“শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী / পুরুষ গড়েছে তোরে সৌন্দর্য সঞ্চারী।”
(মানসী)
আদি গ্রন্থ বাইবেল থেকে আমরা জানতে পারি আদমের পাঁজরের হাড় থেকে ঈশ্বর নারী সৃষ্টি করেছেন। ভারতীয় মার্কণ্ডেয় পুরাণে দেখা যায় অসুর নিধনের জন্য স্বীয় তেজপুঞ্জ একত্রিত করে দেবতারা এক সর্বগুণান্বিতা নারী সৃষ্টি করেছেন।
হাদিসে আছে, “স্ত্রীগণকে সদুপদেশ দাও কেননা পাঁজরের হাড় দ্বারা তারা সৃষ্ট”
(হাদিস শরীফ)
বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থের মূলে দেখা যাচ্ছে যে, নারী তার সৃষ্টির জন্য পুরুষের ওপর নির্ভরশীল। ধর্মই মানুষকে প্রতিনিয়ত চালিত করে, প্রভাবিত করে, সমাজগঠনের, জীবনধারণের নির্ণায়ক হয়। সুতরাং পুরুষতন্ত্রের সূত্রটি আমাদের মানবজাতির জীবনধারণের উৎসেই নিহিত আছে।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার বুকে নবজাগরণের সূচনা হল। সেই নবজাগরণের প্রধান সাফল্য হল নারী স্বাধীনতা প্রবর্তন। রামমোহন ও বিদ্যাসাগর এই সব প্রণম্য ব্যক্তিদের হাত ধরে নারীর সামাজিক অবস্থানের পুনঃসংস্কার আরম্ভ হল।
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িও নারী স্বাধীনতার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নিল। এই বাড়ির মেয়ে ও বউরা নতুন দিগন্তের সন্ধানে তৎপর হলেন। তবে এই ব্যাপারে তাঁদের পিতা ও স্বামীরা যথেষ্ট উৎসাহ দিলেন। যেমন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখরা।
পেলাম স্বর্ণকুমারী, জ্ঞানদানন্দিনী, কাদম্বরী, নীপময়ি, সরলা, ইন্দিরা দেবীদের। ঠাকুরবাড়ির উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর বিশাল সাহিত্য সৃষ্টি যা অগাধ সমুদ্রের সঙ্গে তুলনীয়।
তিনি তাঁর কাব্য, নাটক, উপন্যাস, ছোটগল্প ও প্রবন্ধের মধ্যে নারীকে কী চোখে দেখেছেন, নারীর স্বাধীন ও স্বনির্ভর হয়ে ওঠার জন্য কোন দিশা দেখিয়েছেন তাই আলোচনা করব।
কালান্তর এই প্রবন্ধ সংকলনের ‘নারী’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, নারী “পুরাতনী” কারণ পৃথিবীতে সৃষ্টির বেদনা নারীই বহন করে। নারীর মধ্যে হৃদয়বৃত্তির প্রাবল্য প্রধান, বুদ্ধির ভূমিকা সে ভাবে নারীর জীবনে নেই। কিন্তু পুরুষ তার বুদ্ধির জোরে নব নব সভ্যতার উন্মেষ ঘটিয়ে চলেছে।
নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা রবীন্দ্রনাথ স্বীকার করেছেন ঠিকই, কিন্তু তার পাশাপাশি এও বলেছেন, শিক্ষা যেন কোনও ভাবেই নারীর হৃদয়বৃত্তিকে পরাভূত না করে।
তিনি শিক্ষার ব্যবহারিক প্রয়োগের কথা চিন্তা করছেন না, নারীর স্বাধীন জীবিকার কথা চিন্তা করছেন না, তাঁর কাছে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা বিবাহ ক্ষেত্রে মেয়েদের সুবিধা লাভের মূলধন, তাই বলছেন, “প্রকৃতির কাছ থেকে তারা পেয়েছে অশিক্ষিত পটুত্ব, মাধুর্যের ঐশ্বর্য… যে মেয়ের স্বভাবের মধ্যে দুর্ভাগ্যক্রমে সেই সহজ রসটি না থাকে, কোনও শিক্ষায়, কোনও কৃত্রিম উপায়ে সে সংসার ক্ষেত্রে সার্থকতা পায় না।”
রবীন্দ্রসাহিত্যে যে সব নারীদের আমরা দেখি, একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে, তারা কিন্তু উন্নত পুরুষের যথার্থ সহযোগী রূপে নিজেদের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে।
