শীর্ষ ১০ বাংলা সিনেমা যা কখনো পুরনো হয় না

আরিফুর রহমান
আরিফুর রহমান - প্রকাশক
8 মিনিটে পড়ুন

বাংলা সিনেমার জগৎ সমৃদ্ধ ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাংলা সিনেমা আমাদের উপহার দিয়েছে এমন সব চলচ্চিত্র যা সময়ের সীমা অতিক্রম করে আজও আমাদের মন ছুঁয়ে যায়। আজ আমি আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই সেই শীর্ষ ১০ বাংলা সিনেমা যা কখনো পুরনো হয় না, এবং যেগুলো আমার নিজের জীবনেও গভীর প্রভাব ফেলেছে।

১. পথের পাঁচালী (১৯৫৫)

সত্যজিৎ রায়ের প্রথম চলচ্চিত্র “পথের পাঁচালী” শুধু বাংলা নয়, সমগ্র বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসে এক মাইলফলক। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে নির্মিত এই চলচ্চিত্র গ্রামীণ বাংলার সরল জীবন ও সম্পর্কের কাহিনী তুলে ধরেছে। অপুর শৈশবের সরল গল্প আমাদের চোখে জল আনে।

প্রথমবার যখন আমি এই সিনেমা দেখেছিলাম, তখন আমি ছোট ছিলাম। অপুর জীবন সংগ্রাম আমাকে মনে করিয়ে দেয় আমার গ্রামের বাড়ির কথা, যেখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীবনযাত্রার কষ্ট পাশাপাশি চলত। আমার দিদিমার সঙ্গে ইন্দির ঠাকরুনের চরিত্রের অনেক মিল খুঁজে পেয়েছিলাম, যা আমাকে ব্যক্তিগতভাবে স্পর্শ করেছিল।

২. অপরাজিত (১৯৫৬)

অপু ত্রয়ীর দ্বিতীয় চলচ্চিত্র “অপরাজিত” আমাদের নিয়ে যায় অপুর কৈশোর ও যৌবনের জগতে। এই চলচ্চিত্রে মায়ের সঙ্গে অপুর সম্পর্ক আমাকে বিশেষভাবে ছুঁয়ে গেছে। যখন আমি শহরে পড়াশোনা করতে আসি, মায়ের সঙ্গে দূরত্বের যন্ত্রণা অনুভব করেছিলাম, যা এই চলচ্চিত্রে অসাধারণভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।

- বিজ্ঞাপন -

অপুর শিক্ষা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা ও পারিবারিক দায়িত্বের মধ্যে দ্বন্দ্ব আমাকে আমার নিজের জীবনের সংগ্রামের কথা মনে করিয়ে দেয়। এই চলচ্চিত্র আমাকে শিখিয়েছে জীবনের পথ কখনো সোজা নয়, কিন্তু আমাদের অগ্রসর হতে হবে।

৩. অপুর সংসার (১৯৫৯)

অপু ত্রয়ীর শেষ চলচ্চিত্র “অপুর সংসার” অপু ও অপর্ণার প্রেম ও দাম্পত্য জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এই চলচ্চিত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও শর্মিলা ঠাকুরের অভিনয় আমার মনে গভীর ছাপ ফেলেছে। প্রেমের সরলতা ও ট্র্যাজেডি আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিল জীবনের অনিশ্চয়তা নিয়ে।

যখন আমি আমার জীবনের প্রথম প্রেমে পড়েছিলাম, তখন এই চলচ্চিত্রের অনেক দৃশ্য আমার জীবনের সঙ্গে মিলে যায়। অপু ও অপর্ণার সম্পর্কের গভীরতা ও সত্যিকারের অনুভূতি আমাকে প্রেমের প্রকৃত অর্থ বুঝতে সাহায্য করেছে।

৪. মহানগর (১৯৬৩)

“মহানগর” চলচ্চিত্রে আরতি চরিত্রে মাধবী মুখোপাধ্যায় একজন কর্মজীবী নারীর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন, যা তখনকার সমাজে বিরল ছিল। আমার মায়ের গল্পের সঙ্গে এই চলচ্চিত্রের অনেক মিল খুঁজে পাই, যিনি পরিবারকে সমর্থন করার জন্য চাকরি করতে শুরু করেছিলেন।

নারীর ক্ষমতায়ন ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এই চলচ্চিত্র আমাকে গভীরভাবে চিন্তা করতে বাধ্য করেছে। আরতির সংগ্রাম ও সফলতা আমাকে প্রেরণা জোগায়। আজকের সমাজেও এই চলচ্চিত্র সমানভাবে প্রাসঙ্গিক, যেখানে নারীরা নিজেদের অধিকার ও স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছেন।

