জনস্বার্থ বা জনমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠাই জনস্বার্থ মামলার লক্ষ্য এবং আইনের শাসনের ব্যত্যয় ঘটার মধ্য দিয়ে সে অধিকার লঙ্ঘিত হলে জনস্বার্থে মামলার মাধ্যমে সেটির প্রতিকারের জন্য আদালতের শরণাপন্ন হতে হয়। সেক্ষেত্রে জনস্বার্থ মামলাকে যদি সরকার রাষ্ট্রবিরোধী মনে করে তাহলে তা নিজের অবস্থান জনস্বার্থের বিপরীতে কি-না সে প্রশ্নটি দেখা দেয়। মঙ্গলবার, ২৯ জুন ২০২১, বিকেলে এএলআরডি ও প্রথম আলো আয়োজিত এক ভার্চুয়াল সেমিনারে বক্তারা এ কথা বলেন।
বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, অ্যাডভোকেট সুলতানা কামালের সভাপতিত্বে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আবু ওবায়দুর রহমান। অন্যান্যের মধ্যে এতে আলোচনায় অংশ নেন সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী ও আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সভাপতি অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না, চাকমা রাজা, ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)’র প্রধান নির্বাহী, অ্যাডভোকেট সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের সভাপতি অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ এবং এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক, শামসুল হুদা।
সভাপতির বক্তব্যে অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, রাষ্ট্র জনস্বার্থ মামলাকে রাষ্ট্রবিরোধী তখনই মনে করতে পারেন যখন তার অবস্থান থাকে জনস্বার্থের বিপরীতে এবং যখন রাষ্ট্র কাঠামোতে অসুস্থতা, অস্বচ্ছ্বতা ও আত্মপরিচয় নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকে। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দেশকে যেভাবে দেখতে চেয়েছি, বাংলাদেশের মানুষ এ দেশকে যেভাবে দেখতে চেয়েছে, সেই ইচ্ছার প্রতিফলন আছে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে, যেটি দেশের সর্বোচ্চ আইন, সংবিধানের অংশ। সেখানে পরিস্কার বলা আছে – রাষ্ট্র এদেশের মানুষের জন্য সাম্য, ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা রক্ষা করবে, মানুষের অধিকার নিশ্চিত করবে। এই অধিকার নিশ্চিতের জন্য, জনস্বার্থ রক্ষার জন্যই রাষ্ট্র আইন প্রণয়ন করে। এখন যদি দেখা যায় সেই আইনই জনস্বার্থ পরিপন্থী কিংবা সেটি মানুষের অধিকার রক্ষা করছে না অথবা আইনের প্রয়োগ ঠিকমত হচ্ছে না, তখনই আইনের শাসনের ব্যত্যয় হয়। জনগণের কিন্তু তখন দায় থাকে জানিয়ে দেয়া যে, আইনের ব্যত্যয় হচ্ছে। জনগণের একটি অংশকে তখন এগিয়ে আসতে হয় এটির প্রতিকার যাতে হয় তার ব্যবস্থার জন্য। জনস্বার্থে মামলা তারই অংশ মাত্র। অনেক সময় এতে নিরাপত্তা ও জীবনের ঝুঁকি থাকে, সেক্ষেত্রে সংঘবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হয়।
অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না বলেন, আইনের শাসন থাকলে তো আর জনস্বার্থ মামলা বা পিআইএলের প্রয়োজন পড়ে না। আইন যদি জনস্বার্থকে রক্ষা না করে কেবল তখনই জনস্বার্থ মামলার প্রয়োজন পড়ে। তিনি বলেন, পিআইএল রাষ্ট্রবিরোধী বা আইন বিরোধী কিছু নয়, এটি আইনের একটি পরিপূরক মাত্র।
অ্যাডভোকেট সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, জনস্বার্থ মামলার ক্ষেত্রে আদালতের রায় পাওয়াই শেষ কথা নয়, যাদের জন্য মামলাটি করা হয়েছে তারা ন্যায়বিচার পেয়েছেন কিনা সেটিই শেষ কথা। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, যারা জনস্বার্থে মামলা করছেন তারা পুরো বিষয়টির সরেজমিন তথ্য সংগ্রহ বা গবেষণা না করেই কেবল পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের কাটিং নিয়ে আদালতে জনস্বার্থ মামলা নিয়ে হাজির হন। যাদের স্বার্থে এই মামলাটি করা হবে তারা এ প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে যান। যে জনগোষ্ঠীর জন্য মামলাটি করা হচ্ছে তারা যদি সংগঠিত না হন তাহলে তাদের পক্ষে প্রকৃত প্রতিকার পাওয়া দুরূহ বলে অভিমত ব্যক্ত করেন তিনি।
অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ বলেন, সংবিধানের বিধান অনুযায়ী মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন হলে ১০২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হওয়া যাবে। কোনো একটি জনগোষ্ঠীর মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে কেবল উচ্চ আদালতেই জনস্বার্থ মামলা বা পিআইএল সম্ভব। তবে পরিবেশ আইন বা অন্যান্য বিভিন্ন আইনে মৌলিক অধিকার বাদে জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট অনেক বিষয় নিয়ে নিম্ন আদালতেও মামলা করার সুযোগ আছে। জনস্বার্থ মামলাকে সন্তানের মতো যত্ন করে চূড়ান্ত প্রতিকার পাওয়া পর্যন্ত লেগে থাকলে এ বিষয়ে প্রকৃত সুফল পাওয়া সম্ভব বলে তিনি অভিমত দেন।
ব্যারিস্টার রাজা দেবাশীষ রায় বলেন, অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য জনস্বার্থ মামলা খুবই কার্যকর পন্থা হতে পারে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, মারমা জনগোষ্ঠীর উত্তারিধাকার নির্ণয়ের ক্ষেত্রে কয়েকটি মামলায় বিচারকগণ হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের প্রয়োগ করেছিলেন, কিন্তু মারমারা যদি হিন্দু আইন অনুসরণ করে তাহলে মারমা নারীরা হিন্দু আইন অনুযায়ী সম্পত্তির অংশ থেকে বঞ্চিত হবে। এজন্য মারমা নারীরা যেন প্রথাগত আইন অনুযায়ী সম্পত্তির অংশ পায় এজন্য জনস্বার্থ মামলা করা হয়েছিল এবং সুফল পাওয়া গিয়েছিল। তিনি দাবি করেন, সমতলের কৃষি জমি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য জেলা পর্যায়ে ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করে এবং আপিলের একটি বা দুটি স্তর রেখে আইন করলে মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
শামসুল হুদা বলেন, অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে রাষ্ট্রীয় এজেন্সিসমূহ নিজেরাই আইনের শাসনের ব্যত্যয় ঘটাচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, অর্পিত সম্পত্তিকে তাদের প্রকৃত মালিককে ফেরত দেয়ার জন্য সরকার ২০০১ সালে আইন প্রণয়ন করেছিল। এরপর ২০০৩ সাল পর্যন্ত কয়েকদফা সংশোধনীও আইনে আনা হলো। কিন্তু আইনের বাস্তবায়নের জন্য আমাদের উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হতে হলো। আদালত আইন বাস্তবায়নের জন্য ৯ দফা নির্দেশনা প্রদান করলেন। আদালতের নির্দেশনা মেনে ট্রাইব্যুনালে আবেদন নিস্পত্তি দ্রুততর হলো ঠিকই কিন্তু জেলা প্রশাসকরা আদালতের রায় ও ডিক্রি বাস্তবায়ন করছেন না ফলে সেখানে ভুক্তভোগিরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তিনি দেশের বিভিন্ন আদালতে স্তুপিকৃত লক্ষ লক্ষ মামলার নিস্পত্তি দ্রুততর করে জনমানুষকে হয়রানী ও ভোগান্তির হাত থেকে রেহাই দেয়ার জন্য বিচার ব্যবস্থার সংস্কারের দাবি জানান।
এর আগে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে অ্যাডভোকেট আবু ওবায়দুর রহমান বলেন, কোন নির্দিষ্ট ঘটনায় কোন ব্যক্তির জন্য করা জনস্বার্থ মামলার ক্ষেত্রে উদ্দেশ্য থাকে যাতে আদালতের রায়ে ঐ ব্যক্তি আইনী সুরক্ষা পেলে অন্যান্য ব্যক্তিরাও একই ধরণের অন্য ঘটনার শিকার হলে সমান আইনী সুরক্ষা পান। এছাড়াও সরকারের কোন সিদ্ধান্ত বা পদক্ষেপের মাধ্যমে কোন বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হলে জনস্বার্থ মামলার মাধ্যমে ঐ বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে আইনী সুরক্ষা দেয়া যায়। এজন্য জনস্বার্থ মামলা রাজনৈতিক বিবেচনায় না নিয়ে আইনের শাসনকে শক্তিশালী করার মানসে জনস্বার্থ মামলার রায় বাস্তবায়নের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ধারাকে অব্যাহত রাখতে এবং নাগরিকের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।