অদ্ভুত কর ব্যবস্থা ও মুলাকরম

ঋভু চট্টোপাধ্যায়
ঋভু চট্টোপাধ্যায়
6 মিনিটে পড়ুন
ছবি সংগৃহীত

পৃথিবীর ইতিহাসে আমরা যদিও ৩০০০-২৮০০ খ্রীষ্টপূর্বে একদিকে যেমন ইজিপ্টে, অন্যদিকে মনুস্মৃতি বা অর্থশাস্ত্রেও কর ব্যবস্থার কথা জানতে পারি, তবে বিভিন্ন অদ্ভুত বিষয়ে কর ব্যবস্থার কথা কিন্তু খুব একটা পুরানো নয়। সাল ১৬৯৬ ইংল্যাণ্ডে তৃতীয় উইলিয়ামের রাজত্বকালে একটা অদ্ভুত ধরনের করের ব্যবস্থা করা হয়, যা পরবর্তীকালে অন্যতম কুখ্যাত ‘উইনডো ট্যাক্স’ নামে প্রচলিত ছিল। এই ট্যাক্সে বলা হয় যার বাড়িতে যত বেশি জানলা সে তত বেশি কর দেবে। বিশেষ করে যে বাড়িতে দশটার বেশি জানলা তার অতিরিক্ত দশ সিলিং কর পড়বে। এর পরিণতি হিসাবে অনেকেই ইট দিয়ে নিজেদের বাড়ির জানলা এক্কেবারে বন্ধ করে দেন।এই উইনডো ট্যাক্স ছাড়াও বিভিন্ন দেশে বাড়ির গরু মোষ, এমনকি গোপ রাখবার ওপরেও ট্যাক্স নেওয়ার প্রথা প্রচলন ছিল। তবে এইসব কিছুকে ছাড়িয়ে যায় এই ভারতের কেরালায় এক সময়কার প্রচলিত ‘মুলাকরম’ বা ‘ব্রেস্ট ট্যাক্স।’ ‘মুলাকরম’ কর ট্রাভাঙ্কর রাজ্যে সেই সময় কার নীচু জাতের মহিলাদের থেকে নেওয়া হত।এই ট্যাক্স প্রায় ১৯২৪ সাল পর্যন্ত প্রচলিত ছিল, এমনকি রাজ্য সরকারের এই ট্যাক্স আদায়ের সাথে যুক্ত কর্মচারীরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে ট্যাক্স আদায় করতেন। মেয়েরা বয়ঃসন্ধিকালীন সময়ে পড়লেই তাদের থেকে কর নেওয়া আরম্ভ করা হত,এবং অদ্ভুত ব্যাপার হল এই কর নির্ধারিত হত স্তনের আকারের ওপর ভিত্তি করে। বর্তমানে সমাজতাত্ত্বিকরা এই কর ব্যবস্থা কেন প্রচলিত হয়েছিল সেই বিষয়ে বিভিন্ন রকমের আলোচনা করেন। তবে যেটুকু জানা যায় তাতে বলা হয়, সেই সময়কারের ট্রাভাঙ্কর রাজ্যের রাজারা ব্রাহ্মণ ছিলেন এবং এই মুলাকরম কর ব্যবস্থাকে সেই সময়কারের সামাজিক ভাবে নীচু শ্রেণির মানুষদের ব্রাহ্মণদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের একটা উপায় হিসাবে ধরা হত। সমাজের নীচু জাত বলতে ‘নাদার’ ‘এজাভা’ প্রভৃতির নাম পাওয়া যায়। মন্দিরে পুজা করতেন নায়ার ব্রাহ্মণরা।তাদের বাড়ির মহিলারা কাঁধ থেকে কাপড় ঢেকে নিতে পারতেন। এই ব্রাহ্মণদের সামনে নিচু্ শ্রেণির মহিলাদের স্তন খোলা রাখতে হত। স্বভাবতই একটা সামাজিক আন্দোলন আরম্ভ হয়। এইসময় আরেক সমস্যার সৃষ্টি হয়, ১৮২০ সালে জন মনরো এক আইন প্রণয়ন করে বলেন, ‘খ্রীষ্টান হলে আর মেয়েদের মুলাকরম কর দিতে হবে না।’ এমনকি ‘পিণ্ডাকাশ’ নামে এক রকমের পোশাকেরও ব্যবস্থা করা হয়। স্বভাবতই শয়ে শয়ে নীচুজাতের মানুষ এই ঘৃণ্য কর ব্যবস্থার থেকে মুক্তির আশায় খ্রীষ্টান হতে আরম্ভ করলেও রাজ্যে একটা অন্যরকমের সংকট উপস্থিত হয়। সেই সময় রাজাকে বোঝানো হয়, ‘এই অবস্থা চলতে থাকলে সামাজিক ব্যবস্থা এক্কেবারে ভেঙে পড়বে, রাজাকে আর কেউ মানবে না, এবং রাজ্যে একটা ধর্ম সংকট নেমে আসবে।’ তাই ১৮১৩ সাল থেকে ১৮৫৯ সাল পর্যন্ত সরকারি উদ্যোগেই নিচু শ্রেণির মানুষ যারা খ্রীষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিল তাদের ওপর চূড়ান্ত অত্যাচার আরম্ভ হয়।উচ্চ জাতের পুরুষেরা প্রকাশ্যে তাদের পোশাক ছিঁড়ে দেয়, তাদেরকে মারাও হয়।অনেক চার্চও জ্বলিয়ে দেওয়া হয়, এমনকি ধর্ম পরিবর্তন করেছে এমন নিম্ন শ্রেণির মেয়েদের বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। পরিস্থিতি চরমে ওঠে যখন নাদার জাতের দুই মহিলাকে ১৮৫৯ সালের ২৬শে জুলাই বাজারে প্রকাশ্য জায়গায় জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। এই সবটাই হয় সরকারি উদ্যোগে। এর পরেই প্রথমে নাদার জাতির মানুষ বিদ্রোহ আরম্ভ করে পরে অন্যান্য জাতের মানুষরাও এই বিদ্রোহে সামিল হয়। চার্চের উদ্যোগেও মানুষদের সঙ্ঘবদ্ধ করবার কাজ আরম্ভ করা হয়।