আমার শিল্পীজীবনে চিত্ত হালদারের (১৯৩৬ – ১৯৭৮) অবদান অনস্বীকার্য। বরিশালের চিত্ত হালদার এবং শান্তি কর্মকারের আঁকা চিত্রকর্ম দেখেই আমি প্রথম চিত্রকলার প্রতি আকর্ষিত হই; অনুপ্রাণিত হই এবং পরবর্তী জীবনে চিত্রকলাকে নেশা-পেশা হিসাবে গ্রহণ করে আজও তা নিয়ে পড়ে আছি। ফলে বলতেই হয় আমার শিল্পীজীবনের অন্যতম এক অনুপ্রেরণাদাতা চিত্ত হালদার। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়- চিত্ত হালদারের সঙ্গে আমার কখনও সরাসরি আলাপ অথবা কোনো বাক্য বিনিময় না হলেও আমি তাঁকে আমার ৯/১০ বছর অর্থাৎ ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রাবস্থা (১৯৫৫) থেকেই বরিশাল শহরের জগদীশ সিনেমা হলের সামনে সিনেমার ব্যানার আঁকতে দেখেছি। তবে ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা চারুকলা ইনিস্টিটিউটে ভর্তির পর থেকে তার সঙ্গে আমার আর কোনোদিন দেখা হয়নি। তবে আমি মনেমনে সর্বদাই তাকে খুঁজেছি, কিন্তু তার সঙ্গে আমার দেখা না হওয়ায় আমার সে মনোবাসনা কখনই পুরণ হয়নি; সে জন্য আজও আমি অনুতপ্ত। আজও আমি যখনই সেই স্মৃতিময় সিনেমা হলের সামনের রাস্তা দিয়ে চলাচল করি, তখনই মনে ভেসে ওঠে চিত্ত হালদারের মুখচ্ছবি; মনে পড়ে জগদীশ সিনেমা হলের সামনে তার ব্যানার আঁকার স্মৃতিকল্প। ছেলেবেলায় বরিশালে যাদের শিল্পকর্ম দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম; তাদের মধ্যে একজন ছিলেন শিল্পী চিত্ত হালদার এবং অপরজন ছিলেন শিল্পী শান্তি কর্মকার। পরে পরিচয় ঘটে শিল্পী বলহরি সাহার সঙ্গে: এদের আঁকা ছবি দেখেই আমি একসময় উদ্বুদ্ধ হয়েছি; অনুপ্রাণিত হয়েছি এবং চিত্রী হওয়ার পথে ধাবিত হয়েছি। ফলে এঁদের পবিত্র আত্মার স্মৃতির প্রতি রইল আমার অকৃত্রিম শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও কৃতজ্ঞতা।
প্রচারবিহীন চিত্রী ও ভাস্কর চিত্ত হালদারকে গভীরভাবে জানার আকাঙ্ক্ষা থেকেই তাকে আমি বরিশালসহ সর্বত্র খুঁজেছি, কিন্তু প্রকৃত তথ্যের অভাবে আমার সে খোঁজা বিফলে গেছে। অবশেষে বরিশালে আমারই এক ভ্রমণসঙ্গী অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা আলতাফ হোসেনের নিকট সন্ধান পেয়ে ১ মার্চ ২০১৮ তারিখে তার সঙ্গে আমি প্রথম চিত্ত হালদারের বরিশালের বাড়িতে যাই এবং তার স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করে শিল্পী হালদার সম্পর্কে অনেক তথ্য জেনেছি; অনেক শিল্পকর্ম স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে; যা আজও আমাকে ঋদ্ধ ও তৃপ্ত করে চলেছে। এ বাড়িতে এসেই আমি দেখা পেয়েছি চিত্ত হালদারের স্ত্রী ঝর্ণা হালদারের; জেনেছি তার মেয়ে জুলিয়েট হালদার, ভায়োলেট হালদার, ব্রিজেট হালদারসহ চিত্ত হালদারের সহযোদ্ধা হেলাল উদ্দিনসহ অন্যান্য সহযোদ্ধাদের সম্পর্কে। ঝর্ণা হালদারের কাছ থেকে নেয়া উপকরণাদি দিয়েই আমার আজকের এ লেখা- এ জন্য ঝর্ণা হালদারকে অবশ্যই কৃতজ্ঞতা জানাতে হয়।
আমরা যারা চিত্ত হালদারকে দেখেছি; তারা তাকে কেবলমাত্র একজন সিনেমার ব্যানার পেইন্টার হিসাবেই জানতাম। বাস্তবে তিনি ছিলেন একজন সৃষ্টিশীল শিল্পী, ছিলেন একজন দক্ষ মডেলার, একজন দক্ষ ভাস্কর, দক্ষ রিলিফ ও রিপ্লিকা শিল্পী। তিনি ছিলেন ক্যালিওগ্রাফিস্ট, যন্ত্রসংগীত শিল্পী, বিজ্ঞান ও শিল্পানুরাগী এবং অসাধারণ পরিশ্রামী এক শিল্পকারিগর। শিল্পকলায় তার প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা না থাকলেও ড. এনামুল হকের ভাষায়, তার ছিল প্রচুর ‘আই কপি’ করার ক্ষমতা। তার দৃষ্টি ছিল এক্স-রে ক্যামেরার মতো; যা দেখতেন তার গভীরে প্রবেশ করে তাকে রঙ-তুলি, কাঠ-পাথরে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন; পারতেন বস্তুর প্রতিরূপ হুবহু আঁকতে।
জীবনের তাগিদে বেশিরভাগ সময়ই তিনি বরিশালে কাটিয়েছেন। বাঁচার তাগিদে তিনি সিনেমা হলের ব্যানার এঁকেছেন, অনুকরণমূলক পোট্রেট এঁকেছেন, সাইনবোর্ড লিখেছেন, ফরমাইসি ছবিসহ বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছেন। পাথর খোদাই করে তাতে নাম লিখেছেন; কাঠ-পাথর-খোদাই করে ছোট ছোট ভাস্কর্য তৈরি করেছেন। ছাঁচ তৈরি করে নানা রিলিফ শিল্পের রিপ্লিকা তৈরি করেছেন। বাঁশের চুড়ি বানিয়েছেন, বেহালা-গিটার বানিয়েছেন, ঘুড়ি বানিয়েছেন, ফটো এনলার্জার বানিয়েছেন; তবে এসব তিনি করেছেন কেবলমাত্র জীবন-জীবিকার তাগিদে। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে তিনি বোমা, ডিনামাইট, মাইন, রাইফেলের গুলি বানিয়েছেন দেশ স্বাধীন করে সোনার বাংলা তৈরির জন্য।
অনেক কাজের কাজী হয়েও চিত্ত হালদার মূলত ছিলেন একজন সৃষ্টিশীল চিত্রী ও ভাস্কর। মনের তাগিদে তিনি এঁকেছেন অনেক অনুকরণমূলক তেল ও জল রঙের চিত্র; তৈরি করেছেন অনেক ছোট ও মাঝারি আকারের ভাস্কর্য; করেছেন প্লাস্টার অব প্যারিস দিয়ে অনেক রিলিফ-রিপ্লিকার কাজ। যার কিছু নমুনা এখনও তার স্ত্রী ঝর্ণা হালদার স্বযত্নে তার শিয়রে পাশে রেখে দিয়েছেন এবং আমাকে দেখিয়ে তার গুণের প্রমাণ করেছেন। তার এ কাজগুলো দেখেই আমি অদেখা শিল্পী চিত্ত হালদারের শিল্পগুণ, শিল্পরুচি, শিল্পবোধ ও তার শিল্পদক্ষতা অনুমান করতে পেরেছি। তবে এ কথাও সত্য যে, অনুকরণমূলক চিত্রকলার মাধ্যমে তিনি চিত্রজগতে প্রবেশ করলেও পরে ভাস্কর্য, রিলিফের-রিপ্লিকার কাজের প্রচুর দক্ষতা অর্জন করে যথেষ্ট সুনাম ও পারদর্শিতার পরিচয়ও দেখিয়েছেন। পটুয়া শিল্পী কামরুল হাসান ও বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের প্রাক্তন মহাপরিচালক ড. এনামুল হকের লেখা পত্র ও সাক্ষাৎকারে এর বাস্তব প্রমাণ রয়েছে।
