আমরা এ কোন সময়ে এসে পৌঁছেছি! কেউ কাউকে চিনি না। পাড়ার কাউকে তো নয়ই, একই আবাসনে থেকেও পাশের ফ্ল্যাটে কে থাকেন, তিনি কী করেন কিচ্ছু খোঁজ খবর রাখি না। এমনকি, যাঁদের সারাক্ষণ লোকজন নিয়ে কারবার, যাঁরা নাকি যে কোনও মানুষের সঙ্গে দু’মিনিট কথা বললেই বুঝতে পেরে যান, লোকটা কেমন, সেই সব নেতা-মন্ত্রীরা পর্যন্ত এঁকে চিনতে পারলেন না!
বলছিলাম দেবাঞ্জন দেবের কথা। যিনি শাসকদলের সাহায্য নিয়ে শুধুমাত্র সোনারপুরেই যে ভ্যাকসিন ক্যাম্প আয়োজন করেছিলেন, তা-ই নয়, খোদ কলকাতার বুকে আমহার্স্ট স্ট্রিটের সিটি কলেজেও ভ্যাকসিন ক্যাম্প করেছিলেন। এবং কেউ সামান্যতমও কোনও সন্দেহ না করায়, একের পর এক সাফল্য আসায় এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন যে, কলকাতার অন্যতম জমজমাট অঞ্চল, কসবা থানা থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে, ১০৭ নম্বর ওয়ার্ডে আয়োজন করেছিলেন ভ্যাকসিন ক্যাম্প। আরও কোথায় কোথায় কী কী আয়োজন করেছিলেন তা এক এক করে এখন সামনে আসছে।
এতটাই নিখুঁত ভাবে উনি এই ক্যাম্পগুলোর আয়োজন করতেন যে, সাধারণ মানুষ তো দূর অস্ত, স্বয়ং সাংসদ থেকে ব্লক সভাপতি, তৃণমূল টাউন সভাপতিও বুঝতে পারেননি এগুলা ভুয়ো।
তাঁরা শুধু সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিতই হননি, ব্লক সভাপতি তো তাঁর পরিবার এবং আত্মীয়-স্বজন মিলিয়ে মোট ১৮ জনকে ওখানে নিয়ে গিয়ে ভ্যাকসিন নিয়েছেন। নিয়েছেন স্বয়ং সাংসদ মিমি চক্রবর্তীও।
যে ভ্যাকসিনগুলো কোভিশিল্ড বলে দেওয়া হয়েছিল, তার ভায়ালগুলো বাজেয়াপ্ত করার পরে কোভিশিল্ডের লেভেলগুলো তুলতেই দেখা যায় ওগুলো আসলে অ্যামিক্যাসিন-৫০০ ইঞ্জেকশন। যাঁদের দরকার নেই, তাঁদের ওই ইনজেকশন প্রয়োগ করলে শুধু যে শ্রবণ ক্ষমতাই নষ্ট হয়ে যেতে পারে তা-ই নয়, কিডনিও আক্রান্ত হতে পারে। হতে পারে আরও অনেক কিছুই। কী কী হতে পারে তা নিয়ে এই মুহূর্তে গবেষণা করছেন চিকিৎসকদের নানান মহল।
শিয়ালদহর খুব কাছে তালতলায় গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি আবক্ষ মূর্তির আবরণ উন্মোচন অনুষ্ঠানে নাকি হাজির ছিলেন শাসক দলের প্রথম সারির নেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, নয়না বন্দ্যোপাধ্যায়, তাপস রায়, অতীন ঘোষ, এমনকি কলকাতার প্রাক্তন মেয়র ও পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমও। এই গুরুত্বপূর্ণ পাঁচ নেতার নামের নীচেই ষষ্ঠ ব্যক্তির নাম হিসেবে ওই ফলকে লেখা ছিল এই দেবাঞ্জন দেবের নামও এবং সেই নামের নীচে লেখা ছিল আই এ এস, জয়েন্ট কমিশনার। লোকটা নিজেকে সর্বত্র আই এ এস অফিসার এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যুগ্ম সচিব হিসেবে পরিচয় দিতেন। এই ভুয়ো পরিচয় ভাঙিয়েই কিছু দিন আগে তিনি প্রচুর মাস্ক, স্যানিটাইজার এবং ১০০০টি পালস অক্সিমিটার কিনেছিলেন। যার বেশির ভাগ টাকাই তিনি মেটাননি। এই পরিচয় দিয়েই পুরসভার স্টেডিয়াম তৈরির বরাত পাইয়ে দেওয়ার নাম করে হাতিয়ে নিয়েছেন ৯০ লক্ষ টাকা। ১৪৪ নম্বর ওয়ার্ডে স্যানিটাইজার বিক্রির টেন্ডার পাইয়ে দেবেন বলে একটি ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থার কাছ থেকে সিকিউরিটি মানি হিসেবে নিয়েছেন চার লক্ষ টাকা।