চিত্রাঙ্গদা রবীন্দ্রকাব্যে আত্মসম্মান দীপ্ত এক নারী। এক স্বাধীনচেতা নারীরূপে রবীন্দ্র কাব্যে তার উজ্জ্বল উপস্থিতি। কিন্তু তীক্ষ্ণ বিচার করলে দেখব যে, চিত্রাঙ্গদা অর্জুনের কাছে স্বাধীন নারী রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাননি। তিনি চেয়েছেন অর্জুনের কর্মচারী হয়ে তার জীবনের দুরহ কঠিন সংগ্রামের সঙ্গিনী হতে—
‘যদি সুখে দুঃখে মোরে কর সহচরী
আমার পাইবে তবে পরিচয়; গর্ভে
আমি ধরেছি যে সন্তান তোমার, যদি
পুত্র হয়, আশৈশব বীরশিক্ষা দিয়ে
দ্বিতীয় অর্জুন করি তারে একদিন
পাঠাইয়া দিব যাবে পিতার চরণে
তখন জানিবে মোরে, প্রিয়তম
আজ শুধু নিবেদি চরণে আমি চিত্রাঙ্গদা
রাজেন্দ্রনন্দিনী…’
এখানে দেখা যাচ্ছে পুরুষের যোগ্য সহচরী রূপেই নারী তাঁর সার্থকতা খুঁজে পাচ্ছেন। চিত্রাঙ্গদা তাঁর গর্ভের অনিশ্চিত সন্তানটি যদি পুত্র হয়, তবে তাকে দ্বিতীয় অর্জুন করে তুলবেন। কিন্তু যদি সে কন্যা হয়, তবে তার ভবিষ্যৎ কী হবে জননী সে সম্বন্ধে নিশ্চিত নন।
‘শাস্তি’— এই ছোটগল্পে চন্দরা স্বামীর অনুরোধে বড়জাকে হত্যা করার মিথ্যা অপবাদ নিজের মাথায় নিয়েছে। এইটি হচ্ছে তার পুরুষতান্ত্রিকতাকে অস্বীকার করার চরম অস্ত্র— ‘চন্দরা মনে মনে স্বামীকে বলিতেছে আমি তোমাকে ছাড়িয়া আমার এই নবযৌবন লইয়া ফাঁসিকাঠকে বরণ করিলাম— আমার ইহজন্মের শেষ বন্ধন তোমার সহিত।’
আইনের সাহায্যে সে আত্মহত্যার পথটিকে সুগম করেছে। বিদ্রোহ তার মধ্যে এনে দিচ্ছে জীবনবিমুখতা। জীবন রসসমৃদ্ধ এই গ্রাম্য মেয়েটির চরিত্র অঙ্কন করে তাকে করে তুলেছেন পুরুষের স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার। কারণ, ‘বউ গেলে বউ পাওয়া যায়, ভাই গেলে ভাই পাওয়া যায় না’। অর্থাৎ মেয়ে মানুষ অতি সস্তা ও সহজেই উপলব্ধ।শেষ পর্যন্ত এই প্রাণচঞ্চল মেয়েটির জীবনবিমুখ এই বিদ্রোহ কোনও ভাবে কি পুরুষতন্ত্রকেই জয়যুক্ত করে না?
‘পয়লা নম্বর’-এর অনিলাও স্বামী, সংসার, প্রেমিক ছেড়ে এক অনির্দেশ্য পথে যাত্রা করে। এখানেও সেই জীবনবিমুখতারই প্রকাশ।
‘স্ত্রীরপত্র’র মৃণাল সংসারে মেয়েদের অবহেলিত অবস্থানটি অনুধাবন করতে চেয়েছে। একটি অসহায় মেয়ে বিন্দুর জন্য সে তার নিজের সংসার, ভাসুর, বড়জা, স্বামী এদের বিরুদ্ধে অর্থাৎ তথাকথিত সাংসারিক ব্যবহারবিধির বিরুদ্ধে যেতে সাহস দেখিয়েছে। শেষ পর্যন্ত নিজের সংসার ছেড়ে শ্রীক্ষেত্রে আশ্রয় নিয়েছে। সংসারহীন জীবনে আধ্যাত্মিকতাই তার একমাত্র আশ্রয়। এখানেও সেই একই জীবনবিমুখতার প্রকাশ।
দেখা যাচ্ছে, নারী যখন তার ব্যবহারিক সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাইছে তখন রবীন্দ্রনাথ তাদের জন্য নির্দিষ্ট করছেন মৃত্যু নতুবা অনির্দেশ্য আধ্যাত্মিক জীবন। যেখানে ইন্দ্রিয়সুখ বা ইন্দ্রিয়জ ভোগের কোনও স্বীকৃতি নেই।
অথচ ‘নৈবেদ্য’ কাব্যগ্রন্থের কবিতায় রবীন্দ্রনাথ বলছেন—
‘বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয়।
অসংখ্য বন্ধন মাঝে মহানন্দময়
লভিব মুক্তির স্বাদ…
…ইন্দ্রিয়ের দ্বার
রুদ্ধ করি যোগাসন, সে নহে আমার
যা-কিছু আনন্দ আছে দৃশ্যে গন্ধে গানে
তোমার আনন্দ রবে তার মাঝখানে। (৩০)
নারী ও পুরুষের মধ্যে এই বিভেদ , এই দ্বৈধতা কেন ?