অভিধান মতে চিত্ত শব্দের প্রতিশব্দ- হৃদয়, মন, অন্তর, আত্মা, মর্ম, অর্ন্তদেশ, অন্তকরণ ইত্যাদি এবং হালদার বলতে বুঝায় গ্রামগঞ্জে যারা হাল অথবা লাঙলের অধিকারী এবং যারা অগাধ সম্পত্তির মালিক বা জমিদার। চিত্ত হালদারের কেবলমাত্র হালদার পদবীর স্বরূপ উদ্ঘাটনেও আমরা চিত্ত হালদারের পূর্বপুরুষের স্বরূপ উদ্ঘাটন করতে পারি। তার পূর্বপুরুষের ছিল বরিশালের উজিরপুরে অগাধ সম্পত্তির মালিক। তবে বাস্তবে চিত্ত হালদারের ব্যক্তিগত কোনো জমির মালিকানা না থাকলেও তিনি ছিলেন এক ব্যতিক্রমধর্মী ব্যক্তি; একজন হৃদয়বান চিত্রী ও ভাস্কর। তার অন্তরাত্মা ছিল নীলাকাশের মতো উদার-উদাস, স্বচ্ছ এবং বিস্তৃত। নিরহংকার, সদালাপি, প্রচারবিমুখ, শিল্পানুরাগী এ মানুষটি জীবনের বেশিরভাগ সময়ই বরিশালবাসীর শিল্পসেবায় নিয়োজিত ছিলেন এবং মাত্র কয়েক বছরের জন্য তাকে বাধ্য হয়ে ঢাকায় অবস্থান করতে হয়েছিল।
বাস্তবে শিল্পী চিত্ত হালদার অগাধ জমি-জমা অথবা ধন-সম্পদের মালিক না হলেও শিল্পসম্পদে তার গোলা ছিল ভরপুর। এ ক্ষেত্রে কখনও তার ভাণ্ডারে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়নি; দেখা দেয়নি রুচির দুর্ভিক্ষ পর্যন্ত। তার অর্থাভাব ছিল, তবে শিল্পাভাব ছিল না; তার ভাণ্ডারে ছিল অগাধ সম্পদ। তার শিল্পের গভীরতা খুঁজেতে হলে- গভীর জলে ডুব দিয়ে খুঁজতে হবে এবং সতর্কতার সঙ্গে তা অনুধাবন ও মূল্যায়ন করতে হবে। নতুবা শিল্পী অথবা তার শিল্পকে অনুভব করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।
বাস্তবে চিত্ত হালদার ছিলেন একজন গুরুগম্ভীর অথচ অর্ন্তস্পর্শী মানুষ। শিল্পীজীবনে তিনি ছিলেন অমায়িক, কুসুম-কোমলে মিশ্রিত এক হৃদয়বান ও প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব। ছেলেবেলায় ছিলেন লাজুক প্রকৃতির; কারো সঙ্গে তেমন মিশতেন না; চলতেন আপন গতিতে, মশগুল থাকতেন চিত্রনেশায়। অতিশৈশব থেকেই তার ছবি আঁকার নেশা ছিল। লেখাপড়ার চেয়ে ছবি আঁকার প্রতি ছিল তার প্রবল ঝোঁক। ছোটবেলায় শ্লেট-পেন্সিলে বর্ণমালা না লিখে ছবিই এঁকেছেন বেশি। ফলে লেখাপড়ার প্রতি তার অতিশৈশব থেকেই ছিল অহিনারভাব। তবে শৈশবে তিনি যা দেখতেন তাই আঁকার চেষ্টা করতেন- যা পরবর্তী সময়ে তাঁকে একজন প্রতিভাধর শিল্পী হতে সাহায্য করেছে।
শিল্পী চিত্ত হালদার জন্মেছিলেন বরিশাল নগরীর অক্সফোর্ড মিশন বোর্ডিং-এ ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে। বড় হয়েছেন তাদের পৌত্রিক বাড়ি ব্রাউন কম্পাউন্ডের গোরাচাঁদ দাস লেনে। মা তরণী হালদার (তরী) এবং বাবা বিশ্বনাথ হালদারের একমাত্র পুত্র ছিলেন চিত্ত হালদার। চিত্ত হালদার ব্যতিত বিশ্বনাথ হালদারের আরও দুই মেয়ে ছিল; যাদের নিয়ে তিনি গোরাচাঁদ দাস লেনের বাড়িতেই জীবন কাটিয়ে গেছেন।
চিত্ত হালদারের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়েছিল বরিশালের বগুড়া রোডের অক্সফোর্ড মিশনারী স্কুলের পাঠশালায়। পরে তিনি ভর্তি হন বরিশাল জিলা স্কুলে। সেখানে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করার পর ভর্তি হন বরিশালের বি.এম. স্কুলে এবং এ স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করে বি.এম. কলেজে ভর্তি হয়ে তিনি আর লেখাপড়া না করে শিল্পচর্চায় লেগে যান। লেখাপড়ায় চিত্ত হালদার নেহায়েত খারাপ ছাত্র ছিলেন না। তবে ছবি আঁকার নেশা ও পারিবারিক পিছুটানের কারণে তিনি কলেজ জীবনের ইতি টেনে সার্বক্ষণিকভাবে শিল্পজীবনে ঢুকে পড়েন। এ সময় শিল্পের নতুন নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রতি ছিল তার প্রবলতর আগ্রহ। কল্পকাহিনী ও বিজ্ঞান বইয়ের প্রতিও ছিল তার পাগল করা আকর্ষণ। যেখানে বিজ্ঞানের বই পেতেন তা পড়ে শেষ না করা পর্যন্ত তিনি অস্থির থাকতেন। নতুন-পুরাতন বই সংগ্রহ ছিল তার নেশা: তার বাসায় ছিল অনেক নতুন-পুরাতন বইয়ের বিরাট সংগ্রহ।
চিত্ত হালদার ছিলেন প্রচারবিমুখ সদালাপি ও আবেগী মানুষ। লোকচক্ষুর আড়ালে থাকতেই তিনি বেশি ভালোবাসতেন। চুরুটে আসক্ত ছিল তার; ছিল প্রবলতর সংগীতাসক্তি। ভাল বেহালা বাজাতে পারতেন; ভাল বাঁশি বাজাতে পারতেন। নিজ হাতে গিটার, বেহালা বানিয়েছেন, বাঁশি বানিয়েছেন; বাঁশের চুড়ি বানিয়েছেন। নিজে ঘুড়ি উড়িয়েছেন এবং ঘুড়ি-নাটাই বানানেও তিনি পারদর্শী ছিলেন। নিজ হাতে ফটো এনলার্জার বানিয়ে তা দিয়ে ছবি প্রিন্টও করেছেন তিনি। তিনি ভাল রান্নাও করতে পারতেন; অর্থাৎ যে কাজে হাত দিতেন সে কাজে বিফল হয়ে ঘরে বসে থাকার মতো মানুষ ছিলেন না চিত্ত হালদার।
অনুকরণমূলক ছবি আঁকায় চিত্রী চিত্ত হালদার ছিলেন সিদ্ধহস্ত; ভাস্কর্য তৈরি, রিলিফের কাজ, রিপ্লিকা তৈরি অথবা যে কোনো বস্তুর ছাঁচ তৈরিতেও তিনি ছিলেন পারদর্শী। এক সময় পাথর কেটে তার উপর নাম লেখার মধ্য দিয়ে রুটি-রুজির চাহিদা মেটালেও পরে একই পাথর কেটে তিনি বানিয়েছিলেন নানা আকৃতির ভাস্কর্য।
শিল্পী চিত্ত হালদার বয়সে আমার চেয়ে প্রায় ৮/৯ বছরের বড় হলেও স্বভাবগত দিক থেকে তার সঙ্গে আমার রয়েছে অনেক মিল রয়েছে তার প্রতি গভীর ভালবাসা ও আত্মিক সংযোগ। আর সে কারণেই মনে হয় আজও এ গুণী মানুষটিকে ভুলতে পারিনি। আজও তিনি আমার গুণী মানুষের তালিকার শীর্ষে বিরাজমান।
১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে শিল্পী চিত্ত হালদার বিয়ে করেন চট্টগ্রামের মেয়ে ঝর্ণা হালদারকে। বিবাহিত জীবনে তাদের ঘরে জন্ম নেয় তিন কন্যা- জুলিয়েট হালদার, ভায়লেট হালদার এবং ব্রিজেট হালদার। মা-বাবা, স্ত্রী-কন্যা নিয়ে চিত্ত হালদারের ছিল যৌথ সংসার। বৃদ্ধ বয়সেও চিত্ত হালদার মা-বাবাকে দেখাশুনা করেছেন। বরিশাল শহরের মত ছোট্ট একটা শহরে ছবি এঁকে তিনি যেটুকু আর্জন করতেন তা দিয়েই স্ত্রী ঝর্ণা হালদারকে সুন্দরভাবে সংসার চালিয়ে নিতে হত। ফলে তার উপর সর্বদাই থাকত একটা আর্থিক ও মানসিক চাপ। পরে অবশ্য তাদের আর্থিকদৈন্যতা মিটেছে- বাড়ির টিনের ঘর বহুতল ভবনে রূপান্তরিত হয়েছে; ব্যবহৃত আসবাবপত্রেও পরিবর্তন এসেছে- তবে জীবিতাবস্থায় চিত্ত হালদার নিজে তা ভোগ করে যেতে পারেননি। সংসারের এ উন্নতির পেছনে রয়েছে তার কন্যাদের ভূমিকা। তার কন্যাদের প্রতিষ্ঠিত করার পেছনে তার স্ত্রী ঝর্ণা হালদারের পরিশ্রম ও অবদান অপরিসীম।