স্পেশাল কমিশনার তাপস রায় চৌধুরীর সই জাল করে কসবার আইসিআইসিআই ব্যাঙ্কে পুরসভার নামে একটি ভুয়া অ্যাকাউন্ট পর্যন্ত খুলে ফেলেছিলেন। ব্যবহার করতেন কলকাতা পুরসভার জিএসটি নম্বরও। নবান্নর নামে বিজ্ঞপ্তি জারি করে নিয়োগ করেছিলেন গাড়ির ড্রাইভার থেকে সশস্ত্র দেহরক্ষী। ব্যবহার করতেন পুরসভার হলগ্রাম যুক্ত প্যাড। গাড়ির সামনে লাগিয়ে নিয়েছিলেন নীল বাতি। তাঁকে দেখা যেত নানান অনুষ্ঠানে একই মঞ্চে নেতা-নেত্রীদের পাশে। থাকতেন আনন্দপুর থানা দেড়শো-দুশো মিটার দূরত্বে।
কসবা থানা থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে কসবা নিউ মার্কেটের ঠিক পাশের একটি বহুতলে অবিকল পুরসভার আদলে খুলেছিলেন নিজের অফিস। অথচ কেউ তাঁকে সামান্যতমও সন্দেহ করেননি। উলটে পুলিশরা তাঁকে স্যালুট দিতেন।
এখন মনোবিদরা বলছেন, এটা এক ধরনের মানসিক রোগ। যেটাকে বলা হয় পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার। এই ধরনের লোকেরা নিজের মিথ্যে পরিচয় দিতে দিতে এক সময় এমন একটা পর্যায়ে এসে পৌঁছন যে, নিজেও বিশ্বাস করতে শুরু করেন, তিনি নিজের সম্পর্কে যা বলছেন, তিনি আসলে সেটাই। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। মিউজিক অ্যালবাম এবং তথ্যচিত্র নির্মাণ করা এই দেবাঞ্জন দেব নিজেকে সত্যি সত্যিই আই এ এস অফিসার এবং যুগ্ম-কমিশনার ভাবতে শুরু করে দিয়েছিলেন। তখন একদম ভুলে গিয়েছিলেন যে, তিনি কোথাও কোথাও নিজেকে এনজিওর কর্ণধার বলেও পরিচয় দিয়েছিলেন। তাঁর পাড়াতেও তাঁর এতটাই গুরুত্ব ছিল যে, ওখানে লোডশেডিং হলে সবাই তাঁকেই ধরতেন এবং অবাক কাণ্ড, অনুরোধ করার কিছুক্ষণের মধ্যেই বিদ্যুৎও চলে আসত। এমনই যোগাযোগ ছিল তাঁর।
কেউ এত দিন ঘুণাক্ষরেও এ সব টের পাননি। সম্প্রতি কসবার ভ্যাকসিন কাণ্ড সামনে আসতেই পুলিশের জালে ধরা পড়েন তিনি। এগুলো কিছুই হতো না, যদি পাড়া কালচার এখনও চালু থাকত। আগেকার দিনে পাড়ার সবাই সবাইকে চিনতেন। কে কার ছেলে, কে কী করে। এমনকী কার বাড়িতে কী রান্না হচ্ছে সেটাও জানতেন। সন্ধে হয়ে গেলে পাড়ার কোনও ছেলে ছোকরাকে গলির মুখে দেখলে তাঁরাই ধমকে ধামকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিতেন।
কিন্তু বেশ কয়েক যুগ হতে চলল সেই কালচার কমতে কমতে যেটুকু তলানিতে এসে ঠেকেছিল, বেশ কয়েক বছর আগে সেটাও উধাও হয়ে গেছে। ফলে কে কোন অভাব অনটনে আছেন আমরা জানতেও পারি না। সপরিবার কেউ আত্মহত্যা করলেও জানতে পারি না তার কী সমস্যা ছিল। হঠাৎ করে পুলিশি ধরপাকড়ের পর জানা যায়, এত দিন ধরে যাঁরা পাশের বাড়িতে ছিলেন, তাঁরা আসলে উগ্রপন্থী। শ্রাদ্ধে নিমন্ত্রিত হওয়ার পরে জানতে পারি তিনি মারা গেছেন।
অতিমারির কারণে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার অনেক আগে থেকেই আমাদের সমাজে একজনের থেকে আরেকজনের দূরত্ব এতটাই বেড়ে গেছে যে, আমরা কেউ কাউকে চিনি না। জানি না। বুঝি না। ফলে এগুলো দিন দিন বাড়ছে। আরও বাড়বে এবং যত দিন যাবে সেই দূরত্ব ততই বাড়বে এবং সামাজিক সম্পর্কে তৈরি হবে উদাসীনতা। সেই উদাসীনতা আটকাতে পারে একটাই দাওয়াই, আর সেটা হল— পাড়া কালচার।
আজ যদি পাড়া কালচার থাকত, তা হলে যতই চালাক চতুর হোন না কেন, যতই আঁটঘাট বেঁধে নামুন না কেন, যতই মানসিক রোগের শিকার হ’ন না কেন, এগুলো করা দেবাঞ্জন দেবের মতো মানুষদের পক্ষে আর কিছুতেই সম্ভব হতো না।