ডাক্তারের নামটা বদলে দিয়েছে গ্রামের লোক। কালো মোহন পাড়িয়াকে বলে ভালো মোহন পাড়িয়া। খুব ভালো ডাক্তার তো! মানুষটাও। গ্রামের কত লোকের যে উপকার করেন!
অল্প টাকায় রোগী দেখেন। রোগীদের হাতে কখনও ওষুধ কিনবার অর্থ গুঁজে দেন। কখনও আবার দুধ ফল কিনে খাবার টাকা। একবার এক গরীব রোগীকে ওষুধ না দিয়ে এক গাড়ি খড় কিনে দিলেন। বললেন, ‘আগে তোমার ঘরের চাল ঠিক কর। বর্ষার জল ঢুকলে তো হাঁপের রোগ সারবে না বাপু।’
ভালো মোহন ডাক্তারকে বছর ভর রোগী দেখতে হয়। দিন রাত। কামাই নেই কোন। বড়ই ব্যস্ত
ডাক্তার। বিশ্রাম নেবার ফুরসত নেই। তার মধ্যে হঠাৎ রোগীর চাপ লাফ দিয়ে একশ গুণ বেড়ে গেল। সামলাতে হিমসিম অবস্থা। গ্রামে মরক লেগেছে তো! মানে মারণ রোগ। সর্বক্ষণ চলছে রোগী দেখা। শ্বাস ফেলবার টাইম নেই কোন। গান শুনতে ভালবাসেন, গল্প কবিতা পড়তেও। কিন্তু সেসবের কোন সময় পাচ্ছেন না ডাক্তার।
ঘরে ঘরে সর্দি-কাশি-জ্বর। বাচ্চা বুড়ো যুবক, বাদ নেই কেউ। কাশতে কাশতে দম আটকে মরেও যাচ্ছে মানুষ। নতুন ধরনের এক ব্যাধি। খুব সাংঘাতিক। বারো-চোদ্দ দিনের জ্বর। সঙ্গে হাঁপানি। শরীর এলিয়ে পড়ে। তবে অনেকেই আবার সামলে উঠছে। দুর্বল রোগী একটু একটু করে উঠে বসছে। চাষবাসে হাত লাগাচ্ছে। হি হি করে হাসছে। আবার অনেকের নসীব খারাপ। রোগের কবলে যমে মানুষে টানাটানি। শেষমেশ ওপারে চলে যাচ্ছে। মানে মরণ।
ঘরে ঘরে জোর আতঙ্ক। ভালো ডাক্তারের বাড়ির সামনে রুগীর লম্বা লাইন। চাপ সামাল দিতে নাজেহাল। ভালো ডাক্তারের ভোর-রাতের সামান্য ঘুমটুকুও উধাও। ডাক্তার কখনও ঘরে বসে রুগী দেখছেন। কখনও ভাঙা চোরা পথেই সাইকেল নিয়ে হনহনিয়ে ছুটছেন শ্বাস আটকানো রোগীর ঘরে।
আজ ভালো মোহন ডাক্তারের ঘরের বাইরে দম চাপা ভিড়। গাজনের মেলা লেগেছে যেন। ভিড়ের মধ্যে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ডাক পেল মদন পাল। ভদ্র মানুষ। গাঁয়ের স্কুলে পাশ দিয়েছে। নিজের জমিতে হাল মারে। দরজার পাল্লা ঠেলে মাথা নিচু করে ঘরে ঢুকল। একটা ঢোঁক গিলে মাথা নাড়িয়ে মদন বলল, ‘ভায়ের খুব জ্বর ডাক্তারবাবু। এত জ্বর ছিল রাতে যে…’
-কত জ্বর?
-খুব তাপ গায়ে। মোমবাতি গলে যায়।
-এখন জ্বর কত’? এক বাচ্চা মেয়ের জিভ দেখতে দেখতে ভালো ডাক্তার কথাটা টেনে টেনে উচ্চারণ করলেন।
-জানিনা তো! রাতে ওর বৌ বলেছিল, ধুম জ্বর। গা পুড়ে যাচ্ছে।
-এখন কত জ্বর?
-জানি না তো!
