যাঁর মতো লেখক ইংরেজি সাহিত্যে পাওয়া সত্যিই দুর্লভ এবং পশ্চিমের প্রথম সারির চিত্রকরদের মধ্যে যিনি নিঃসন্দেহে অন্যতম, সেই ‘উইলিয়াম ব্লেক’ কিন্তু আদতে ছিলেন একজন অর্ধোন্মাদ।
এক গরিব কারিগরের ঘরে তাঁর জন্ম। কিন্তু বাবার সেই কাজের প্রতি তাঁর কখনও আগ্রহ ছিল না। তাই বাবাও তাঁর এই অপ্রকৃতিস্থ ছেলেকে হাতে হাতে কাজ তুলে দেবার জন্য কোনও দিন জোর করতেন না। ফলে ছেলে তাঁর নিজের মতো থাকতেন। যখন যা মন চাইত তাই করতেন। কখনও মাটি ছেনে ছেনে পুতুল বানাতেন। কখনও বা রং তুলি কাগজ নিয়ে ছেলেখেলা করতেন। খেলার ছলেই আঁকতেন ছবি। কখনও আবার খাতা কলম নিয়ে বসে পড়তেন। যা মনে হতো তাই লিখতেন। তার পর সেগুলো ঢুকিয়ে রাখতেন একটা কাঠের বাক্সে। তিনি যেমন কারও কোনও খোঁজখবর রাখতেন না। তাঁরও কোনও খোঁজখবর রাখতেন না কেউ।
তিনি নিজের খেয়ালখুশি মতো চলতেন। কোনও কাজকর্ম করতেন না। রোজগারপাতি তো নয়ই। তাই জীবদ্দশায় তিনি ছিলেন ভীষণ গরিব। এতটাই গরিব যে, কোনও কোনও দিন তাঁর খাওয়াও জুটত না। অথচ খাবার জন্য কারও কাছে হাত পাততেও তাঁর লজ্জা করত। এতটাই সম্মানবোধ ছিল তাঁর। অথচ তাঁকে দেখলে লোকে ভাবত এ নিশ্চয়ই একটা ভিখারি। তাই তিনি যখন মারা যান, তখন আরও তিন জন বেওয়ারিশ ভিখারির সঙ্গে তাঁকেও সমাধিস্থ করা হয়।
এ রকম ঘটনা তো আকছাড়ই ঘটে। ফলে কেউ মনেও রাখেন না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে হল ব্যতিক্রম। কারণ তাঁর নাম উইলিয়াম ব্লেক।
তাঁর মৃত্যুর কয়েক দিন পরেই এক বিদগ্ধ শিল্পরসিক মানুষ তাঁদের বাড়িতে এসেছিলেন কাঠের কাজ করাবেন বলে। কিন্তু ঘরে ঢুকেই তিনি একেবারে অবাক হয়ে গেলেন। বুড়োর ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছবিগুলো দেখে। ঘুরে ঘুরে সব ক’টা ছবি খুব ভাল করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। তিনি ছিলেন সত্যিকারের ছবির সমাজদার। তাই নিজে থেকেই যেচে প্রচুর দাম দিয়ে কিনে নিয়ে গেলেন বেশ কয়েকখানা ছবি। যে ছবিগুলো এত দিন অবহেলায় অনাদরে এ দিকে-সে দিকে পড়ে ছিল, তার দাম এত! বাড়ির লোকজন তো একেবারে থ’।
সেই ছবিগুলো নিয়ে এক টানা সাত দিন ধরে তিনি একটি চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন করলেন। আমন্ত্রণ করে নিয়ে এলেন বিদগ্ধ সব শিল্পরসিকদের। নিয়ে এলেন শিল্প সমালোচকদের। হাজির করালেন বিভিন্ন পত্র পত্রিকার সম্পাদকদের। করলেন সাংবাদিক সম্মেলনও।
প্রথম সারির প্রায় সমস্ত দৈনিক কাগজগুলোতে ফলাও করে ছাপা হল সেই খবর। প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন তাবড় তাবড় সব শিল্পীরা। অনেক উন্নাসিক চিত্রসমালোচকরাও প্রাণ খুলে প্রশংসা করলেন সেই ছবিগুলোর।
অল্প কিছু দিনের মধ্যেই মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল তাঁর খ্যাতি। সাংবাদিক সম্মেলনে সেই বিদগ্ধ শিল্পরসিক বলেছিলেন, তাঁর বাক্সবন্দি হয়ে পড়ে থাকা লেখাজোখার কথা। যিনি এত ভাল ছবি আঁকেন, তিনি যখন লিখেছেন, সে কি আর ফেলনা হবে! তাই এক প্রকাশক তড়িঘড়ি গিয়ে হাজির হলেন উইলিয়াম ব্লেকের বাড়ি। প্রকাশ করলেন একের পর এক তাঁর বই। আর সেগুলো বেরোতে না বেরোতেই হয়ে গেল বেস্ট সেলার।
ছবির সঙ্গে সঙ্গে তাঁর লেখাজোখার খবরও ছড়িয়ে পড়ল দেশবাসীর কাছে। মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই সেই সব বই বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হয়ে পৌঁছে গেল গোটা বিশ্বে। তাঁর ছবি দেখে যেমন মুগ্ধ হয়েছিলেন চিত্রপ্রেমিকেরা, ঠিক তেমনি তাঁর লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়ে গেলেন পাঠকেরা।
তাঁরাই দল বেঁধে ঠিক করলেন, তাঁদের প্রিয় এই শিল্পী-লেখককে তাঁরা শ্রদ্ধা জানাবেন। ঘটা করে পালন করবেন তাঁর জন্মদিন। কিন্তু তাঁর জন্মদিনটা কবে?
অনেক খোঁজাটোজ করেও উদ্ধার করা গেল না কবে তাঁর জন্মদিন। কেউ ঠিক ভাবে বলতেও পারল না কোথায় তাঁর সমাধিক্ষেত্র। ফলে আজও অজ্ঞাত রয়ে গেছে সেই সব। তা বলে এই নয় যে, তিনি খুব কষ্টে ছিলেন। হ্যাঁ, চরম আর্থিক সংকটের মধ্যে থাকলেও, এই আলাভোলা উইলিয়াম ব্লেক কিন্তু তাঁর জীবদ্দশায় খুব সুখী ছিলেন। কারণ, তাঁর স্ত্রী ক্যাথরিন সোফিয়া বুচার তাঁকে দিয়েছিলেন প্রাণ ভরা ভালবাসা আর প্রচণ্ড প্রশ্রয়। তাই দ্বিধাদ্বন্দ্বহীন এই কবি নিজের মতো করে একটা জগত তৈরি করে নিতে পেরেছিলেন। হাজার অভাব অনটনের মধ্যে থাকলেও তিনি ছিলেন সদা হাস্যময়। আনন্দময়।