চিত্ত হালদারের তিন কন্যাই বর্তমানে দেশে-বিদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত। ছোট মেয়ে ব্রিজেট হালদারের জামাই একটি বেসরকারী সংস্থায় কর্মরত। বার্ধক্যজনিত কারণে ঝর্ণা হালদারের সার্বক্ষণিক দেখাশুনা ব্রিজেট হালদার করে থাকে। বড় মেয়ে জুলিয়েট হালদার স্থায়ীভাবে থাকে নরওয়ে। জেনেছি সেখানে একটা ভাল পদে চাকরি করে বর্তমানে অবসর জীবনযাপন করছে। মেঝ মেয়ে ভায়লেট হালদারও থাকে নরওয়ে; চাকরীর পাশাপাশি পরিচালনা করে ‘সময়ের শব্দ’ বাংলা অনলাইন পত্রিকা ও ‘আরক প্রকাশনী’ নামের বই প্রকাশনার সংস্থা। সে নরওয়েতে উন্নয়নমূলক সংস্থা কমন ইমিগ্রেশন কাউন্সিল এর নারী বিষয়ক সম্পাদক এবং বার্গেন ইন্টারন্যাশনাল কালচারাল সেন্টার বোর্ডের সদস্য হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানেও বিভিন্ন সমাজ সেবামূলক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত আাছেন। এছাড়াও তিনি নরওয়ে থেকে প্রকাশিত একমাত্র পত্রিকা ‘সাময়িকী’র সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
চিত্ত হালদারকে আমি ছেলেবেলা থেকেই দেখেছি কিন্তু তখন তার সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না, সেটা ছিল আমার একান্ত অপরাধ। আজ তাকে গভীরভাবে জানার আগ্রহ নিয়ে ১১-৩-২০১৮ তারিখে আমি এবং আমার পাড়ার স্নেহভাজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা আলতাফ হোসেনকে (চিত্ত হালদারের পরিবার তার পূর্বপরিচিত ছিল) সঙ্গে নিয়ে চিত্রী ও ভাস্কর চিত্ত হালদারের ব্রাউন্ড কম্পাউন্ডের বাড়ি যাই। আলতাফ পূর্ব থেকেই এ পরিবারের সঙ্গে পরিচিত হওয়ায় তাকে নিয়ে আমি সেখানে যাই- উদ্দেশ্য চিত্ত হালদারের জীবিত স্ত্রী ঝর্ণা হালদারের মুখ থেকে শিল্পীর ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক অবস্থানসহ তার শিল্পকর্ম ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কর্মকাণ্ডের বিস্তরিত তথ্য সংগ্রহ করে শিল্পীকে অনুধাবনে আনা।
পরিকল্পনা মাফিক আমরা সন্ধ্যার পর চিত্ত হালদারের গোরাচাঁদ দাসের বাড়িতে পৌঁছি এবং অসুস্থ শরীর নিয়েও ঝর্ণা হালদার সে দিন আমাদেরকে সানন্দে গ্রহণ করেন এবং আমাদের সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে খোলাখুলি আলাপ করেন। ঝর্ণা হালদারের সঙ্গে সেদিনের আলোচনায় অনেক অজানা তথ্য বেরিয়ে আসে; বেরিয়ে আসে শিল্পী চিত্ত হালদারের শিল্পচর্চা, সাংসারিক-সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ সহ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ও ভূমিকার বাস্তব কাহিনী।
ঝর্ণা হালদার সে দিন তার উনিশ বছরের দাম্পত্যজীবনের সুখ-দুঃখের কাহিনীসহ সংসারের নানা ঘটনা আলোচনায় আনেন। তার মতে- স্বামীর সংসারে আর্থিক সচ্ছ্বলতা না থাকলেও দাম্পত্য জীবনে তাদের কখনও অসচ্ছ্বলতা বা অশান্তি ঘটেনি; মধুরতার মধ্যেই তাদের দীর্ঘ সাংসারিক জীবন কেটেছে- যা ছিল তার কাছে এক পরম পাওয়া; পরম সুখ।
ঝর্ণা হালদারই জানিয়েছেন- স্বামীর পাশে-পাশে থেকে ঝর্ণা হালদার স্বামীর শিল্প সাধনায় উৎসাহ যুগিয়েছেন। স্বামীর কাছ থেকেই তিনি চিত্রকলার রঙসহ রেপ্লিকা তৈরিতে হাত পাকিয়েছেন। শিল্পচর্চায় স্বামীর ব্যাঘাত ঘটতে পারে ভেবে সংসারের অভাব অনটনের কথা ভুলেও তাকে কখনও জানাননি। একান্নবর্তী পরিবারের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রেখে, সবার মন জয় করে চলার চেষ্টাই তিনি সর্বত্র করছেন। সে দিনের দীর্ঘ আলোচনায় স্বামীর বিরুদ্ধে ঝর্ণা হালদারের কোনো ক্ষোভ বা অভিযোগের কথা আমরা শুনিনি; প্রশংসাই শুনেছি বারবার- যা আমাদের নিকট অবাক করার মতো ঘটনা মনে হয়েছে। বয়সের কারণে বর্তমানে ঝর্ণা হালদারের শরীরটা খুব ভাল যাচ্ছে না- অফুরন্ত সময়ে স্বামীর স্মৃতি বহন করেই দিন গুজার করছেন তিনি। এখনও শিল্পী স্বামীকে নিয়ে তার রয়েছে বিরাট অহংকার; যা সাধারণত দেখা যায় না।
বলা যায় চিত্ত হালদার তার জীবন কাটিয়েছেন বরিশালের ব্রাউন কম্পাউন্ডের খ্রিস্টান গোরস্থানের পশ্চিম পাশের পৈত্রিক বাড়িতে। ১২/১৩ বছর বয়স থেকে ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত আমি চিত্ত হালদারকে বরিশালের জগদীশ সিনেমা হলের দেয়ালে সিনেমা ব্যানার আঁকতে দেখেছি। নিজের লাজুকতার কারণে তাঁর সঙ্গে আমি সরাসরি কখনও আলাপ করতে পারিনি; পারিনি তার মুখ থেকে সরাসরি সুখ-দুঃখের কথা জানতে। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে বরিশাল ছেড়ে ঢাকার চারুকলা ইনিস্টিটিউটে ভর্তি হওয়ার পর থেকে তার সঙ্গে আমার আর কোনোদিন দেখা হয়নি। এমনকি তার কোনো অবস্থানের কথাও আমার জানার সুযোগ হয়নি। জানলে অবশ্যই আমি তার সঙ্গে দেখা করতাম, কথা বলতাম, অভিজ্ঞতা বিনিময় করতাম।
বলতে দ্বিধা নেই- আমার শিল্পীজীবনের পেছনে চিত্ত হালদার এবং শান্তি কর্মকার উভয়েরই সমান অবদান বিদ্যমাান। স্বীকার করতেই হয় তাঁদের আঁকা ছবি দেখেই আমি ছবি আঁকার প্রেরণা পেয়েছি- চিত্রশিল্পী হতে পেরেছি। আর সে কারণে আজও এঁদের আমি কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করি; তাদের কাছে আমি ঋণাবদ্ধ।
বরিশালের এ. কে স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণীর (১৯৫৫ সালে) ছাত্রাবস্থা থেকেই আমি চিত্ত হালদারকে বরিশালের জগদীশ সিনেমা হলের দেয়ালে নিয়মিত সিনেমা ব্যানার আঁকতেন দেখতাম। স্কুলের টিফিন পিরিয়ডে (দুপুর ২-৩০ মি.) আমি জগদীশ সিনেমা হলের পাশের এক রেস্টুরেন্টের মারফি রেডিওতে, প্রতি শনি ও রবিবার কোলকাতা বেতারের পুরনো আধুনিক বাংলা গানের অনুরোধের আসর শুনতাম এবং খাতায় তা লিখে রাখার চেষ্টা করতাম। এরই ফাঁকে-ফাঁকে দেখতাম চিত্ত হালদার জগদীশ সিনেমা হলের সামনে দেয়ালে বাঁশের মাচার উপরে দাঁড়িয়ে রঙের প্লেট হাতে নিয়ে এক মনে সুচিত্রা-উত্তমের ছবি এঁকে চলছেন। নিচের রাস্তার কোলাহল কখনও তার আঁকার ধ্যান ভঙ্গ করতে পারেনি। এমনকি আঁকার সময় বাঁশের মই থেকে পড়ে আঘাত পেতে পারেন- এ বোধও তার মনে তখন কাজ করতে দেখিনি। আঁকার উপকরণ হিসাবে তাকে ব্যবহার করতে দেখেছি- চাইনিজ লিকারের ছোট কৌটার লাল, নীল, হলুদ, সবুজ, সাদা রঙ ব্যবহার করতে। কখনও খরচ কমানোও উদ্দেশ্যে তিনি লাল-নীল-হলুদ অক্সাইড রঙের সঙ্গে তিসি ও তারপিন তেল মিশিয়ে রঙ বানিয়ে আঁকা ছবি জীবন্ত করে তুলতেন। মূল ছবির উপর গ্রাফ করে প্রথমে চক ও পরে কাল লাইন দিয়ে ড্রইং বের করে তার উপর চাইনিস লেকারের নানা রঙের মিশ্রণ লাগিয়ে নায়ক-নায়িকাদের ছবি জীবন্ত করে তুলতেন।
