আমাদের এই মন
মন এমন একটি জিনিস যার উপর নির্ভর করে আমাদের সব কিছু। কেননা মন সায় না দিলে আমাদের কাজ করতে ইচ্ছে করে না। যে কাজে আমাদের মন বসে না সেই কাজ আমাদের দ্বারা আর হয়ে উঠে না। আর মনের বিরুদ্ধে কাজ করলে সেটা নিখুঁতও হয় না। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় যেই কাজগুলো আমাদের জীবনের জন্য খুবই জরুরী বা এই কাজ না করলে আমাদের জীবনে অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে সেই কাজগুলোতেও আমাদের মন বেঁকে বসে আর এখানেই মূল সমস্যাটা তৈরী হয়। মনকে প্রশ্রয় দিয়ে সেই কাজগুলো থেকে আমরা পালিয়ে বেড়াই। তাই আমাদের সেই মূল্যবান কাজগুলো করা হয়ে ওঠে না, যার ফলে আমাদের জীবনে নেমে আসে নানা ধরনের সমস্যা।
তার উপর আমাদের মানসিক চাপ, কাজের চাপ, সম্পর্কের চড়াই-উতরাই ইত্যাদি আমাদের মনকে বিক্ষিপ্ত করে দেয়। এই সব কিছুই আমাদের মনকে নষ্ট করে দিতে যথেষ্ট। কিন্তু জীবনে উন্নতি করতে হলে নিজের মনকে নিজের আয়ত্তে বা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। কেননা বলা হয়, শারীরিক রোগের অনেক গুলোই হয় মানসিক রোগের কারণে। এ ছাড়া মন বিক্ষিপ্ত থাকলে কাজকর্ম সব ব্যাহত হয়ে যায়। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে আমাদের আয়ত্তে থাকা অবস্থাও নিজেদের নাগালের বাইরে চলে যাবে। আর যা আয়ত্তে নেই তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে আরো মুশকিল হবে। তাই আত্মনিয়ন্ত্রণ খুবই জরুরি। নিজেকে সফল করার জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণ একটি বড় হাতিয়ার বলা যেতে পারে। আর নিজের মনকে যখন আমরা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারব তখন আমাদের অবচেতন মন চাইলেও তার ইচ্ছা মত আমাদেরকে কন্ট্রোল করবে না বরং আমরাই নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করব। তখন যে কাজটা আমার জীবনের জন্য জরুরী সে কাজকে ফাঁকি দিতে মন আমাদেরকে উৎসাহিত করতে পারবে না। তখন আমরা আমাদের মনকে নিজের কন্ট্রোলে রেখে কাজগুলো সম্পাদন করতে পারব এবং আমাদের লক্ষ্য ব্যাহত হবে না। তার ফলে আমাদের জীবন সাফল্যের স্বাদ গ্রহণ করবে সব ক্ষেত্রেই।
মন নিয়ন্ত্রণ করা রাতারাতি কোন বিষয় না। তার জন্যে কিছু কৌশল সঠিকভাবে নিয়মিত পালন করলে যে কেউ মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।
১। মেডিটেশন
যেমন প্রথমেই বলা যেতে পারে মেডিটেশনের কথা। করেই দেখুন, ফল হাতে হাতে পাওয়া যাবে। মনকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে মেডিটেশনের বিকল্প আর কিছু নেই। মনকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে ধ্যান বা মেডিটেশন করা খুব উপকারী একটি বিষয়। যখন নেগেটিভ চিন্তাগুলো আমাদের মনকে একটু একটু করে গ্রাস করে, তখন আমাদের মধ্যে মানসিক দৃঢ়তা