- বিজ্ঞাপন -

৫. চারুলতা (১৯৬৪)

“চারুলতা” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “নষ্টনীড়” গল্পের উপর ভিত্তি করে নির্মিত। চারুলতার একাকীত্ব ও মানসিক টানাপোড়েন সত্যজিৎ রায় এমনভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যা আমাকে মুগ্ধ করেছে। সম্পর্কের জটিলতা ও মানুষের মনোস্তাত্ত্বিক দিক নিয়ে এই চলচ্চিত্র আমাকে গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করেছে।

একাকীত্বের মধ্যে সৃষ্টিশীলতার উন্মেষ এই চলচ্চিত্রে সুন্দরভাবে দেখানো হয়েছে। আমি নিজেও যখন একাকী সময় কাটাই, তখন সৃষ্টিশীল কাজের মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করার চেষ্টা করি, যা এই চলচ্চিত্র থেকে অনুপ্রাণিত।

৬. মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০)

ঋত্বিক ঘটকের “মেঘে ঢাকা তারা” পূর্ব বাংলার উদ্বাস্তুদের জীবন সংগ্রামকে কেন্দ্র করে নির্মিত। নীতা চরিত্রের আত্মত্যাগ ও কষ্ট আমার হৃদয়ে গভীর ছাপ ফেলেছে। আমার দাদুর কাছ থেকে শোনা দেশভাগের কাহিনীগুলো এই চলচ্চিত্রের সঙ্গে মিলে যায়, যা আমাকে আমাদের ইতিহাসের এক করুণ অধ্যায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়।

- বিজ্ঞাপন -

নীতার “দাদা, আমি বাঁচতে চাই” সংলাপটি আমার হৃদয়ে গভীরভাবে গেঁথে আছে। এই চলচ্চিত্র আমাকে শিখিয়েছে কিভাবে আত্মত্যাগ ও ভালবাসা মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলে।

৭. হীরক রাজার দেশে (১৯৮০)

“হীরক রাজার দেশে” একটি স্যাটায়ার চলচ্চিত্র, যা সমাজের নানা অসঙ্গতিকে হাস্যরসের মাধ্যমে তুলে ধরেছে। ছোটবেলায় যখন এই সিনেমা দেখতাম, তখন মজার গান ও চরিত্রগুলো ভালো লাগত। বড় হয়ে বুঝতে পেরেছি এর গভীর রাজনৈতিক বার্তা, যা আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।

শিক্ষা, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের গুরুত্ব নিয়ে এই চলচ্চিত্র আমাকে চিন্তা করতে শিখিয়েছে। “ডাণ্ডা দিয়ে মানুষ মানুষ নয়” এই সংলাপটি আমাদের সমাজের বাস্তবতা তুলে ধরে।

৮. গুপী গাইন বাঘা বাইন (১৯৬৯)

এই ফ্যান্টাসি চলচ্চিত্রে গুপীবাঘার অ্যাডভেঞ্চার আমাদের সকলের শৈশবের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমি এখনও সেই জাদুকরী গান ও দৃশ্যগুলো মনে করতে পারি, যা আমাকে এক অন্য জগতে নিয়ে যেত। এই চলচ্চিত্রের সৃজনশীলতা ও কল্পনার বিস্তার আমাকে সবসময় মুগ্ধ করেছে।

ছোটবেলায় আমি আর আমার বন্ধুরা গুপী ও বাঘার মতো সঙ্গীত ও ম্যাজিক নিয়ে খেলতাম। এই চলচ্চিত্র আমাদের কল্পনাশক্তিকে উসকে দিয়েছে এবং সৃজনশীল হতে শিখিয়েছে।

৯. দেবী (১৯৬০)

“দেবী” চলচ্চিত্রে ধর্মীয় কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের বিপরীতে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। শর্মিলা ঠাকুরের অভিনয় এখানে অনবদ্য। আমার পরিবারেও এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে যেখানে কুসংস্কারের কারণে মানুষ কষ্ট পেয়েছে।

এই চলচ্চিত্র আমাকে সেই ঘটনার কথা মনে করিয়ে দেয় এবং সমাজের এই দিকটি নিয়ে চিন্তা করতে উৎসাহিত করে। দেবী চরিত্রের মানসিক চাপ ও সমাজের প্রত্যাশা আমাকে মানুষের বিশ্বাস ও তার প্রভাব নিয়ে ভাবতে বাধ্য করেছে।

১০. নায়ক (১৯৬৬)

নায়ক চলচ্চিত্রে উত্তম কুমারের অভিনয় এক কথায় অসাধারণ। একজন জনপ্রিয় অভিনেতার অন্তর্মুখী দিক, তার সংকট ও আত্মঅনুসন্ধান এই চলচ্চিত্রে অসাধারণভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। সেলিব্রিটির মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা মানুষের গল্প আমাকে সবসময় আকর্ষণ করেছে।