এমনকি খ্রীষ্টান ধর্মের প্রচার ও প্রসারের ফলে নিচু শ্রেণির মানুষরা দলে দলে খ্রীষ্টান হতে আরম্ভ করলে এই ঘৃণ্য প্রথা আস্তে আস্তে অবলুপ্ত হয়। পরে মাদ্রাজের গর্ভনর চালর্স ট্রাভেলিনের ব্যবস্থাপনাতে সবাই এই পোশাক পরবার অনুমতি পায়। তবে প্রথম দিকে ব্রাহ্মণ বাড়ির মেয়েরা যেভাবে বক্ষ বন্ধনী ব্যবহার করতেন সেভাবে বাকি সবাইকে পোশাক ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়। এই ‘মুলাকরম’ কর ব্যবস্থার সাথে আরেক জনের নাম বিশেষ ভাবে জড়িয়ে গেছে। তার নাম নাঙ্গেলী। কেরলের মধ্য অঞ্চলে ট্রাভাঙ্কর রাজ্যের চারথালা (বা চেরথালা) গ্রামের এজাভা জাতের নাঙ্গেলী এই রকম এক অদ্ভুত অশালীন কর প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ কর চাইতে আসা এক রাজকর্মচারীর হাতের ওপর নিজের দুটি স্তন কেটে তুলে দেয়। অতিরিক্ত রক্তপাতে তার মৃত্যু হয়।তার স্বামী চিরুকাদান জ্বলন্ত চিতায় ঝাঁপিয়ে আত্মবিসর্জন করে। তাকেই ভারতের প্রথম পুরুষ সতী বলে দাবি করা হয়।অনেক ঐতিহাসিক এই তথ্যকে স্বীকার করে না। কিন্তু ভাবতে অবাক লাগে যে ভারতে একের পর এক নিচু জাতের মানুষরা একের পর এক ভক্তি আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন (কবির তাঁতির ঘরের, দাদু ধুনুরি ঘরের, রবিদাস মুচির ঘরের), যেখানে মহাভারত রচনা করেন এক ক্যাওট সম্প্রদায় ভুক্ত মহিলার পুত্র, সেখানেই মুলাকরমের মত একটা জঘন্য কর ব্যবস্থা শুধু এই দেশের নয় সারা পৃথিবীর কাছে লজ্জা। যদিও অনেক ঐতিহাসিক এই কর ব্যবস্থার কথা স্বীকার করেন না। তাঁরা বলেন সেই সময় কেরালার কিছু জাতের মধ্যে বক্ষবন্ধনী ব্যবহারের প্রচলন ছিল না, এমনকি কোন কোন ঐতিহাসিক এই প্রথাকে শুধু মাত্র ভিক্টোরিয়ান যুগের রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে একটা সাধারণ বিদ্রোহ হিসাবেই দেখেছেন। তবে সেই সময়কারের নিচুজাতের মহিলাদের যে একটা বিশেষ ধরনের কর দিতে হত সেটা প্রায় সব ঐতিহাসিক স্বীকার করেছেন। একটা যে সামাজিক আন্দোলন হয়েছিল সেকথাও স্বীকার করেছেন অনেকেই স্বীকার করেছেন নাঙ্গেলীর কথাও। এর পরবর্তী কালে আরেক সামাজিক আন্দোলনের ফলে ১৯৮১ সালে প্রায় ২৪০০০ নাদার জাতের মানুষ নিজেদের ক্ষত্রিয় বলে দাবি করে, এবং পৈতে পরা ও পাল্কি চেপে বিয়ে করতে যাবার অধিকার দাবি করে এবং স্বীকৃতি পায়,এমন কি নাম্বোদিরী ব্রাহ্মণদের মধ্যে প্রচলিত থাকা আরেকটি অশালীন প্রথারও অবলুপ্তি হয়।তারা আগে নায়ার পরিবার থেকে যেকোন মহিলাকে রাতের জন্যে নিয়ে যেতে পারতেন।‘মুলাকরমের’ সামাজিক আন্দোলন এই জঘন্য প্রথারও অবলুপ্তি ঘটায়। যাই হোক ঐতিহাসিক যা তথ্য বা তত্ত্ব থাকুক ভারতেবর্ষে একটা সময় ধরে হিন্দু ধর্মের তথাকথিত নিচু জাতের মানুষদের ওপর বর্ণ হিন্দুরা যে অত্যাচার করত সেই ব্যাপারে আর কোন ঐতিহাসিক দ্বিমত করেন নি, হয়ত মুলকরম কিছুটা সত্য কিছুটা অতিরঞ্জিত, কিন্তু এটি একটি অত্যাচারের দলিল।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

বিষয়:
এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
ঋভু চট্টোপাধ্যায়, পোশাকী নাম সৌগত চ্যাটার্জী, কবিতা গল্প নিবন্ধ, বিভিন্ন বানিজ্যিক পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হয়। ইংরেজি সাহিত্যে এম.এ, সরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!