শিক্ষা, সঙ্গীত ও পাঠাগার
আমাদের বিদ্যালয়গুলিতে সেই সত্তরের দশকে একটি লাইব্রেরী বা পাঠাগার কক্ষ ছিলো। মাগুরা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের পুরাতন ভবনে যেখানে আমার মাধ্যমিক শিক্ষার পথচলা শুরু, সেখানে লাইব্রেরিটি ছিল প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষকের কক্ষের পাশে। লাইব্রেরির দায়িত্বে ছিলেন বিদ্যালয়ের হিসাব রক্ষক সুবোধ চন্দ্র মহাশয়। আমরা তাকে সুবোধ স্যার বলেই সম্বোধন করতাম। একটু রাগী, বাহ্যত খড়খড়ে ধরনের মানুষ ছিলেন তিনি, কিন্তু মানুষটি খুব ভালো ছিলেন – পরোপকারী ছিলেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, লাইব্রেরিটি বছরের প্রায় সমস্ত সময় বন্ধ থাকতো। পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত আমি এই লাইব্রেরি থেকে দুই বা তিনটার বেশি বই নিতে পারিনি। লাইব্রেরিতে বই সাজানো থাকতো আলমারিতে তালাবদ্ধ অবস্থায়। আমরা শুধু বই এর বহিরাঙ্গ দেখতে পেতাম। সুবোধ স্যার সময় দিতে পারতেন না। আর কর্তৃপক্ষেরও এ নিয়ে উদাসীনতার কোন শেষ ছিল না। আমাদের বই পড়ার তৃষ্ণা মেটানোর অবধারিত উৎস ও উপায় ছিল পাড়ায় অবস্থিত সরকারি গণ প্রন্থাগার আর বিভিন্ন স্থান থেকে ধার করা বই। সরকারি গণ প্রন্থাগারে শিশুদের জন্যে খুব বেশি বই পাওয়া যেত না – কিছু রূপকথা, ঠাকুরমার ঝুলি ছাড়া। যে কারণে ষষ্ঠ শ্রেণীতে উঠেই আমাকে গণ গ্রন্থাগার থেকে ধার করতে হয় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের – রামের সুমতি। তারপর বড়দি, দেবদাস।
এখনও সম্ভবত বিদ্যালয়ের পাঠাগারের অবস্থা প্রায় একই রকম বা হয়ত আরেকটু অবনতিশীল। কিন্তু এই পাঠাগারের বইগুলি তো শিক্ষার্থী-বিকাশের জন্যেই কেনা হয়। পাঠ্যপুস্তকের বাইরে গিয়ে শিক্ষার্থী বিভিন্ন বিষয়ে জগতটাকে আরেকটু চিনবে, তার কল্পনার রাজ্য প্রসারিত হবে, মূহুর্তে সে চলে যাবে তার নিজস্ব জগত থেকে ভিন্ন এক জগতে, বই পড়ার মাঝ দিয়ে তার ভাষা দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে, বই এর চরিত্রের মাঝ দিয়ে সে মানুষ চিনবে, জীবনের বা সমাজের সমস্যা উপলব্ধি করবে, সমস্যার সমাধান প্রত্যক্ষ করবে – সেটিই তো লক্ষ্য হবার কথা এ সকল পাঠাগারের। এটিও উদ্দেশ্য হবার কথা যে, শিক্ষার্থী সিলেবাসের বাইরে গিয়ে বিজ্ঞান, ইতিহাস, সাহিত্য, ভ্রমন কাহিনী, রূপকথা, কৌতুক, সাইন্স ফিকশন পড়বে নিজের পছন্দে আর মন ভরে নির্মল আনন্দ উপভোগ করবে। আক্ষরিক অর্থে হয়ত লক্ষ্যগুলি এরকমই ছিল শুধু ছিলোনা তার বাস্তব প্রয়োগ। আর সেজন্যে বইগুলি আলমারি-বন্দি