বলতে দ্বিধা নেই, সে সময় ছবি সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই ছিল না; হাতে আঁকা ছবি দেখলেই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম- ভাবতাম, মানুষ এত সুন্দর করে কিভাবে আঁকে। শিল্পী চিত্ত হালদারের আঁকা তৎকালীন সময়ের সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের আবেগঘন রঙিন ছবি দেখেও আমি অবাক হতাম; অনুপ্রাণিত করে তুলত এবং ভাবিয়ে তুলত আমাকে।
মনে আছে প্রথমাবস্থায় আমি চিত্ত হালদারের আঁকা ছবি দেখে তার অঙ্কনরীতি ও রঙপদ্ধতি অনুকরণের চেষ্টা করতাম। নির্জনে নিজের পড়ার টেবিলে বসে তার মতো আঁকার চেষ্টা করতাম। তবে শিক্ষা ও যোগ্যতার অভাবে আমার আঁকা হুবহু সেরকম না হলেও স্কুলের বন্ধুরা আমার আঁকার প্রশংসা করত এবং উপহাস করে শিল্পী নামে সম্বোধনও করত।
আমার ছেলেবেলায় আমি বরিশাল শহরে ছবি আঁকার কোনো প্রতিষ্ঠান অথবা চারুকলায় শিক্ষিত কোনো চিত্রীর দর্শন পাইনি। ফলে শিল্পতেষ্টা মেটাতে আমাকে অনেক বাঁধা অতিক্রম করে ঢাকার চারুকলা ইনিস্টিটিউটে (১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে) ভর্তি হয়ে পাঁচ বছরের শিক্ষা সম্পন্ন করে ডিগ্রি অর্জন করে শিল্পী হতে হয়েছে। পরে সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়ে শিল্পীজীবন শুরু ও শেষ করে অনেক ছাত্র-ছাত্রী তৈরি করেও আজও আমি প্রকৃত চিত্রী হতে পারিনি। তবে শিল্পী চিত্ত হালদারের কথা আজও কিন্তু আমি ভুলতে পারিনি। তিনি স্বশিক্ষিত শিল্পী হলেও তার চিত্র ও ভাস্কর্য আমাকে মুগ্ধ করেছে, তিনি আমার প্রথম শিল্পগুরু এবং অনুপ্রেরণাদাতা।
বরিশাল শহরে সে সময় ভাস্কর্য ও চিত্রকলার মতো উভয় ক্ষেত্রেই চিত্ত হালদারই ছিলেন একমাত্র পারদর্শী শিল্পী। তিনি চিত্রাঙ্কনসহ মডেলিং, ভাস্কর্য, রিলিফ এবং রিপ্লিকার কাজে ছিলেন সুদক্ষ। মানুষ সামনে বসিয়ে মাটি দিয়ে অল্প সময়েই তিনি যে কোনো মানুষের আবক্ষ তৈরি করতে পারতেন। পারতেন অতি অল্প সময়ের মধ্যে যে কোনো অনুকরণমূলক ভাস্কর্য ও রিলিফের কাজ করে দিতে। রিপ্লিকা তৈরিতেও তার ছিল দক্ষ হাত। প্লাস্টার অব প্যারিস দিয়ে তিনি অনেক অনুকরণমূলক রিলিফ ও রেপ্লিকার কাজ করেছেন।
চিত্ত হালদার শুধু একজন দক্ষ চিত্র শিল্পীই ছিলেন না: সুরের ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন একজন দক্ষ শিল্পী। তাঁর ছিল সুতীক্ষ্ণ সুরালো কান। বাজাতে পারতেন বেহালায় আবেগময় সুর। বেহালা বাজানোর হাতটিও ছিল তার সুমিষ্ট ও প্রাণবন্ত। আত্মতুষ্টির জন্য তিনি বেহালা চর্চা করতেন; গিটার বাজাতেন, বাঁশি বাজাতেন এবং সবগুলো যন্ত্রই তিনি নিজ হাতে বানিয়ে বাজাতেন।
নিরিবিলি পরিবেশে থাকতে তিনি বেশি পছন্দ করতেন। অকারণে জনসম্মুখে ঘুরে বেড়ানো অথবা আড্ডা দেয়া ছিল তাঁর স্বভাববিরোধী কাজ। শিল্পের নেশায় ধ্যানমগ্ন থাকতে বেশি পছন্দ করতেন। চাকরির কঠোর বাঁধনে আবদ্ধ থাকতে কখনও তিনি পছন্দ করতেন না। ছিলেন আবেগ তাড়িত স্বাধীনচেতা মানুষ। বরিশালের কালীবাড়ি রোডে ‘চিত্রালী’ নামে তার একটা ছবি আঁকার স্টুডিও ছিল।
আজ মনে হয় অগ্রজ চিত্রী চিত্ত হালদারের এসব কিছুই কেন যেন আমার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। তার প্রভাবেই আমি চারুকলা ইনিস্টিটিউটে ভর্তি হয়েছি; বেহালা শেখার জন্য সংগীত মহাবিদ্যালয়ে ১৯৬৫ সালে ভর্তি হয়ে বি.মিউজ. ডিগ্রি নিয়ে বেহালা বাজানোর তেষ্টা মিটিয়েছি। তবে চিত্রকলা এবং নতুন তেষ্টা সাহিত্যচর্চা আজও না মেটার কারণে বেশির ভাগ সময় আমি এদিকে নিয়োগ করে চলছি।
আমার ছেলেবেলায় আমি রঙিন আলোকচিত্রের প্রচলন দেখিনি। দেখেছি সাদা-কালোর প্রচলন। আপনজনের কোনো রঙিন মুখায়ব অথবা ফুল ফিগারের কোনো চিত্র বড় আকারে ধরে রাখতে হলে একমাত্র অভিজ্ঞ চিত্রীর দ্বারস্থ ব্যাতীত অন্য কোন গতান্তর ছিল না। তখন একমাত্র দক্ষ চিত্রীই পারতেন একটি ছোট সাদাকালো আলোকচিত্রকে রঙ-রেখায় বড় করে এঁকে দিতে। বরিশাল শহরে তখন এ কাজটি করার মত অভিজ্ঞ আঁকিয়ে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে চিত্ত হালদার, বলহরি সাহা এবং শান্তি কর্মকার অন্যতম। তবে এদের মধ্যে চিত্ত হালদারের আঁকা ছবিই আমার নিকট রঙ-রেখায় একটু বেশি জীবন্ত ও মোহনীয় মনে হত।
শিল্পীজীবনে চিত্ত হালদার সিনেমা ব্যানারসহ অনুকরণমূলক প্রতিকৃতি ও নক্সা এঁকেছেন, বইয়ের প্রচ্ছদের কাজও করেছেন; ছাঁচ তৈরি করে রিপ্লিকা করেছেন, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি স্তম্ভের নক্সা করেছেন। তিনি ভাল ক্যালিওগ্রাফিও জানতেন- আর সে কারণেই ভাল সাইনবোর্ড ও ব্যানার লিখতে পারতেন। তার অগ্রজ শিল্পী শান্তি কর্মকারকেও একই কাজ করে সংসার চালাতে হত। তবে তিনি চিত্ত হালদারের মতো ভাষ্কর্য, রিলিফ রেপ্লিকার কাজ জানতেন না।
কালীবাড়ি রোডের শিল্পী বলহরি সাহা সে সময় পোট্রেট আঁকতেন, বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকতেন, নাটকের ব্যাকস্ক্রিন তৈরি করতেন- তবে সাইনবোর্ড লিখতেন না। তিনি ছিলেন একজন খ্যাতমান নাট্যকার। শুনেছি কোলকাতা আর্ট স্কুলের ছাত্র ছিলেন তিনি। বাধ্য হয়ে তাকে সংসার চালানোর জন্য ফরমাইশি ছবি আঁকতে হয়েছে; স্কুলে ড্রইং শিক্ষকের কাজও করতে হয়েছে তাকে।
বলতেই হয়- চারুকলা ইন্সিটিটিউটে ভর্তির পূর্বে আমার চিত্রমান বিচারের যোগ্যতা এবং দক্ষতার ঘাটতি ছিল। ঘাটতি ছিল পোর্ট্রেট ও ফুল ফিগার ড্রইং, রঙমিশ্রণ, কালার মেচুইরিটি, কালার ব্যালেন্স, পরিপ্রেক্ষিত অথবা চিত্রের সামগ্রিক পারিপার্শিকতার ধারণার। ফলে আঁকা চিত্রকর্ম দেখলেই অপূর্ব বলে মনে হত; মনে হত- এমন সার্থক চিত্রকর্ম আমি কি কখনও আঁকতে পারব?