কমে যায়। এই ধরনের চিন্তা মানসিক শক্তিকে দুর্বল করে দেয়। মানসিকতা দুর্বল হয়ে গেলে আমাদের আত্মবিশ্বাস হারিয়ে যায়। আর আমরা জানি আত্মবিশ্বাস একবার হারিয়ে গেলে কাজের অনুপ্রেরণা থাকে না। তখনই ওই কাজের উপর আমাদের অনীহা চলে আসে। কাজটি করতে আর আমাদের মন বসে না। ফলে আমাদের সেই কাজটি অসম্পন্ন থেকে যায়। আর আমরা সাফল্যের করিডরের খুব কাছাকাছি এসেও আমরা ব্যর্থতার তকমা কপালে দিয়ে থাকি। কিন্তু নিয়মিত মেডিটেশনের অভ্যাস মনকে শান্ত করে এবং দৃঢ় রাখতে সাহায্য করে। আর মন ঠিক থাকলে অনুপ্রেরণার ঘাটতি থাকে না। তাই মনকে শান্ত রাখতে মেডিটেশন করা খুবই প্রয়োজন।
২। শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম
এটা হয়ত আমাদের প্রায় মানুষই জানি যে মনকে শিথিল রাখতে শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম ভীষণ কার্যকারী একটা মাধ্যম। নানা চাপের কারনে আমাদের মন প্রায়শই বিক্ষিপ্ত থাকে। এই চাপ হতে পারে সংসারের চাপ, পড়ার চাপ, কাজের চাপ ইত্যাদি। আর এই চাপের কারণে মাঝে মাঝে বেঁচে থাকার আনন্দটাই নষ্ট হয়ে যায়। জীবনের প্রতি একটা বিরূপ ধারণার সৃষ্টি হয়। আর চাপ নিয়ে কাজ করলে সেই কাজ কখনই ভালো হয় না, এ কথা আমাদের অজানা নয়। তাই আমাদের মন ভীষণ বিক্ষিপ্ত এবং অস্থির থাকলে একে নিয়ন্ত্রণের জন্য শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম করা যেতে পারে। এই ব্যায়াম করতে প্রথমে গভীরভাবে শ্বাস নিতে হবে। সেই শ্বাস কিছুক্ষণ আটকে রাখতে হবে। এরপর ধীরে ধীরে শ্বাস ছাড়তে হবে। এভাবে কয়েকবার ধরে করতে হবে। এই ব্যায়াম আমাদের নেগেটিভ চিন্তা ও আবেগগুলো থামাতে সাহায্য করবে, যার ফলে আমরা আমাদের কর্মক্ষেত্রে ভালো কাজ করতে পারব এবং জীবনটাও সুন্দর মনে হবে।
৩। চিন্তাকে চিহ্নিত করতে হবে
আমাদের মন বিক্ষিপ্ত হওয়ার মূল কারণই হচ্ছে আমাদের নানা ধরনের নেতিবাচক বা নেগেটিভ চিন্তা। কোন কাজে হাত দিলেই সেই কাজের ফলাফল বা নানা বিষয় নিয়ে আমরা নেগেটিভ চিন্তার আসর খুলে বসি। ধীরে ধীরে এসব চিন্তা আমাদের মধ্যে বাসা বাঁধা শুরু করে, তখনই আমাদের মন বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়, বিচলিত হয়ে পড়ে, তার ফলে আমাদের অনুপ্রেরণা হারিয়ে যায় আর সারাদিনে সেই কাজ আমাদের দ্বারা হয়ে ওঠে না আর উঠলেও ফলাফল আমাদের আশানুরূপ হয় না। তাই নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যে চিন্তাগুলো আমাদের এলোমেলো করে দিচ্ছে, সেগুলো আগে চিহ্নিত করতে হবে। নেগেটিভ চিন্তাগুলো বারবার মনে এলে অকারণেই মন অস্থির হয়ে ওঠে। তাই প্রথমে চিন্তার উৎসটা খুঁজে বের করতে হবে। এরপর ভাবনাগুলোকে একেবারে থামিয়ে দিয়ে পজিটিভ চিন্তা শুরু করতে হবে। ভাবতে হবে আমাদের জীবনে পজিটিভ বা ভাল কী কী দিক রয়েছে। এ ছাড়া পজিটিভ বিষয়গুলোর একটি তালিকাও তৈরি করা যেতে পারে। নেগেটিভ চিন্তাগুলো যখন মাথায় আসবে, তখন পজিটিভ চিন্তার সেই তালিকাটি পাশাপাশি দেখতে হবে। তাতে করে আমাদের মন শান্ত হবেই।
