লেখক: মারসেল এইম
অনুবাদক: ড. সৌমিত্র চৌধুরী
প্যারিসের কাছেই এক পাহাড়ি শহর, মমার্ত্রে। সেখানকার ৭৫/১/২ অরচ্যাম্পট রোড। সেই ঠিকানায় ছোট্ট এক ফ্ল্যাট। থাকতেন এক শান্তশিষ্ট ভদ্রলোক, দ্যুতিলো। অসাধারণ এক ক্ষমতা ছিল তাঁর। অবলীলায় দেওয়াল ভেদ করে ওপারে চলে যেতে পারতেন। পেশায় সরকারী নিবন্ধীকরণ দফতরের তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী। মুখে ছাগল দাড়ি। ডাটি বিহীন গোল চশমা নাকে ঠেসিয়ে অফিসে যেতেন। শীতকালে বাসে চাপতেন আর গরম পড়া শুরু হলে পায়ে হেঁটেই অফিসে যেতেন। মাথায় থাকতো ধুচুনি টুপি, ক্রিকেটের ময়দানে বোলাররা যেমন পড়ে।
সদ্য বেয়াল্লিশ পেরনো বয়সে নিজের মধ্যে এক অসাধারণ শক্তির স্ফুরণ আবিষ্কার করলেন দ্যুতিলেো। সেদিন হয়েছিল কি, সন্ধ্যা বেলা নিজের ব্যাচেলার-ফ্ল্যাটের ছোট্ট হলঘরে দাঁড়িয়েছিলেন। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল, অন্ধকার। বন্ধ অপরিসর ঘরে পায়চারি করছিলেন। যখন বিদ্যুৎ এল, দ্যুতিলো অবাক। তিনি তাঁর ফ্ল্যাটের বাইরে সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এ দাঁড়িয়ে আছেন। দরজা তো ভিতর থেকে বন্ধ, তাহলে হঠাৎ ঘটল কী? মাথা খাটিয়ে ব্যাপারটার কোন ব্যাখ্যা খুঁজে পেলেন না। তবুও ভাবলেন, আচ্ছা যে ভাবে বাইরে এলাম, সে ভাবেই কি বন্ধ ঘরে ঢুকতে পারবো? আশ্চর্য ব্যাপার, সে ভাবেই বন্ধ ঘরের ভিতর অনায়াসে সেঁধিয়ে গেলেন দ্যুতিলো। বুদ্ধিতে ব্যাখ্যা চলেনা এমন কোন ক্ষমতার অধিকারী হতে তিনি কোনদিনই চাননি। যা ঘটল সে সব দেখে এক ধরণের বিরক্তি এবং আচ্ছন্নতার মধ্যে বসে রইলেন তিনি।
পরদিন ছিল শনিবার। শনি–রবি দু’দিনই অফিস ছুটি। দেরি না করে শনিবার সকালেই ডাক্তারের চেম্বারে নাম লেখালেন দ্যুতিলো। তার কথা শুনে ডাক্তার বললেন, ‘আমি মানছি আপনি যা বলছেন, সব সত্যি’। তারপর একগাদা পরীক্ষার পর ডাক্তার রোগের কারণ খুঁজে পেলেন। দ্যুতিলোর থাইরয়েড গ্রন্থি বড় হয়ে হেলিক্সের মতন পেঁচিয়ে শক্ত হয়ে উঠেছে। সুস্থ হবার উপায় বাতলে দিলেন ডাক্তার। প্রচুর ঘাম ঝরাতে হবে। বিস্তর খাটা-খাটনি আর মেহনতের সাথে প্রয়োজন ওষুধ খাওয়া। বছরে দু’বার চালের গুঁড়ো আর অশ্বমানবীর হরমোনের সাথে মিশিয়ে টেট্রা ভ্যালেন্ট পাইরেট পাউডার গিলতে হবে। ডাক্তারের উপদেশ মত এক ডোস ওষুধ খেলেন দ্যুতিলো। বাকিটা ড্রয়ারের পিছন দিকে ঢুকিয়ে রাখলেন। যথারীতি একদিন ওষুধটার কথা ভুলেই গেলেন ।
চাকরীর প্র্যাত্যহিক কাজে খাটা খাটুনীর তেমন সুযোগ নেই। নিজেকে ব্যস্ত রাখতে অবসর সময়ে তিন বার করে খবরের কাগজ পড়া শুরু করলেন দ্যুতিলো। সাথে ডাকটিকিট জমানোর নেশাটা আবার ধরলেন। এসব কাজে অনেকটা শক্তি ঝড়িয়ে ফেললেও, দেখা গেল এক বছর পরও তার অসাধারণ ক্ষমতা সম্পূর্ণ অটুট। অবশ্য এই ক্ষমতার ব্যবহার তিনি আদৌ করতেন না। ক্ষমতা প্রয়োগ করে কোন রকম অ্যাডভেঞ্চার দেখানোর উৎসাহ তার হত না। তেমন বাসনা ঘুনাক্ষরে মনে এলেও তিনি চেপে রাখতেন। নিজের বন্ধ ফ্ল্যাটে দেওয়াল ভেদ করে ঢুকবার ইচ্ছাকে তিনি আমলই দিতেন না। চাবি ঘুরিয়ে তালা খুলেই তিনি ফ্ল্যাটে ঢুকতেন।