শিল্পী চিত্ত হালদারকে আমি তার তরুণ বয়সের ভরা যৌবনে দেখেছি; দেখেছি তার উজ্জ্বল শ্যামলা গায়ের রঙ, লম্বা গোলগাল চেহারার সুঠাম দেহ ও রাশভারী ব্যক্তিত্ব। এক কথায় তখন তাকে একজন সুপুরুষ না বলে উপায় নেই। আয়রন করা ধবধবে সাদা সার্ট ও হাফ প্যান্টসহ মাথায় সাহেবী টুপি রোদের জন্য পরে তিনি জগদীশ সিনেমা হলের সিনেমার ব্যানার আঁকতেন। তখন কার সঙ্গে কখনও কোনো আলাপ করতে দেখিনি তাকে। নিরব সাধক ছিলেন তিনি। তার সমবয়সীরা যখন সিগেরেট টানতেন- চিত্ত হালদার সে সময় সিগেরেটের পরিবর্তে চুরুট টানতেন।
চিত্ত হালদারের চলন-বলন ও চেহারায় অভিজাত্যের ছাপ ছিল; লম্বা-চওড়া ও সুদর্শন চেহারার শিল্পী চিত্ত হালদারের পোষাক-পরিচ্ছদে ছিল শালীনতার ছাপ। চিত্রকলায় ছিল তার একটি নিজস্ব ঘরানা; যা দিয়ে আজও তাকে একজন ভিন্নতর শিল্পী হিসাবে পরিমাপ করা যায়।
তার আঁকা চিত্রকলা, ভাস্কর্য, রিলিফ ও রেপ্লিকার বা প্রতিলিপির কাজ দেখে যতটুকু উপলব্ধি করতে পেরেছি; তা থেকে অনুমান করা যায়- তিনি তার শিল্পকর্মে ছিলেন সদা সতর্ক এক অভিজ্ঞ শিল্পী। তার সৃষ্ট চিত্রকর্মে রঙের কোমলতা, সামঞ্জস্যতা ও পারদর্শিতার অভাব দেখিনি। তার তৈরি ভাস্কর্যেও রয়েছে নিখুঁত কাজের চিহ্ন: রিলিফ ও রেপ্লিকার কাজেও রয়েছে দক্ষতার পরিচয়। বস্তুর ছাঁচ তৈরিতেও তিনি পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। আর সে কারণেই তার আঁকা ছবি অথবা ভাস্কর্যে খুঁজে পাওয়া যায় নিজস্ব স্বকীয়তার ছাপ। তার সৃষ্ট শিল্প আমাদের আনন্দ দেয়; অবাক করে, তৃপ্ত করে। তবে এ কথা না বললেই নয়- শিল্পী চিত্ত হালদার সমগ্রজীবনে যত পরিমাণ ছবি এঁকেছেন, তার চেয়ে ভাস্কর্য, রিলিফ-রেপ্লিকার কাজ করেছেন অনেক বেশি। আর সে কারণেই তিনি চিত্রকরের চেয়ে ভাস্কর বা মডেলার হিসেবেই বেশি পরিচিতি পেয়েছেন।
শিল্পচর্চায় চিত্ত হালদার কোনো প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা না নিয়েও যে কোনো চিত্রকর্মের প্রতিলিপি এঁকে দিতে পারতেন। পারতেন মানুষকে সামনে বসিয়ে মাটি দিয়ে তার মডেল বা অবয়ব তৈরি করে দিতে এবং যে কোনো ভাস্কর্য অনুকরণে তা নিখুঁত করে বানিয়ে দিতে। একইভাবে তিনি সমান দক্ষ ছিলেন তৈরি ছাঁচের উপর প্লাস্টার অব প্যারিসের গোলার ঢালাইয়ের মাধ্যমে রেপ্লিকা তৈরিতে।
চিত্রী হিসেবে চিত্ত হালদার যে সকল ছবি এঁকেছেন তার বেশিরভাগই তেলরঙের ছবি; জল রঙের ছবির পরিমাণ খুবই কম। তার আঁকা ছবির বেশিরভাগই অনুকরণমূলক এবং বাস্তববাদী; সৃষ্টিশীল বা প্রকাশধর্মী ছবি নেই বললেই চলে। শিল্পীর আঁকা ছবির মধ্যে রয়েছে- তার নিজের আত্মপ্রতিকৃতি, ঝর্ণা হালদারের প্রতিকৃতি, নজরুলের প্রতিকৃতি, মাছ ধরার দৃশ্য, হালচাষ করার দৃশ্য, চাঁদনী রাতের দৃশ্য, ময়ূর ও রমণীর দৃশ্য, বিয়ে ও পাল্কির দৃশ্য, কর্মরত নারীর দৃশ্য, মাটিকাটার দৃশ্য, মাঝি ও নৌকার দৃশ্য, ¯œানরতা মহিলার প্রতিকৃতি, সুরা-সাকির দৃশ্যসহ আরও অনেক ছবি। রঙ রেখায় আঁকা এ ছবিগুলোর অনুকরণমূলক হলেও তেল এবং জল রঙের অরিএয়েটাল ঢং-এর আঁকা এ ছবিগুলোর রঙের প্রলেপ, ড্রইং, অনুপাত, সামঞ্জস্যতা, কোমলতা ও স্বচ্ছতার ছাপ অনন্য।
চিত্ত হালদারের কাঠ-পাথরে তৈরি মৌলিক ভাস্কর্যের সংখ্যা হাতে গোনার মতো- মধূবালা, ওমর-খৈয়ম, সূরা ও সাকি ইত্যাদি। তবে রেপ্লিকার কাজ অনেক। বরিশাল জগদীশ বালিকা বিদ্যালয়ের সম্মুখের শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটি তার স্থাপত্যকলার একটা জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। তার রিলিফ ও রেপ্লিকার কজের মধ্যে রয়েছে; ক্লিওপেট্রা, ভেনাস, হেলেন অব ট্রয়, সূরা ও সাকি, সাপুড়ে, পুজারী, নাইয়র, চিরন্তন ভালবাসা, সাঁওতাল, শ্রমিক, মাটিকাটা ইত্যাদি অন্যতম।
কাঠ, পাথর অথবা প্লাস্টার অব প্যারিস দিয়ে কোনো বস্তুর মাত্র অর্ধেক অংশ তৈরি করে তার হুবহু ছাঁচ তৈরি করার পর তার উপর তরল প্লাস্টার অব প্যারিস ঢেলে বানাতেন আকর্ষণীয় ঢালাই মূর্তি। এক সময় রেপ্লিকা তৈরির মাধ্যমে চিত্ত হালদার অনেক আকর্ষণীয় শো-পিছ বানিয়ে বরিশালসহ রাজধানী ঢাকার সেসময়ের ঐতিহ্যবাহী দোকানে বিক্রি করে অর্থ ও সুনাম উভয়ই উপার্জন করেছিলেন; বিদেশের বাজারেও তা পাঠিয়ে প্রসংসা কুড়িয়েছিলেন।
শিল্পী চিত্ত হালদার সাইনবোর্ড লিখতেন কেবলমাত্র জীবন-জীবিকার তাগিদে। মনের তাগিদে আঁকতেন জল ও তেল রঙের ছবি। যার কিছু ছবি এখনও তাঁর স্ত্রীর সংগ্রহে রয়েছে। চিত্ত হালদারের সকল শিল্পকর্ম (চিত্র ও ভাস্কর্য) পর্যালোচনা করে বলা যায়- তিনি ছিলেন অসম্ভব মেধাবী শিল্পী: যা দেখতেন তাই রঙ-তুলি অথবা কাঠ-পাথর-মাটি দিয়ে তৈরি করতে পারতেন। শিল্পীজীবনে তিনি নিজেকে চিত্র-ভাস্কর্যের সীমায় আবদ্ধ রেখে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে আপন শিল্পমান উন্নত করতে চেয়েছিলেন। ফলে তার শিল্পে খুঁজে পাওয়া যায় নিজস্বতার ছাপÑযার পর্যবেক্ষণে ধরা পড়ে শিল্পীর নিজস্ব স্বকীয়তা। ব্যক্তিগতভাবে চিত্ত হালদার ছিলেন একজন শিল্পানুরাগী, ধৈর্য্যশীল, আন্তরিক, নিরহংকার, সদালাপী, রুচিশীল, অথচ কঠোর পরিশ্রমী মানুষ। তার অর্থাভাব থাকলেও রুচির দুর্ভিক্ষ কখনও ছিল না।
চিত্ত হালদার ১৯৭১ এর মুত্তিযুদ্ধে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধের কাজ করেছেন; ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন একত্রিশ বছরের এক তরুণ যুবক। যে বয়সে তার রঙ-তুলি ও অর্থের মোহে জীবন কাটিয়ে দেয়ার কথা- তিনি তা না করে জীবন-জীবিকা ও সংসারের মায়া ছিন্ন করে গোলা-বারুদ-বিস্ফোরক তৈরির মাধ্যমে দেশ স্বাধীনের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। কাজটি ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও তিনি তা থেকে পিছপা হননি। তবে এ কাজের জন্য তাকে সর্বক্ষণিক সাহায্য করেছিলেন তার স্ত্রী ঝর্ণা হালদার। তার মুখে থেকেই শুনেছি চিত্ত হালদারের ৬৯ এর গণআন্দোলন, ৭০ এর গণবিক্ষোভ এবং ৭১ এর মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত স্বাধীনতা সংগ্রামে তার বীরত্বের কাহিনী।
ঝর্ণা হালদারই শুনিয়েছেন- ৭১-এর যুদ্ধকালীন সময়ে তার তৈরি মাইন ফাটিয়ে বরিশালের রহমতপুরের পুল ধ্বংস করে বরিশালে পাকবাহিনীর প্রবেশে বাঁধার সৃষ্টি করা হয়েছিল। তার তৈরি বোমা, মাইন, ডিনামাইট ব্যবহার করেই বরিশাল শহরের বেশিরভাগ অঞ্চল শত্রুবাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করা হয়েছিল। তিনিই আমাদের সে দিন শুনিয়েছিলেন- পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর কালো তালিকায় চিত্ত হালদারের নাম থাকার কারণে তাদের দোসররা তার বাড়িতে দু’বার হানা দেয় এবং চিত্ত হালদারকে না পেয়ে একবার তার বাবা ও মাকে দোসরবাহিনী ধরে নিয়ে নির্যাতন ও অপমান করে।
