যুগে যুগে মহামারী ও বিশ্ব রাজনীতি

টুনু কর্মকার
টুনু কর্মকার
6 মিনিটে পড়ুন
লেখক টুনু কর্মকার

সময়ের ধারাবাহিকতায় মানুষের মৌলিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্যে স্বাস্থ্য-অবশ্যই অন্যতম। তবুও স্বাস্থ্য ঝুঁকির আষ্ফালন ঠেকাতে বিশ্বের কোন দেশই নিশ্চিত সুরক্ষা বলয় তৈরি করতে পারেনি। তাই, মানব ইতিহাসের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করে দেখা যায় স্বাস্থ্য খাতের অনুন্নতির ফলে প্রতি ১০০ বছর পরে দেশে দেশে ফিরে এসেছে ব্যাপক মহামারী। যুগে যুগে মহামারির প্রাদুর্ভাব পাল্টে দিয়েছে পৃথিবীর চেহারা। ক্রমবিবর্তনের মধ্য দিয়ে নতুন করে শুরু হয়েছে সভ্যতা। যদিও মহামারীর ইতিহাস মানব সভ্যতার মতোই প্রাচীন। বিভিন্ন সময় সংক্রামক ব্যধি ছড়িয়ে পড়েছে কোনো নির্দিষ্ট এলাকায়, কখনও আবার বিশ্বব্যাপী। প্লেগ, কলেরা, যক্ষ্মা, কুষ্ঠ, ইনফ্লুয়েঞ্জা, গুটিবসন্ত ‍এমন বিভিন্ন রোগ নানা সময়ে মহামারীর আকার নিয়েছে পৃথিবীর বুকে। ১৭২০ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বিগত চারশত বছরের ভাইরাস জনিত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এর যে চিত্র খুঁজে পাওয়া যায়, তা হলো- এই চার শতাব্দীতে , প্রতি ১০০ বছর অন্তর বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া যেসব মহামারির কারণে, যেমন বিপর্যস্ত হয়েছে মানব সভ্যতা, তেমনি কোথাও কোথাও আবার নিঃশেষ হয়ে গেছে বহু জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব। প্রতি একশ বছর পর পর পৃথিবীতে আবির্ভূত সেই ভয়ংকর মহামারিগুলো দেখা গেছে, সেগুলো হলো-

ক) ১৭২০ সালে শুরু হয়েছিল প্লেগ অফ মার্সেই। পৃথিবী জুড়ে ‍এই মহামারিতে কয়েক লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল ।
খ) ১৮১৭ সালে শুরু হওয়া কলেরা ১৮২০ সালে সেই রোগ সবার আগে সর্বোচ্চ আকার ধারণ করেছিল ব্রিটিশ সেনাদের মধ্যে। তারপর এই দুর্ভোগ পৃথিবীর অর্ধেক অংশে ছড়িয়ে পড়েছিল। তখনকার সেই মহামারিতে ঠিক কত লোক মারা গিয়েছিল, তা এখনও স্পষ্ট জানা যায়নি। তবে, শুধু ব্যাঙ্ককেই নাকি মারা গিয়েছিলেন ৩০ হাজার মানুষ।
গ) ১৯২০ সালে আরেক বড়রকমের মহামারি নাম ছিল স্প্যানিশ ফ্লু। স্পেনে শুরু হওয়া এই রোগ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল। তখন এতেও মারা গিয়েছিল বিশ্বের লাখ লাখ মানুষ।
ঘ) এরপর সর্বশেষ ২০২০ সালে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে কোভিড-১৯। বিশ্ব গ এখনও ‍এই মারণ করোনা ভাইরাসের কবলে পড়ে দিশেহারা। যার জেরে এখনও পর্যন্ত চলছে এবং পৃথিবীব্যাপি লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর মিছিল প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে।

তাহলে, হিসাব করলে দেখা যাচ্ছে, প্রতি ১০০ বছর অন্তর যে মহামারী ছড়িয়ে পড়েছে দুনিয়ায়, সেগুলোর সঙ্গে শুধু ধারাবাহিক সময়ের আশ্চর্য মিলই নয়, মিল ছিল সংক্রামিত ব্যাধি ও ভাইরাসের কর্মক্ষম ক্ষেত্রেও। এ যেন এক অঘোষিত অলৌকিক নিয়ম।