স্বভাবসিদ্ধ অভ্যাস গুলো নিয়ে নিরুপদ্রবে জীবন কাটিয়ে দিতে পারতেন তিনি। কিন্তু তার শান্তিপূর্ণ দিন যাপনে বাধ সাধল হঠাৎ করে জীবনে নেমে আসা এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা। অফিস ডিরেক্টর মঁসিয়ে মুরন বদলী হয়ে গেলেন এবং তার যায়গায় এলেন মঁসিয়ে লেক্যুয়ার। ভদ্রলোকের ঠোঁটের উপর টুথ ব্রাশের মতন এক জোড়া গোঁফ। ছোট ছোট বাক্যে কাটা কাটা কথা বলেন। প্রথম দিনই দ্যুতিলোর ছাগলদাড়ি আর চোখে মান্ধাতা আমলের ডাটি বিহীন গোল চশমা দেখে বিরক্তিতে চোটে উঠলেন নোতুন অফিস ডিরেক্টর। এমন ব্যবহার করলেন যেন দ্যুতিলো একটা মহা আপদ, জাদুঘর থেকে উঠে আসা আস্ত একটা শো-পিস।
মঁসিয়ে লেক্যুয়ার এক বড় কাজে হাত দিলেন। অফিসের আগা পাস্তালা সংস্কারে ব্রতি হলেন। সবাই মনে করল মানুষটির আসল উদ্দেশ্যই হচ্ছে অধস্তন কর্মচারীদের পেছনে লাগা, তাদের শান্তির দফারফা করে দেওয়া। যেমন কুড়ি বছরের চাকরি জীবনে দ্যুতিলো এরকম কায়দাতেই চিঠি লিখে আসছে, ‘আপনার বর্তমান মাসের বারো ১২ তারিখের মূল্যবান চিঠির প্রত্ত্যুত্তরে এবং আমাদের পূর্বের জবাবের প্রেক্ষিতে আমি আপনাকে অবগত করতে সম্মানিত বোধ করছি যে…।’ মঁসিয়ে লেক্যুয়ার চিঠির এই বয়ান পরিবর্তন করে এরকম লিখতে নির্দেশ দিলেন, ‘আপনার ১২ তারিখের চিঠির প্রত্ত্যুত্তরে জানাই যে..’। নোতুন কায়দা মেনে নিয়ে চিঠি লেখায় অভ্যস্ত হতে পারলেন না দ্যুতিলো। তিনি গোঁ ধরে থাকলেন এবং আগের কায়দাতেই চালাতে লাগলেন চিঠির জবাব লেখা। ফলে নোতুন ডিরেক্টরের চক্ষুশূল হয়ে উঠলেন দ্যুতিলো। ক্রমশ অনুভব করলেন নিবন্ধীকরণ দফতরের পরিবেশটাই দমন মূলক হয়ে উঠছে। সকালে কাজের সময় কেমন যেন সন্ত্রস্ত হয়ে থাকতেন তিনি। রাত্তিরে বিছানায় শুয়ে অন্তত পনের মিনিট ধরে উল্টো পাল্টা ভাবতেন, তারপর এক সময় ঘুমিয়ে পরতেন।
মঁসিয়ে লেক্যুয়ার দ্যুতিলোর উপর বিরক্তিতে ফুঁসছিলেন। জেদ ধরে পিছিয়ে থাকবো, নোতুন কিছু শিখবোনা—দ্যুতিলোর অনড় মনোভাবের জন্য সংস্কার প্রক্রিয়াটাই মার খাবে! তাই দ্যুতিলোকে সরিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিলেন উপরওয়ালা তথা সহকারী নির্দেশক মঁসিয়ে লেক্যুয়ার। দ্যুতিলোর চেয়ার-টেবিল অফিস ঘরের বাইরে আবর্জনা ভর্তি ছোট্ট একটা ঘিঞ্জি ঘরে পাঠিয়ে দিলেন তিনি। করিডোর লাগোয়া ঘুপচি ঘরে ছোট দরজা ঠেলে নিচু হয়ে ঢুকতে হয়। ঘরের বাইরে দরজায় বড় করে লেখা–‘আবর্জনা’। নোংরা আর আবর্জনায় ঠাঁসা ঘরে ঢুকে প্রচণ্ড অপমানিত বোধ করলেও, মুখ বুজে সব হজম করলেন দ্যুতিলো । কিন্তু বাড়িতে বসে খবরের কাগজে কোন মারদাঙ্গা মৃত্যু সংবাদ দেখলেই দ্যুতিলো ভাবতেন, লেক্যুয়ার বদমাশটারই যেন মরন হয়।
একদিন হন্তদন্ত হয়ে হাতে একটা চিঠি নিয়ে দ্যুতিলোর ঘরে ঢুকলেন মঁসিয়ে লেক্যুয়ার। গলা ফাটিয়ে চিঠিটা বারিয়ে ধরে গর্জন করে উঠলেন, ‘এখনই এটা ঠিক করে দিন। ওঃ, আমার দফতরের বদনাম করে দেবে আপনার এই জঘন্য চিঠি। একটা ঘৃণ্য লোক মশাই আপনি, একটা ঘিনঘিনে আরশোলা’!