হয়েই থাকতো আমাদেরকে আনন্দ দেবার পরিবর্তে। পরিবর্তন একটি দুসাধ্য কাজ। হয়ত এজন্যে এই সংস্কৃতি এতদিনেও খুব একটি পাল্টায়নি। সম্ভবত বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এগুলিকে খুব একটি প্রয়োজনীয় বিষয় বলে মনেও করেন না। শিক্ষার্থী শুধু জিপিএ-৫ পেলেই বিদ্যালয়ের সার্থকতা এখন। সেই দিনেও খুব যে ব্যাতিক্রম ছিল তা নয়। তখনও ছিল ফার্স্ট ডিভিসন পাবার বা স্ট্যান্ড করার লড়াই।
সেই সময় বিদ্যালয়ে সপ্তাহে এক বা দু’টি পিরিওড ছিল সোশাল একটিভিটির জন্যে। রুটিনে ওটি ‘সোশাল’ বলেই লেখা থাকতো। আমরা বুঝতাম না এর মানে কী। জিজ্ঞেস করাতে এক স্যার অনিশ্চিতভাবে বলেছিলেন – এই গান বাজনা হবে আর কি। কিন্তু সাহিত্য–সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা ব্যতীত বিদ্যালয়ে কখনো আমাদের গান বা কবিতা শেখানোর কোন চেস্টার কথা মনে পড়ে না। সেই ‘সোশাল’ ক্লাসগুলোতে অনেক সময় কোন শিক্ষকই আসেননি আর কখনও এলেও গল্প-গুজবে কেটে গিয়েছে সময়। কখনও হয়তো কাউকে কৌতুক বলতে বলা হয়েছে বা গল্প। এর পিছনে কারণ ছিল – বিদ্যালয়গুলিতে সঙ্গীতের কোন শিক্ষক ছিল না। একইভাবে আর্ট ক্লাসেও নির্দিষ্ট কোন শিক্ষক ছিল না। এর কোন ধারাবাহিকতাও ছিল না এবং এই ক্লাসটিও অনিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হতো। সামাজিকিকরণের জন্যে সপ্তাহে একটি পিরিওড বা সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের জন্যে একটি পিরিওড চেতনার দিক থেকে খুবই উন্নত ছিল কিন্তু জনবলের অভাবে সেই শুভ উদ্যোগ অন্তত আমাদের সময়ে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জন করতে পারেনি। এটি অন্তত একটি বিষয়কে পরিস্কার করে তুলে ধরে – শুধু পরিকল্পনা নিলেই বা হুট করে একটি সিদ্ধান্ত শিক্ষকের উপরে চাপিয়ে দিলেই হয়না, পরিকল্পনা প্রণয়নে মাঠ পর্যায়ের প্রস্তুতি কতটুকু সেটি বিবেচনায় না নিলে একটি সাধু উদ্যোগও ব্যর্থ হতে পারে।
কিন্ত এখানে সাথে সাথেই যে প্রশ্নটি সামনে চলে আসে সেটি হচ্ছে – যেটি সত্তর বা আশির দশকে সম্ভব হয়নি সেটি এখন হতে সমস্যা কোথায়? এখনও কি চারু ও কারুকলার স্নাতকের অভাব? এখনও কি সঙ্গীতের শিক্ষকের অভাব? এখনও কি বাজেটের অভাব? না অভাবটি আমাদের ইচ্ছের বা মানসিকতার বা দূরদৃষ্টির? বিদ্যালয়ের জনবল কাঠামোতে কোন ঘাটতি থাকলে বিদ্যালয় বিকল্প পন্থায় জনবল সমস্যার সমাধান করতে পারে। প্রয়োজন ইচ্ছের আর সমস্যা সমাধানে দক্ষতার।