তবে মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক-একটি বীভৎস, অমানবিক ও কালো ইতিহাসের প্রাদুর্ভাব যেমন সর্বত্রই ছিল, তেমনি আধুনিকতার চরম উৎকর্ষের কালেও এমন মহামারির আগ্রাসনে গত বছরের এপ্রিল থেকে আবারও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে পৃথিবী। চীনের উহান শহর থেকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতি করোনাভাইরাস নামের এক অজ্ঞাত গুপ্তহন্তারকের কড়ালগ্রাসে নিপতিত আজকের মানব সভ্যতা। কিন্তু প্রতি শতকেই পৃথিবীতে এমন মহামারি এসেছে এবং বলাও ছিল এভাবে আসবে প্রতি একশত বছর পরে। তবুও, জেনেশুনেও মানুষের কেন এতো নিরবতা পালন করল? রাজনৈতিক ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অতীতের সব মহামারি‍ই অনেক প্রাণের বিনিময়ে সুরক্ষিত হয়েছে ‍এবং আজকের কোভিডেও বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ মৃত্যুবরণ করছে। তবে, এবারের ভয়াবহ অমানবিকতার চিত্র পূ্র্বের যে কোনও মহামারির মধ্যে অন্যতম । মা-বাবা তার সন্তানকে, স্বামী স্ত্রীকে ফেলে চলে গিয়েছেন করোনার ভয়ে যা অন্যান মহামারিতেও ছিল। স্বজন-বিদ্বেষি এমন সব হৃদয়বিদারক দৃশ্য এবারের মহামারিতে পূর্বের থেকেও বেশি দেখা যাচ্ছে ।

- বিজ্ঞাপন -

দেশ-বিদেশের সকল ইতিহাসবিদ, গবেষক কিংবা যারা মহামারি বিষয় নিয়ে গবেষণা করছেন, তাদের প্রতি সম্মান রেখেই বলতে চাচ্ছি যে, তারা কেন আগে থেকেই এ বিষয়ে আরও সতর্ক হলেন না? এখন কেন তাদের এতো অসহায় মনে হচ্ছে? ভ্যাক্সিন তৈরীতে এত সময় লাগছে কেন? কেনই বা আমরা একে অন্যকে দোষারোপ করছি? অন্যদিকে পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ মারা যাচ্ছে এবং মরনঘাতী অসুখে কাতরাচ্ছে? অথচ এসব সমাধানের প্রশ্ন কোথায় কার কাছে রাখব?

উন্নত, উন্নয়নশীল, উন্নয়নগামী স্বল্প-উন্নত, না দরিদ্র রাষ্ট্র ‍এসব ভেবে কি হবে? তবে, একজন উন্নয়নশীল দেশের সাধারণ নাগরিক হিসেবে অনুভব করছি, যেসব রাষ্ট্রগুলো পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করছে, তাদের একমাত্র লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে কেবলই ক্ষমতা? আর তারা ক্ষমতাকেই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার জন্য পারমানবিক শক্তি সহ বিভিন্ন মারনাস্ত্র তৈরি করছে। যা কেবল প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটানোর জন্যেই যথেষ্ট। ‍এ সম্পর্কিত বৈশ্বিক রাজনীতির অনেক উদাহরণ আমাদের জানা আছে।

কিন্তু তথ্য-প্রযুক্তি ও যোগাযোগের নতুন বিশ্বে এখন আর লুকানোর কোন কিছু আছে বলেও আমরা বিশ্বাস করিনা। অথচ বিশ্বকে রক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর কেন গবেষণা অব্যাহত করা হলোনা? কেনই বা আগে থেকেই সতর্ক হওয়ার ‍উদ্যোগ ছিল না? কেন এখন ডাক্তার, নার্স অন্যান্যকে অসহায় হতে হচ্ছে? যে সমস্ত দেশ এই পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করছেন এবং যারা নিজেদের শক্তিধর রাষ্ট্র ভাবছেন, তাদের এ-বিষয়টির ওপর আরও মনোনিবেশ থাকার প্রয়োজন ছিল কি? এ প্রশ্ন এসেই যায়। আপনারা বিবৃতি দেবেন, অভিভাবকত্ব দেখাবেন অথচ মানবিক হবেন না, আবার ভুলও করবেন। আর আমরা ‍সাধারণ মানুষ, সারা পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া সব অমানবিক, করুণ-মর্মস্পর্শী দৃশ্য ভোগ করব, তা কিন্তু মোটেই ঠিক নয়।

আসুন, দ্বৈতনীতি পরিহার করে সত্যিকারের পৃথিবীতে মৌলিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত করি। বিশ্বকে বাসযোগ্য করে তুলি। কেবলই ক্ষমতা নয় বরং সকল রাষ্ট্রের কর্ত‍াব্যক্তি যেন সেবক হিসেবে অর্পিত দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হই। সেই লক্ষ্যেই সকলে অঙ্গিকারাবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
প্রাবন্ধিক, সমাজসেবক ও অধাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, অমৃত লাল দে মহাবিদ্যালয়।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!