-লেখক ড. সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায়
শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত কে না পড়েছে! তার প্রথম পর্ব শুরু হচ্ছে এক ফুটবল ম্যাচের কথা ব’লে; “ইস্কুলের মাঠে বাঙ্গালী ও মুসলমান ছাত্রদের ফুটবল ম্যাচ।” অমর কথাশিল্পীর বিখ্যাত এই উপন্যাস বেরিয়েছিল ১৯১৭ সালে। তারপরে একশো বছরের বেশি কেটে গেলেও বাঙালি আর মুসলমান বলার অসঙ্গতি দূর হল কৈ? এখনও দেশের এক সাংসদকে তাঁর সহনাগরিকের কাছ থেকে শুনতে হয়, “অ্যা! মুসলমান! আমি তো ভেবেছিলাম বাঙালি!” দেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির পঁচাত্তর বছর হতে চলল। এখনও বাঙালি মুসলমানকে এদেশে আত্মপরিচয়ের সঙ্কটে পড়তে হয়। সেই সঙ্কটের স্বরূপ নতুন করে উপলব্ধি করা গেল বাঙালি ও মুসলমান নামে একটা সদ্যপ্রকাশিত বই পড়তে গিয়ে।
এই বইয়ের ছ’টি অংশ জুড়ে সেই সত্তাসঙ্কটের কাহিনী, যার জন্য দায়ী আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি। তবে লেখক মইনুল হাসান নিজেই বইয়ের মুখবন্ধে জানিয়েছেন এ-বই তত্ত্ব আলোচনার বই নয়, একান্তই তাঁর ব্যক্তিগত অনুভবের বহিঃপ্রকাশ। সেই প্রসঙ্গেই বোধহয় বইটির লেখকের সঙ্গে একটু পরিচয় করিয়ে দেওয়া দরকার। লেখক তিনবারের সাংসদ; দুবার লোকসভার আর একবার রাজ্যসভার। সাংসদ হয়েছিলেন সি পি আই এম মনোনীত প্রার্থী হিসেবে। তবে বর্তমানে তিনি তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত। এই রাজনৈতিক পরিচয়ের পাশাপাশি এটাও জানানো যাক যে তিনি নিরলস লেখক; তাঁর বহু বই প্রকাশিত। লেখালেখির একটা বড় অংশ জুড়ে বাঙালি মুসলমান সমাজ। সবার সঙ্গে নিজের ভাবনা ভাগ করে নেওয়ার তাগিদ থেকেই তাঁর লেখালেখি। এই মুখ খোলার প্রয়োজন রয়েছে সমাজের স্বার্থেই। তা না হলে সংলাপ রচিত হবে কি করে?
লেখক প্রথমেই প্রশ্ন তুলেছেন, মুসলমানদের বাঙালি না হয়ে ওঠার কারণ কী? তাঁর মতে, সবচেয়ে জোরালো কারণ মুসলমানদের সম্বন্ধে না জানা। পাশাপাশিভাবে দুটো ধর্মের মানুষ শতাব্দীর পর শতাব্দী বাস করলেও মুসলমানদের সম্বন্ধে জানা বড় কম। শুধু জানা কম নয়, জানার চেষ্টাও কম। আর কম জানার থেকে বড় বিপদ বোধ হয় ভুল জানা। সিংহভাগ লোকের ধারণা “মুসলমান মানেই মাথায় টুপি, মুখে দাড়ি, পায়ের পাতার অনেক ওপরে পরা পাজামা। তাদের ভাষা উর্দু। মেয়েরা বোরখা পরে। যুবকরা সন্ত্রাসবাদী হয়।”
এই ভুল ভাঙাতে দরকার বাঙালি মুসলমানকে সঠিকভাবে চেনা আর বাঙালি সংস্কৃতি যে হিন্দু সংস্কৃতি নয় বরং এক মিশ্রিত সংস্কৃতি সেটা বোঝা। অমর্ত্য সেন দীর্ঘদিন ধরে আমাদের নানান পরিচিতির কথা বলছেন। একই সঙ্গে আমরা অনেক পরিচিতিতে চিহ্নিত। কোনও একটা পরিচিতি প্রবল হয়ে গেলেই সংঘাত দেখা দেয়। মইনুল অমর্ত্য সেনের একটা বক্তৃতার সূত্র ধরে জানিয়েছেন, বঙ্গাব্দের সন-তারিখে মিশে আছে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি। আকবরের সময়ে বাংলা সন পুনর্নির্ধারিত হয়েছিল তারিখ-ইলাহির শূন্য বছরকে ধরে, হিসাবটিকে ১৪৭৮ শকাব্দ থেকে হিজরি ৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে পিছিয়ে দিয়ে। যেটা দাঁড়াল তা হল ৯৬৩ পর্যন্ত মুসলমানদের চান্দ্র মাস গণনা। তারপর থেকে হিন্দু সৌর মাস। ফলে তথাকথিত পবিত্র হিন্দু তিথির সঙ্গে মিশে আছে ইসলামিয় অনুষঙ্গ। এই খবর ক’জন রাখেন?