রুখে উঠতে চাইলেন দ্যুতিলো। তখনই লেক্যুয়ার হাতের চিঠিটা দুমরে মুচরে দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে মারলেন দ্যুতিলোর মুখের উপর।
ভদ্র এবং মার্জিত ভঙ্গীমায় চেয়ারে বসে পড়লেন দ্যুতিলো। ছোট্ট ঘরে চুপচাপ বসে ফুঁসতে থাকলেন। হঠাৎ বুকের গভীরে অন্য একটা সাড়া পেলেন। চেয়ার থেকে উঠে দেওয়ালের কাছে গেলেন। দেওয়ালের ওপারেই মঁসিয়ে লেক্যুয়ারের অফিসঘর। খুব সাবধানে শরীরের অর্ধেকটা দেওয়ালের ভিতর দিয়ে গলিয়ে দিলেন দ্যুতিলো। দেহটা রইল নিজের ঘরে, মাথাটা ওপারে। অফিসের চেয়ারে বসে অন্য এক কর্মচারীর অনুমোদনের জন্য রেখে যাওয়া চিঠিতে তখন একটা ‘কমা’ সরিয়ে দেয়ার জন্য কলম চালাচ্ছিলেন মঁসিয়ে লেক্যুয়ার। হঠাৎ তার কানের কাছে কে যেন কেশে উঠলো। মুখ তুলতেই কেঁপে উঠলেন লেক্যুয়ার। শিকার করা জানোয়ারের একটা কাটা মুণ্ডু কেউ যেন টাঙ্গিয়ে রেখেছে দেওয়ালে। আরও আশ্চর্য, মুণ্ডুটা জীবন্ত। মঁসিয়ে লেক্যুয়ার মুখ তুলে দেখলেন, ছাগলদাড়ি একদৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে, মুখে এক রাশ ঘৃণা। নাকে ডাটি বিহীন গোল-চশমা-লোকটা কথাও বলছে, ‘আরে মঁসিয়ে, ইতর ছোকরা, তুমি একটা আস্ত বদমাশ’।
ওই ভূতুরে মুখের দিকে হাঁ-করে তাকিয়ে ভয়ে কাঁপতে লাগলেন মঁসিয়ে লেক্যুয়ার। চেয়ারে চেপে বসে আছেন। দৃষ্টি অনড়। অনেক চেষ্টা করে চেয়ারের সাথে লেপ্টে থাকা শরীরটা টেনে করিডোরে লাফ মাড়লেন। তারপর সোজা ছোট্ট ঘিঞ্জি ঘরটায়। আশ্চর্য ব্যাপার! দ্যুতিলো নিজের জায়গায় বসে। হাতে কলম। শান্ত পরিশ্রমী চেহারা। এক দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে বিজবিজ করলেন মঁসিয়ে লেক্যুয়ার। তারপর ফিরে এলেন নিজের ঘরে। চেয়ারে বসতে না বসতেই আবার ওই ছাগলদাড়ি মুখটা দেওয়ালে ভেসে উঠল। তারপর আবার সেই স্বর– ‘আরে মঁসিয়ে, ইতর ছোকরা, তুমি একটা আস্ত বদমাশ’।
এই ভয়ংকর মুখটাই সেদিন দেওয়ালে ভেসে উঠল তেইশ বার। পরের দিনও একই রকম চললো। তবে দ্যুতিলো এবার অনেক ভদ্র। গলা উঁচিয়ে কোন খিস্তি ঝাড়ল না। শুধু হাল্কা চালে হাসতে হাসতে একটু হুমকি দিল — নেকড়ে শিকার খুঁজছে। সব যায়গায় তার নজর। সাবধান! কেউ বাঁচবে না।
এ কথা কানে ঢুকলেই মিইয়ে যাচ্ছে সহ অধিকর্তা। গলা বুজে আসছে। খাড়া হয়ে উঠছে মাথার চুল। হিম শীতল ভয়ে শরীর ভিজে একসা। শিরদাঁড়া দিয়ে টপটপ করে নামছে ঘাম। এক দিনেই অনেকটা শুকিয়ে গেল মসিয়ে লেক্যুয়ার। পাক্কা এক পাউন্ড ওজন ঝরে গেল। এক সপ্তাহের মধ্যেই অফিসের সহ অধিকর্তা জুবু থুবু মার্কা হয়ে গেলেন। সুপ খেতে কাঁটাচামচ ধরছেন আর কোন পুলিশ দেখতে পেলেই মিলিটারি কায়দায় স্যালুট ঠুকছেন। দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরুতে একটা অ্যাম্বুলেন্স তাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে স্বাস্থ্যনিবাসে ভর্তি করিয়ে দিল।
মঁসিয়ে লেক্যুয়ারের অত্যাচার থেকে মুক্ত হয়ে দ্যুতিলো আবার আগের মত নিজের কর্মক্ষেত্রে। পুরানো কায়দাতেই অফিসের চিঠি লেখা শুরু করলেন, ‘আপনার বর্তমান মাসের ২৭ তারিখের মূল্যবান চিঠির প্রত্ত্যুত্তরে এবং আমাদের পূর্বের জবাবের পরিপেক্ষিতে আমি আপনাকে অবগত করতে সম্মানিত বোধ করছি যে…’। নিজের অফিসে ফিরে মর্জি-মাফিক চলবার অধিকার পেয়েও মনের গভীরে একটা অসন্তোষ অনুভব করতে লাগলেন দ্যুতিলো একটা অচরিতার্থ আকাঙ্খা ক্রমাগত চাগিয়ে উঠছিল নিজের ভিতর। দ্রুত চাহিদা পুরনের এক প্রবল বাসনা পেয়ে বসল তাকে এবং সেটা দেওয়ালের ভিতর দিয়ে ওপারে পৌঁছে যাবার ইচ্ছে।
