সারপ্রাস
ছুটির দিন। সকাল সকাল কম্পিউটারে বসে গেছি। ‘শীতলগিরির পদ্য’-র পাণ্ডুলিপি প্রায় শেষের পথে। দশম শতাব্দীর চৈনিক কবি হানশান প্রণীত পদ্যাবলি ইংরেজি থেকে বাংলায় রূপান্তর করছি। যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং কাজ, বলা যায় সামর্থ্য ডিঙিয়ে কাজটিতে হাত দিয়েছি। প্রকাশককে দেওয়ার আগে প্রিন্ট আউট নিয়ে স্যারকে একবার দেখিয়ে নিতে হবে। স্যার আমার এই কাজটি চাক্ষুষ করার জন্য উৎসুক হয়ে আছেন। প্রায় বছর খানেক ধরে কাজটি করছি। স্যার সমানে উৎসাহ দিয়ে চলেছেন। বার্ধক্য স্যারকে কাবু করতে পারেনি, মানসিক ও শারীরিকভাবে তিনি যথেষ্ট সক্ষম। এখনও লেখালেখি চালিয়ে যাচ্ছেন, তাঁর লেখা বইয়ের সংখ্যাও কম নয়। এই সপ্তাহের মধ্যে পাণ্ডুলিপি শেষ করতে পারব বলে মনে হয়। সামনের সপ্তাহে প্রিন্ট আউট নিয়ে স্যারের বাড়ি পৌঁছে সারপ্রাইস দেব। ভূমিকাটা মেরামত করে চায়ে চুমুক দিতে দিতে পদ্যগুলিতে চোখ চালিয়ে ছন্দের চলন দেখে নিচ্ছি, এমন সময় মোবাইল বেজে উঠল। কবি ও সাংবাদিক সৈকতের গলা ‘শুনেছেন, নীহারবাবু আর নেই! রাজুদা আমাকে এইমাত্র জানাল।’ আমার বিশ্বব্রহ্মাণ্ড দুলে উঠল। কম্পিউটার বন্ধ করে উঠে পড়লাম।
পায়েল বলল, ‘একি উঠে পড়লে পাণ্ডুলিপি শেষ।’
‘না। নীহারবাবু নেই।’
‘সেকি কালকেই তো তোমার সঙ্গে ফোনে কথা বললেন। আমি কি যাব?’
‘না। তুমি বরং বাবুকে দ্যাখো।’
বেরোনোর সময় ভাবতে লাগলাম কাকে কাকে খবরটা জানানো যায়। তারপর ঠিক করলাম,আগে তো পৌঁছাই। হাঁটতে হাঁটতে মনে হল কেন যে এতদিন পাণ্ডুলিপিটা শেষ করে প্রিন্ট নিইনি! তাহলে অন্তত স্যারকে দেখাতে পারতাম; বইটা না দেখলেও পাণ্ডুলিপিটা দেখে যেতে পারতেন। মনের মধ্যে একটা আক্ষেপ কাঁটার মতো ফুটতে লাগল। মিনিট পনেরোর হাঁটা পথ। মোবাইলটা বেজে উঠল। পায়েলের গলা, ‘শোনো ফুল নিতে ভুলো না’। ফুলের দোকান পেরিয়ে গেলাম। ইচ্ছে হল না। অশীতিপর স্যারকে একটিবার দেখতে যাওয়ার কথা যাদের মাথায় আসেনি তারা আজ ফুল নিয়ে হাজির থাকবেই। ফুল দেওয়ার লোকের অভাব হবে না।
পায়ে পায়ে স্যারের বাড়ির কাছে পৌঁছে গেলাম। কিন্তু একি চারিদিক এত শুনশান কেন! তবে কী স্যার শ্মশানযাত্রায় বেরিয়ে পড়েছেন! আহা রে, খবরটা যদি আরেকটু আগে পেতাম। এখন কোথায় যাব আমি! কী মনে করে সদর দরজার দিকে এগিয়ে দরজার ঠিক পাশে থাকা বকুল গাছটির তলায় দাঁড়ালাম। রাশি রাশি সাদা ফুল ঝরে পড়ে আছে, এখনও ঝরছে। আমি যেন ঠিক প্রকৃতিস্থ নই, টলছি। বকুলফুলের গন্ধে কেমন ঝিম ধরে যাচ্ছে। দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। স্নানঘর থেকে জলের শব্দ আসছে। তার মানে ভিতরে কেউ আছে। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে মিনিট কয়েক দাঁড়িয়ে থাকলাম। অন্যান্যবার এসেই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হাঁক দিতাম, স্যার! ভিতর থেকে গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে আসত, ‘কে?’ আজ কী বলে হাঁক পাড়ব? শেষে কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ডুবে চেঁচিয়ে উঠলাম ‘স্যার!’ প্রায় সঙ্গে সঙ্গে স্নানঘর থেকে ভেসে এল সেই নিনাদ ‘কে? চন্দন! একটু দাঁড়াও স্নানটা সেরে নিই।’