৪। মনকে ভিন্ন দিকে নিয়ে যেতে হবে
আমাদের মনকে বিক্ষিপ্ত করে তোলে আমাদের নেগেটিভ ভাবনাগুলো। আর যার ধ্বংস করার শক্তি অত্যন্ত প্রবল। আর যেই কাজে আত্মবিশ্বাস আর অনুপ্রেরণা নামক মূল খুঁটিই নেই সেই কাজের পরিণতি কি হতে পারে তা আমাদের সকলেরই জানা। তাই যদি মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে সবার প্রথমে নেগেটিভ ভাবনাগুলো থেকে মনকে ভিন্ন দিকে নিয়ে যেতে হবে। মন খারাপ হওয়ার পরিবেশ থেকে খুব তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসতে হবে। কোনো কিছু খুব বেশি সমস্যার মনে হলে বা কষ্টদায়ক হলে, কিছু সময়ের জন্য বিষয়টিকে এড়িয়ে যেতে হবে। সেই সময়টিতে অন্য কোনো কাজে মনোযোগ দিতে হবে। তাতে করে আমাদের মনের উপর বিরূপ প্রভাব পড়বে না। এবং আমাদের মনকে প্রভাবিত করতে পারবে না। ফলে আমাদের মন আমাদের নিয়ন্ত্রণেই থাকবে।
৫। সংগীত থেরাপি
গান আমাদের সবারই একটি ভালো লাগার জায়গা। আমাদের মনকে নিয়ন্ত্রণ করতেও গান মাঝে মাঝে ভূমিকা পালন করে। তাই মন খারাপ থাকলে নিজের প্রিয় গান শুনলে খুব তাড়াতাড়ি আমাদের মন ভালো হয়ে যাবে। তবে মাথায় রাখতে হবে ‘স্যাড সং’ আপনার বা আমার যতই প্রিয় হোক না কেন, মন খারাপ বা চাপে থাকলে এই ধরণের গান একেবারে এড়িয়ে চলতে হবে। শান্তও মন ভালো করা গানগুলো শোনার চেষ্টা করতে হবে। ভালো গান শোনার ফলে শরীরে ডোপামিন নামক একটি হরমোন নিঃসৃত হয় যা মন ভালো করে তুলতে সাহায্য করে। এটা চ্যালেঞ্জগুলোকে মোকাবিলা করতে সাহায্য করবে। পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের হালকা মিউজিকও শোনা যেতে পারে।
৬। মোমের আলোয় তাকান
খুব অস্থির লাগলে এবং কষ্ট লাগলে মোমের আলোর দিকে তাকালে মন শান্ত হয়। মোমবাতি জ্বালিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে কিছুক্ষণ। যতক্ষণ পর্যন্ত আলোকে স্থির মনে না হবে, ততক্ষণ তাকিয়ে থাকলে আমাদের মন শান্ত হবে এবং নিয়মিত এটা করলে আমাদের মনযোগ শক্তি বৃদ্ধি হবে। কেননা এটা আমাদের একদিকে মন স্থির করা শেখাবে এবং বার বার মন ডিস্ট্রাকের হাত থেকে চিন্তাশক্তি নিয়ন্ত্রণে রাখবে।
৭। স্নান
এছাড়া মন খুব অস্থির লাগলে ভাল করে স্নান করতে হবে। শরীরে জলের স্পর্শ মনকে শান্ত করতে অনেকটাই সাহায্য করে ।
৮। জীবনে প্রতিমুহূর্তে আশাবাদী হতে হয়