খুব সহজে বাড়িতে বসেই এই আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারতেন তিনি। দেড়ি না-করে করলেনও তাই। কিন্তু যে মানুষ অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী, তিনি কখনই সাধারণ কাজে নিজেকে সন্তুষ্ট রাখতে পারেন না। দেওয়াল ভেদ করে ওপারে পৌঁছে যাবার মধ্য দিয়ে কোন বাসনা তো পূরণ হয় না। এই ক্ষমতা ব্যবহার করে কোন রোমাঞ্চকর কাজ করা যেতে পারে। তারপর সেটার অনুশীলন চালিয়ে যাওয়া। ক্রমশ উন্নততর কায়দায় ক্ষমতা ব্যবহার করে ভালো উপার্জনও করা সম্ভব। নিজেকে আরও ছাপিয়ে যাবার কথা ভাবলেন দ্যুতিলো। উত্তরোত্তর তার আকাংখ্যা—দেওয়ালের ওপারে পৌঁছে যাবার দুর্বার টান, অম্লমধুর এক আকর্ষণ, অনুভব করতে লাগলেন দ্যুতিলো।
দুর্ভাগ্যের কথা, দ্যুতিলোর নির্দিষ্ট কোন নির্দিষ্ট লখ্য ছিল না। খবরের কাগজের ঘটনা গুলো পড়ে তিনি কিছু করবার উপায় খুঁজতে লাগলেন। খুব সম্মানজনক কাজ ভেবে তিনি প্রথমে মনোযোগ দিলেন খেলা এবং রাজনীতির খবরে। এই জাতীয় সংবাদ পড়েই বুঝতে পারলেন, দেওয়াল ভেদ করে চলে যাবার ক্ষমতা দেখিয়ে এসব ফিল্ডে তেমন সুবিধা করা যাবেনা। এরপর, খবরের কাগজে পুলিশ ডায়েরির পাতায় মনোযোগ দিলেন তিনি। কোথায় ক’টা ডাকাতি খুন জখম রাহাজানি হয়েছে, সব খুঁটিয়ে পড়ে নিজের ক্ষমতা সদ্ব্যবহারের উপায় খুঁজে পেলেন দ্যুতিলো।
ব্যাঙ্ক ডাকাতিটা ঘটল বিখ্যাত রাইট ব্যাঙ্কে। অসংখ্য দেওয়াল আর ছোট ছোট খুপরি ভেদ করে দ্যুতিলো পৌঁছে গেছিলেন ভল্টের সামনে। তারপর ব্যাঙ্কের টাকায় দু’হাতে নিজের পকেট ভর্তি করে ফেললেন। ব্যাঙ্ক থেকে বেড়িয়ে আসবার আগে লাল চক দিয়ে নিজের ছদ্মনাম—‘নিঃসঙ্গ নেকড়ে’, লিখে রেখে গেলেন দ্যুতিলো। পরের দিন সব খবরের কাগজে ‘নিঃসঙ্গ নেকড়ে’ হেডিং দিয়ে সারম্বরে খবর ছাপা হল। সপ্তাহ খানেকের মধ্যে ‘নিঃসঙ্গ নেকড়ে’ এক সেলিব্রিটি বনে গেল। সমাজের এক নামী লোক। পুলিশকে অপদার্থ বানিয়ে সেই মানুষ জনসাধারণের সহানুভূতি কুরোতে লাগল।
কখনও তার আক্রমণ ব্যাঙ্ক, কখনও অলঙ্কারের দোকান আবার কখনও ধনী লোকের বাড়ি। নিত্য নোতুন ঘটনা ঘটিয়ে খুব বিখ্যাত হয়ে উঠলেন দ্যুতিলো। প্যারিস থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চল জুড়ে এমন কোন মহিলা ছিলনা যে একবারও কল্পনায় ‘নিঃসঙ্গ নেকড়ের’ সাথে ঘনিষ্ঠ ভাবে মিলিত হয়নি।
এক সপ্তাহের মধ্যে পর পর দুটো ঘটনা। বিখ্যাত বারদিগালা হিরে চুরি আর শহরের পূর্ত দফতরে ডাকাতি। মানুষের বাঁধভাঙা উচ্ছাস তুঙ্গে পৌঁছে গেল। আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা দফতরের মন্ত্রী পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন সেই সঙ্গে নথীকরন দফতরেরও দুর্নাম রটল। এসবের মধ্যে দ্যুতিলো প্যারিসের এক অন্যতম ধন কুবের বনে গেলেন।
ঠিক সময়ে অফিসে গিয়ে মন দিয়ে নিজের কাজ কর্ম করেন দ্যুতিলো। ভালো কাজের স্বীকৃতি হিসাবে তার হাতে জাতীয় পুরস্কার তুলে দেবার কথা বিবেচনা করছে শিক্ষা দফতর। প্রতিদিন দফতরে এসে সহকর্মীদের আলোচনায় গত রাতের লুটপাটের প্রসঙ্গ ওঠে। ওদের কথায় খুব মজা পান দ্যুতিলো। ‘জানো গতকাল নিঃসঙ্গ নেকড়ে কী কাণ্ড ঘটিয়েছে! দারুন লোক ও, অতিমানব। অসাধারণ প্রতিভা’– এসব শুনতে শুনতে লজ্জায় লাল হয়ে উঠতেন দ্যুতিলো। বন্ধুত্ব ও কৃতজ্ঞতায় গোল চশমার ওপারে জ্বলজ্বল করে উঠত তাঁর দু’চোখ।
