ভারতবর্ষের স্বাধীনতার ইতিহাসে বাঙালিদের অবদান অনস্বীকার্য। ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সময় ধরে চলা আন্দোলনে অনেক বাঙালি বিপ্লবীর অদম্য সাহস, আত্মত্যাগ এবং দেশপ্রেমের এক অনন্য নজির তৈরি করেছিলেন। তাঁদের স্বপ্ন, আদর্শ ও আত্মত্যাগের গল্প আজও নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে। এখানে সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো শীর্ষ ১০ জন বাঙালি বিপ্লবীর কথা, যাঁদের অবদান আমাদের কাছে চিরস্মরণীয়।
১. নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু (Netaji Subhas Chandra Bose)
- স্বাধীনতা সংগ্রামে ভূমিকা: ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন। পরে ফরওয়ার্ড ব্লক গঠন করে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র লড়াইয়ের প্রয়োজনীয়তা প্রচার করেন।
- আজাদ হিন্দ ফৌজ: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য আজাদ হিন্দ ফৌজ (আইএনএ) গঠন করেন।
- মহত্ব: “তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব” – এই আহ্বান তাঁর অদম্য দেশপ্রেমের পরিচায়ক।
২. মাস্টারদা সূর্য সেন (Surya Sen)
- চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন: ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের সূচনা করেন।
- গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্ব: তরুণ বিপ্লবীদের সংগঠিত করে শাসকশক্তিকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন।
- আত্মত্যাগ: ব্রিটিশদের হাতে ধরা পড়ে অকথ্য নির্যাতনের পর ফাঁসিতে শহীদ হন, কিন্তু দেশপ্রেমের আদর্শ অম্লান রেখে যান।
৩. ক্ষুদিরাম বসু (Khudiram Bose)
- বয়সে কনিষ্ঠ বিপ্লবী: অতি অল্প বয়সেই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন।
- মুজাফফরপুর বোমা হামলা: ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যার প্রচেষ্টায় অংশ নেওয়ার কারণে গ্রেফতার হন।
- শহীদ বরণ: মাত্র ১৮ বছর বয়সে ফাঁসি কার্যকর হয়, যা যুবসমাজের কাছে আত্মত্যাগের সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
৪. বাঘা যতীন (Jatindranath Mukherjee)
- সশস্ত্র বিপ্লবের পুরোধা: ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সংগঠক ছিলেন।
- ব্যক্তিগত সাহসিকতা: ‘বাঘা যতীন’ নামে পরিচিত হওয়ার কারণ একটি বাঘের সাথে লড়াই করে তাকে পরাস্ত করার ঘটনা।
- আন্দোলনে প্রভাব: যুগান্তর দলের সাথে যুক্ত থেকে স্বাধীনতার জন্য নানা অভিযান পরিচালনা করেন। পুলিশের গুলিতে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে শেষমেশ শহীদ হন।
৫. রাসবিহারী বসু (Rash Behari Bose)
- ইউগান্তর ও অনুশীলন সমিতির সাথে যুক্ত: সশস্ত্র বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সংগঠক ছিলেন।
- দিল্লি প্লট: ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জকে লক্ষ্য করে বোমা হামলা পরিকল্পনার সাথে জড়িত ছিলেন।
- আজাদ হিন্দ ফৌজের পূর্বসূত্র: জাপানে গিয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠনের ভিত্তি তৈরি করেন, পরে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু সেই ফৌজকে নেতৃত্ব দেন।
৬. প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার (Pritilata Waddedar)