চিত্ত হালদারের মেঝ মেয়ে ভায়োলেট হালদারের সঙ্গে আমার পরিচয়ের পর থেকেই শিল্পী চিত্ত হালদার সম্পর্কে আমার চোখ খুলতে থাকে; তার কাছ থেকে অনেক নতুন তথ্য পাই- যা আমার এ লেখাকে ঋদ্ধ করতে সাহায্য করেছে। একইভাবে ১২.৩.১৮ তারিখে আমি অনুজ আলতাফ হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে আমার ও চিত্ত হালদারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সহ মুক্তিযোদ্ধা-যুক্তিবাদী দার্শনিক হেলাল উদ্দিনের চরকাউয়ার বাসভবনে যাই। তার সঙ্গে আলাপকালে চিত্ত হালদারের বোমা বানানোর উৎস সহ স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের অনেক অজানা গল্প শুনি। তার কাছ থেকেই জেনেছি, বঙ্গবন্ধুর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ৭ মার্চের ভাষণের পর বাংলার মানুষ যখন ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলার প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নামছিল- ঠিক তখনই ২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে বর্বরর পাকিস্তানী বাহিনী বাঙালীর উপর অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং গণহত্যায় মেতে ওঠে। ফলে সমগ্র বাংলার মানুষসহ বরিশলবাসীও পাকবাহিনীর এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে, যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলায় ঝাঁপিয়ে পড়ে পাল্টা পাল্টা আক্রমনের প্রস্তুতি নেয়ার জন্য শুরু করে, শুরু করে গোলা-বারুদ তৈরি ও মজুদের পরিকল্পনা। ঠিক এ সময় শিল্পী চিত্ত হালদার তার রঙ-তুলি বাদ দিয়ে দিনরাত গোলা-বারুদ তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। উল্লেখ্য, ২৫ মার্চ থেকে ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত বরিশাল শহর ছিল শত্রুমুক্ত এক নিরাপদ জায়গা। ফলে বরিশালবাসীরা শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য দীর্ঘ সময় পায় এবং সে সুযোগও কাজে লাগায়।
১৮ এপ্রিল ১৯৭১ পাকবাহিনী বরিশাল শহরে বিমান থেকে গোলা বর্ষণ করে এবং ২৫ এপ্রিল জলপথ অবরোধ করে জনসাধারণের উপর অমানুষিক নির্যাতন শুরু করায় বরিশালবাসী পাক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরির প্রস্তুতি নেয় এবং বরিশালের প্রগতিশীল সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘যুবসংঘ’র কিছু নির্ভীক কর্মী কালীবাড়ির ধর্মরক্ষিণী মন্দিরের সভাকক্ষে মিলিত হয়ে পাকবাহিনীর বিরদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সংকল্প নিয়ে গোলা-বারুদ তৈরি করতে থাকে।
বরিশালের যুবসংঘ সংগঠনটি এক সময় বরিশালসহ সকল জাতীয় দুর্যোগে জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছে। ১৯৬৮ এর আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন, ’৬৯-এর গণআন্দোলন, ’৭০-এর প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস, ’৭১-এর স্বাধীনতাযুদ্ধ- সর্বত্রই এ সংগঠন জনসাধারণকে সঙ্গে নিয়ে জাতির পাশে দাঁড়িয়েছেন। সে সময় এ সংগঠনের সঙ্গে যারা অঙ্গাঙ্গিভাবে সংযুক্ত ছিলেন তাদের মধ্যে এস এম ইকবাল, পুস্তক ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসেন, ফিসারি অফিসার নুরুল ইসলাম, সত্যেন সাহা, অরুণ গাঙ্গুলী, হারেচ আহমদ খান, গৌরঙ্গ নাথ, অরুণ গাঙ্গুলী, হেলাল উদ্দিন, নুরুল আলম ফরিদ প্রমূখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
‘যুবসংঘ’র সদস্যরা যেসব গোলাবারুদ বানাতে সক্ষম হয়েছিল তা হল: গ্রেনেড, মলোটভ বোমা, শক্তিশালী হাত বোমা, এসিড বোমা, ভাসমান মাইন, আকাশ বিধ্বংসী রকেট, ডিনামাইট, রাইফেলের গুলি, রিফিল করা গুলি ইত্যাদি। বিস্ফোরক তৈরির কাজে তখন প্রধান হিসেবে কাজ করেন শিল্পী চিত্ত হালদার এবং তাকে এ কাজে সাহায্য করেছিল হেলালউদ্দিন, এনায়েত হোসেন মিলন, সৈয়দ ওয়াহিদুজ্জামান কচি, আলম, মাহতাব, ফরিদ খান এবং এর নেপথ্যে কাজ করেন এস. এম. ইকবাল, নজরুল ইসলাম চুন্নু, , মিন্টু বসু, ডা. এস. সি. রায়, হারেচ খান প্রমুখ। বিস্ফোরক তৈরির কাঁচামাল সংগ্রহ করা হত স্কুল-কলেজের ল্যাবরেটরি ও বানিয়াদির দোকান থেকে। তৈরি বোমার কার্যকরিতা পরীক্ষা করা হত বরিশাল জেলা স্কুলের মূল দুই দালানের মধ্যবর্তী স্থানে এবং স্কুলে ঢোকার পথের পাকা ড্রেনের নিচে। পরিক্ষিত মালামাল সরবরাহ করা হত বরিশাল, ফরিদপুর, চাঁদপুর, খুলনায়।
উল্লেখ্য, ৭১-এর যুদ্ধপূর্বে শিল্পী চিত্ত হালদারের বিস্ফোরক তৈরির কাজে কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না; ছিল তার সংগৃহীত একটি পুরনো ইংরেজি ভাষায় লিখিত বই- এক্সপ্লোসিভ ফরমুলা বুক’: অনেকে ধারণা করেন যার ফরমুলা পড়ে তিনি বিস্ফোরক তৈরিতে পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন। তবে জানা যায় তিনি বিভিন্ন বিষয়ক বই পড়তেন। তার মাঝে একটি অংশ জুড়ে ছিল বিজ্ঞান বিষয়ক বই। সেসব বই পড়ে তিনি বিভিন্ন রাসায়নিকের গুণাগুণ সম্পর্কে জানতেন ও তার প্রয়োগ করেছিলেন ছবি আঁকায়, অন্যান্য কাজে ও বাস্তব জীবনে ১৯৭১ সালে মুক্তিসংগ্রামে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় পাকবাহিনীর দোসররা কালীবাড়ির যুবসংঘের কার্যক্রম আঁচ করতে পেরে তারা এ সংগঠনের সকল মালামাল লুট করে অফিসটি পুড়িয়ে দেয় এবং স্বাধীনতার পর এ সংগঠন তাদের অফিস সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে বরিশাল সদর রোডের অনামী লেনে (জ্যোতিষ ঘোষাল লেনে) পুনঃস্থাপন করে।
২৫ এপ্রিল পাকবাহিনী বরিশাল শহর পৌঁছেই মুক্তিবাহিনী দেখামাত্র গুলি করার ঘোষণা দিয়ে লুটপাট ও বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিতে শুরু করে। ফলে শহরের লোকজন ভীত হয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের আত্মগোপনের পথ খুঁজতে থাকে। চিত্ত হালদার তার পরিবার এবং সঙ্গে আরও কয়েকজন সহকর্মী নিয়ে শহর ছেড়ে আত্মগোপনে চলে যান। তবে আত্মগোপনে যাওয়ার পূর্বমুহূর্তে তার বিস্ফোরক ভাণ্ডারে রক্ষিত সকল গোলাবারুদ বরিশালে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট হস্তান্তর করেন।