উৎসাহ আর সহানুভূতির আবহে, দ্যুতিলো বুঝতে পারলেন, নিজেকে আর বেশি দিন গোপন রাখা যাবেনা। সেদিন খবরের কাগজ ঘিরে সহকর্মীরা ব্যাঙ্ক অফ ফ্র্যান্সে ডাকাতির রোমহর্ষক ঘটনার কথা পড়ছিলেন। লাজুক মুখে ওদিকে তকিয়ে সত্যি কথাটা বলেই দিলেন দ্যুতিলো, ‘আরে, যাই হ’ক, আমিই তো নিঃসঙ্গ নেকড়ে’। দ্যুতিলের স্বীকারোক্তি শুনে ব্যাঙ্গের সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। পরিহাস করে সহকর্মীরা তাকে ‘নিঃসঙ্গ নেকড়ে’ বলে ডাকা শুরু করল। রাত্রিতে কাজের পর বাড়ি ফেরার সময় গুচ্ছের টিটকারি আর বিদ্রূপের লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠেছিলেন দ্যুতিলো। বেঁচে থাকার আনন্দটাই মাটি হয়ে যাচ্ছিল ।
ক’দিন পর প্যারিসের বিখ্যাত শপিং সেন্টার ‘দি রু ডে-লা-পে’ তে রাতের পাহারাদারদের হাতে ‘নিঃসঙ্গ নেকড়ে’ ধরা পরে গেল। সেল কাউন্টারে নিজের পরিচয় লিখে মত্ত অবস্থায় গান গাইতে গাইতে একটা প্রাচীন সোনার পানপাত্র দিয়ে দোকানের কাঁচ ভাঙছিল ও। ইচ্ছে করলেই পাহারাদারদের নজর এড়িয়ে দেওয়াল ভেদ করে পালিয়ে যেতে পারত। কিন্তু তার চেষ্টা না করে সে হয়ত নিজেকে প্রকাশ করতেই স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছিল। সহকর্মীদের তাছিল্য আর অবিশ্বাস সহ্য হচ্ছিল না তার।
পরদিন খবরের কাগজের প্রথম পাতায় দ্যুতিলোর ছবি দেখে অফিসের সহকর্মীরা হতবাক। এত কাছের বন্ধুকে ভুল বুঝে তারা আত্মযন্ত্রণায় বিদ্ধ হতে থাকল। তাকে সন্মান জানাতে সহকর্মীরা নিজেদের থুতনিতে ছাগলদাড়ি রাখা শুরু করল। কেউ কেউ আবার প্রশংসা ও দুঃখে এতটাই গলে গেল যে আত্মীয়-বন্ধুদের দামী ঘড়ি বা ব্যাগ হাতানোর চেষ্টা শুরু করে দিল।
কেউ ভাবতে পারে, কয়েক জন সহকর্মীকে অবাক করে দিতে পুলিশের হাতে ধরা দেওয়ার মত হঠকারিতা দ্যুতিলওর মত ক্ষমতাবান মানুষের পক্ষে শোভা পায়না। স্বেছায় নেওয়া এমন একটা সিদ্ধান্ত তার ক্ষমতার সঙ্গে একদমই বেমানান। দ্যুতিলো ভেবেছিলেন যে ইচ্ছাশক্তির হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে কোথাও যেন তিনি একটা বদলা নিতে পেরেছেন। বাস্তবিক, তিনি ভাগ্যের হাতে ধীরে ধীরে পর্যুদস্ত হতে চলেছেন। একটা মানুষ যখন দেওয়াল ভেদ করে চলে যেতে পারে সে কখনই পুলিশের হাতে, অন্তত একবার ধরা না দিলে নিজের কর্মকাণ্ড প্রকাশ করতে পারবে না।
‘লা সান্তে’ জেল খানায় ঢুকে দ্যুতিলো অনুভব করলেন, এবার যেন ভাগ্যলক্ষ্মী তার দিকে মুখ তুলে চেয়েছেন। জেলখানার মোটা প্রাচীর ভেদ করে আরামেই বেড়িয়ে যাওয়া যাবে। পরদিন সকালে জেলের প্রহরীদের নজরে এল, কারা কক্ষের দেওয়ালে কয়েদি একটা পেরেক ঢুকিয়ে, পেরেকের গায়ে ঝুলিয়ে রেখে গেছে স্বয়ং জেল রক্ষকের সোনালি পকেট ঘড়িটা। এটা বন্দীর হাতে এল কী ভাবে, প্রহরীরা বুঝতেই পারল না। ঘড়ির মালিকের কাছে জিনিসটা পৌঁছে দেওয়া হল। পরদিন আবার নেকড়ের জেলকক্ষে থ্রি-মাস্কেটিয়ার্স বইটার পাশে ওই ঘড়িটা দেখা গেল। বইটা জেল রক্ষকের ব্যক্তিগত আলমারি থেকে আনা। এসব কাণ্ড-কারখানায় জেল-কর্মচারীরা একদমই ঘাবড়ে গেল। তার উপর অনেক জেল গার্ড আবার যখন তখন পেছনে লাথি খাচ্ছে। শূন্য থেকে ধেয়ে আসছে সে সব কিক। দেওয়ালের কান আছে বলা হয়, এখন দেখা যাচ্ছে দেওয়ালের পা-ও আছে। এক সপ্তাহ ধরে নিঃসঙ্গ নেকড়ে জেল খানায় আছে। এর মধ্যে জেল-রক্ষক একদিন অফিসে ঢুকেই দেখল, টেবিলের উপর একটা চিঠি পড়ে আছে।