যখন আমি নিজে কোনো সফল ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি, তখন তাদের অন্তর্মুখী দিক সম্পর্কে জানতে ইচ্ছা হয়েছে। এই চলচ্চিত্র আমাকে বুঝতে সাহায্য করেছে যে খ্যাতি ও সফলতার পিছনে অনেক সংগ্রাম ও একাকীত্ব লুকিয়ে থাকে।


উপসংহার

এই চলচ্চিত্রগুলো শুধুমাত্র বিনোদন নয়, আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি ও জীবনের প্রতিচ্ছবি। প্রতিটি চলচ্চিত্রে আছে গভীর বার্তা, যা আমাদের চিন্তা করতে, অনুভব করতে এবং আরও ভাল মানুষ হতে সাহায্য করে। বাংলা সিনেমার এই ক্লাসিকগুলো আমাদের সবার দেখা উচিত, যাতে আমরা আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে আরও ভালভাবে বুঝতে পারি।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি

এই চলচ্চিত্রগুলো আমার জীবনের নানা পর্যায়ে আমাকে প্রভাবিত করেছে। কখনো আনন্দ দিয়েছে, কখনো কাঁদিয়েছে, আবার কখনো নতুন কিছু শিখিয়েছে। আমি মনে করি, এই চলচ্চিত্রগুলো সময়ের সীমা অতিক্রম করে আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক, কারণ এগুলো মানব মনের গভীরতম অনুভূতিগুলোকে স্পর্শ করে।

যখন আমি “পথের পাঁচালী” দেখেছি, তখন গ্রামের সরল জীবন ও সম্পর্কের গভীরতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। “মেঘে ঢাকা তারা” আমাকে আমাদের ইতিহাসের এক করুণ অধ্যায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে, যা আমি আগে এত গভীরভাবে অনুভব করিনি। “হীরক রাজার দেশে”“গুপী গাইন বাঘা বাইন” আমার কল্পনাশক্তিকে উসকে দিয়েছে, যা আমাকে সৃজনশীল হতে উৎসাহিত করেছে।

সমাপ্তি

বাংলা সিনেমার এই রত্নগুলো আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ। এগুলো দেখে আমরা শুধু বিনোদন পাই না, আমাদের জীবন ও সমাজের নানা দিক সম্পর্কে গভীরভাবে ভাবতে পারি। আমি আশা করি, এই চলচ্চিত্রগুলো আপনারাও দেখবেন এবং এগুলো থেকে কিছু না কিছু শিখবেন। বাংলা সিনেমা আমাদের গর্ব, আসুন আমরা একে সম্মান করি এবং এর থেকে প্রাপ্ত শিক্ষাকে জীবনে প্রয়োগ করি।

সার্বিকভাবে বাংলা সিনেমার গুরুত্ব

বাংলা সিনেমা আমাদের সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এরা শুধু বিনোদন নয়, আমাদের সমাজের নানা সমস্যা, সম্পর্কের জটিলতা, ঐতিহাসিক ঘটনা ও মানুষের মনোভাবকে তুলে ধরে। আমি বিশ্বাস করি, এই চলচ্চিত্রগুলো নতুন প্রজন্মের জন্যও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। আজকের প্রযুক্তিনির্ভর যুগে, যেখানে মানুষ দ্রুতগতির জীবনে ব্যস্ত, এই চলচ্চিত্রগুলো আমাদের থামতে এবং জীবনের গভীরতা নিয়ে ভাবতে সাহায্য করে।

শেষ কথাঃ

শিল্প ও সংস্কৃতি আমাদের জীবনের প্রতিচ্ছবি। বাংলা সিনেমার এই ক্লাসিকগুলো সময়ের সীমা অতিক্রম করে আজও আমাদের হৃদয়ে জীবন্ত। আসুন আমরা এই চলচ্চিত্রগুলো দেখে, অনুভব করে এবং অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়ে আমাদের সংস্কৃতিকে আরও সমৃদ্ধ করি।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
প্রকাশক
অনুসরণ করুন:
আরিফুর রহমান একজন বাংলাদেশী-নরওয়েজিয়ান রাজনৈতিক কার্টুনিস্ট, চিত্রকর এবং অ্যানিমেটার। টুনস ম্যাগের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রকাশক। কার্টুনিস্ট হিসাবে, তিনি ২০০৪ সালে তার পেশা হিসেবে কার্টুন আঁকা শুরু করেছিলেন। এখন অবধি তিনি অসংখ্য কার্টুন, কমিকস, ক্যারিকেচার এবং অঙ্কন করে চলেছেন।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!