ক্যালিফোর্নিয়াতে বেশ কিছু বিদ্যালয় সঙ্গীতের জন্যে পূর্ণকালীন শিক্ষক না রেখে স্থানীয় কোন সঙ্গীত একাডেমি বা কোন সঙ্গীত গুরুর সাথে চুক্তি করে নিয়েছে। সেখানে সঙ্গীত বা নৃত্য শিক্ষক সপ্তাহে দুই বা তিন দিন এসে শিক্ষার্থীর সাথে কাজ করে যান। তাঁদেরকে কিছু সম্মানি দেয়া হয় কিন্তু তাঁরা ‘বিদ্যালয়ের নিয়মিত বা প্রথাগত বেতনভুক শিক্ষক নন। এটা খানিকটা ‘ভলান্টিয়ারিজম’ খানিকটি ‘সোশাল সার্ভিস’ শিক্ষকের প্রান্ত থেকে। আবার যে সকল শিক্ষক এই সার্ভিসটি দিচ্ছেন, তাঁদের কিছু অতিরিক্ত উপার্জনও হচ্ছে। এর ফলে শিক্ষার্থী অন্তত বিদ্যালয়ের নিয়মিত রুটিনের অংশ হিসেবে পেশাদার মানুষের কাছে তালিম নিতে পারছে এবং সঙ্গীত বা নৃত্য শিক্ষা শুধুমাত্র গুটিকয় শিক্ষার্থীর শখের বিষয়ে পরিণত হচ্ছে না। বিশিষ্ট মার্কিন শিক্ষাবিদ হাওয়ার্ড গার্ডনার একজন শিক্ষার্থীর জন্যে যে নয়টি মৌলিক দক্ষতার কথা বলেছেন, সঙ্গীত দক্ষতা তার একটি আর সেই দক্ষতা অর্জনে প্রতিষ্ঠানের অগ্রগামিতা ও উদ্যোগ খুবই প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে, মাধ্যমিক শিক্ষাই শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্ব গঠনে সব থেকে বড় ভূমিকা পালন করে থাকে।
আসলে আমাদের দেশে সাংস্কৃতিক চর্চায় এক ধরনের ক্রমঅপসৃয়মানতা লক্ষ্যণীয়। সঙ্গীত দক্ষতাকে জীবনের জন্য কোন আবশ্যিক বিষয় বলেও হয়তো মনেও করা হয় না। পারিবারিক পর্যায়ে সঙ্গীতের যে চর্চা এমনকি সত্তর বা আশির দশকেও দৃশ্যমান ছিল তা এখন অনেকটাই ম্রিয়মান। এই পরিবর্তন শুরু হয়েছিল ১৯৭৫ এর পট পরিবর্তনের পরে। সামাজিকভাবে পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর প্রথমে বাতিল হতে থাকে নববর্ষের অনুষ্ঠান। এরপর আলাদাভাবে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর পরিবর্তে শুরু হয় একত্রে রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী পালন। আগে আমরা দেখতাম বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নজরুলের বিদ্রোহী চেহারার ছবি। পঁচাত্তরের পর নজরুলের মাথায় কিস্তি টুপি চেপে বসে। বিদ্রোহী কবিতা, ’গাহি সাম্যের গান’ টিকে থাকলেও শ্যামা সংগীত দূর হয়ে যায় সঙ্গীত অংগন থেকে। বিদ্রোহী কবি, সাম্যের কবি – এই পরিচয় আস্তে আস্তে মুছে গিয়ে নজরুল হয়ে ওঠেন মুসলিম নব জাগরণের কবি; আর তা চলতে থাকে প্রায় দুই দশকের বেশি সময় ধরে। পঁচাত্তর-ছিয়াত্তর পর্যন্ত ইশকুলে নববর্ষ, রবীন্দ্র জয়ন্তী, নজরুল জয়ন্তী পালন হলেও ধীরে ধীরে তা উঠে যায় একেবারে। সামাজিক পরিবর্তন বিদ্যালয়ের অনুশীলনেও পরিবর্তনের সূচনা করে। আমরা পাঠাগার হারাই, হারিয়ে না ফেললেও, সংকুচিত করে ফেলি