আশাবাদী হয়ে উঠলে এটা প্রত্যক্ষভাবে আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর খোরাক হয়ে ওঠে। আমাদের অনুপ্রেরণাকে বাঁচিয়ে রাখে। জীবন থেকে আশা ছেড়ে দিলে হতাশা আমাদের গ্রাস করবে, আর সেই হতাশা আষ্টেপৃষ্ঠে ধরবে তার শক্তিশালী পর্দা দিয়ে। যার ফলে তা ভেদ করে বেরোনোটা আমাদের পক্ষে খুবই কষ্টসাধ্যই। এই হতাশা খুব সহজেই আমাদের মনকে অস্থির করে তোলে এবং এর প্রকোপ ধীরে ধীরে বাড়তেই থাকে। তখন কোনো কাজে আমরা নিজেদের সেরাটুকু দিতে পারি না। আর ক্রমেই আমরা ব্যর্থতার রাস্তায় প্রবেশ করতে থাকি। তাই হতাশার কারণগুলোকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে নিজের পজেটিভ দিকগুলোর দিকে নজর দিতে হবে এবং প্রতিমুহূর্তে আশাবাদী হয়ে উঠতে হবে। আর মনে রাখতে হবে জীবনে উত্থান-পতন আসবেই, আর মন যদি অশান্ত হয় তাহলে সামনের দিকে কিছুতেই আমরা এগিয়ে যেতে পারব না। আর এই কথাটা যদি মনকে সুন্দর ভাবে বোঝানো যায় তাহলে মন সব সময়ই শান্ত থাকবে।
৯। পর্যাপ্ত ঘুমান
পর্যাপ্ত ঘুম সব শারীরিক ও মানসিক সমস্যার সমাধানের একটি অন্যতম উপায়। পর্যাপ্ত ঘুম আমাদের সকলেরই প্রয়োজন। শুধু মনকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেই নয় সব ক্ষেত্রেই। ঘুমটা ঠিক মত না হলে আমাদের সব কাজেই ব্যাঘাত ঘটে। সারাদিন শরীরে আর মনে বিরক্তি কাজ করে এবং মন বিক্ষিপ্ত থাকে। কোন কাজেই মন বসতে চায় না। কাজটি ফেলে রাখার একটি বাসনা আমাদের মধ্যে দেখা যায়। যার ফলে আমাদের কর্মক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই চাপে থাকা অবস্থায় আমরা যদি না ঘুমাই, আমাদের মন আরো বিক্ষিপ্ত হবে। এজন্য এই সময়টাতে অন্তত ছয় থেকে আট ঘণ্টা ঘুমানো খুব জরুরি।
১০। মানবিক চর্চা করুন
মানবিকতা শুধু এক্ষেত্রেই দরকার তা নয়, এটা জীবনের প্রত্যেক ধাপেই আমাদের সাহায্য করবে। যারা অমানবিক কার্যক্রমে লিপ্ত তারা কখনই সাফল্যের শীর্ষচূড়ায় অবতরণ করতে পারেননি। তার আগেই ঝরে পড়েছেন। অন্যদিকে যারা শান্তি, উদারতা, মানবিকতার পথ ধরে নিজ নিজ লক্ষ্যে এগিয়ে যান তারা সহজে বিচলিত হন না। তারা বেলা শেষে সাফল্যের স্বর্ণ শিখরে পৌঁছে যান। তাই নিজের ভিতরে মানবিকতার গুণগুলো ধারণ করে ক্ষমাশীল হতে হবে। এর ফলে নিজের আবেগ, অনুভূতি এবং মনের উপর আমরা নিজেরাই নিয়ন্ত্রণ করতে পারব ।
১১। হাসুন
সব প্রশ্নের খুব ভালো উত্তর হলো হাসি। মন ভালো রাখতে হাসির বিকল্প আর কিছুই নেই। হাসি এমন একটি সৌন্দর্য যেটা আমাদের শরীরকে সজীব রাখতে সাহায্য করবে। হাসলে মন খারাপ কোথায় চলে যাবে। তাই খুব বেশি চাপে থাকলে হাসার চেষ্টা করা খুবই জরুরী। কিন্তু রাজ্যের চাপ যখন মাথায় এসে ভিড় করে তখন তো আর এমনি এমনি হাসা যায় না, তাই না? এক্ষেত্রে সিনেমা, হাসির অনুষ্ঠান গুলো দেখতে হবে। হাসির সিরিয়াল বা সিনেমা খুঁজে বের করে দেখতে হবে, যেটা পরক্ষণেই আমাদের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করবে। পুরনো সিরিয়াল বা সিনেমাও দেখা যেতে পারে আরও একবার। প্রিয় চরিত্রগুলোর মজার কান্ডকারখানা আমাদের মানসিক অবস্থার উন্নতির জন্য সহায়তা করবে। এবং সব চাপ নিমিষেই কেটে আমাদের মন ভালো হয়ে উঠবে।
(চলবে)