‘প্রিয় জেল রক্ষক মহোদয়,
বর্তমান মাসের সতের তারিখের আমাদের কথোপকথনের প্রত্ত্যুত্তরে এবং আপনার ১৫ তারিখের সাধারণ নির্দেশের পরিপেক্ষিতে আমি আপনাকে অবগত করতে সম্মানিত বোধ করছি যে… আমি থ্রি মাস্কেটিয়ার্স-এর দ্বিতীয়খণ্ড অধ্যয়ন এই মাত্র সমাপ্ত করলাম। আমি আজ রাত ১১-২৫ হইতে ১১.৩৫ ঘটিকার মধ্যে জেলখানার বাইরে প্রস্থান করবো।
ইতি,
শ্রদ্ধাবনত আপনার
নিঃসঙ্গ নেকড়ে’।
রাতে সতর্ক পাহারা স্বত্বেও ঠিক ১১-৩০ এ দ্যুতিলো জেল থেকে পালিয়ে গেল। পরদিন খবরটা জানাজানি হতেই সব যায়গার মানুষ উত্তেজনায় ফেটে পড়ছে। এর পর আরেকটা বড় ডাকাতির পর যখন দ্যুতিলো খ্যাতির মধ্যগগণে, তখন আর লুকিয়ে থাকবার চেষ্টা করতেন না। মমার্ত্রে শহরের রাস্তায় কোন রকম সাবধানতা ছাড়াই খোলামেলা ঘুরে বেড়াতেন। জেল পালানোর তিন দিনের মাথায় কলিন কোর্ট সরণীর কাফে ডু রেভেতে দুপুরের একটু পরেই ধরা পড়ে গেলেন দ্যুতিলো। তখন বন্ধুদের সাথে লেবুর রস মিশিয়ে মদ্যপান করছিলেন তিনি।
‘লা সান্তে’ জেল খানায় আবার চালান হলেন দ্যুতিলো। তাকে জেলের ছোট্ট একটা কুঠুরিতে ঢুকিয়ে দরজায় তিনটে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হল। তবুও সেখান থেকে পালিয়ে জেল রক্ষকের বাড়ির অতিথি কক্ষে রাত কাটালেন। সকালে ঘণ্টা বাজিয়ে পরিচারিকাকে ডেকে আদেশ দিলেন, ‘আমার খাবার আনো’।
রক্ষীদের ডাকা হোল। দ্যুতিলো বিছানার যেখানে বসেছিল সেখানেই তাকে জাপটে ধরল রক্ষীরা। দ্যুতিলো বাধা দিল না। রেগে আগুন হয়ে আছেন জেল রক্ষক। জেলের বদ্ধ খুপরিতে দ্যুতিলোকে ঢুকিয়ে বাইরে কড়া পাহারার ব্যাবস্থা করলেন। সামান্য খাদ্য—রুটি আর জল, বরাদ্য হোল তার জন্য। দুপুর বেলা জেলের কাছেই একটা রেস্টুরেন্টে খাবার খেতে ঢুকলেন দ্যুতিলো। খাবারের পর কফি শেষ করে ওখান থেকেই জেল রক্ষককে ফোন করলেন, ‘হ্যালো জেল রক্ষক, আমি আপনাকে বিরক্ত করা মোটেই পছন্দ করি না। কিন্তু আপনার ওখান থেকে বেরোবার সময় আপনার মানি ব্যাগটা আনা হয়নি। এখন আমি রেস্টুরেন্টে বসে আছি। আপনি তাড়াতাড়ি কাউকে পাঠিয়ে খাবারের বিলটা মিটিয়ে দেবার ব্যাবস্থা করুন’।
জেল রক্ষক নিজেই হাজির। মাথা গরম করে কড়া গলায় দ্যুতিলোকে ধমকাতে লাগলেন। আঁতে ঘা লাগল দ্যুতিলোর। পরদিন রাতে জেল থেকে একেবারে পালিয়েই গেলেন।
এবার অনেক সাবধান হয়ে গেলেন দ্যুতিলো। ছাগল দাড়ি কামিয়ে ফেললেন পুরোপুরি। আগের সেই ডাটি বিহীন গোল চশমা বাদ দিয়ে শিং দিয়ে তৈরি গোল রিমের চশমা কিনলেন। স্ট্রাইপ জামা আর গলফ প্যান্ট পরে মাথায় দামি টুপি চাপিয়ে দ্যুতিলো এখন অন্য মানুষ। নোতুন ফ্ল্যাট কিনে চলে এলেন জুনো এভেনিউ। আগের বাড়ির কিছু জিনিস, প্রথম বার জেলে যাবার আগে যেসব দামি আসবাব ছিল, সঙ্গে নিয়ে এলেন।
নোতুন খ্যাতির ঠ্যালায় ক্লান্ত হয়ে উঠতে লাগলেন দ্যুতিলো। লে সান্তে জেল খানায় থাকার সময় থেকেই দেওয়ালের ভিতর দিয়ে হাঁটা সম্পর্কে বীতস্পৃহ হয়ে উঠেছিলেন। প্রচণ্ড চওড়া ও জবরদস্ত দেওয়ালও তাঁর কাছে গোটানো পর্দা বলে মনে হত। আরও বড় কিছু, যেমন মিশরের পিরামিড, তার দেওয়ালে ঝাঁপিয়ে পড়া — এ ধরনের ইচ্ছে হত। সেই দিনগুলো, যখন মিশরে যাবার পরিকল্পনা করছেন, খুব সুন্দর ছিল। অত্যন্ত শান্তিতে সময় কাটছিল। ডাকটিকিট জমানো, সিনেমা দেখা আর মমার্ত্রে শহরের দীর্ঘ রাস্তা ধরে হেঁটে যাওয়া – এই ছিল কাজ।
