সময়ের বাঁকে বাঁকে আশার দীপ জাগে।