- নারী বিপ্লবী: মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম বিপ্লবী দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
- পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ: ১৯৩২ সালে ব্রিটিশদের বর্ণবাদী “Dogs and Indians not allowed” নীতির বিরুদ্ধে অভিযান চালান।
- আত্মবলিদান: ধরা পড়ার আগেই পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে নিজের জীবন বিসর্জন দেন, নারীদের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভূমিকার অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন।
৭. দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ (Chittaranjan Das)
- আইনজীবী ও রাজনীতিক: অসহযোগ আন্দোলন ও স্বদেশী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।
- সুবিশাল ত্যাগ ও সামাজিক উদ্যোগ: ‘নৈহাটি স্বরাজ আশ্রম’, ‘নরেন্দ্রপুর আনন্দ আশ্রম’ সহ বহু সমাজকল্যাণমূলক কর্মের উদ্যোক্তা ছিলেন।
- নেতাজির মেন্টর: নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে তিনিই রাজনীতিতে তুলে এনেছিলেন, তাই দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর অবদান অপরিসীম।
৮. বিনয়-বাদল-দীনেশ (Binoy-Badal-Dinesh)
- রাইটার্স বিল্ডিং আক্রমণ (১৯৩০): ব্রিটিশ শাসনের মূল সদর দপ্তর রাইটার্স বিল্ডিংয়ে সশস্ত্র অভিযান চালিয়ে ছাড়পত্র অফিসারকে হত্যা করেন।
- আত্মবলিদান: বিনয় ও দীনেশ ফাঁসিতে আত্মাহুতি দেন, বাদল বন্দুকের গুলিতে জখম হয়ে পরে আত্মঘাতী হন।
- সাহস ও দৃঢ় প্রত্যয়: এই ঘটনা ব্রিটিশ শাসনের হৃদয়ে ভয় এবং ভারতীয়দের হৃদয়ে সাহসের স্ফূরণ ঘটায়।
৯. যতীন্দ্রনাথ দাস (Jatindra Nath Das)
- গণঅসন্তোষ জাগ্রতকরণ: ব্রিটিশদের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন।
- কারাবন্দি অবস্থায় অনশন: ঐতিহাসিক লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেফতার হয়ে জেলখানায় অনশন শুরু করেন।
- শহীদ বরণ: টানা ৬৩ দিন অনশন করে মৃত্যুবরণ করেন, যা ব্রিটিশদের বর্বরতার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে তুলতে সহায়তা করে।
১০. কল্পনা দত্ত (Kalpana Datta)
- চট্টগ্রাম বিপ্লবী দলের অন্যতম সদস্য: সূর্য সেনের সঙ্গী হয়ে সশস্ত্র আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন।
- জেলে নির্যাতন ও বিবাহিত জীবন: দীর্ঘ সময় কারাবন্দি থেকে পরে বিবাহসূত্রে সংসার জীবন শুরু করলেও আজীবন বিপ্লবের আদর্শ ধরে রাখেন।
- প্রেরণাদায়ী নারীচরিত্র: তরুণীদের জন্য সাহস ও দৃঢ় প্রত্যয়ের প্রতীক হিসেবে আজও কল্পনা দত্তের নাম শ্রদ্ধাভরে উচ্চারিত হয়।
শীর্ষ ১০ বাঙালি বিপ্লবী
বাঙালি বিপ্লবীদের দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ, আর ভালোবাসার মাধ্যমে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলন এক নতুন মাত্রা পেয়েছিল। তাঁদের ঝাঁপিয়ে পড়ার অনুপ্রেরণা কেবল তৎকালীন সময়েই নয়, আজও বাঙালিসহ গোটা ভারতবর্ষের মানুষকে উজ্জীবিত করে। দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য জীবনপণ করা এসব মহান বিপ্লবী চিরকাল আমাদের হৃদয়ে অমর হয়ে থাকবেন। তাদের স্বপ্ন, সাহস, এবং আদর্শকে মনে রেখে আমরা যদি দেশ ও সমাজের উন্নয়নে কাজ করে যাই, সেটাই হবে তাঁদের প্রতি যথার্থ সম্মানজ্ঞাপন।
✍️এই নিবন্ধটি সাময়িকীর সুন্দর এবং সহজ জমা ফর্ম ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে। আপনার লেখা জমাদিন!