চিত্ত হালদার আত্মগোপনের উদ্দেশ্যে প্রথমে তার স্ত্রী-কন্যা ও শ্যালিকাকে সঙ্গে নিয়ে নিজ গৃহ ছেড়ে কাউনিয়ার কবীরদের বাসায় ওঠেন। পরে সেখান থেকে চিত্ত হালদার, তার পরিবার, মিন্টু বসু ও অন্যান্যদের সঙ্গে নিয়ে এস.এম.ইকবাল উজিরপুরের বাড়িতে যান। মিন্টু বসু কয়েক দিন সেখানে অবস্থানের পর ভারতে চলে গিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।
পাকবাহিনীর দোসর বরিশাল জেলা স্কুলের পাশের পেট্রল পাম্পের দারোয়ানের ছেলে হাদিস চিত্ত হালদারের বাসস্থানে হানা দেয়, কিন্তু চিত্ত হালদারকে বাড়িতে না পেয়ে তারা বাড়ির মূল্যবান মালামাল লুট করে এবং বাড়িতে অবস্থানরত বৃদ্ধ মা তরণী হালদার এবং আশি বছর বয়স্ক বাবা বিশ্বনাথ হালদারের উপর নির্যাতন ও হামলা চালায়। এরপর আর একবার স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের সদস্যরা চিত্ত হালদারের মা-বাবাকে তাদের ক্যাম্পে ধরে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদসহ তাদের উপর নির্যাতন চালায়: যাতে বিশ্বনাথ হালদার দু’টি দাঁত হারান এবং মা তরণী হালদারও আহত হন ।
বাড়ি লুটপাট ও মা-বাবার নির্যাতনের করুণ কাহিনী শুনে চিত্ত হালদার বাধ্য হয়ে গোরাচাঁদ দাস রোডের বাড়িতে ফিরে এসে সতর্কতার সঙ্গে সেখানে অবস্থান করতে থাকেন। তবে হানাদার বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার ভয়ে দিনের বেশিরভাগ সময়ই তাকে ঘরের মাচার উপর লুকিয়ে দৈনন্দিন আহার-নিদ্রা সম্পন্ন করতে হত। এ অবস্থায় সেখানে থাকা নিরাপদ নয় ভেবে পুনরায় ভাদ্র মাসে মা-বাবাকে বাড়িতে রেখে চিত্ত হালদার পরিবারসহ বাংলাদেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
এ যাত্রাও তাদের নানা বাঁধা ও কষ্টের সম্মুখীন হতে হয়। তারা প্রথমে উজিপপুরের বানারীপাড়া থেকে যাত্রা শুরু করে কালমাঘা হয়ে আগৈলঝারার উপর দিয়ে জোবারপাড় গ্রাম হয়ে গোপালগঞ্জের খাকবাড়ি পৌঁছান এবং সেখান থেকে বনগাঁ হয়ে কোলকাতার বনগ্রামের অভয়াশ্রমে পৌঁছান, পরে পরিবারসহ চলে যান জ্যাঠাত ভাই নিরঞ্জন করের কোলকাতাস্থ দমদমের বাড়িতে।
বাংলাদেশ স্বাধীনের পর স্বাধীন স্বদেশে চিত্ত হালদার প্রত্যাবর্তন করে তার আনন্দনিঃশ্বাস গ্রহণ করেন। কিন্তু বরিশাল ফিরে এসেও চিত্ত হালদার সুখের সন্ধান পাননি, কেননা তার বাড়ি ও দোকান লুট হয়ে গিয়েছিল। বরিশাল এসে তাকে অনেক দিন বেকার খাকতে হয়েছিল। অনেক কষ্টের মধ্য তাকে সংসার চালাতে হয়েছে। তবে দেশের পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হওয়ার পর জীবন-জীবিকার তাগিদে তিনি পুনরায় শিল্পকর্মে ফিরে যান। তবে সীমিত আয়ের কারণে সংসার চালাতে অপারগ হয়ে ১৯৭২ সালে তিনি রাজধানী ঢাকায় আসেন। দিনরাত পরিশ্রম করে তাকে নানা ছবি আঁকার কাজ করতে হয়েছে, ছাঁচ ঢালাইয়ের মাধ্যমে নানা শো-পিছ তৈরি করে বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করে সংসারের চাহিদা মেটাতে হয়েছে। তবে এ সকল কাজের জন্য তিনি শিল্পী পটুয়া কামরুল হাসান ও বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক ড. এনামুল হকের প্রচুর সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছেন।
১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে চিত্ত হালদার ঢাকায় এসে রাজাবাজারে একটি দু-রুমের বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে ও শিল্পচর্চা শুরু করেন এবং রান্নার সাহায্যের জন্য রাখেন কানন নামের একটা ছোট্ট মেয়েকেÑযাকে তিনি নিজের মেয়ের মতো দেখতেন। তার কন্যাকে যে জামা পরাতেন, তার গৃহকর্মী কাননকেও একই জামা পরাতেন। ঢাকার নিরিবিলি পরিবেশে এসে চিত্ত হালদারের শিল্পচর্চা বেশ ভালো জমে ছিল। এ সময়ই তিনি প্রচুর কাজ করে দেশ-বিদেশের বাজারে প্রচুর প্রশংসা ও অর্থ উপার্জনে সামর্থ লাভ করেছিলেন।
পটুয়া শিল্পী কামরুল হাসানের সঙ্গে চিত্ত হালদারের সুসম্পর্ক এবং ঘনিষ্ঠতা জমে উঠেছিল। কামরুল হাসানও চিত্ত হালদারের আচার-আচরণ ও শিল্পকর্ম দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকে স্নেহের পতাকাতলে স্থান দিয়ে আদর করে ‘পাগলা’ নামে সম্বোধন শুরু করেছিলেন এবং মৃত্যুর পরও এ সম্বোধন তিনি বজায় রাখেছিলেন।
কামরুল হাসানের সঙ্গে চিত্ত হালদারের ছিল অনেক দিনের পুরনো সম্পর্ক- সম্ভবত ১৯৬৪ সালের দিকে বরিশালে ডিস্ট্রিক্ট এ্যাডজুডেন্ট অব আনসার পদে নিয়োগ নিয়ে কামরুল হাসানের এক ভাই বেশ কিছুদিন বরিশাল থাকার সুবাদেই কামরুল হাসানের সঙ্গে চিত্ত হালদারের ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। ফলে চিত্ত হালদার বরিশাল থেকে ঢাকায় গেলে কামরুল হাসানের সঙ্গে দেখা না করে তিনি কখনও বরিশাল ফিরতেন না।
শিল্পী কামরুল হাসানের সঙ্গে চিত্ত হালদারের পরিবারের সঙ্গেও ছিল তার আন্তরিকতা। চিত্ত হালদারের পরিবারের প্রতি কামরুল হাসানের স্নেহ-মমতার প্রমাণ মেলে শিল্পীর মৃত্যুর পর পর কামরুল হাসানের লেখা ১৯৭৮ এর ৩ আগস্টের খেরোখাতার এক উদ্ধৃতি থেকে এভাবে:‘বেতারে বাংলা সংবাদ হচ্ছে। আমার ড্রাইভার এসে গাড়ী গ্যারেজ থেকে বের করল। আমাকেও প্রস্তুত হয়ে অফিস যেতে হবে। এবার চিত্ত হালদার। ‘‘পাগলা” নাই। পটুয়া কামরুর হাসানের স্নেহাস্পদ ‘পাগলা” আর নাই। বরিশালের শিল্পানুরাগী সমাজের প্রিয় চিত্ত কিম্বা চিত্তদা আর ইহজগতে নাই। একপ্রকার বিনা চিকিৎসায় বরিশাল-এর শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাধারণ বিছানায় হিমশীতল মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে একজন শিল্পী। আজকের সংবাদে এই সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। দুপুরে বাসায় এসে কাগজ খুলতেই চোখে পড়ল। চমকেই উঠলাম না শুধু নিজের কাছেই নিজে কৈফিয়ত কি দেব তাই ভাবছি সেই থেকে।”
চিত্ত হালদারের মৃত্যুর পর ৬-১১-৭৮ তারিখে কামরুল হাসান তার স্ত্রী ঝর্ণা হালদারকে বোন সম্বোধন করে তাকে সহযোগিতা করার কথা জানিয়ে লিখেছিলেন, “মানুষের বিপদ কখন কোন ভাবে আসে কেউই বলতে পারে না। আপনার জন্য আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। বোন আপনাকে একটু ধৈর্য্য ধরতেই হবে। আপনার বোনের নিকট থেকে জানতে পারলাম আপনারাও কাজে হাত দিয়েছেন এবং বিভিন্ন দোকানে মাল সরবারহ করছেন। এটা অত্যন্ত আনন্দের কথা। আমি এনামুল হককে আবার সব কিছু জানিয়েছি। তিনিও যে বিশেষ সহানুভ’তিশীল আপনার প্রতি তা আপনি জানেন। অতএব একটু অপেক্ষা করতেই হবে।”