পরিস্কার কামানো মুখে শিঙের তৈরি গোল চশমা তার মুখ বদলে দিয়েছে। মুখের পরিবর্তন কারুর চোখে ধরা পড়ত না। প্রিয় বন্ধু পাস দিয়ে হেঁটে গেলেও তাকে চিনতে পারতো না। ব্যাতিক্রম শুধু চিত্রশিল্পী জেঁ পল। দীর্ঘ কাল পরেও কোন প্রতিবেশীর মুখের সামান্য পরিবর্তন তার চোখে ঠিক ধরা পড়ে যেত। দ্যুতিলোকে দেখে চিনে ফেলল জেঁ পল জেন। সেদিন সকালে এল অ্যাভ্রুবারে দ্যুতিলোকে মুখোমুখি দেখে খিস্তি মারল জেঁ, ‘এই বুঢঢা, আমার ইটের দেওয়াল তুমি পর্দা টাঙিয়ে ঢেকে দিয়েছ’’। তারপর হেঁয়ালি ছেড়ে সহজ ভাষায় বলল, ‘তুমি ছদ্মবেশ ধরতে ওস্তাদ হয়ে গেছ দেখছি। টিকটিকি পুলিশ কোন ব্যাটা তোমার নাগাল পাবে না’।
‘ওঃ তুমি চিনে ফেললে আমাকে’? দ্যুতিলো বলল বটে কিন্তু ভিতরে ভিতরে প্রচণ্ড অস্থির চলছে। মিশরে পালাবার ভাবনাটা চাগিয়ে উঠল। আবার সেদিন বিকেলেই সোনালি কেশ এক সুন্দরীর সাথে তার ভাব হয়ে গেল। লেপিক সরণিতে পনের মিনিটের ব্যবধানে দু’বার দেখা। মহিলার রূপের আকর্ষণে সব ওলটপালট। ডাক টিকিট জমানো, মিশর পিরামিড–সব পরিকল্পনা মাথায় উঠল। ডাকসাইটে সুন্দরীও দ্যুতিলোর প্রেমে মজে গেল। পরিস্কার কামানো মুখে শিঙের তৈরি গোল চশমা, পরনে গলফ প্যান্ট এই মানুষটাও স্বর্ণ কেশীর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। সারা রাত ককটেল পার্টি আর হুল্লোরবাজী–দুজনেই এই ভাবনায় মশগুল হয়ে গেল।
কিন্তু প্রেমের পথে বড় বাধা ছিল ভদ্র মহিলার স্বামী। চিত্রশিল্পী জেঁ পল শুনিয়েছিল, মহিলার স্বামী প্রচণ্ড বদরাগী। খুব সন্দেহ বাতিক আর হিংসুটে ধরণের লোক। রাতের প্যারিসে উচ্ছৃঙ্খল অনিয়মিত জীবন যাপনে অভ্যস্ত। রোজ রাত দশটা থেকে পরদিন ভোর চারটে অবধি বাড়িতে নিজের স্ত্রীকে একলা ফেলে রেখে ফুর্তি করতে যায়। যাবার আগে ঘরের দরজায় দু’টো তালা ঝোলাতে কখনো ভোলে না। আর ঘরের শাটার ফেলে তাতেও তালা লাগিয়ে রাখে। দিনের বেলা নিজের স্ত্রীর চলাফেরার উপর নজরদারি চালায়। এমনকি মমার্ত্রের রাস্তায় তাকে অনুসরণও করে।
‘আরে বুড্ডা, তুমি দেখছি এখনও সুন্দরীর ভাবনায় মশগুল হয়ে আছো। ধীরে চল দ্যুতিলো, ধীরে চল। ওই পাখির ছানা ডিনারে জমিয়ে খাবার মত। কোন বিড়াল ওই আংটায় বাঁধা পাখির দিকে নজর দিয়ে যদি মালিকের কাবাবটা বরবাদ করে, মালিক তাকে ছেড়ে দেবে? আস্ত গিলে ফেলবে’।
জেঁ-র সাবধানবানী দ্যুতিলোর প্রেম আরও উস্কে দিল। পরদিন থোলোজ সরণিতে ওই মহিলার সাথে আবার দেখা। দ্যুতিলো সাহস করে তার পিছু নিল। সুন্দরী যখন রুটি নেবার লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল, দ্যুতিলো সরাসরি তাকে বলল, ‘আমি সসম্মানে তোমাকে প্রেম নিবেদন করছি। তোমার ব্যাপারে সব জানি। তোমার নির্দয় স্বামীর কথা, দরজায় আর সাটারে তালা লাগানো – সবই শুনেছি। তুমি চাইলে সব বাধা কাটিয়ে তোমার বন্ধ শোবার ঘরে আজ রাতেই আমি আসতে পারি’।
দ্যুতিলের কথায় উত্তেজনায় থর থর কেঁপে উঠল সুন্দরী। হাতে ধরা বোতল থেকে দুধ ছলকে উঠল। বুক ঠেলে উঠে এল চাপা দীর্ঘ শ্বাস। বলল, ‘না মশায়, একাজ একদম অসম্ভব’।