-জেনে এসে আমাকে বল’, শান্ত মুখে ডাক্তার বললেন।
-আচ্ছা,’ বলে চলে গেল মদন।
সেদিন আর এলো না। পরের ক’দিনেও না।
অনেক কাজের মধ্যেও মদনের ভাই হেমন্তের অসুখের কথাটা মনে ছিল ডাক্তারের। যুবক ছেলের মারণ রোগ! চিন্তা তো থাকবেই। কয়েক জনকে জিজ্ঞেস করে উত্তর পেয়েছিলেন, ‘ওঃ, পাল পাড়ায় থাকে। ওদিক পানে যাই না আমরা’।
রোগীর ভিড়। মাথায় ভাবনা। ছোঁয়াচে অসুখ। গ্রামের ঘরে ঘরে রুগী। কোন্ ওষুধে যে সারবে! নানা চিন্তা মাথায়। কাজের চাপে পাল পাড়ার হেমন্তর কথা আর মনে পড়েনি ভালো ডাক্তারের। অনেক দিন গড়িয়ে গেল। তবে সেদিন এক ঝটকায় মদনের ভায়ের অসুখের কথাটা মাথায় ঢুকে পড়ল। সেদিন মানে গত পরশু দিনের মেঘলা সকাল।
সাঁওতাল পাড়ার দিকে সাইকেলে জোরে প্যাডেল ঠুকতে ঠুকতে যাচ্ছিলেন ভালো মোহন। গনেশ আটা মিল পেরিয়ে একটা বাঁক নিতে হয়। ভাঙাচোরা রাস্তা। ওখানে সাইকেলের গতি আরও কমে গেল। তখনই চোখে পড়ল। নতুন কালভার্টের কাছে দাঁড়িয়ে রুমালে নাক মুখে বেঁধে আকাশের কালো মেঘ দেখছে মদন পাল। ওর সামনে এবড়োখেবড়ো রাস্তায় সাইকেলটায় ঘচ করে ব্রেক কষলেন। বাঁ-পায়ে শরীরের ভর রেখে সামনে ঝুঁকলেন ভালো ডাক্তার। গলায় বেশ একটু ঝাঁজ। বললেন, ‘কৈ, সেদিন জানিয়ে গেলি না তো! তোর ভায়ের জ্বর কত ছিল?
প্রশ্নটা কানে ঢুকতেই মদনের মুখ কাঁচুমাচু। মিনমিনে গলায় বলল, ‘গত দু’হপ্তা একটুন সময় পাইনি কো! ফসল রোয়া করতি আর নিড়ানি দিতেই দিনমান কাবার। আজ ভাবছিলাম আপনারে জানায়ে আসবো’।
-কী জানাবে?
-জানাবো, ভায়ের জ্বর তো নাই। দুই হপ্তা ঘর বন্দী থাকতেই শরীল খান একদম নরমাল হয়ে গেইচে।
-বলিস কি রে’! ডাক্তারের চোখ বড় বড়। মুখে কথা নেই।
-আমি কিছু ভুল কইলাম ডাক্তার বাবু’? মদন পালের কাঁপা কাঁপা স্বর।
বড় একটা শ্বাস ফেললেন ডাক্তার। কপালে ভাঁজ। কিছু একটা ভবছেন যেন! মনে মনে বললেন, আশ্চর্য কথা! দু’সপ্তাহ ঘাপটি মেরে ঘরে থাকতেই জ্বর পালিয়ে গেল!
মদন পাল কিছু একটা বলল। কথাটা কানে ঢুকল না ডাক্তারের। খানিক চুপ থেকে ওর দিকে তাকালেন ভালো ডাক্তার। একটু থেমে মুখ খুললেন। গলার স্বর উঁচু। বললেন, ‘ওকে কে বলল, ঘরে বন্দী হয়ে থাকতে? কোন্ ডাক্তার?
-না না, ডাক্তার না। আমার ঠাকমা।
-ঠাকুমা! কী বলল?
-কবিতা বলল।
-কী কবিতা? চটপট বল।
একবার কেশে নিয়ে গলাটা পরিস্কার করে এক নিঃশ্বাসে মদন বলল,
‘চুপ করে থাক বসে কোন দিকে যাস নে
রুমালেতে মুখ ঢাক অমন হাঁচিস নে।।
রোগ যাস ছড়িয়ে-
জীবাণুতে ভরিয়ে-
কটা দিন থাক একা কাছেতে ঘেঁষিস নে’।।
মদনের মুখের দিকে থম মেরে তাকিয়ে ডাক্তার। কবিতাটা আওড়ালেন। মনে মনে বললেন, ‘দারুন ছন্দ। মনে হচ্ছে সত্যেন্দ্র নাথ দত্তের কবিতা। তারপর মাথার টুপিটা ঠিক করে নিয়ে বিড়বিড় করলেন, ‘জ্বরজারি হয়েছে তো ঘর-বন্দী থাকো। এবার থেকে সেটাই বলবো’।
বুকে বাতাস টেনে নিয়ে সাইকেলের প্যাডেলে জোরে চাপ দিলেন ভালো ডাক্তার। ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করতে করতে কালভার্ট পার হয়ে এবার ভালো রাস্তা। পিচ ঢালা পথ। মেঘের ফাঁক গলে চকচকে রাস্তা জুড়ে উঁকি মারছে নরম রোদ। ভালো ডাক্তারের মুখে কবিতা, ‘…চুপ করে থাক্ বসে কোন দিকে যাস নে…’।
ভালো রাস্তায় সাইকেলটা সাঁই সাঁই ছুটছে এখন।