ক’জন খবর রাখেন যে গত কয়েকবছর ধরে পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান সমাজে শিক্ষার অভূতপূর্ব অগ্রগতি ঘটেছে? যদি ভেবে থাকেন, মুসলমান মানে তো মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে তাহলে বলি সে ভাবনা ভুল। ২০১৯ সালে এরাজ্যে মাধ্যমিক স্তরের হাই মাদ্রাসা পরীক্ষার্থী ছিল মোটে ৬৬ হাজার আর মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ছিল দশ লাখেরও বেশি। মুসলমানদের শিক্ষার উন্নতিতে খুব বড় ভূমিকা নিচ্ছে এরাজ্যের নানান প্রান্তে গড়ে ওঠা মিশন। এই মিশন আন্দোলনের পুরোধা নিঃসন্দেহে আল আমীন মিশন। এই মিশনগুলোয় নিয়ম করে আবাসিক পড়াশোনার দৌলতে মুসলমান বাড়ির ছেলে-মেয়েদের কাছে ডাক্তারি-ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ-আই আই টি- তে পড়ার দরজা খুলছে। পড়ার ক্ষেত্রে যদি সহায়ক হয় এই মিশনগুলো তবে চাকরির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অবদান স্কুল সার্ভিস আর কলেজ সার্ভিস কমিশনের। মইনুলের সিদ্ধান্ত, এভাবেই মুসলমানদের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া মধ্যবিত্ত অংশটা আবার ধীরে ধীরে ফিরে আসছে।
মইনুলের সঙ্গে সম্পূর্ণ সহমত হতে পারলে ভাল হত। কিন্তু সে-পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে গবেষণা-প্রত্যাশী এবং চাকরি-প্রত্যাশী উচ্চশিক্ষিত মুসলমান ছাত্রদের সামাজিক মাধ্যমে সাম্প্রতিককালে করা পোস্ট। তাঁরা জানাচ্ছেন, ‘ও বি সি- এ’ সংরক্ষণ চালু হওয়ার পরে অসংরক্ষিত পদে মুসলমানদের নিয়োগপ্রাপ্তি দুর্লভ হয়ে গেছে। ‘ও বি সি- এ’ সংরক্ষণেও মুসলমানরাই যে শুধু সংরক্ষণের সুযোগ পাচ্ছেন তাও নয়। ফলে বঞ্চনার ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। এই বিষয়টি মইনুল নজর করেন নি।
তবে মইনুল সঠিকভাবেই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, শহরাঞ্চলে মুসলমানদের বাড়ি পাওয়ার সমস্যার দিকে। শিক্ষিত সুচাকুরে মুসলমানও শহরের হিন্দু পাড়ায় বাড়ি ভাড়া পান না। সরকারি আবাসন ছাড়া ফ্ল্যাট কেনাও তাঁদের পক্ষে সহজ হয় না। উদারতা আর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে বড় বড় বক্তৃতা দেওয়া লোকেরা তাঁদের কলকাতা শহরে পার্ক সার্কাস বা খিদিরপুরে বাসা খোঁজার উপদেশ দেন!
লেখক দেখিয়েছেন এরাজ্যের মূলধারার সমাজ-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে বাঙালি মুসলমানেরা একরকম ব্রাত্য হয়েই আছেন। সাহিত্যের আঙিনায় মুসলমান সাহিত্যিক শুধু যে কম তাই নয়, এবাংলার সাহিত্য আর সংবাদপত্রেও অবহেলিত থাকে মুসলমান সমাজ। তার সমস্যা-কৃতিত্ব- উৎসবের কাহিনী কোথাওই ‘বিষয়’ হয়ে ওঠে না, না খবরের কাগজে, না সাহিত্যে।
তবে মইনুল একথাও বলেছেন যে “সব হিন্দু জনগণের দোষ, আর মুসলমানরা ধোয়া তুলসীপাতা তা কিন্তু নয়। তাদেরও অনেক দোষ আছে।” সেই কবে ‘শাশ্বত বঙ্গ’তে আব্দুল ওদুদ লিখেছিলেন, “মুসলমান সমাজের কর্মকর্তারা যে কী আশ্চর্যভাবে পাষাণ-প্রতিমার সেবক পাণ্ডাদের মতো পাষাণচিত্ত হয়ে পড়েছেন। …মানুষের মাথায় কতকগুলো বিধি-নিষেধ ছুঁড়ে মেরেই আল্লাহ-র সৈনিক হওয়ার গৌরব তাঁরা উপলব্ধি করতে চান।” এই অবস্থার হাল ফেরাতে দরকার সম্পর্ক-সেতু নির্মাণ। বিশ্বভারতীতে প্রদত্ত আব্দুল ওদুদের বক্তৃতার সংকলনের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “এদেশে হিন্দু-মুসলমান-বিরোধের বিভীষিকায় মন যখন হতাশ্বাস হয়ে পড়ে, এই বর্বরতার অন্ত কোথায় ভেবে পাই না, তখন মাঝেমাঝে দূরে দূরে সহসা দেখতে পাই দুই বিপরীত কুলকে দুই বাহু দিয়ে আপন করে আছে এমন এক-একটি সেতু”। সেই সেতু ছিল আব্দুল ওদুদের উদার ভাবনা। মইনুলের এই বইটিও কি এমন এক সেতু হয়ে উঠতে পারে না?
লেখক মইনুল হাসান এর ‘বাঙালি ও মুসলমান’ বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছে এপ্রিল ২০২১, উদার আকাশ প্রকাশনী থেকে। বইটি মূল্য–১৫০ টাকা।