মেয়েদের বোধবুদ্ধির বিকাশকে রবীন্দ্রনাথ চিরকালই একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে বেঁধে রাখতে চেয়েছেন; তাঁর মনে হয়েছে, মেয়েদের বুদ্ধি ও বোধের বিকাশ কখনওই অসীম পর্যায়ে যেতে পারে না।
‘শেষ কথা’য় অচিরার মুখেই শুনতে পাই তার প্রতিফলন— ‘যে দুর্গম পথে মেয়ে পুরুষের চিরকালের দ্বন্দ্ব সেখানে পুরুষেরা হোক জয়ী। যে মেয়েরা মেয়েলি প্রকৃতির বিধানে তাদের সংখ্যা অনেক বেশি। তারা ছেলেমানুষ করে, সেবা করে ঘরের লোকের। যে পুরুষ যথার্থ পুরুষ তাদের সংখ্যা খুব কম; তারা অভিব্যক্তির শেষ কোঠায়। মাথা তুলছে দুটি একটি করে। মেয়েরা তাদের ভয় পায়; বুঝতে পারে না টেনে আনতে চায় নিজের অধিকারের গণ্ডিতে।’
অথবা— ‘পুরুষ যেখানে অসাধারণ সেখানে সে নিরতিশয় একলা, নিদারুণ তার নিঃসঙ্গতা, কেননা তাকে যেতে হয় যেখানে কেউ পৌঁছায় না।’
অচিরা শিক্ষিতা নারী। কিন্তু সে এই পাঠ পেয়েছে তার বিজ্ঞানী দাদুর কাছে। আর সেই জন্যই পুরুষতান্ত্রিকতার ভিত্তিটি তার হৃদয়ে সুচারু ভাবে প্রতিষ্ঠিত।
নারী সক্রিয় সংসারের ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে— মাতা, পত্নী কিংবা আত্মীয়তার গণ্ডিতেই সীমায়িত এবং সংখ্যায় বহু ব্যাপ্ত। কিন্তু পুরুষের কঠিন কর্মে, পুরুষের বুদ্ধি বিকাশের পথে তার কোনও স্থান নেই। সেখানে সে পুরুষের সহযোগী নয়। কারণ, রবীন্দ্রনাথের মতে নারীর মধ্যে নেই সেই ক্ষমতা যা তাকে যথার্থ পুরুষের সঙ্গিনী করে তুলতে পারে।
আর এইখানেই এক অদ্ভুত নিষ্ঠুর পরিহাস যে, রবীন্দ্রনাথ একজন নারীর মুখ দিয়েই এ কথাগুলো বলিয়েছেন। প্রকারান্তরে নারী কি আপন বুদ্ধিহীনতাকেই স্বীকার করে নিচ্ছেন না?
‘চার অধ্যায়’-এর এলা ‘রবিবার’-এর বিভা— এরা সবাই শিক্ষিতা নারী। অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা আছে। কিন্তু এরা কি যথার্থ আধুনিক মনের অধিকারিণী?
তাই যদি হতো তা হলে এলা কেন বলে—‘নব্য সাহিত্য দেখি বাঙালি মেয়েরা নিজেদেরই প্রশংসায় মুখরা, দেবীপ্রতিমা বানাবার কুমোরের কাজটা নিজেরাই নিয়েছে। স্বজাতির গুণগরিমার উপর সাহিত্যিক রঙ ছড়াচ্ছে। সেটা তাদের অঙ্গরাগের সামিল, স্বহস্তে বাঁটা বিধাতার হাতের নয়। আমার এতে লজ্জা করে।’
বিভা বলে, ‘অভী তোমরা নিজেদের থেকে মেয়েদের বিশেষ মূল্য দিয়ে দামি করে তুলেছিলে, তাদের খেলো করোনি নিজের গরজেই। সেই দাম আজ যদি ফিরিয়ে নাও, নিজের খুশিকেই করবে সস্তা, ফাঁকি দেবে নিজের পাওনাকেই। কিন্তু মিথ্যে বকছি, মডার্ন কালটাই খেলো।’
পুরুষতান্ত্রিকতার বুলি আউড়ে এই নারী নিজেকে কতটা খেলো করছে, তা কি তার নিজের বুদ্ধিহীনতারই প্রমাণ নয়? আর রবীন্দ্রনাথ প্রকারান্তরে এই উক্তিটি বিভার মুখে বসিয়ে তাঁর চিরন্তন মত নারীর বুদ্ধিহীনতাকেই আর একবার প্রতিষ্ঠা করেছেন।
এই ভাবে— যোগাযোগ, চোখের বালি, গোরা, ঘরে বাইরে প্রভৃতি উপন্যাসে, প্রবন্ধে, ছোটগল্পে ছড়িয়ে আছে রবীন্দ্রনাথের পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের অজস্র উদাহরণ যোগ্য উদ্ধৃতি। যা আমাদের চমকিত করে, রবীন্দ্র অনুভবের এই অন্ধকারময় নিগড়টি আমাদের নারীসত্তাকে এক কঠিন বন্ধনে আবদ্ধ করে। ‘অর্ধেক মানবী তুমি অর্ধেক কল্পনা’— এই অর্ধেক কল্পনা কবে স্বতন্ত্র ব্যক্তিরূপ পেয়ে এক পূর্ণ মহিমার নারীরূপে বিকশিত হবে তারই প্রতীক্ষা।