সাংস্কৃতিক চর্চা। চারু ও কারুকলা থেকে যায় আমাদের স্পর্ষিত দুরত্বের বাইরে; হারাতে থাকে বিদ্যালয় ভিত্তিক খেলাধুলা। বিদ্যালয়ের খেলাধুলা মুলত বন্দী হয়ে যায় শুধুমাত্র জাতীয় দিবসের প্রাক্কালে ৪-৫ দিন অনুশীলন করে প্যারেড করা আর আন্ত-বিদ্যালয় ফুটবল প্রতিযোগিতার মাঝে। আমাদের বিদ্যালয়ে সেই প্যারেডেও মাত্র তিনটি পিটি রাজত্ব করে চলে দশকের পর দশক কোন নতুনত্ব ছাড়া এবং এক সময় তা হাস্যকরও হয়ে পড়ে দর্শক এমনকি বিদ্যালয়ের স্কাউটদের মাঝে; যদিও এখানে ব্যাতিক্রমী ছিল সরকারি বালিকা বিদ্যালয়।
ক্ষয়টা শুরু হয়েছিল এভাবেই। ক্ষয়িষ্ণু হতে হতে একসময় মাগুরা সাংস্কৃতিকভাবে বন্ধ্যা হয়ে ওঠে। এখন আর মাগুরাতে ’জয় জগা নন্দনও ঘটি বাটি বন্ধন…’ বা ’মরিব মরিব সখি নিশ্চয় মরিব …’ – কীর্তন করতে করতে কেউ মাত্র-প্রদোষের ঘুম ভাঙ্গায় না; করতাল বাজিয়ে এখন আর কেউ ভিখ মাগে কিনা জানিনা। রাত এগারোটা-বারোটা পর্যন্ত পুজোর মাঠে জমাটি গান বাজনা হয়তো এখন শুধুই স্মৃতি। কাঠু স্যার (খান জিয়াউল হক), নিরো স্যার (অধ্যাপক মাহফুজুল হক)দের আবৃত্তির উত্তরাধিকার এই প্রজন্মের মাগুরাবাসী লালন করে কিনা বলতে পারব না। বুলু কাকার বাঁশির সুরে উদ্বেলিত হয় না মাগুরার নাগরিক হৃদয়। ভোলা স্যার আর মন-প্রাণ ঢেলে ছেলেমেয়েদের শেখান না – ’খোলো খোলো দ্বার, রাখিও না আর …’, কিম্বা ’ও গো গৃহবাসী, খোল দ্বার খোল …’; সুধীর স্যারও আর তালিম দেন না ’সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে …, বা ’এরা সুখের লাগি চাহি প্রেম/প্রেম মেলে না…’। এমন কি শফিক ভাই (আগমনী বুক সাপ্লাই)ও আর গলা ছেড়ে ’একা একা কেনো ভালো লাগে না …’ গানটি গেয়ে হয়তো চমকে দেন না সবাইকে। বাচ্চু ভাই (জননেতা ও আইনজিবী সফিকুজ্জামান) আর মেরি আপার মতো কেউ এখনকার কিশোরদের নিয়ে কোনো দিবস উপলক্ষে শেখান কিনা জানি না – ’তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে….’। হরিজন সম্প্রদায় থেকে উঠে আসা বুলু কাকার মতো একজন বংশীবাদক এবং পরদেশী কাকার মতো একজন গায়ক, তবলচি, বংশীবাদকের অভাব মাগুরা দীর্ঘদিন অনুভব করবে। কাঠু স্যার, মদন রায় চৌধুরী, দীপক রায় চৌধুরীর সমান উচ্চতার সাংস্কৃতিক সংগঠক আমি জানি না মাগুরাতে আর বেরিয়ে এসেছে কিনা।
ফেলে আসা দিন নাকি সকল সময়েই সোনালী হয়। পক্ষান্তরে, স্মৃতি সকল সময়েই বেদনার – কখনও হারিয়ে যাবার জন্য বেদনার; কখনও বেদনাময় স্মৃতির জন্য বেদনার। যেটিই হোক, পিছনে ফিরে তাকালে রবি বাবু কানে কানে বলে যায় ’তুই ফেলে এসেছিস কারে, মন, মন রে আমার…’।
(চলবে)