তারপর, আনন্দের সেই দিন। রাত্রি তখন দশটা। দ্যুতিলো পাহারাদারের মত দাঁড়িয়ে আছেন নরভিন সরনির ধারে। নজরে এক বাড়ির বাগানের দুর্ভেদ্য প্রাচীর। বাগানের ওপারে বাড়ির পিছন দিকের চিমনি আর হাওয়া-পাখি চোখে পড়ছে। এবার দেয়ালের একটা দরজা খুলে গেল। বাইরে বেরিয়ে এল একটি লোক। তার পিছনের দরজাটায় সন্তর্পণে তালা লাগিয়ে জুনো সরণির দিকে পা বাড়াল। লোকটি চোখের আড়াল না-হওয়া পর্যন্ত দ্যুতিলো ঠাই দাঁড়িয়ে রইল। রাস্তাটা ঢালু হয়ে নেমে পাহাড়ের নিচে যেখানে বাঁক নিয়েছে, সেখানে মিলিয়ে যাবার পর দ্যুতিলো এক, দুই… করে দশ গুনল। তারপর অ্যাথলেটিকের ক্ষিপ্রতায় বাড়ির দেওয়ালের দিকে ধেয়ে গেল। বাগানের দুর্ভেদ্য দেওয়াল ভেদ করে যাবতীয় বাধা টপকে শেষমেশ সুন্দরীর ঘরের দেওয়াল ভেদ করে তার শোবার ঘরে ঢুকে পড়ল। আনন্দে উদ্বেল সেই নারী উষ্ণ অভ্যর্থনায় ভরিয়ে দিল দ্যুতিলোকে। পরস্পরের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে ভোর রাত অবধি চলল তাদের প্রনয় লীলা।
দ্যুতিলোর দুর্ভাগ্য, পরদিন শুরু হল তীব্র মাথা ব্যাথা। কিন্তু এই সামান্য ব্যাপারে নিজের প্রেমলীলা বন্ধ রাখবার ভাবনাকে কোন পাত্তাই দিলেন না তিনি। নিজের ড্রয়ার ঘাঁটতে ঘাঁটতে ভিতর দিকে খুঁজে পেলেন দু’টো ট্যাবলেট। সকাল বেলাতেই গিলে ফেললেন একটা। আরেকটা ট্যাবলেট খেলেন বিকেলের দিকে। সন্ধ্যার আগে মাথা ব্যাথা কমে এলে প্রেমিকার উষ্ণ সান্নিধ্যের কথা মনে পড়তে লাগল। দ্যুতিলো বেমালুম ভুলে গেলেন যে সে অসুস্থ, ওষুধের দৌলতে খানিক সুস্থ্য এখন। তাঁর মাথায় পাক খাচ্ছে শুধু সেই সুন্দরীর মুখ। তার অপেক্ষাতেই বসে আছেন সেই মহিলা। গত রাতের মধুর মিলনের স্মৃতি অস্থির করে তুলল দ্যুতিলোকে।
দ্যুতিলো একবারও ভাবলেন না যে গতরাতে ভোর তিনটে অবধি এক সাথে কাটিয়ে দেওয়াল ভেদ করে বেড়িয়ে আসবার সময় ঘাড়ে আর পশ্চাৎ দেশে ভালো রকম আঘাত লেগেছিল। আজ বাগানের মোটা দেওয়াল ভেদ করবার সময় তিনি একটা বাধা টের পেলেন। প্রথমে মনে হচ্ছিল দেওয়ালের ভিতর কোন পিছল পদার্থের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। পদার্থটা জেলির মত হলেও ক্রমশ শক্ত হয়ে উঠছে। যতই ও সামনের দিকে ঠেলে বেরোবার চেষ্টা করছেন, থকথকে পদার্থটা ততই কঠিন হয়ে উঠছে। দেওয়ালের ভিতর সম্পূর্ণ শরীরটা ঢুকে গেলে দ্যুতিলো বুঝতে পারলেন, তিনি আর সামনে এগোতে পারছেন না। প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেলেন। তখনই মনে পড়ে গেল, মাথা ব্যাথার ওষুধ অ্যাসপিরিন ভেবে সে দু’টো ট্যাবলেট গিলে ফেলেছেন। ওগুলো টেট্রা ভ্যালেন্ট পিরেট পাউডার, এক বছর আগে ডাক্তারের দেওয়া ওষুধ।
দেওয়ালের ভিতর গেঁথে গেল তার শরীরটা। সেদিন পাথরের মধ্যে সমাহিত হলেন দ্যুতিলো। প্যারিসের কোলাহল স্তিমিত হয়ে এলে নরভিন রোড ধরে গভীর রাতে হেঁটে যাওয়া মানুষ দুর্ভেদ্য পাথরের দেওয়ালের গভীর থেকে চাপা কণ্ঠস্বর শুনতে পায়। মনে হয় কোন কবর থেকে উঠে আসছে সেই ফিস ফিস আর্তনাদ। মানুষ ভাবে এই আওয়াজ বুঝি মমার্ত্রে শহরের বুকের ভিতর থেকে উঠে আসা বাতাসের মর্মর ধ্বনি। এটা আসলে নিঃসঙ্গ নেকড়ে দ্যুতিলোর অনুশোচনা। একটি মহান কর্মজীবনের অবসান এবং সংক্ষিপ্ত এক প্রেম কাহিনীর পরিসমাপ্তি।
শীতের রাতে চিত্রশিল্পী জেঁ কখনও এই নির্জন রাস্তা ধরে গিটার হাতে নিয়ে গান গাইতে গাইতে হেঁটে যান। কণ্ঠে ধ্বনিত হয় করুণ সুর। পাষাণে বন্দী দ্যুতিলেোর উদ্দেশে গাওয়া সান্তনা গীতি। তার ক্লান্ত আঙ্গুলের মূর্ছনায় জেগে ওঠা সঙ্গীত স্নিগ্ধ জ্যোৎস্না মত পাথরের গভীরে সেঁধিয়ে যায়।
[জাদু বাস্তবতার এক আদর্শ উদাহরণ ফরাসি সাহিত্যিক মারসেল এইম-এর (Marcel Ayme, 1902-1967) এই গল্পটি। রচনাকাল ১৯৪৩। লেখকের রচিত গল্প সংখ্যা ৮০, উপন্যাস ১৭, নাটক ১২। বর্তমান গল্পটি (Man who could walk throug the wall) মূল রচনার (Le Passe মুড়াইলে) অনুবাদ]