উল্লেখ্য, চিত্ত হালদারের মৃত্যুর পর আর্থিক অনটনের কারণে ঝর্ণা হালদার মাত্র পাঁচ টাকা পুঁজি নিয়ে শিল্পকর্ম তৈরির কাজে হাল ধরেছিলেন এবং পরে পটুয়া শিল্পী কামরুল হাসান ও ড. এনামুল হক এ কাজে তাকে সহায়তা প্রদান করেন। এভাবেই তিনি সংসার চালান।
শিল্পী চিত্ত হালদারের মৃত্যুর পর, তার সাংসারিক অভাব-অনটনের কথা জেনে উবায়েদ জায়গিরদার নামের এক শিল্পানুরাগী পটুয়া কামরুল হাসানের নিকট ঝর্ণা হালদারের জন্য ১০০০ টাকা পাঠিয়ে তা পৌঁছে দেয়ার অনুরোধ জানিয়ে একটা চিঠি দিয়েছিলেন। কামরুর হাসান ঝর্ণা হালদারকে ১৫-১১-৭৮ তারিখে পত্রমারফত সে সংবাদ জানিয়ে তাকে সে টাকা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
বাংলাদেশ জাদুঘরের প্রাক্তন মহাপরিচালক ড.এনামুল হকের সঙ্গে পটুয়া শিল্পী কামরুল হাসানের প্রথম পরিচয় ঘটেছিল চল্লিশের দশকে বগুড়ায়। কামরুল হাসান তখন বগুড়াতেই থাকতেন। পরে ঢাকার চলে আসার পর, এনামুল হক ঢাকায় কাজে আসলে কামরুল হাসানের সঙ্গে দেখা না করে কখন বগুড়ায় ফিরে যেতেন না। এ ভাবে ঢাকা আসার পর একদিন কামরুল হাসানের বিসিক অফিসে ঢাকা জাদুঘরের প্রাক্তন পরিচালক এবং পরে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক ড.এনামুল হকের সঙ্গে চিত্ত হালদারের দেখা ও আলাপ হয়। তবে ড. এনামুল হক পূর্বেই কামরুল হাসানের মাধ্যমে চিত্ত হালদারের ভাল মডেল তৈরির খবর জেনে নিয়েছিলেন।
ইতোপূর্বে ড. এনামুল হক বিশ্বের অনেক বড় বড় জাদুঘর পরিদর্শন করে দেখেছেন; সেখানকার জাদুঘর কর্তৃপক্ষ মূল্য অথবা বিনামূল্যে সৌজন্যের নিদর্শন হিসাবে জাদুঘরের নিজস্ব প্রকাশনা অথবা ছোট আকারের একটা রেপ্লিকা দর্শকদের হাতে তুলে দেন। তবে অর্থসংকটের কারণে তখন ঢাকার নিমতলী জাদুঘরে এ ধরনের কোনো ব্যবস্থা নিতে না পারায় পরিচালক মহোদয় ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। উল্লেখ্য সে সময় নবপ্রতিষ্ঠিত ঢাকা জাদুঘরের দারুণ আর্থিক অনটন চলছিল। অর্থাভাবে প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগ দেয়াও তার পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠছিল না। মাত্র কয়েকজন কর্মচারীসহ একমাত্র অফিসার হিসাবে ড. এনামুল হক নিজে ঢাকার নিমতলী জাদুঘর চালাতেন। এমনকি জাদুঘরের নিয়মিত ব্যয় মেটানোর জন্য ড. এনামুল হক নিজে জনসাধারণের কাছ থেকে মাসিক এক লক্ষ কুড়ি হাজার টাকা চাঁদা তুলে তা দিয়ে জাদুঘরের ব্যয়ভার মিটাতেন।
এ অবস্থায় একদিন এনামুল হক চিত্ত হালদারকে তার নিমতলী জাদুঘরে আমন্ত্রণ জানান; চিত্ত হালদার যথাসময়ে সেখানে উপস্থিত হয়ে তার সঙ্গে দেখা করায় চিত্ত হালদারকে জাদুঘরে রক্ষিত যে কোনো এটি ভাষ্কর্যের রেপ্লিকা তৈরির অনুরোধ জানান।
ড. এনামুল হক জাদুঘরে রক্ষিত সূর্য দেবতা, দেবী গৌরী, মা ও শিশু, শিবসহ অনেকগুলো মূর্তি দেখিয়ে কোনটার রেপ্লিকা তিনি তৈরি করে দিতে পারবেন জানতে চাওয়ায় চিত্ত হালদার জানান, ড. এনামুল হক যেটি নির্দিষ্ট করে দেবেন ঠিক সেটিই তিনি করে দিতে পারবেন। অতএব এনামুল হক মহাস্থানগড় থেকে সদ্য আনা ‘মা ও শিশু’র (প্রকৃতপক্ষে ‘গৌরী’ বা ‘মহামায়া’) ভাস্কর্যটি চিন্তা-চেতনায় সেক্যুলার হওয়ায় এর রিপ্লিকা তৈরি করলে সাধারণ দর্শক এটা কিনে নিয়ে ঘরে রাখতে দ্বিধাবোধ করবে না বিধায় সে ভাস্কর্যটির একটি রেপ্লিকা তৈরি করে দেয়ার অনুরোধ করেন। চিত্ত হালদার মা ও শিশু ভাস্কর্যের রেপ্লিকাটি তৈরি করে দেন। পরে তিনি জাদুঘরকে আরো চুক্তিভিত্তিক কাজ করে দেন।
তবে সুখ কখনও তার ভাগ্যে স্থায়ী হয়নি; ১৯৭৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে চিত্ত হালদার লিভার সিরোসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকা থেকে ফিরে এসে বরিশালে শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হন। তবে এ রোগ থেকে সেরে ওঠা তার পক্ষে সম্ভব না হওয়ায় মাত্র ৪২ বছর বয়সে ১৯ জুলাই ১৯৭৮ সালে অনেকটা বিনা চিকিৎসায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাকে তারই বাড়ির পাশে খ্রিস্টান গোরস্থানে সমাহিত করা হয়।
ঝর্ণা হালদার বর্তমানে অসুস্থাবস্থায় দিন কাটালেও এখনও তার স্মৃতিশক্তি প্রখর। এখনও তিনি তার স্বামীর ভিটা আগলে আছেন; স্বযত্নে শিয়রে রেখে দিয়েছেন স্বামীর সর্বশেষ শিল্পকর্মটুকু। এ বাড়িতেই তিনি তার শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। আমার সঙ্গে আলাপকালে পুরোটা সময় ধরেই তিনি শিল্পী চিত্ত হালদারের স্মৃতি আওড়েছেন। স্বামীর ভালবাসা তিনি এখনও ভুলতে পারেননি। সংসার জীবনে স্বামীর উদারতা, দায়িত্ব-কর্তব্য ও ভালবাসা স্মরণ করে আজও তিনি আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন। আজও তিনি একজন শিল্পী ও বীর মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী হতে পেরে তৃপ্ত, কৃতজ্ঞ এবং গর্ববোধ করেন। আজও চিত্ত হালদারের পরিবারের সদস্যরা শিল্পীর রেখে যাওয়া শিল্পকর্ম আকড়ে ধরে আছেন। আজও স্ত্রী ঝর্ণা হালদার শিল্পী-ভাষ্কর-বীরমুক্তিযোদ্ধা ও দক্ষ বোমার কারিগর: শিল্পী কামরুল হাসানের প্রিয় ‘পাগলা’-র স্মৃতি অন্তরে ধারণ করে পথ চলছেন। স্বামীর প্রশংসায় এখনও তিনি পঞ্চমুখ।
১১-৩-২০১৮ তারিখে তার বাসায় আলাপ-আলোচনার সময় ঝর্ণা হালদারের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে চিত্ত হালদারের শিল্পসাধনার কথাসহ ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ ও যোদ্ধার কৃতিত্বের কথা; যার সবটাই ছিল আমার অজানা। তবে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি জীবন বাজী রেখে বোমা তৈরি করে যে সুঃসাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন সে দিক বিচারে করে বলা যায় বীর মুক্তিযোদ্ধা চিত্ত হালদার আজও তার যথাযোগ্য মর্যাদা পাননি: বরং বলা যায় তিনি উপেক্ষিত হয়েছেন। এ অভিযোগটিও সেদিন তার স্ত্রী আমার নিকট করেছেন। তার ক্ষোভ- জীবিতাবস্থায় বীর মুক্তিযোদ্ধা চিত্ত হালদার অর্থকষ্টে ভুগেছেন; চিকিৎসা পাননি, প্রতিষ্ঠা পাননি, যোগ্য সম্মান পাননি, স্বীকৃতি পাননি, এমনকি মৃত্যুর পর গার্ড আব অনারটুকুও পাননি। তবে এত ক্ষোভের পরও তিনি এখনও স্বামীর স্বীকৃতির মহেন্দ্রক্ষণের দিন গুনছেন- দিন গুনছেন মুক্তিযোদ্ধার যোগ্য প্রকৃত সম্মানের আশায়। তার আশা ‘পূর্ণ হোক, পূর্ণ হোক- হে ভগবান’।
আমি তার আত্মার শান্তিকামনা করি। তিনি আমার শিল্পীজীবনের অন্যতম প্রেরণাদাতা; তার প্রতি রইল আমার অকৃত্তিম শ্রদ্ধা ও ভালবাসা। একইভাবে তার পরিবারের জন্য রইল আমার শুভেচ্ছা ও মঙ্গল কামনা।